রং পর্ব ৪৯
তন্নী তনু
একদিন পর…….
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রির শেষ, শুরু এক স্বর্ণালী সকালের। তবে পৃথিবীর কিছু কিছু মানুষের জীবন এই আলো ঝলমলে দিনেও অন্ধকারে তলিয়ে আছে,সুভা তাদের মধ্যে একজন। সকালের শুরুতে বাসায় ফিরে সুভা। ক্লান্ত শরীর তুলতুলে বিছানায় আয়েশী ঘুম দিতে টানছে তাকে তবে তার না আছে মনের বিশ্রাম না আছে শরীরের। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বাসায় বসবে সে তার মা কিছুক্ষণ হাসপাতালে সুমনের কাছাকাছি থাকবে। সুমনের শরীরে বি*ষের পরিমাণ অনেক বেশী, ওয়াশের পরেও তার প্রাণ আশঙ্কায়। খাদ্যনালী ও ফুসফুসেও প্রভাব পড়েছে। তাকে রাখা হয়েছে ইন্টেন্সিভ ট্রিটমেন্ট ইউনিটে। খরচের দিকে তাকাতে ই নিজের হাত পা অসাড় হয়ে আসে।
সুভা মনে মনে তলিয়ে ভাবে,তার স্পর্শেই আজকাল অশান্তির সূত্রপাত। বাসায় পা পড়তেই একদল লোক লাইন দিয়ে আছে। যাদের সকলের মুখের কথা একই। তাদের থেকে সুমন টাকা নিয়েছে। তবে তাদের কি করে বোঝাবে কালকের হাসপাতালের বিলটাও লজ্জা মাটিচাপা দিয়ে হাত পেতে নেয়া। বাবার ঔষধ, বাসার খরচ, হাসপাতালের বিল সবমিলিয়ে পুরো পৃথিবী তার দুলছে। বাসায় ফিরতেই একের পর এক কলিং বেলে কড়া নাড়ছে। ডেইট এর পর ডেইট দিয়ে যাচ্ছে সে। তবে সে কি আদও টাকা দিতে পারবে? টাকা না দিলে তারা কি ছাড়বে তাকে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মানসম্মান কোথায় যাবে? এতো এতো মানুষিক যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে মাথা। ওয়াশরুমে প্রবেশ করে সুভা। ফ্রিজ থেকে আনা কিউব আকারের বরফের টুকরো গুলো বালতির পানিতে মেশায়। গরম ধোয়া ওঠা মাথার ভেতরের যন্ত্রণা কমাতে না পারলেও উপরের যন্ত্রণা কমাতেই হবে। লাল রঙের মগে পানি নেয় সুভা এরপর মাথায় ঢালে। ঠিক সে সময়েই তীব্র শব্দে কেঁপে ওঠে কলিং বেল। আজকাল কলিং বেল এর মৃদু গুঞ্জনের শব্দটাও বিকট, তীব্র, ঝাঝালো লাগে। এক মূহুর্ত্তের জন্যে শান্তি নেই। বালতি ভর্তী পানিতে পানিপূর্ণ মগটা ছুড়ে মারে সুভা। মাথার পানি গুলো চুইয়ে পড়ছে গাঁ বেয়ে। লুকিং গ্লাসে চোখ রাখে সুভা। এরপরেই খুলে দেয় দরজা। অতঃপর,
–সুমন আছে?
— ও অসুস্থ! হসপিটালাইজড। তুমি জানো না?
— না আপা!
–ভেতরে আসো।
–ভেতরে যাবো না আপা। আসলে…
— বলো..
— পনেরো দিন প্রায় হয়ে এলো। আমার কাছে থেকে চল্লিশ হাজার টাকা এনেছে। আসলে আমি তো আর ইনকাম করিনা। বাসায় ফ্রিজ কেনার জন্যে দিয়েছিলো। ও বললো আংকেল নাকি অসুস্থ টাকা লাগবে। পরে দিয়েছিলাম। কিন্তু টাকাটা আর দেয়নি। ঐদিকে আমি তো আর বাসায় ঢুকতে পারছি না। মা বাবা ভাবছে কি না কি অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছি, টাকা পয়সা উড়াচ্ছি না হয় নে!শা পা!তি করছি।তাদের বুঝাতে পারছি না আপা। আজ যে করেই হোক টাকা দিতেই হবে আপা।
সুভা দূর্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই মূহুর্তে কি উত্তর দিবে সে? উত্তর দেওয়ার মতো কিছু না থাকার মূহুর্তে কি বলতে হয়। পৃথিবীর কিছু যন্ত্রণা কেবল অনুভব করা যায় যখন তা নিজের সাথে ঘটে। এই যন্ত্রণা কাকে বোঝাবে সে? কিভাবে বোঝাবে তার অসহনীয় লাগছে। ইরফাদের মতো একজন হৃদয়বান বন্ধু ছিলো বলে এখনো হাসপাতালের বিল টান পড়েনি। কিন্তু এরপর? এরপর কি?
জীবনের কাছে তার একটাই প্রশ্ন! এরপর কি?
সুভা কিছুক্ষণ নিরব থেকে উত্তর দেয়,
— ভাই! দেখো ও হসপিটালাইজড। ও ভালোভাবে বাসায় ফিরে আসুক। আই”ল ম্যানেজ। সবার সব টাকা আমি দিয়ে দিবো।
–কিন্তু আপা আমি তো ফেসে গেছি। বাসায় আজ টাকা অথবা ফ্রিজ না নিয়ে গেলে আমাকে মেরেই ফেলবে।
— আমি কি তোমার বাবা “র সাথে কথা বলবো?
— জানিনা আপা। যদি পারেন ম্যানেজ করেন। আমার কোনো সমস্যা নেই।
— তাহলে তুমি তোমার বাবা”র নম্বর দিয়ে যাও। আমি কথা বলবো।
কথা শেষ করে বিছানায় বসে সুভা। চিন্তায় শক্ত ঢোক গিলছে একটু পর পর। শুকনো চরচরে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিচ্ছে বার বার। এভাবে কতোক্ষণ টিকবে। ভুল এমন একটা জিনিস যা সব জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। এক ভুলে পরিবারের সবার জীবন এখন আগুনের মতো ধাও ধাও করে জ্বলছে। ঠিক সেই মূহুর্তে আরেকবার কলিংবেল। সুভা চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। সত্যিই আর নেয়া যাচ্ছে না। অনেকটা সময় দাঁতে দাঁত পিষে বসে থাকে। তবে কলিংবেলের অনবরত ডাকুনিতে সে টিকতে পারে না। দরজা খুলেই আতকে ওঠে সুভা। মুখ থেকেই আপনিআপনি বেড়িয়ে আসে,
–আপনি??
বছর সাতেক আগের ঘটনা। সুভার রুপের প্রেমে পড়া যুবক তাকে একপলক দেখার অপেক্ষায়,প্রতীক্ষায় রাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে থাকতো সকাল বিকাল সন্ধ্যা। সর্বদা উপেক্ষা করে এসেছে তাকে। এমনকি ফিরিয়ে দিয়েছে তার দেয়া প্রস্তাব অহরহ বার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেও কখনো বাসার দরজায় আসার সাহস দেখায়নি। কিন্তু সে আজ বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেনো? সুভা বলে,
–আতিক ভাই আপনি?
— এলাম, এলাম। প্রয়োজনেই এলাম। ভেতরে যেতে বলবে না?
— আসলে বাসায় কেউ নেই তো।
— ও! তাহলে কি আর করার। দাঁড়িয়েই কথা বলি। শুনলাম তোমার ভাই কি একটা খেয়ে খাদ্যনালী গলিয়ে ফেলেছে। এখন কি অবস্থা।
— আল্লাহ্ চাইলে সুস্থ হয়েই খুব শিঘ্রই বাসায় ফিরবে। দোয়া করবেন।
— সেতো অবশ্যেই, অবশ্যেই। তবে সুভা তোমার ভাই তো আমার থেকে টাকা নিয়েছিলো ঐ আর কি লাখ খানেকের মতো।টাকা টা খুব দরকার।
সুভার চোখ কুয়াশার ধোঁয়ার মতো ছেপে আসে। এমন একটা মানুষকেও সুমন ছাড় দেয় নি। এই লোকের কাছে পর্যন্ত গেছে। এখন কি উত্তর দিবে সে? সুভা মিনমিনে দূর্বল গলায় বলে,
— দেখেন ভাই। ও কার থেকে টাকা নিয়েছে তা তো আমি জানিনা। ও ফিরুক আমি শুনবো। তারপরে সবার টাকাই দিয়ে দিবো।
— আর যদি না ফিরে? আমার টাকা কি আকাশ থেকে পড়বে?
— এমন বলছেন কেনো ভাই!দোয়ায় রাখবেন। ও যেনো খুব শিঘ্রই সুস্থ হয়ে ফেরে। ওর সমস্ত ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ পাক। ওর জীবনটা আমি ফুলের মতো সুন্দর করে দিবো।
— সে তুমি দিও। আগে টাকাটা দাও..
— বললাম তো দিবো..
–টাকা যখন দরকার তখন না দিলে সে টাকার মূল্য নেই। এখন দরকার মানে এখন দিবে।
— আমি কি করে বুঝবো ও আপনার থেকে টাকা নিয়েছে?
— এই নাও সমস্ত প্রমাণ। টাকা নেওয়ার সময়ের একটা ভিডিও তোলা আছে তোমাকে দেখাচ্ছি। টাকাটা দিয়ে দাও..
— আমাকে একটু সময় তো দিবেন।
— সময় পাঁচ মিনিট। হয় টাকা দিবে নয় আমার একটা শর্ত আছে।
— কি শর্ত?
–ঐ যে আমাকে বিয়ে করবে।
— আতিক ভাই!
— বলো কি করবে?
— আমি টাকা ফেরত দিবো। সময় লাগবে।
— কোনো সময় নেই। টাকা দিতে না পারলে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও।
–সুযোগ নিচ্ছেন আতিক ভাই।
— সুযোগ বুঝে কখনো কখনো আঙুল বাঁকাতে হয় না হলে সব হারাতে হয়।
–টাকা এই মূহুর্তে নেই। আর আমি আপনার প্রস্তাবে রাজিও নই। আপনি যা পারেন করেন।
আতিক লম্বা গোফের প্রান্ত হাতের আঙুলে পেঁচায়, মুখে তার পৈচাশিক হাসি। ফোনের ডায়েল কলে কাঙ্ক্ষিত নম্বরটি। অতঃপর,
— ঐ চইলা আয়। ঘরের সব জিনিসপত্র নিয়ে যা আমার বাসায়।
সুভা কপাল কুচকে দাঁড়ায়। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ। তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
— ঘরের জিনিস পত্র মানে?
— মানে লাখ টাকার জিনিস তো ঘরে আছেই? এই যে খাট, বিছানা, তোষক, ফ্রিজ, আলমারী লাখ টাকার বেশীই হয়ে যাবে।
— এতো নিচ মনের পরিচয় দিলেন?
— বড় মন তো দেখিয়েই এলাম এতোদিন। কাজে তো আসলো না। তোমার ঘটি বাটি বন্ধ করলেই কিনা তোমার মা বাবার চাপ পড়বে। তাদের বলে যাবো তাদের মেয়ের জন্যে আমার বাড়ির দরজা সব সময়-ই খোলা।
— মানুষকে ট্র্যাপে ফেলে কি আর ভালোবাসা হয়? আপনি তো নিজের আসল রূপটাই দেখিয়ে দিলেন।
— সবার-ই দেখা উচিত ভেঙ্গে পড়ার মূহুর্ত্তের অনুভূতি কেমন।
সহসাই পায়ে পায়ে ঘরে ঢোকে একের পর এক লোকজন। সুভা বাঁধা দিয়েও পেরে ওঠে না। একের পর এক সব জিনিস পত্র টেনে বের করে হাতে হাতে নিচে নিয়ে যায় সবাই। সুভা হায় হুতাশ করতে থাকে। কল দেয় ইরফাদের নম্বরে। তবে দুটো কল রিং হতে হতে কেটে যায়। সুভা শূন্যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর দেখতে থাকে মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক দৃশ্যপট। তার হাতে কেনা তার পছন্দের খাটের স্ক্রু খোলা হচ্ছে, শূন্যে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তার সবচেয়ে পছন্দের গাঢ় নীল রঙের ফ্রিজটাও। শখের আলমারি সব সব কিছু চোখের সামনে থেকে নাই হয়ে যাচ্ছে।
সবশেষে তার অসুস্থ বাবাকে দু”জন ধরে মেঝেতে শুইয়ে দিলো আর নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুভা। নিস্তদ্ধ, নিরব, নির্বাক সুভার এক চোখ থেকে টুপ করে পড়লো নোনা জল। দুঃখ, যন্ত্রণা আর হাহাকার ঠেকলো গলায়। তীক্ত গলা ঠেলে ভাঙা স্বরে বললো,
— আতিক ভাই, আপনি বলেছিলেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন। সেদিন আপনার পাগলামি দেখেছি, আপনার চোখে হাহাকার দেখেছি। কোনো এক কারণে আমি হয়তো সম্মতি দেইনি। তবে আমি বিশ্বাস করেছিলাম– আপনি আমাকে ভালোবাসেন।
কেটে গেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন অনেকগুলো দিন, অনেকগুলো রাত, অনেকগুলো ঘন্টা,মিনিট,সেকেন্ড। অপেক্ষার শেষে আজ সেই দিন রিমার। সে থানায় এসেছে। অনেক অপেক্ষার পরে সেই মূহুর্ত। সামনে দাঁড়িয়ে আছে আপাদমস্তক ভালোবাসায় মোরানো মানুষটি। যে কি না যত্ন করে তার জীবনটা নষ্ট করেছে। তবে হিসেবের খাতা তো একবারের জন্যে খুলতেই হবে। অন্ধকার চুইয়ে পড়া লোহার শেল। ওপারে দাঁড়িয়ে শুভ্র এপারে রিমা।মাঝখানে দন্দের দেয়াল। যে দেয়াল ভেঙ্গে আর মানুষটিকে কাছে আনা যায় না, যে শেল ভেঙে তার হওয়াও যায় না। রিমা অসাড় শরীর হীম শীতল। কন্ঠ অগ্নী,
— তোমার সাথে দেখা হওয়া টা ভিষণ প্রয়োজন ছিলো। অনেক অপেক্ষার ফল। অনেক অনেক কষ্টের পর একটু সস্তি লাগছে। অবশেষে তোমার দেখা পেলাম।
শুভ্র শেল ধরে এগিয়ে দাঁড়ায়। চোখের উপচে পড়া জলে ভিজছে পরনের জামা। কথা বলার অবস্থা বেগতিক। ভেজা আবছা গলায় বলে,
–তোমাকে খুব মনে পড়ে।তুমি আসবে আমি ভাবতেও পারিনি।
— আসতে তো হতোই। অনেকটা হিসাব বাকি আছে না। শেষ বারের মতো একবার দেখা না হলে কি হয়?
-এতো কঠিন গলায় কথা বলছো?
— যখন দু”বেলার ভাত টুকু বিনা দোষে, বিনা অপরাধে চোখের জল দিয়ে মেখে খেতে হয়। কোমল হৃদয়ে চোখের জল পড়ে পাথর হয়ে যায়।
— আমি জানি। আমার জন্যে তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো।
— এটা যদি আগে বুঝতে? না আমার জীবন নষ্ট হতো, না নিষ্পাপ বাচ্চাটার।
— আমাকে ক্ষমা করে দিও।
— ক্ষমা করলে যদি আমার অনাগত সন্তান একটা সুন্দর জীবন পেতো তাহলেও করতাম। কি হবে আমার ক্ষমায়?
— আমাকে ক্ষমা করো, তুমি বাচ্চাটাকে আমার বোনের কাছে পাঠিয়ে দিও। নতুন জীবন শুরু করো। তোমার জীবনটা শুভ্র ফুলের মতো ফুরফুরে হোক।
— তুমি চাইলেই জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।একটা সুন্দর গল্প হতে পারতো। গল্প হলো সে এক হৃদয় বিদারক গল্প। চোখের জলের গল্প।
–তুমি চাইলে জীবন রঙিন করতে পারো।ভুল তো শোধরানো যায়। সময় চলে যায়নি।
— জীবন যদি তোমার কথার মতো সহজ হতো তাহলে চোখের জলে জীবন ভাসতো না শুভ্র। একটা মেয়েকে বিয়ে করার আগে তার নিরাপত্তা, ভালো থাকার দায়িত্ব নিশ্চিত করা উচিত। মেয়েরা বড্ড অসহায়। স্বামী নামক আশ্রয়স্থল টা কেড়ে নিলে তাদের পুরো পৃথিবীর এককোণে দাঁড়ানোর জায়গাও থাকে না।
–আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তবে জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভুলগুলো বিশাল রূপ নিয়ে তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নিলো। আমার হয়েও তুমি আমার হলেনা। হারিয়ে গেলো বাড়ি,ঘর, মা,বাবা, অবশেষে তুমি সাথে আমার সন্তান।
–কষ্ট লাগে?
–নাহ…. শুধু দম ফুরিয়ে আসে। জীবন আমাকে শেখালো কিছু ভুল জীবনের সব কেড়ে নেয় সব।
রিমা মৃদু হাসে। তারপর বলে,
–Wrong choice, Wrong decision জীবনের রং শুষে নেওয়ার জন্য যতেষ্ঠ।
— ক্ষমা করবে না আমাকে?
— তোমার ছুটি হয়ে গেছে শুভ্র। ছুটি হয়ে গেছে সেদিন ই যেদিন বুঝতে পেরেছি আমার চয়েজ রং, আমার ডিসিশন রং।
কেবিনরুমে শুয়ে আছে ইরফাদ। পাশে চেয়ার টেনে বসে আছে সিনথিয়া। ঠিক সে সময়ে দরজায় কড়া নাড়ে ইভা। সিনথিয়া উঠে দাঁড়ায়। ইভা বাইরে থেকে বলে,
–ভাইয়া আসবো একটু?
ইরফাদ ফোল্ড করা বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে। সিনথিয়া এগিয়ে গিয়ে বলে,
–আসো আপু!
ইভা রুমে প্রবেশ করে। ধীর গলায় বলে,
— ভাইয়া! সাজিদ ভাই এসেছেন।
–এখানে কেনো?
–তোমাকে দেখতে?
— জানলো কিভাবে?
— আমি জানি না। বাবা বলেছে হয়তো।
— বাবা! আমি তো বলেছিলাম কারো সাথে বিষয়টা শেয়ার না করতে? লোকেশন না দিতে।
— আমি জানিনা ভাইয়া। তুমি বাবাকে বলো।
আমি কি আসতে বলবো?
— হুম।
সিনথি ইভার সাথে বাইরে যাও। পরে আবার এসো।
সিনথিয়া আর ইভা বাইরে যায়। সাজিদ আসে এর পরে।দেখা সাক্ষাৎ এর পরের ঘটনা।
সাজিদ কেবিনের বাইরে যায়। অন্য একটি কেবিনে টুম্পা আর সিনিথিয়া ছোট বল নিয়ে খেলা করছে বিছানার উপর। ইভা কেবিনের বাইরে পায়চারী করছে। এমন অবস্থায় ইভা কেবিনে প্রবেশ করে। তারপর বলে,
— আম্মু আসোতো।
টুম্পা খেলায় মজে আছে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে,
–না। আমি খেলা করবো।
ইভা কাছে আসে। তারপর বলে,
— চলো আংকেল এসেছে। দেখা করবে। সাজিদ আংকেল!
টুম্পার চোখের উচ্ছাস চোখে পড়ে সিনথিয়ার। একবার টুম্পা একবার ইভার চোখ পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। টুম্পা তড়িঘড়ি করে ওঠে ইভার কোলে। সিনথিয়া মনের সাথে তলিয়ে ভাবে কে এই সাজিদ। যার জন্য টুম্পার চোখে এতো উচ্ছাস। সিনথিয়া ইভার পিছু পিছু বাইরে যায়। ছোট্ট টুম্পা মায়ের কোল থেকে নেমে এক ছুটে চলে যায় করিডোরের শেষ প্রান্তে। কেউ এক জন হাত বাড়িয়ে টুম্পার দিকে ছুটে আসছে। দুজনের মধ্যে একহাত পরিমাণ জায়গা। টুম্পাকে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিচ্ছে লোকটি। এতোটুকুতেই বুকের ভেতরে তান্ডব শুরু হয় সিনথিয়ার। কিসের সংকেত এসব? নিজের ভাইয়ের রক্ত, নিজের আত্মার বন্ধন কি ছুটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে?
সাজিদ টুম্পার কপালে ছোট্ট করে হামি দিচ্ছে। আর কোমল চোখে তাকিয়ে আছে ইভার দিকে। দূর থেকে এতোটুকু দৃশ্যে সিনথিয়ার হৃদয় নাড়িয়ে দিচ্ছে। অশান্ত লাগছে। সিনথিয়া ছটফট করতে করতে ইরফাদের কেবিনে প্রবেশ করে। একহাতে ফোন স্ক্রল করছে ইরফাদ। সিনথিয়া আনমনা হয়ে বসে ইরফাদের পাশে। ইরফাদ চোখে ফিরিয়ে তাকায় সিনথিয়ার শুকনো, অশান্ত মুখের দিকে। তারপর ধীর গলায় সুধায়,
— কি হয়েছে?
সিনথিয়ার কোমল হৃদয়ে যে ঝড় শুরু হয়েছে তা বলে দিতে চায় অবলিলায়। তবে কোথাও একটা থেমে যায়। সব এভাবে বলা যায় কি? সিনথিয়া বলে,
–ঐ লোকটা কে?
–বাবার ফ্রেন্ডের ছেলে।
— টুম্পাকে এতো আদর করছে যে?
–এমনিই, বাচ্চা পছন্দ করে তাই হয়তো। বাচ্চা তো সবাই পছন্দ করে। বাচ্চা দেখলে সবাই আদর করে।
–নাহ! আমার কাছে…
— খারাপ লেগেছে?
সিনথিয়া কোমল চোখে তাকায় ইরফাদের দিকে। মানুষটা কি করে বোঝে তাকে?না বলতেই সব বুঝে নেয়।সিনথিয়া চুপচাপ থাকে। ইরফাদ ধীর গলায় বলে,
— ইভা যদি নতুন লাইফ চায় তাহলে ও যা চায় তাই হবে। তবে টুম্পাকে দিবো না। ওকে আমি রেখে দিবো। আমি রেখে দিবো মানে তোমার আত্মার মানুষ তোমার কাছে থাকবে।
— আর ইভাপু!
–ইভার জীবন ইভা ডিসিশন নিবে।
— আমার ভাইয়াকে ছেড়ে দিবেন না?
— বাচ্চাদের মতো কথা বলছো? আমার হাতে কিছু আছে নাকি? অপরাধীরা অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি পাবে?
— আমি কখনো আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমি বিশ্বাস করি আপনি কোনো অন্যায় করবেন না। তবে আজ একটা প্রশ্ন করি?
রং পর্ব ৪৮
— অফ কোর্স।
সিনথিয়া ধীর গলায় বলে,
— আমার বাবা কোথায়?
ইরফাদ সিনথিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— যদি বলি তোমার বাবাকে আমি মেরে ফেলেছি। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?