রং পর্ব ৫৮ (২)

রং পর্ব ৫৮ (২)
তন্নী তনু

তোমার জীবনের সুপারস্টার! তোমার জীবনের সুপার হিরো! তোমার পাপা!
তৎক্ষণাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষ জ্বলে ওঠে আলোতে। লাল, নীল রঙের ধোঁয়া গোল গোল পাকিয়ে ঘুরতে থাকে। আলোয় আলোয় ভাসতে থাকে কক্ষ।কক্ষ জুরে ঝিলমিল বেলুনের উড়াউড়ি, মেঝে ভর্তি বেলুনে ভাসানো। সেই বেলুনে ভাসানো পথ সাঁতরে ছুটে আসছে রাফসান। হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ দমাতে ছুটে আসছে এক ছোট্ট রাজকণ‍্যার বাবা! একজন বাবা! সে শুধুই বাবা!

হাঁটু অবধি বেলুনে ভাসানো,কুন্ডলী পাঁকানো লাল, নীল রঙের ধোঁয়া ঠেলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পা ফেলে রাফসান।স্বপ্নের ছোট্ট রাজকণ‍্যার দিকে কোমল চোখে তাকিয়ে থাকে, যেনো তার চোখের সামনে আসমান থেকে টুক করে পড়লো জীবন্ত পরী, খসে পড়লো রূপালী চাঁদ,তার সাত রাজার ধন, তার সোনামণি। বলিষ্ঠ শরীরটাতে এই মূহুর্তে রাজ‍্যের দূর্বলতা, এই টুকু দূরত্ব ঘোচানোর শক্তিও,সর্বশরীর থেকে উধাও। দুচোখের পল্লব ভারী হচ্ছে যন্ত্রণায়, বুকটা তো আগে থেকেই পাহাড়সম ভারী। দূর্বার হৃদয়ের দহন, আর কম্পমান হাত,পা নিয়ে বেলুন গুলো সরিয়ে সরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসে রাফসান। আকস্মিক নতুন জগতে আবির্ভাবে পিছু হটে টুম্পা। ইরফাদের হাতের মধ‍্যে ঠেলে দেয় হাত, পরক্ষণেই জড়িয়ে ধরে গলা। টুম্পার এহেম আচরণ স্বাভাবিক। হঠাৎ কোনো একদিন টুক করে বাবা নামক নক্ষত্র উদীয়মান হওয়া তো স্বাভাবিক ভাবে কোনো বাচ্চা নিতে পারবে না। ইরফাদ টুম্পার পিঠে হাত বুলায়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— ভয় পাচ্ছো কেনো মা!
ছোট্ট টুম্পার হাতের বাঁধন আরোও শক্ত হয়ে আসে। ইরফাদ আলতো করে পিঠ চাপড়ায়। আধো আধো গলায় টুম্পা বলে,
— আমি থাতবো না এথানে। থাতবো না। চলো। চলো মামাই।
ততোক্ষণে রাফসান মেঝে ভাসানো বেলুন ঠেলে সরিয়ে টুম্পার পেছনে দাঁড়ায়। আত্মগ্লানীতে জরাজীর্ণ হৃদয় বয়ে নিয়ে ব‍্যথাতুর চোখে দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষায় কখন মেয়েটা তার দিকে ফিরবে, কখন তৃষ্ণার্ত চোখে একফোটা জল মিলবে। ইরফাদ সবটা বুঝতে পারে। টুম্পার কোমল পিঠটাতে হাত বুলায়। গলার স্বরে শুধুই ছোট্ট বাচ্চাটাকে বোঝানোর প্রচেষ্ঠা,

— তুমি না পাপাকে চাইতে! পাপা কেনো আসে না! সবার পাপা আছে তোমার পাপা নেই কেনো? কতো প্রশ্ন ছিলো তোমার। তাহলে এখন ভয় পাচ্ছো যে?
— তোথায় ছিলো! সবার পাপাই তো ত্লাসে ( ক্লাসে)আসে, বাবু ল‍্যান্ডেও তো সবার পাপাই আসে। আবার বাসায়ও পাপা থাকে। আমার পাপা কেনো থাতে না?
এই সহজে বলা প্রশ্নগুলোর উত্তর কতোটা কঠিন, কতোটা হৃদয়বিদারক তা এখানে উপস্থিত, প্রাপ্তবয়স্ক, হৃদয়ভাঙা মানুষগুলো জানে।সহজ প্রশ্নের উত্তর কখনো কখনো এতো জটিল হয়, তখন শব্দ বের হয় না। শুধু হৃদয় পোড়ানো ধোঁয়ায় চোখ থেকে খসে পড়ে বিন্দু বিন্দু জল। ইরফাদ টুম্পার মাথায় হাত বুলায়।
— পাপা তো অসুস্থ! ট্রিটমেন্ট চলছে। তাই যেতে পারে না।

ছোট্ট মস্তিষ্কে ঐ ছোট্ট শব্দটা বারি খায়।”বাবা অসুস্থ”। বাবা সন্তানের মধ‍্যে মায়া নামক অদৃশ‍্য শেকলে টান পড়ে, মেয়ের ছোট্ট হৃদয় হু হু করে দুলে ওঠে। আর কোনো কথার প্রয়োজন পড়ে না। ঝড়ো হাওয়ার গতিতে পেছন ঘুরে টুম্পা। ছোট্ট হৃদয়ের সাথে পরণের মাটি ছোঁয়া জামার নিচের অংশটা দুলে ওঠে। ছোট্ট হরিণী চোখদুটো আটকায় রাফসানের চোখে। শীতল চোখের চাহুনিতে বাবার প্রতি মেয়ের দূর্বলতা, মায়া, ভালোবাসাটুকু রাফসানের জরাজীর্ণ হৃদয়ে লেগে যায় বুলেটের গতিতে, বুকের রক্ত ক্ষরণ বাড়ে। সমুদ্রের উচ্ছাসের মতো হাঁটু ভেঙ্গে আছড়ে পড়ে মেয়ের সামনে, রাফসানের গলা ছিড়ে বেড়িয়ে আসে স্নেহময়ী, আবেগঘন ডাক,
— মা!

হৃদয় নিংড়ে আসা যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ চোখের শিরায় শিরায় ছ ড়িয়ে যায়। একটুকরো চাঁদের আলোকে সামনে পেয়ে রুদ্ধ হয় ব‍্যাথারা। কতোটা সময়ের প্রতিক্ষা, কতো হাহাকার বুকে নিয়ে তার বাবা বেঁচে আছে ঐ অবুঝ বাচ্চাটা কখনো অনুভব করবে? এই অদৃশ‍্য অনুভূতি, হাহাকার, শূন‍্যতা টুম্পা কখনো বুঝবে? কখনো ক্ষমা করবে তার বাবাকে। চোখের শিরা ফেটে বেয়ে আসা রক্তকণাগুলোকে রোধ করে শুকনো কড়কড়ে ওষ্ঠজোড়া মুছে নেয় রাফসান। একবুক শূন‍্যতা,হাহাকার নিয়ে গলা চিরে আবারো ডাকে,
— মা! আম্মু! আসো…. আসো আমার কাছে..

অদৃশ‍্য শেকলে টান পড়ে রাফসানের মুখের দিকে অদ্ভুত মায়া নিয়ে একপলকে তাকিয়ে থাকে টুম্পা। নির্জীব, অবসন্ন হয়ে দুহাত ছড়িয়ে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে রাফসান। ভাঙা গলায় বলে,
— পাপার কাছে আসো.. আসো মা… আমিই বাবা। তোমার বাবা! আসো না মা।
অদ্ভুত চাহুনিতে কয়েকপল তাকিয়ে থাকে টুম্পা। অতঃপর রিনরিনে গলায় বলে,
— তোমাল কি ব‍্যাথা লেগেচে? কোথায় ব‍্যাথা পেয়েচো তুমি?
সুমিষ্ট,কোমল গলা শুনে বাবা নামক খড়ায় ফাঁটা হৃদয়ে একফোঁটা শীতল জল চুইয়ে পড়ে। রাফসানের কড়কড়ে ফাঁটা শুকনো ঠোঁটের কোণে সস্তির পরশ লাগে। মেলে দেয়া ডান হাতটা বুকের বা’পাশে ঠেকায়। পালকের মতো কোমল করে হাতটা বুকে ঘষতে ঘষতে বলে,

— এই খানে ব‍্যাথা মা। এইখানে শূন‍্য,হাহাকার, ধূ ধূ অন্ধকার! এইখানে ব‍্যথা মা! এইখানে।
— আমি তো কতো কাঁদলাম, মামনি কাঁদলো তুমি তেনো এলেনা! আমার জ্বল হলো, মামনিরও হলো। তুমি তো এলেনা।
— তুমি তো অনেক দূরে থাকো মা! বাবাই তো অসুস্থ! তাই যেতে পারিনি।
— তাহলে আমাদেল বলতে– আমিই তোমাল কাছে চলে আসতাম।
— তাহলে এখন আসো। পাপা”র কাছে আসো।
–তোমাল কোথায় ব‍্যতা লেগেচে বলো! তোমালও কি মামনির মতো কষ্ট হয়! তুমি কি আমাল মতো কাঁদো? মামনির মতো!
বাচ্চার মায়াবী কথা গুলো একটা একটা করে লাগে রাফসানের বুকে।জানালার আড়ালে দাঁড়ানো আরোও দুজোড়া চোখ অশ্রুতে ভেজে। একজোড়া চোখ কাঁদে তার পূর্বের মানুষটার জন‍্য, সন্তানের জন‍্য, আরেকজোড়া চোখ কাঁদে তার ভাইয়ের জন‍্য। সে চাপা কান্নার আওয়াজ শুধু বুক ঝাঝড়া করে দেয়। দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ানো হৃদয়পোড়া ইভা উঁকি দিয়ে দেখে তার চাঁদের আলো তার বাবার সামনে আদুরে স্বরে কথা বলছে। টুম্পার গলাটা রিনরিনে,

— বলো! তুমিও কাঁদো?
কোমল পাতলা মোমের মতো হাতটা টেনে নিজের গালের পাশে ধরে রাফসান। পাপিষ্ঠ ওষ্ঠজোড়ার স্পর্শ হাতে ছোঁয়াতেও বুকটা কেঁপে ওঠে। জীবনে যতো পাপ সে করেছে, এই অপবিত্র ওষ্ঠজোড়ার ছোঁয়ায় যদি মেয়ের জীবনে আধার নামে। ভয় হয়, যন্ত্রণা বাড়ে। একি যন্ত্রণা — মেয়েকে দুচোখ দিয়ে দেখতেও ভয় করে।কখন যেনো তার স্পর্শে অশুভ ছায়া টুপ করে আধার ছড়িয়ে দেয়। পাতলা হাতটা গালের পাশে ঘষতে থাকে রাফসান। ছোট্ট টুম্পা আরেকটা হাত রাফসানের গালের পাশে ছোঁয়ায়। আদুরে গলায় বলে,

— কি ভাবছো…..!
এইবার নিজের চাঁদের আলোকে আদর করার লোভটুকু সামলাতে পারে না রাফসান। বুকের ভেতরটা সমুদ্রের স্রোতের মতো উথলে ওঠে। গালের পাশ থেকে হাতজোড়া টেনে হাতের পাতায় চুমু খায় রাফসান। একটা…দুইটা…তিনটা… অজস্র চুমু। টুম্পা ডান হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। ভাঙাচোরা, খড়ায় ফাঁটা রাফসানের বুকটাতে হাত রেখে বলে,
— হাত বুলিয়ে দিই!

বুকের পাজর ভেঙে একাকার হয়ে আসে, ঝোড়ো হাওয়ায় সব এলোমেলো, লন্ডভন্ড।এমন একটা বাচ্চাকে সে দূরে রেখেছিলো। আজ চেয়েও কাছে ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। আগুনে দগ্ধ ঘাঁ এ মরিচপোড়া যন্ত্রণা। একঝটকায় দুহাতে মেয়েকে পাজরে মিশিয়ে নেয় রাফসান। চুলভর্তী মাথা, কপাল, চোখ মুখে অজস্র চুমুতে ভাসিয়ে দেয়। মেয়েকে পাজরে মিশিয়ে নিয়ে রক্তচক্ষু, ভাঙা গলা ছিড়ে ছিড়ে বলে,
— এতো আদর করে কথা বলিস না সোনা! তোর দূরত্ব, তোকে দেখার তৃষ্ণায় ধুকে ধুকে মরবো আমি।
কথাটুকু জানালায় উঁকি দেয়া ভাঙাচোরা হৃদয়ের ইভা ঠিকই অনুভব করে। পৃথিবীটা কেনো সহজ নয়। ইস্পাতকঠিন হৃদয়টা যে ঝুরঝুরে বালির মতো ঝরে ঝরে পড়ছে। জানালার পর্দা খামছে পেছন ফেরে ইভা। চারপাশের সমস্ত প্রিয় মানুষের হৃদয়ের দহনে পুড়ে সিনথিয়া নিজেও ছাঁই। দগ্ধ আগুনে ছাঁইচাপা দিয়ে ইভার মাথায় হাত বুলায় সিনথিয়া। গলা ফেড়ে শান্তনা আর বের হয় না। তবুও বলে,

— ধৈর্য্য ধরো আপু।
— বেরঙিন পৃথিবীতে রঙ খুঁজতে গিয়ে আমি একটা ভুল ই করলাম। আর সে ভুলে আমার মেয়েটাসহ আগুনে পুড়ছি। মেয়েটা এখন কতো খুশি। এই খুশি আমি কোথায় থেকে এনে দিবো? মেয়ে যখন বাবাকে চাইবে আমি কোথায় পাবো? এতো কঠিন বাস্তবতার সামনে কেনো দাঁড়াতে হলো? কেনো?
এসব কথার কোনো উত্তর হয় না। শুধু হয় হাহাকার, আর যন্ত্রণা। সিনথিয়া নিজেও আস্ত সত‍্য চাপা দিয়ে এখনো টিকে আছে। বাবা মেয়ের সন্ধিক্ষণে প্রিয় মানুষগুলোর অগ্নিদগ্ধ চোখ, হৃদয় তার হৃদয়কেও পুড়িয়ে দিচ্ছে,সে নিরবে সয়ে যাচ্ছে সব। পৃথিবীতে কোনো মানুষ এমন ভুল পথে না যাক, একজনের শাস্তিতে আর না পুড়ুক গোটা পরিবার। ভস্মীভূত না হোক সকলের হৃদয়।

বাচ্চা মেয়েটাকে পাজরে চেপে উঠে দাঁড়ায় রাফসান। তারপর তুলে নেয় কোলে। বাচ্চা মেয়েটা নিরবে মাথা রাখে রাফসানের কাধে। দুহাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে রাফসান। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে নৈঃশব্দে হাঁটে কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর কক্ষ জুড়ে নামে শৈত্যপ্রবাহ। রাফসানের গলাটা তিক্ত ব‍্যাথায় রুদ্ধ হয়ে আসে। পুরুষ চোখ বলে কথা, হৃদয় ফেটে একাকার, শুধু চোখ দিয়ে জল আসে না। নিরবে হাঁটে আর তার ফাঁকে ফাঁকে টুম্পাকে শুধায়,
–মা!আমি কে তোমার…?
বাচ্চাটা অল্প সময়েই মিশে গেছে বাবা নামক অস্তিত্বের সাথে। সে গলা জড়িয়ে রাখে। রাফসান আবার বলে,
— ও মা! আমি কি হই তোমার! পাপা! আমি পাপা তোমার!
কক্ষ জুরে চুইয়ে পড়া নিরবতা। আলোগুলো ফিকে হয়ে গেছে। আলো আধারিতে বাবা মেয়ের কথোপকথন,
— কথা বলো মা! আমি কে। পাপা? তোমার পাপা?

বাচ্চা মেয়েটা মাথা নাড়ায়। রাফসানের হৃদয়ে শীতলতা বইতে থাকে। অপর দিকে শুরু হয় সময় শেষ হওয়ার তাড়া। আর কয়েক মিনিট। এরপরে তার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে তার কলিজার টুকরা। টুম্পাকে কেড়ে নিলে তার কলিজা ছিড়ে, ফেটে কি বেড়িয়ে আসবে এইবার! ভাবনার জাল থেকে বেড়িয়ে আসে রাফসান। মেয়ের সাথে আবারো খুনশুটিতে মাতে,
— বাবা বলোনা আমি কে? কে তোমার?বলো না বাবা। আমি কি তোমার বাবা।বাবা তোমার?
ছোট্ট রিনরিনে গলায় বাচ্চা মেয়েটা বলে,
–হুউউউ
— তুমি আমাকে চেনো মা!তুমি আমাকে চিনেছো? আমাকে তুমি চিনে নিলে! আমাকে তুমি খুঁজে নিয়েছো পাপা?
–হুউউউ
— কি হুউউ মা!
— পাপা!

মেয়েটাকে বুকের পাজরে চেপে ধরে রাফসান। আবারো অজস্র চুমু খায়। তারপর ভাঙা গলায় বলে,
— আরেকবার ডাকো “পাপা”!
— পা….পা
— আবার বলো….
— পাপা!
— আমি তোমার পাপা?
— হুউউউ।
— তাই বাবা!
— হুউউউ বা… বা… বাবা… বাবাই।
— তাই মা?
— হুম বাবাই!
— এতো সুন্দর করে ডাকলে যে পাপা আর বাঁচবে না মা। তোমাকে ছাড়া বাঁচবেই না।
–আই লাভ ইউ বাবাই।

অগ্নিদগ্ধ হৃদয়টা ধুক করে জ্বলে উঠলো রাফসানের।মেয়ের আধো গলায় ফুটে ওঠা কথা শুনে থমকে যায় ইভা, স্তব্ধ হয় হৃদয়।বাচ্চাটা ঠিকই বাবাকে চিনে নিলো, ভালোবাসার কথাটা বলে দিলো। সাজিদ কতোবার পাপা ডাকতে বলেছে,কতো আদোর করেছে। সাজিদকে পছন্দ করলেও কখনো পাপা ডাকেনি। অথচ নিজের আপনজনকে মেয়েটা ঠিকই চিনে নিলো। জানালার পর্দার ফাঁক গলিয়ে তাকায় ইভা। দুচোখ ভেসে যায় নোনাজলে। রাফসানের চোখটা রক্তলাল। যেনো এখনই চোখ থেকে খসে পড়বে একফোটা রক্ত। ফ‍্যাঁকাসে মুখটা নিয়ে মেয়েকে বুকে চেপে ফিসফিসিয়ে বলে,

— আই লাভ ইউ অলসো সোনা। আই লাভ ইউ।
বাকিটা মনে মনে আওড়ায়,
— কিন্তু তোমার বাবার ভালোবাসা যে আজ মূল‍্যহীন। ভালোবাসি বলে আকাশ বাতাশ কাঁপিয়ে ফেললেও কেউ বুঝবে না। কেউ না। আমার যন্ত্রণা, আমার হাহাকার কেউ বুঝবে না।
একবুক শূন‍্যতায় মেয়ের ভালোবাসা নিয়ে কক্ষজুড়ে দুলে দুলে হাঁটে রাফসান।মেয়েকে পেয়ে ভুলে যায় পুরো দুনিয়া। সময় কখনো খুব সংক্ষিপ্ত। ঘড়ির কাটা কড়া নাড়ে “সময় শেষ।” বুকের পাজর ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে যায়। দূরে কোথাও থেকে পালিয়ে যাওয়া যন্ত্রণারা আবারো ঝাক বেঁধে তেড়ে আসে রাফসানের দিকে। হাহাকার, শূন‍্যতায় তলিয়ে যায় রাফসান। রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকে টুম্পাকে জড়িয়ে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ইরফাদ। আদুরে স্বরে ডাকে,

— টুম্পা!
–হুম মামাই।
— চলে আসো তো আমার কাছে।
রাফসানের কাধ থেকে মাথা তোলে টুম্পা। অবুঝ মেয়েটা বলে,
— আরেকটু বাবার কাছে থাকবো?
— বাসায় ফিরতে হবে তো!
— তাহলে পাপাকেও নিয়ে চলো।
— পাপা অসুস্থ! সুস্থ হলেই নিয়ে যাবো।
— তাহলে আমি পাপার কাছে থাকি?
কিঞ্চিত মেয়েটার কি ছিলো ঐ কথায়। কক্ষে থাকা কয়েকটা হৃদয় যে সহ‍্য ক্ষমতা হারাচ্ছে। রাফসান ঠায় দাঁড়িয়ে, যেনো অনুভূতিহীন কোনো মানুষ। ইরফাদ হাত বাড়িয়ে ডাকে,

–চলো যাই। আবার আসবো মিট করতে। মামাই এর হাতে আজ একটুও সময় নেই । টুম্পা তো গুড গার্ল। চলো।
— না! আমি পাপাকে নিয়ে যাবো। আমি পাপাকেই চাই। পাপা আমি যাবো না।
— জেদ কোরো না টুম্পা। পাপা তো সিক। ব‍্যথা পাবে। ছেড়ে দাও। আই সয়ার মা! আমি তোমাকে আবার নিয়ে আসবো।
ছোট্ট মেয়েটা বাবা নামক অস্তিত্বকে আরোও আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। হাতের বাঁধন সর্বোচ্চ শক্ত করে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
–তুমি চলো পাপা। আমি তোমাকে গালি(গাড়ি) কোলে নিয়ে দাবো। তোমাল একটুও কষ্ট হবে না।
রাফসানের কম্পমান হৃদয় স্থির। কি করে মেয়েকে বোঝায় তার বাবা অপরাধী। চাইলেও এই গন্ডি পেরিয়ে যাবার ক্ষমতা তার নেই। ছোট্ট মেয়েকে কি করে বুঝাবে সে? নিস্তব্ধ, নিরবে শূন‍্যতায় তাকিয়ে গুণছে প্রহর। তার বুক ছিড়ে কলিজা টেনে হিচড়ে বের করে নিচ্ছে যেনো। ভুলের কতো ক্ষমতা তার সমস্ত শক্তি রোধ করে রেখেছে। বাচ্চাটা তার বুকে হাহাকার করছে। অথচ তার হাতদুটো ক্ষমতাহীন। বাবা হিসেবে যে সে অযোগ‍্য সে কথা মেয়েকে কি করে বোঝাবে। নিরব, নিস্তব্ধ রাফসান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

ইরফাদ তাড়া দেয়। মেয়েটা আজ তার কথাও শুনছে না। তবুও নিয়মের কাছে সে তো বন্দি। যতোটুকু সময় সে চেয়ে নিয়েছিলো ততোটুকুই তো তার হাতে। এর পরে তো ফিরতেই হবে। এখন অথবা পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, ঘন্টা…. ফিরতে তো হবেই। জোরপূর্বক হাত বাড়িয়ে টুম্পাকে কোলে নিতে চায় ইরফাদ। দুই জনের মাঝে দ‍্যদুল‍্যমান টুম্পা খামছে ধরে রাফসানের শার্ট।মায়ার বাঁধন থেকে মেয়েকে টেনে ছাড়ানোর মতো কঠিন হৃদয় কি আদোও আছে ইরফাদের। পারবে কি সে…..?
শার্ট থেকে মেয়ের হাত ছাড়িয়ে নেয় রাফসান। হাতের মুঠোতে আরেকটা চুমু খায়। ছোট্ট বাচ্চাটার চোখে জল। রাফসান নৈঃশব্দে মোছে মেয়ের ভেজা চোখ দুটো। অতঃপর আরেকবার কোলে তুলে নেয়। পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। আর হাতের ইশারায় ইরফাদের থেকে চেয়ে নেয় কয়েকটা মিনিট।

— যাস্ট কয়েকটা মিনিট।মেয়েটা কাঁদছে। রিকুয়েস্ট। প্লিজ….
ইরফাদের নিরব সম্মতি।
কক্ষজুড়ে নামে আধার।একবুক ভালোবাসা, সাথে হাহাকার।শূন‍্য বুকটাতে মেয়েকে মিশিয়ে নেয় রাফসান। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে গায়,
–লক্ষীসোনা, আদর করে দিচ্ছি তোকে
লক্ষ চুমু, মায়া ভরা তোরই মুখে।
কলিজা তুই আমার,
তুই যে নয়নের আলো
লাগেনা তুই ছাড়া,
লাগেনা তো যে ভালো।
রূপকথা তুই তো আমারই,
জীবনের চেয়ে আরো দামি।
তুই আমার জীবন, তুই ছাড়া মরণ,
তুই যে আমারই সাত রাজারও ধন
কলিজা তুই আমার,
তুই যে নয়নের আলো
লাগেনা তুই ছাড়া,
লাগেনা তো যে ভালো।
রূপকথা তুই তো আমারই,
জীবনের চেয়ে আরো দামি
তুই চাঁদের কণা, তুই ছানা বোনা,
তুই যে আমারই, সব সুখেরই ক্ষণ
কলিজা তুই আমার,
তুই যে নয়নের আলো
লাগেনা তুই ছাড়া,
লাগেনা তো যে ভালো।
রূপকথা তুই তো আমারই,
জীবনের চেয়ে আরো দামি।

রং পর্ব ৫৮

রাফসানের হাতের আদুরে চাপরে চাপরে ঘুমিয়ে যায় টুম্পা। হুহু শূন‍্যতায় নিরব, নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় রাফসান। সময় শেষ। এবার কেবল দূরত্বের শুরু। রাফসানের বুকের পাজর থেকে টুম্পাকে টুপ করে সরিয়ে নিজের কোলে নেয় ইরফাদ। সহসাই রক্তচক্ষু থেকে খসে পড়ে একফোটা নোনাজল। একবিন্দু নোনাজল যেনো বুকের তাজা রক্ত। এলোপাথাড়ি ঝড়ে টালমাটাল রাফসান। বিন্দু বিন্দু জলে ভিজছে বুক। এক পা দু পা করে বাড়ছে মেয়ের সাথে দূরত্ব। বুকের খাঁচা থেকে কিছু যেনো আস্তে আস্তে নাই হয়ে যাচ্ছে। নাই হয়ে যাচ্ছে সব। চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়ায় রাফসান। এই ঝড় যে তাকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। টিকতে দিচ্ছে না। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে মাঝ সমুদ্রে ভাসছে সে। ঝ ড়ের তান্ডবে ব‍্যকুল রাফসান বন্ধ চোখে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে। সহ‍্যের সীমানা পেরিয়ে যায়। অতঃপর তিক্ত গলা ফেড়ে বলে,
— আপনার রিভলবারের একটা বুলেট যতেষ্ঠ আমার কষ্ট কমানোর জন‍্য। প্লিজ শ‍্যুট মি স‍্যার। শ‍্যুট মি।

রং পর্ব ৫৮ (৩)