রং পর্ব ৬৬
তন্নী তনু
জীবন সংগ্রামে যন্ত্রণা নামক শব্দটা’র ঝাঝালো, তীব্র অনুভূতি’টা ধীরে ধীরে অভ্যাসে বদলে যায়, আজকের তাজা ব্যথা কাল দাগ হয়ে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে আবার নতুনের স্বাদ দেয়, ঘুম কেড়ে নেয়, হৃদয় জ্বালিয়ে দেয়। জীবন চলে এভাবেই। চোখ ক্লান্ত হয়, শরীর ক্লান্ত হয়, মন ক্লান্ত হয়, হৃদয় ক্লান্ত হয়; ক্লান্ত হয় না কেবল সময়। সে নিজের মতোই চলতে থাকে। হৃদয় নিংড়ানো তীব্র ঝাঝালো ব্যথায় ব্যথায় চোখের সামনে থেকে এক মূহুর্ত সরানো কষ্টসাধ্য হলেও দিব্যি বছর কেটে যায়। এসব ভাবনায় ডুবে রিমা জানালায় ফাঁকে চোখ রাখে।
একবছরে বদলে গেছে কতো কিছু!তবে আগেও চোখ পুড়িয়ে সকাল হতো, এখনো হয়। তবে দুঃখগুলো বদলে গেছে ভালোলাগা, খুশি, আর প্রশান্তি’তে। ঘুমহীন চোখদুটো বাচ্চার খিলখিল হাসিতে শান্ত হয়ে যায়। চোখের পাতা ফুলে ওঠে, ঘুমহীন আত্মা’টা তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে ঠিকই; তবে একবার নিষ্পাপ, কোমল মুখটা দেখলে সব ভুলে যায় রিমা। জীবন নামক যুদ্ধে জয়ী হয়ে গেছে সে– যখন ঘরে বাইরে লড়ে নিষ্পাপ বাচ্চা’টাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পেরেছে। সব কষ্ট স্বার্থক হয়ে গেছে সেখানেই। আর বাকি স্বার্থকতা তো আসবে মেয়েটাকে ‘মানুষ’ করে গড়ে তুলতে। এটাই হবে, “রিমার মেয়ে থেকে এক মা হয়ে ওঠার গল্প”। মেয়েটা সেই কখন ঘুমিয়েছে। এখনো উঠছে না। সুখ দুঃখের সাথী তো কেবল একজন’ই। খুব ইচ্ছে করছে মেয়ে’টার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে। তবে সে তো ‘মা’। তাই কি আর পারে? রিমা মেয়েটার মাথায় হাত বুলায়,শখের চুলগুলো কাটা হয়নি। সেগুলোর ঝুটি করা যায়। গার্ডার দিয়ে দুটো ঝুটি করে দিয়েছে সে; কি যে মিষ্টি মেয়েটা। কপালের কোণে ছোট্ট চুমু দিয়ে রিমা বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— তুমি সুখ হয়ে এলে আম্মু!! আমার মা হয়ে এলে!! আমার কেউ নেই, তাই এলে আমার বুকে। আমার সুখ তুমি। আমার ঘুম না আসা রাতের সঙ্গী তুমি। সব টাই তুমি মা। পৃথিবীর কেউ তো বুঝলো না, তুমি বুঝতে ভুল কোরো না মা। তোমার মা’য়ের মা হয়ে ওঠার গল্প এতো সহজ ছিলো না। তুমি আমার গল্প হয়ে ওঠো, পৃথিবীতে সকল ঠকে যাওয়ার নারীর;মেয়ে থেকে মা হয়ে ওঠার গল্প হয়ে ওঠো।
কপালের কোণে আরেকটা চুমু বসাতে যাবে এর মধ্যে রিমার মায়ের গলা,
–ঘুমের মধ্যে এতোবার হামি দিবি না।
–দিলে কি হয় গো মা!
— দিবি না ব্যাস! এতো কেনোর উত্তর আমি জানি নাকি?
রিমা তলিয়ে হাসে। এই কঠিন কথা’র মধ্যে যে কতখানি ভালোবাসা জমে আছে, সে তো এই কয়েক মাসে ঠিক উপলব্দি করতে পেরেছে। তার মা’য়ের পরিবর্তন দেখে বেশ অবাক হয়। অবাক হয় উপরওয়ালার রহমতের উপর। বাচ্চা, সত্যিই বড় নেয়ামত। না হলে কি আর ঐ কঠিন মানুষের মন গলে!! যে মা একদিন নিষ্পাপ বাচ্চা’র মৃত্যু কামনা করতো,মেরে ফেলতে চাইতো,সেই মানুষ’টা বাচ্চাটাকে আদর করে। কাঁদলে ছুটে আসে! ফিটার ধরে, পি করায়। ইসস! এই বুঝ যদি সে সময় আসতো তার কি একা জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে হতো, ক্ষুধায় কষ্ট করতে হতো, আর হৃদয়ে যে ক্ষত হয়ে গেছে সে ক্ষত? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিমা। জীবন নাটকের চেয়ে নাটকীয়। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে রিমা। এর মধ্যেই তার মা’য়ের উপস্থিতি। হাতে তেলের কৌটা।
— এদিকে আয়। শখ’ ঘুম থেকে উঠে যাওয়ার আগে মাথায় তেল’টা দিয়ে দিই।
আগে হলে রিমা বাহানা করতো, মাথায় তেল দিতে ইচ্ছে করে না, তেল দিলে মুখ তেলতেলে হয়, হাত তেলতেলে হয়। কিন্তু এখন তো তার ভালোবাসার অভাব, একটুখানি আদরের অভাব, যত্নের অভাব, স্পর্শের অভাব। তাই সাথে সাথেই বসে যায় মা’য়ের কাছে। আর চোখ বন্ধ করে অনুভব করে মায়ের স্পর্শ, গন্ধ। চুলে তেল মাখাতে মাখাতে রিমার মা বলেন,
— ডিজাইন তো ভালোই শিখেছিস! এরপর কিছু কি হলো?
— হয়নি এখনো, কিন্তু হবে মা। আমি চেষ্টা করছি। তুমি দোয়া করো শুধু।
— শুভ্র যদি জামিনে বের হতে পারে। ওকে নিয়ে কিছু ভেবেছিস…..!
— না মা…… হৃদয়ের সব ক্ষত মোছা যায় না। সব ভুলের ক্ষমা হলেও আগের জায়গায় ফেরা যায় না। কখনো কখনো বিশ্বাস এমন ভাবেই নষ্ট হয়, একজন প্রতারকের কারণে পুরো পৃথিবীকে আর বিশ্বাস হয় না, ভরসা করা যায় না। জানো মা; ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষরে যে পেয়ে হারাইলো, তার যন্ত্রণা যে কতোখানি গভীর!!! অপরপৃষ্ঠের সেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া মানুষ তা জানলো না। রাতের আধারে কতোটুকু পুড়লো, কতোটুকু জ্বললো, কতোটুকু হৃদয় ভাঙলো কেউ জানলো না। তাই প্রত্যেক মেয়ের উচিত আগে নিজেকে প্রায়োরিটি দেয়া।
” নিজের জন্য একটা সকাল হোক। আকাশের বুকে রক্তিম সূর্যটা আলোর বার্তা নিয়ে উদ্ভাসিত হোক আমার জন্য, জানালার পর্দা সরিয়ে এক কাপ চায়ে প্রগাঢ় চুমুক দিয়ে, নিজেকে নিয়ে খানিকটা ভাবার সময় হোক; এলোমেলো বিনুনি খুলে যত্ন করে বাঁধা, মুখে একটুখানি সাজগোজ, একটুখানি যত্ন, আয়নায় বার বার নিজেকে দেখা হোক শুধু নিজের জন্য। অন্তরদহনে, ভষ্মিভূত হৃদয়ের যন্ত্রণায় যে কতোখানি নিজের শরীর ক্ষয় হলো, তার গতি হোক। কোন ড্রেসে কতোখানি সুন্দর দেখালো, কোন লুকে কতখানি মিষ্টি লাগলো– এ অনুভূতি আমাকে ছুঁয়ে যাক;কারোর বলার অপেক্ষা না রাখুক,’তোমাকে সুন্দর লাগছে’। আমার চোখেই আমাকে সুন্দর লাগুক, আয়নায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ঢং হোক কেবল আমার হৃদয়ের জন্য, আমার প্রশান্তির জন্য, আমার আত্মার খোড়াকের জন্য, আমার খুশি থাকার জন্য, আমার ভালো থাকার জন্য।খানিকটা সময় হোক আমার নিজের জন্য।
অন্যের সব সাজাতে গিয়ে নিজের কতোখানি হারিয়ে এলাম, তা নিয়ে ভাবার জন্য একাকী বিকেল, ধূসর রঙের সন্ধ্যা হোক। নিজের জন্য একটা বৃষ্টির রাত হোক– সেখানে কারো বুকে মুখ লুকিয়ে প্রশান্তির উল্লাসে না মেতে, বৃষ্টির রাত সম্পূর্ণ আমার একা’র হোক। জরাজীর্ণ হৃদয়ের বিষাক্ত অনুভূতি ধুয়ে ফেলার জন্য বৃষ্টির প্রতিটি কণা আমার হোক। আমার জন্য ভোর হোক, আমার জন্য দুপুর হোক, আমার জন্য খ ড়া নামুক আবার আমার জন্যেই দিনের কোলে রাত নেমে আসুক, বৃষ্টি হোক। এই পৃথিবীতে সকল ভালোলাগা আমার হৃদয়ের জন্য হোক,ভালোবাসা হোক কেবল নিজের প্রতি।”
রং পর্ব ৬৫
কিছু কাপুরুষের কাছে নারী অসহায়, অস্তিত্বহীন। তুমি আমার পাশে থাকো। আমি পুরো পৃথিবীকে দেখাতে চাই। মেয়ে মানে দূর্বল নয়। আমি ঠকে যাওয়া প্রতিটি নারীর ঘুড়ে দাঁড়ানোর গল্প হয়ে উঠতে চাই……….
গল্প আজ গল্পের নিয়মে পোস্ট করলাম না….. রিমার কথাটুকু আলাদা করে একটু দিলাম।আমার মনে হলো এভাবেই ভালো লাগবে। নির্ঘুম রাতটা সার্থক লাগছে রিমার “নিজের জন্য সব হোক” এইটুকু অংশ লিখতে পেরে। তিথি, ইভার টুকু রাতে দিবো ইনশাআল্লাহ……..