রং শেষ পর্ব
তন্নী তনু
বর্ষণমন্দ্রিত রজনী!!নিকষ কালো আধার। বিছানায় পাশে জানালায় পিঠ ঠেকিয়ে জীবনের হিসেব কষতে বসেছে অনিমা। ছোটবেলা থেকেই সে খুব শান্ত, নিরবতা তার সঙ্গী। বাবা মায়ের বাধ্য মেয়ে। কখনো অবাধ্য হয়নি। বাবা মা সন্তানের সবচেয়ে ভালো চায় এই কথার উপর ভিত্তি করে বিয়ে নিয়ে তার কোনো অমত ছিলো না। বিনা দোষে, বিনা অপরাধে, ভুল না করেও সে ভুক্তভোগী–কেনো…?এই প্রশ্নের উত্তর কখনো মিলবে না। জীবন কখন কোথায় কতোটা জটিল মোর নিবে কেউ জানে না। দিন পাল্টেছে, পাল্টে গেছে সময়। এই রঙের দুনিয়ায় কখন কার জীবনের রঙ আধারে ডুবে যাবে, বৃষ্টিতে ধূয়ে যাবে কারো জানা নেই। কারোর না….! দু’ চারদিনের সংসার! একটা জীবন্ত মানুষ! কয়েক মূহুর্তের স্মৃতি। এর পরে সব টা ঘোলাটে, প্রশ্নের ভীর… আর যন্ত্রণা। তবুও বাঁচতে হবে, চলতে হবে, প্রয়োজনে হাসতে হবে। চোখ বন্ধ করে অনিমা, বুক ভার হয়ে আসে। চোখের কোণ বেয়ে গরম জল টুপ টুপ করে পড়ে। বোবা কান্নার কোনো শব্দ নেই, নেই মুখের অভিব্যক্তি। নিরবে, নৈঃশব্দে হাতের উপর কারো স্পর্শ। কোমল হাতের উপর কারো স্পর্শে চোখ খোলে অনিমা। অন্যে হাতে তড়িঘড়ি করে মোছে চোখের কোণ। ভেজা গলাটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে,
— মা আপনি? এখানে?
রাফির মা নিরব। মুখে কোনো কথা বলে না। শুধু নিরবে জ্বালিয়ে দেয় টেবিল ল্যাম্প এর স্বর্ণালী আলো। অনিমা আরেকবার চোখ দু’টো মোছে। মাথার কাপড়টুকু আরোও ভালোভাবে টেনে নেয়। রাফির মা ওড়নার তলায় থেকে কিছু একটা বের করেন। অনিমার হাত টা ধরে একটা বক্স ধরিয়ে দেন তিনি। বিস্মিত, বিচলিত কন্ঠে অনিমা সুধায়,
–কি এটা মা?
— তোর ভবিষ্যৎ উজ্জল করার সামান্য চেষ্টা। আজকাল মেয়েরা কিন্ত দূর্বল না মা। দূর্বল হবি না কখনো।
— কি এগুলা…?
— খুলে দ্যাখ!
অনিমা বক্সটা খুলে বিস্মিত নয়নে তাকায় তার শাশুড়ি’র দিকে। নিরবে ঠোঁট জোড়া নাড়ায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
–এগুলো তো তোমার গহনা। তোমার সম্পদ! তুমি আমাকে দিচ্ছো কেনো….?
— আমি তো মেয়ে, আবার আমি–ই মা। বিয়ের পরে স্বামী খারাপ হলে একটা মেয়ের জীবন কত জটিল হয় আমি কি বুঝিনা? এই যে তোর বাপের বাড়ি’র কেউ তোর খবর নেয় না, দেখতে আসে না! কেনো? আমি কি বুঝিনা কিছু? আমি সব বুঝি মা। আমি সব বুঝি। বিয়ের পরে মাইয়া ভার হইয়া যায়। এতোদিন হইছে– না রাফি ফিরা আইলো, আর না তোর দুঃখ গেলো। এভাবে তো হয়না।
শোন! আমরা তো নারী!! আমরা কখনো কখনো কা’পুরুষের বানানো নিময়ের বাইরে যেতে পারিনা। রাফি”র আব্বায় রাফির বিয়ে টা যখন তোর সাথে দিলো। আমি জানতাম ঠিক হচ্ছে না। ছেলে তো ভালো হয় নাই। অবশ্য ছেলের বাপ ভালো হইলে তো ছেলে ভালো হইবো। জমি-জমার গ্যারাকলে একটা মাইয়ার জীবন নষ্ট করলো। নিজের পোলা তো আগে থেকেই নষ্ট!! আমার কিছু করার ছিলো না।
ঐ যে আমাদের মুখে স্কচটেপ মারা। আমরা বন্দি, আমাদের হাতে কিচ্ছু নাই। তবে তোরে দেখে ভাবছিলাম– এই রকম মায়াবী মেয়ের ছোঁয়া’য়, ভালোবাসায়, কোনো একদিন রাফি ভালো হইয়া যাইতেও পারে, ভালোবাসা’য় কতো কিছু তো বদলে যায়। আমার ছেলেও বদলাতেই পারে। কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে জানোয়ার রে মানুষ করা যায় না।এটা ভাবাও অন্যায়। এরা কোনো দিন ভালো হয় না। এসবের আশায় থাকিস না আর। তোর বাপের বাড়ির সবার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে,আর রাফির আব্বায় তো চোখ খোলার মানুষ না। এক মাইয়ার জীবন নষ্ট হইছে, তার তো কিছু হয় নি, তার ছেলেরও কিচ্ছু হয়নাই।
— আমি কি করবো মা….? আমার খুব নিরুপায় লাগে, অসহায় লাগে। আমার পাশে কেউ নেই কেউ না।
— এখন কি সেই আগের যুগ আছে? এতো ভয় পাস? যা আমার করার দরকার ছিলো, যা আমি পারিনাই তুই করে দেখাবি। শক্ত হ। মন শক্ত কর। এসব অমানুষ, জানোয়ার কোনোদিন ভালো হয় না। যারা টাকার নেশায় পড়ে তারা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত বাপ – মা, বউ রে চেনে না। তারা ভালোবাসা বোঝে না। ওদের হৃদয় পঁচে যায়। তুই ওর আশা আর করিস না। তুই মনের কর তোর জীবনে কখনো এসব কিছু হয়নি। জীবন টাকে নতুন করে শুরু কর।
— কি করবো আমি মা? কোথায় যাবো?
— আমি তো টাকা পয়সা ছুঁয়ে দেখতে পারিনা। সে অধিকার আমার নাই। তবে এইগুলো আমার বাপের বাড়ি থেকে দেয়া। কাল এইগুলো বিক্রি করে আসবো। ঐ টাকা দিয়ে তোর যা যা ইচ্ছে করে কিনে দিবো। তোর যেখানে যেখানে গেলে ভালো লাগবে নিয়ে যাবো। আমি আমার বোনের কাছে খবর নিছি এই যে এই হাইওয়ের পরের গলিতে ইংলিশ ক্লাস করায়।ঐখানে তোরে পড়তে দিবো।
— এখন আবার পড়াশোনা?
— তোর তো লাস্ট সেমিস্টার দেয়া বাকি। ঐটা শেষ করবি। এদিকে IELTS টা দে।
— তুমি আমাকে দেশের বাইরে পাঠাতে চাচ্ছো মা?
— হুমম!
— যে দেশে তোর পরিবার তোকে চাইলো না, আপনজন দেখলো না। সে দেশে তোর থাকতে হবে না। আমি চাই তোর সুন্দর জীবন হোক!
— কিন্তু……
— কোনো কিন্তু না…. এই খানে মেয়েদের জীবন নষ্ট সবাই করতে পারে, এরপর কাঁদা ছোড়াছুড়ি সবাই করতে পারে। এরপর মেয়েটা বাঁচলো নাকি মরে গেলো কারো কিচ্ছু এসে যায় না।তবে তোর জীবন এভাবে নষ্ট হতে পারে না। ভাগ্য একবার কষ্ট দিয়েছে বলে বার বার দিবে না। জীবন সুন্দর! তবে সময় মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দেরি করিস না।আমাদের মতো ভুল করিস না। ভুল মানুষের জীবনে থেকে আরেকটা ভুলের জন্ম দিয়ে তোর জীবনটা ধ্বংস করে দিলাম। আমাকে তুই মাফ করে দিস।
— কি বলছো এসব?
— তোর জীবন যেদিন বদলে যাবে সেদিন আমিও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবো।
— তোমার কোনো অপরাধ নেই মা। তবে আমার জীবনকে আমি বদলে ফেলবো আর এভাবে ঝিমাবো না, বসে থাকবো না। আমার তো কেউ নেই…তুমি পাশে থেকো!
ডোর বেল”টা বেজেই চলেছে। মন্থর গতিতে দরজা খোলে সুভা। সেই একই বিষয় একাধিক বার মুখোমুখি হয় সে। ভাইয়ের ঋণ..ঋণ.. আর ঋণ..! সারাদিন কাজ করে যা উপার্জন হয় তা ইনস্টলমেন্ট আর ঋণ দিতে দিতে সে ক্লান্ত। এরপর ভাইয়ের পড়াশোনা,আবার সংসার খরচ। আজকাল চোখ ক্লান্ত, মন ক্লান্ত, শরীর ক্লান্ত। অপর প্রান্তের মানুষটা কিছু বলার আগেই সুভা বলে,
— আই নিড টাইম। সুমনের সাথে যোগাযোগ করবেন। টাকা পেয়ে যাবেন। প্লিজ এখন আসুন।
দরজা চাপিয়ে ক্লান্ত মুখে কক্ষে’র দিকে ফেলে সুভা। মন টা ভার করে সে পথে’র সামনে দাঁড়িয়ে যান সুভার মা।
–কিছু বলবা মা? না হলে সরো। শুধু শুধু মাথা গরম কোরো না।
— এভাবে আর কতো দিন থাকবি বলতো? এবার তো কিছু একটা ভাব?
–কি ভাববো?
— দেখ এতো টাকা ঋণ! সংসার খরচ। বিয়ে টা করে নে। অন্তত মুক্তি পাবি।
— আমি বিয়ে করলে তোমাদের কে খাওয়াবে। বিয়ের পর যদি বর জব করতে না দেয়? টাকা দিতে না দেয় তখন তো না খেয়ে মরবে। সরো এখান থেকে।
–ঐ ছেলেটা তো ভালোই মনে হলো।
–কোন ছেলে?
–যে ছেলেটা তোকে বিয়ে করার জন্য এত জোর করছে।
— বিয়ের আগে সবাই এমন করে মা। সবাই সুন্দর রূপ টাই দেখায়।
— তোকে ভালোবাসলেই হবে। আমাদের চিন্তা করিস না। আর তো অল্প সময় এরপর সুমন কিছু করলেই আমাদের দুজনের চলে যাবে।
— আর ততোক্ষণ কি তোমরা না খেয়ে থাকবে?
— একটু নরম হ মা! কখনো কখনো– যে তোকে ভালোবাসে তাকে গ্রহণ করতে হয়। নিজে যাকে ভালোবাসিস তাকে নয়!
সুভা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর রগচটা স্বরে বলে,
— যাও ডেকে নিয়ে আসো! বিয়ে করে তোমাদের উদ্ধার করি।
–সত্যি?
— আমি মিথ্যা বলিনা মা।
রাত বাড়ছে, তিথির ঘুম ছুটে যায়। কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভূতি! শরীর ঘামছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, আবার পেটেও অশান্তি লাগছে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে উঠে বসে তিথি। পেটের মধ্যের সব উগলে আসছে। নিঃশ্বাসের বেগতিক ওঠানামায় শিশিরের ঘুম ছোটে। নরম আবছা আলোর ঘরটাতে তার চোখ এড়ায় না কোনো কিছুই। লাফিয়ে উঠে বসে শিশির। তিথি ততোক্ষণে আধভাঙ্গা হয়ে শরীর এলিয়ে দিয়েছে- বিছানায় ঠেস দিয়ে রাখা বালিসে। শিশির আলো জ্বালায়। দু’বার ডাকে তিথিকে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। হাতের তালুতে হাত ঘষে, গালের পাশে হাত রেখে ডাকে। মূহুর্তেই অশান্ত শিশির একলাফে নিজের কক্ষের দরজা খুলে তার মা কে ডাকে,
— মা, বাবা।
মূহুর্ত্তেই সবাই চলে আসে। মার্জিয়া বেগম এসে তিথির চোখ মুখে পানির ছিট দেয়। চোখ মেলে তাকায় তিথি। একে একে সবার দিকে তাকায়। মার্জিয়া বেগম তিথির মাথায় হাত বুলায়,
–ঠিক আছিস!
তিথি মাথা নাড়ায়।
— কেমন লাগছে?
— বুঝতে পারছি না।কেমন লাগছে বলতে পারছি না?গা গুলায়, অশান্তি পেটের মধ্যে….
–বমি লাগে….!
তিথি মাথা উপর নিচ করে। মার্জিয়া বেগম বিছানায় উঠে বসেন। নিজের কোলের মধ্যে বালিস নিয়ে তিথি ডাকেন,
— এখানে আয়। এখানে মাথা রাখ। আমি হাত বুলিয়ে দেই।
এই একবছরে মামি তিথিকে ছোট বাচ্চার মতোই কাছে টানেন। এ আর নতুন কিছু না। তিথি ছোট বাচ্চার মতো মামির কোলে শুয়ে যায়। মাথায় হাত বুলান মার্জিয়া বেগম। শিশির উদভ্রান্তের মতো ছটফট করে।
— মা, ডক্টর ডাকবো।
— এতো রাতে মেয়ে ডক্টর পাবি কই।
— কেনো মা।
— তোর বউ’কে বল চুল গুলো এইবার যেনো বড় করে। একসাথে দু’টো বাচ্চার ঝুটি বেঁধে দিবো রোজ।
কুটুস কপাল ভাজ করে বলে,
— কিন্তু আমার চুলে তো বিনুনি হয়।
— আমি কি তোর কথা বলেছি?
— বাড়িতে আমি আর ভাবিই তো বাচ্চা তাহলে?
–নতুন বাচ্চা আসবে।
এক মূহুর্তে’র জন্য নৈঃশব্দতায় তলিয়ে যায় কক্ষ। হতবাক, হতবুদ্ধ হয়ে তাকায় তিথি, শিশির। আর আনন্দে চিৎকার করে ওঠে কুটুস।
পরের দিন সন্ধ্যা…..
ধূসর রঙের আকাশ, এলোমেলো বাতাস হচ্ছে। টুম্পা’কে নিয়ে ছাদে যায় ইভা। টুম্পার হাতে লাল রঙের বেলুন। ছাদের কার্ণিশে দাঁড়ায় মা, মেয়ে। বেলুনের একটুকরো সুতোয় জড়িয়ে বেঁধে দেয় ছোট একটা ভাজ করা কাগজ। রোজ একই নিয়মে সাদা কাগজে চুমু খায় টুম্পা। এরপর মুক্ত করে দেয় আকাশে। বেলুনের ছুটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে দু’টো চোখ। আর টুম্পা বিড়বিড়িয়ে বলে,
–ভালোবাসি পাপা! অনেক ভালোবাসি।
অকস্মাৎ শুরু হয় এলোপাথাড়ি বাতাস। আকাশ চিড়ে বেড়িয়ে আসে আলো। ইভা টুম্পাকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ছাদ থেকে নেমে যায়।
কেবিনেট থেকে একটা একটা করে প্রয়োজনীয় জিনিস নামাচ্ছে সিনথিয়া। তার বরের স্বপ্নের দেশে সঙ্গী হয়ে যেতে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্য কাল দেশ ছাড়বে তারা, কয়েকদিনের জন্য সুন্দর ভ্রমণ। ভিষণ খুশি লাগছে।
টুম্পাকে দেখার ইচ্ছে, আর মায়া’র টানে বার বার ছুটে আসে সাজিদ। তবে একবছরে একবারো ইভার সাথে তার দেখা হয়নি। এই নিয়ে তার অভিযোগ নেই। কিছু বলারও নেই। মেয়ে টার প্রতি তার মায়া আত্মা থেকে,এখানে স্বার্থের ছিটেফোটা অংশ নেই। সেই উদ্দেশ্য আজকে আবার ছুটে আসা। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই এলোমেলো বাতাস। বৃষ্টির আনাগোনা। সে মূহুর্তেই বাতাসের সাথে ভেসে আসে একটুকরো সুতা। যার একপ্রান্ত লাল কাপড়ের মতো, আরেক অংশে ভাজ করা কাগজ। সাজিদ তুলে নেয় কাগজটা। অপরপ্রান্তের বেলুনটা কিছুর সাথে লেগে ফেটে গেছে। সুতোয় জড়ানো কাগজটা ছাড়িয়ে নেয় সাজিদ। এরপরে,
–“টুম্পার পাপা”
দেখো!!নিশীথে অবরুদ্ধ হৃদয়ে, রুদ্ধ নীল, রক্তিম ব্যথাগুলো নিমিষেই মুঠোভর্তি রঙ হয়ে গেলো। তুমি দেখলে তো…….! তীব্র খড়ায় নেমে এলো দিনকে ডুবিয়ে এক বর্ষণমন্দিত নিকাশ কালো আধার, নেমে এলো কল্পনার রাজ্য নিজেই। আর….! এরপরেই তীব্র বর্ষণ!!!এরপরে স্বয়ং তুমি। অদৃশ্য তুমি!! এরপর!!! এরপর সবটা বদলে গেলো……
তুমি এসো….! নিকষ কালো রজনী’র নির্ঘুম রাত্রিতে, বজ্রাঘাতের তীব্র ঝংকারে উত্তাল কুকড়ে যাওয়া ভয়াল আধারিতে,তুমি এসো দূর্দমনীয় স্রোতের বিপরীতে ফুলে ওঠা চোখের পাতায় ঘুম হয়ে। তুমি এসো আধারে তলিয়ে যাওয়া ধূসর রঙের সুখ হয়ে। তুমি এভাবেই আসো কল্পনা জুড়ে, এভাবেই বেঁচে থাকো হৃদয় জুড়ে। আমি পুরো জীবনটা তোমার জন্য উৎসর্গ করলাম। অপেক্ষা করবো সেই দিনের। সেদিন আমাদের ভালোবাসার সংসার হবে…..
চিঠিটা’ থেকে চোখ সরিয়ে নেয় সাজিদ। ফোনের স্ক্রিনে ইভা’র নম্বের কল দেয় সাজিদ। সে জানে ইভা কল ধরবে না। তার কল রিসিভ করবে ইভা, তবে কথা বলবে টুম্পা। আজ ও হলো তাই।
–মামনি!
— আংকেল!
— হুউউ মা! একটু বেলকুনি আসবে মা?
টুম্পা দৌড়ে যায় বেলকনিতে। সাজিদ হাতের উপর চুমু খেয়ে ঢিল ছোড়ে। বাচ্চা মেয়ে টা হাত বাড়িয়ে মুঠো পাকায়। তারপর গালে ছোঁয়ায়। সাজিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নিরব, শান্ত গলায় বলে,
— দড়ি টা ফেলো তো টুম্পা। তোমার চকলেট গুলো দেই।
— তুমি উপরে এসো আংকেল!
–আজ না মা। আজ কাজ আছে। অন্যদিন যাবো।
— আসো না!
— আজ না বাবা। আবার আসবো। আজ সত্যি তাড়া। টুম্পা তো লক্ষি বাচ্চা, জেদ করে না । আমি কাল তোমার স্কুলে যাবো। খুশি?
— হুউউ।
— একটা ছোট্ট চিরকুট আছে! মামনি’কে দিবে। বাকি সব তোমার।
–ওকে আংকেল!
— ওকে বাবা “আই লাভ ইউ”। টাটা….
— লাভ ইউ ঠুউউ আংকেল। টা টা……
টুম্পা ঘুমালে চিঠিটা খুলে দেখে ইভা,
— ভালোবাসা মানে হলো তোমার খুশি! তুমি খুশি তো? তুমি খুশি হও। আমৃত্যু আমার হৃদয় ভস্মিভূত হোক। তবুও তুমি খুশি থাকো…..
নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে সিনথিয়ার চোখ দু’টো আটকে যায় একটা স্যাতস্যাতে মুখোশের দিকে। সমুদ্রপাড়ে বালিতে মাখামাখি এক অবয়ব।যার চারপাশে লোকজনের ভীর। যার মুখে মাস্ক টা পরিচিত। সিনথিয়া পুরো বিষয়টা ভালোভাবে দেখে। নিউজটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখে সিনথিয়া। নিউজ পড়ছেন একজন মেয়ে।
“সমুদ্র পাড়ে মাস্ক পরিহিত যে লাশটি পাওয়া গিয়েছিল, শনাক্তকরণে জানা গেছে লাশটি ” রায়হান রাফির।” তিনি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমের সাথে জড়িত ছিলেন। একবছর আগে সমুদ্র পাড়ে ক্ষমতার দাপটে আকাশের বুকে তিনিই লিখেছিলেন– “রাফি দ্যা সাইল্যান্ট কিলার”। আজ তার নিরব মৃত্যু কেবল ধোঁয়াসা। চলছে তদন্ত…..
সিনথিয়া সমুদ্রপাড়ের একবছর আগের ভিডিও আর এখনকার ভিডিও টা নিঁখুত করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। মাস্ক’টা খুব চেনা। এই ধরণের মাস্ক সে আগেও দেখেছে। একটু আগেও দেখেছে। অসংখ্য প্রশ্নেরা ভীর করে। মাথা ভার হয়ে আসে। স্পিডবোটের উপর দাঁড়ানো গথিক ভ্যাম্পায়ার জগতের ভ্যাম্পায়ার রূপী অবয়ব কি করে রাফি হতে পারে….? কাছের মানুষ চিনতে সে ভুল করতে পারে না। অসংখ্য প্রশ্নের ভীর! বাস্তবে সামনে দাঁড়ায় ইরফাদ। সিনথিয়া’র নিরব চাহুনি। ইরফাদ ভ্রু উচিয়ে বলে,
— হোয়াট হ্যাপেন্ড?
— কিছু না?
— ঠিক আছো?
— একটা প্রশ্ন করবো?
বিছানার পাশে সিনথিয়ার রাখা ফোনের স্ক্রিনে একপলক তাকায় ইরফাদ। এরপরেই তার উত্তর,
— সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেই। কাল ফ্লাইট। এখন রিলাক্সে ঘুম দিবে।
— কিন্তু….
— কোনো কিন্তু না, আসো ঘুম পাড়াই….
বর্ষনমদ্রিত নিকষ কালো রজনী, ভারী রাত। রকিং চেয়ারে দুলছে বলিষ্ঠ দেহী ইরফাদ। বুক ছুঁয়ে আদুরে বাচ্চার মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সিনথিয়া। বুকের এককোণে প্রশ্নরা এখনো ভীর করে আছে। ভার লাগছে। চোখ জুড়ে অশান্ত ঘুমে’রা পালিয়েছে। নৈঃশব্দে বুক জুড়ে জড়িয়ে যাচ্ছে প্রশ্নেরা। ইরফাদ রকিং চেয়ার দোলায়, সিনথিয়ার শ্বাসের ওঠানামা পরোখ করে। পিঠজুড়ে ক্ষণে ক্ষণে আদুরে চাপড় দেয়। ঘরজুড়ে নামে নিরব আধার। জানালার ফাঁক গলিয়ে ছুটে আছে বৃষ্টি কণা। ইরফাদ সিনথিয়ার পিঠে হাত বুলায়। গুরুগম্ভীর নিগূঢ় গলার স্বরে সুধায়,
রং পর্ব ৬৬
— “ভালোবাসি!”
এ বিষয়ে কোনো ডাউট আছে?
সিনথিয়া নিরবে মাথা নাড়ায়। ইরফাদ পিঠ ছেড়ে মাথায় আঙুলি চালায়। কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
— আমি তোমাকে ভালোবাসি! একথাটুকুই সত্যি। এইটুকু জানলে আর পৃথিবী তোমাকে জানতে হবে না। ক্লিয়ার…….!
সিনথিয়া মাথা নাড়ায়। রকিং চেয়ার দোলায় ইরফাদ। সিনথিয়ার কপালের এককোণে ছোট্ট চুমু দিয়ে বলে,
—পৃথিবীর সমস্ত ভুল রঙ হয়ে যাক।