রাগে অনুরাগে পর্ব ১০
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
মেইন গেটের কাছাকাছি আসতেই দারোয়ান দরজা খুলে দিলেন। জাওয়াদের সাথে হাসিমুখে কথাও বললেন। তাদের নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। মালিহা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। জাওয়াদ এবং দারোয়ানের কথোপকথনের ধরনে বেশ বোঝা যাচ্ছে তারা পূর্ব পরিচিত। অন্ধকার হওয়ায় গেটের সামনে লাগানো বড়সর নেমপ্লেট চোখে পড়েনি মালিহার। মনের মধ্যে কৌতূহল জেগেছে ভিষন।
তিনদিক দালানে ঘেরা। একপাশে বড় উঠানের মতো ছোট মাঠ। মাটির বুকে সবুজ গালিচার মতো সবুজ ঘাস বিছিয়ে আছে। হাঁটার সময় মালিহার পায়ে নরম ঘাসের ছোঁয়া লাগছে। খাবারের সুন্দর ঘ্রাণ মালিহার নাকে ভেসে এলো। রান্নার আয়োজন চলছে রান্নাঘরে। জাওয়াদ মালিহাকে নিয়ে অফিস কক্ষে গেলো। ফ্যাকাশে রঙের শাড়ি পরিহিত মধ্যবয়স্ক নারী মুখের দেখা মিললো। জাওয়াদকে দেখে ভদ্রমহিলার ঠোঁট প্রসারিত হলো। জাওয়াদ সালাম দিলো। বিনয়ের সাথে শুধালো, “কেমন আছেন খালাম্মা?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তোমরা ভালো আছো তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
কথোপকথন খানিক সময়ের জন্য থামলো। ভদ্রমহিলা গলা ছেড়ে কাউকে ডাকলেন। একটি অল্প বয়সী কিশোরী এগিয়ে এলো। জাওয়াদকে দেখে মেয়েটি হেসে জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন আছেন আঙ্কেল?”
জাওয়াদ প্রতিত্তোর করলো, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি ভালো আছো তো? পড়াশোনা চলছে তো ঠিকঠাক?”
“জি আঙ্কেল সব ভালো।”
মধ্যবয়স্ক মহিলাটি কিশোরী মেয়েটিকে আদেশের স্বরে বললেন, “তৃনাকে বলো নাস্তার ব্যবস্থা করতে। জাওয়াদ এসেছে নতুন বউমাকে নিয়ে। ওদের বসার ব্যবস্থা করতে বলো।”
মেয়েটি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। অতঃপর দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল তার গন্তব্যে।
মালিহা সবটা অবাক হয়ে দেখছে। কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। আর না জাওয়াদ কিছু খোলাসা করে বলছে।
জাওয়াদ বলে উঠলো, “কিছু করতে হবে না খালাম্মা। আমরা খেয়ে এসেছি। পরশু চলে যেতে হবে। মিশনে যেতে হচ্ছে আমারও। বহুদিন এদিকে আসা হবে না। ওকে নিয়ে আপনাদের দেখে যেতে এলাম।”
“তা বললে কি হয় বাবা! বউমা প্রথমবার এলো। খালিমুখে কি করে যেতে দিই? তুমি আজকে বাচ্চাদের স্পেশাল করে খাওয়াচ্ছো। নিজেরা না খেয়ে বেড়তেই পারবে না। তোমাদের মত দয়ালু মানুষগুলো আছে বলেই এতিম বাচ্চাগুলো তিনবেলা খেতে পড়তে পারছে। আজ ওরা কত খুশি! দু বছরের টুনিও জেগে আছে কাচ্চি খাবে বলে।”
জাওয়াদ কিছু বলে না। একটু হাসে শুধু। মালিহা সে হাসির দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যায় মুগ্ধতার রাজ্যে। কিছুটা বুঝতে পারে সে। অফিস রুমের দেয়ালে বড় করে লেখা, ‘মায়া নিবাস।’ আন্দাজ করতে পারে হয়তো কোন চাইল্ড কেয়ার হবে।
মিনিট দশেক পরে ট্রেতে করে ঘন সরের দুধ চা আসে। সাথে আছে পাকা কেঁটে দেওেয়া আম আর টোস্ট। দুধ চায়ের সাথে আম! মালিহা হতভম্ব দৃষ্টিতে খানিক চেয়ে থাকে সেদিকে।
ভদ্রমহিলা টেবিলে খাবার সাজিয়ে বললেন, “বাইরের আম গাছগুলোয় বেশ ভালো আম ধরেছে। খেয়ে দেখ ভালো লাগবে। বউমা চা টা অবশ্যই খাবে। আমাদের রান্নার মেয়েটা ভালো চা বানায়। মুখে লেগে থাকবে স্বাদ।”
মালিহার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলে সে ইতস্তত করে নেয়। জাওয়াদ কাঁটা চামচ দিয়ে আম খেতে থাকে। চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বুজে ফেলে মালিহা। মনে মনে বলে, “মাশাআল্লাহ!”
বড় একটা রুম। রুমের দুপাশে মাদুর বিছানো। মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা। বাচ্চারা সব বসে আছে খাবারের আশায়। কেউ দুষ্টুমি করছে না। বড় সসপ্যান ভর্তি খাবার এলো। খাবারের ঘ্রাণে চোখ মুখ চকচক করে উঠলো বাচ্চাদের। একে একে সকলের প্লেটে খাবার বেড়ে দেওেয়া হলো। আগ্রহ নিয়ে বাচ্চাগুলো খেতে লাগলো। শুধু দু বছরের ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ে খেতে পারছিল না। খাবারটা একটু গরম হওয়ায় বারবার হাত উঠিয়ে নিচ্ছিল প্লেট থেকে। মালিহা দরজায় দাড়িয়ে দেখছিল সব। এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। আদুরে গলায় বললো, “আমি খাইয়ে দিই?”
বাচ্চা মেয়েটি বিস্ময় নিয়ে দেখছে তাকে। হয়তো ছোট্ট মস্তিষ্ক প্রশ্ন জাগছে, সুন্দর মুখের চকচকে পোশাক পরা যুবতি কে? দুপাশে মাথা দুলালো মেয়েটি। অর্থাৎ হ্যাঁ। রুমের সকলের দৃষ্টি তখন মালিহার দিকে। খাবার পরিবেশনরত মেয়ে দুটি দৌড়ে এসে বললো, “আমরা খাইয়ে দিব ম্যাম। আপনার কষ্ট করতে হবে না।”
মালিহা বললো, “আমাকে হাত ধোয়ার পানি দিন আপু। ওকে খাইয়ে দিই। আপনারা তো আছেনই। আমি সবসময় থাকবো না। আজ না হয় আমিই দিলাম। আপত্তি আছে?”
চটপট উত্তর এলো, “একদমই না। আচ্ছা ঠিক আছে।”
হাত ধোয়ার পানি এলে মালিহা হাত ধুয়ে মেয়েটির পাশে বসে পড়লো। লোকমা পাকিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলো। মেয়েটি চরম বিস্ময় নিয়ে প্রতিটি খাবারের লোকমা খেতে লাগলো। তার দু বছরের ছোট্ট জীবনে হয়তো তাকে এতটা মমতা নিয়ে কেউ খাওয়ায়নি।
মালিহা বাচ্চাগুলোকে দেখে নিজ মায়ের কথা মনে পড়তে লাগলো বারবার। মা ছিল বলেই দুনিয়াটা সহজ হিসাবে ধরা দিয়েছিল জীবনে। হয়তো এত ছোট বয়সে হাত দিয়ে খেতেও হয়নি। আড়ালে চোখ মোছে মেয়েটি। বাচ্চাগুলোর প্রতি মায়া জন্মে। এদের পিছনের গল্প জানতে ইচ্ছে হয় না। হয়তো কোন করুণ অতীত বেরিয়ে আসবে।
আশ্রয় থেকে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয় দুজনের। চাবি দিয়ে মেইন দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মায়ের ঢুলুঢুলু মুখশ্রী। মায়ের কাছে এগিয়ে যায় জাওয়াদ। শুধায়, “এখনো বসে আছো? ঘুমিয়ে পড়তে আম্মা।”
তড়িৎ গতিতে চোখ খুলে ভালো করে দেখেন ছেলে এবং বউমাকে। বলেন, “তোরা বাড়ির বাইরে। আমার টেনশন হয়। তাই বসে ছিলাম। খাবার গরম করে দিচ্ছি। হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”
“আমরা খেয়ে এসেছি আম্মা। তুমি খেয়েছো?”
“হ্যাঁ। তাহলে আমি ঘুমাতে গেলাম। রাত বেশি জেগে থাকিস না। শরীর খারাপ করবে।”
ঢুলতে ঢুলতে নিজ রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন। জাওয়াদ মালিহাকে নিয়ে দোতলায় চলে এলো। চোখেমুখে ক্লান্তি ভাব মালিহারও। আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেড়লো। জাওয়াদ ততক্ষণে পোশাক বদলে ফেলেছে। জাওয়াদ ওয়াশরুমে ঢুকতেই মালিহা এলোমেলো পায়ে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়লো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়লো। নিঃশ্বাস ভারি হলো। জাওয়াদ ফিরে এসে ঘুমন্ত মালিহাকে দেখে আলতো হাসলো। কোমল মেয়েটি। এটুকু জার্নিতে হাপিয়ে গিয়েছে।
সকালের নরম আলো মালিহাকে এসে পরম আদরে ছুয়ে যায়। হাওয়ায় চপল কিশোরীর মতো পর্দা দুলছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে বাইরে। আড়মোরা ভেঙে উঠে বসে মালিহা। জাওয়াদকে চোখে পড়ে না। একদিনও ঘুম থেকে উঠে সে জাওয়াদকে দেখতে পায়নি। আজও তাই। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো। শাশুড়ি মা সকালের নাস্তার আয়োজন করছেন। মালিহার রান্না করার শখ জাগলো। শশুর বাড়িতে এসেছে পর্যন্ত কুটো ভেঙে দুখানা করতে হয়নি তাকে। কিন্তু আজ তার ভিষন রাধতে মন চাইছে। শাশুড়ি মা বেশ সহজ স্বাভাবিক মানুষ। মালিহা বললো, “আমি রান্না করবো মা?”
স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসলেন তিনি। প্রতিত্তোরে বললেন, “তুমি পারবে মা?”
“চেষ্টা করে দেখি। আপনি গিয়ে রেস্ট করুন। আমি এটুকু পারবো।”
আপত্তি করলেন না। সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। মালিহা কোমরে ওড়না গুজে নেমে পড়লো রান্না নামক যুদ্ধে।
রান্না যখন শেষের দিকে রিপ্তি এলো মেয়েকে কোলে নিয়ে। মালিহাকে দেখে অবাক হয় সে। বিস্ময় নিয়ে বলে, “বাহ! কি রান্না হচ্ছে মালিহা?”
মালিহা হেসে উত্তর দেয়, “খিচুড়ি, বেগুন ভাজি আর ভুনা গরুর গোশত।”
রিপ্তি প্রথমবারের মতো মালিহার মুখে হাসি দেখলো। ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “আমার খুব পছন্দের জানো! খিদে পেয়ে গেলো তো।”
“বাবুকে নিয়ে বসুন। আমি খাবার বাড়ছি।”
রিপ্তি মেয়েকে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলো। একে একে জাওয়াদ তার বাবাও এসে বসলেন। মালিহা সার্বিং ডিসে খাবার বেড়ে খুব সাবধানে কিচেন থেকে ডাইনিং টেবিলে এনে রাখতে লাগলো। চোখাচোখি হয় দুজনের। জাওয়াদ অবাক হলেও চুপ রইলো। শাশুড়ি মা বেতের ঝুড়িতে করে দুটো শশা আর কয়েকটি টমেটো নিয়ে এলো। নিজেই কাঁটতে লাগলো। মালিহা বললো, ”আমিই কাঁটতাম।”
শাশুড়ি মা আপত্তি করে বললেন, “অনেক করেছো মা। এগুলো আমার লাগানো গাছের টাটকা সবজি। খেয়ে দেখ অন্যরকম স্বাদ পাবে। তুমি যাও তো। টেবিলে গিয়ে বসো। আমি কেঁটে নিয়ে আসছি।”
মালিহা কথা বাড়ায় না। এ বাড়িতে আলাদা করে খাবার বেড়ে দিতে হয় না কাউকে। সবাই প্রয়োজন বুঝে নিয়ে খায়। খাবার টেবিলে প্রশংসার ঢেউ উঠলো। সকলে খেয়ে খুব প্রশংসা করলো। একমাত্র জাওয়াদ বাদে। পুরোটা সময় নির্লিপ্ত ছিল সে। মালিহার অজান্তেই একটু মনঃক্ষুন্ন হলো। সে আশা করেছিল জাওয়াদ কিছু বলবে।
রান্নাবান্না করে বেশ ক্লান্ত মালিহা। শাশুড়ি মা তাকে খাবার পরে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, “খাবার সময় এসো। আমি আর বড় বউমা মিলে দুপুরেরটা করতে পারবো। আজকের দিনটা জাওয়াদ বাড়িতে আছে। কাল চলেই যাচ্ছে। দুজনে সময় কাটাও। কিছু লাগলে জানিও। পাঠিয়ে দিব।”
শাশুড়ি মায়ের এহেন ভালো মানুষী দেখে এখন আর অবাক হয় না মালিহা। দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গিয়েছে। এরা মানুষ মাত্রই যথেষ্ট ভালো।
ব্যালকনিতে বসে ছিল মালিহা। খানিক বাদে জাওয়াদও পাশে গিয়ে দাড়ায়। নিরবতা ভেঙে বলে, “খিচুড়ি সহ প্রতিটা খাবারের স্বাদ খুব সুন্দর ছিল। বহুদিন মুখে লেগে থাকবে।”
মালিহা বাইরের সবুজ প্রকৃতি দেখছিল। জাওয়াদের কথায় মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায়। বলে, “ধন্যবাদ। আপনার জন্যই করেছিলাম।”
রাগে অনুরাগে পর্ব ৯
“সত্যিই?” জাওয়াদের কন্ঠে বিস্ময়ের ছাপ।
মালিহা এককথায় জবাব দিলো, “আমি মিথ্যা বলি না।”