রাগে অনুরাগে পর্ব ১৩
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
নতুন ফোনে সিম ঢুকিয়ে মালিহা সর্বপ্রথম কল করলো তার দাদুর কাছে। কতদিন কথা হয় না। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল ধরলেন জামিলা বেগম। ভঙ্গুর কন্ঠস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে বলছেন?”
এপাশ থেকে খিলখিলিয়ে হাসে মালিহা। হাসির শব্দে জামিলা বেগম বুঝে ফেললেন ফোনের অপর পাশের মানুষটি তার প্রিয় নাতনি। বহুদিন পরে মালিহার হাসির শব্দ শুনলেন। মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। কিছু আগেই জেনেছেন নাতনি তার সন্তান সম্ভাবা। শুনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলেন। পরক্ষণেই শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। জামিলা বেগম আদুরে গলায় শুধালেন, “কেমন আছো দাদু?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আল্লাহ রেখেছেন ভালো। তোমার শরীরটা তো ভালো?”
“ভালো।”
বহুদিন পরে ফোন কানে ধরলো মালিহা। সে বরাবরই চঞ্চলা যবতী। ছটফটে স্বভাব। কিন্তু বিয়ে নামক বন্ধনে আটকে পড়ার পর নানান প্রতিকূলতায় ভাটা পড়েছে সে চঞ্চলতার। যখন তখন ফোটে না মুখে হাসি। দাদুর সাথে অনেকটা সময় কথা বললো। এরপর কল করলো বাবার কাছে। এই মানুষটার সাথে এ বাড়িতে আসার পরে মাত্র দুবার কথা হয়েছে। একবার জাওয়াদ থাকতে। আরেকবার শশুরের ফোন দিয়ে। মায়ের সাথে সাথে বাবা, ভাইবোনদেরও ভুলতে বসেছিল সে। একজনের প্রতি হওয়া অভিমানের তাপ বাকিদের ওপরও পড়েছিল কিছুটা। ওপাশ থেকে চেনা কন্ঠস্বর ভেসে এলো। আবেগে হানা দিলো মালিহাকে। একটা সময় ছিল যখন এই মানুষটার কাছে সকাল বিকাল কত আবদার করতো। অভিযোগের ঝাপি খুলে বসতো। অথচ আজ কত দূরত্ব তাদের মধ্যে। ফোনের এপাশ থেকে মালিহা স্বাভাবিকভাবে বললো, “আসসালামু আলাইকুম আব্বু।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো মা?”
বাবার মুখ থেকে মা শব্দটি শুনে হৃদয়ে প্রশান্তির পবন বয়ে গেল মালিহার। একজন পুরুষ মানুষ জীবদ্দশায় দুবার তার মাকে পায়। একবার নিজের গর্ভধারিনী মাকে। আরেকবার নিজ কন্যাকে। তাইতো মেয়ের ক্ষেত্রে আম্মু, মা এসব সম্মানীয়, আদুরে সম্বোধন চলে আসে। কিন্তু অবিচার হয় নারীর প্রতি। জীবনে নিঃস্বার্থ ভাবে তাকে ভালো শুধু তার জন্মদাতা পিতাই বাসেন।
পিতার আসনে একমাত্র তিনিই থাকেন। পুরুষ নিজ কন্যার মাধ্যমে মায়ের স্বাদ পেলেও নারীগন পায় না নিজ ছেলের কাছ থেকে বাবার ভালোবাসা। আশপাশ খুজলে একশ জন ছেলের মধ্যে নিরানব্বই জন ছেলেই মায়ের কাছে শুধু ছেলেই থেকে যায়। বাবা হয়ে আর উঠতে পারে না। বৃদ্ধ বয়সে সময় করে মায়ের আবদারগুলো শোনা হয় না। মায়ের অভিমান, অভিযোগও জানা হয় না। এক্ষেত্রে পুরুষ মানুষ মাত্রই ভাগ্যবান। নারীর কেবল দিয়েই যেতে হয়। পাওয়া হয় না আর!
মালিহা জবাব দিলো, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আব্বু। তুমি কেমন আছো?”
“ভালো আছি রে মা। তোর শরীর ভালো?”
“জি আব্বু। অনিমা, আনিশা কোথায়? ওরা ভালো আছে?”
“আছে কাছেই।”
“ফোন দাও ওদের কাছে কথা বলি।”
বাবার হাত থেকে ফোনটা একপ্রকার কেড়ে নিয়েই কানে ধরলো আনিশা। সে বোনকে খুব মিস করেছে। কচি কন্ঠে শুধালো, “কেমন আছো আপু? বিয়ের পরে একদমই ভুলে গিয়েছো। কথা বলো না। আসো না। তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না আপু।”
ফোনের মিষ্টি অভিযোগে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে মালিহা। সত্যি তো কতদিন ছোট ছোট ভাইবোন দুটোর সাথে কথা হয় না। একসাথে কত মধুর স্মৃতি জমে আছে তাদের। একই মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠা, একই ছাদের নিচে হাটি হাটি পা পা করে বড় হয়ে ওঠা। তার হাত আকড়ে ধরেই তো ভাইবোনগুলো জমিনে হাঁটতে শিখেছে। অথচ আজ কত দূরত্ব তাদের। সময়ের তালে সে হয়েছে বাড়ির মেয়ে থেকে বাড়ির অথিতি মাত্র। ওড়না দিয়ে চোখ মোছে মালিহা। প্রতিত্তোরে বলে, ”আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? পরিক্ষা কেমন হয়েছিল?”
“সবই ভালো। আগে বলো কবে আসবে তুমি? কতদিন দেখি না তোমাকে।”
“তুমি আসো আপু।”
এরপর ভাইয়ের সাথেও কথা বলে কিছুক্ষণ। সবার কথা বলা শেষে মায়া বেগম যখনই ফোন কানে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ভালো আছিস মা?”
ঠিক তখন মালিহা কট করে কলটি কেঁটে দিলো। মায়া বেগম হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ ফোন কানে ধরে বসে রইলেন। বুঝতে অসুবিধা হলো না মেয়ে তার সাথে কথা বলতে নারাজ। খারাপ লাগে তার। এতই পর হয়ে গিয়েছে? এতগুলো দিন কষ্ট করে বড় করে তুলে এই তার প্রতিদান দিলো মেয়ে! অথচ মায়া বেগমের মনে একটিবারও পড়ল না মেয়ের প্রতি তার অবিচার। কি করেছে তার মেয়ের সাথে। নিজেই দূরত্বের জন্য দায়ী একটিবারও ভাবলেন না। কেবল অভিমান করে গেলেন।
মাকে ভালোবাসে মালিহা। কিন্তু মায়ের নিষ্ঠুর আচরণও ভুলতে পারে না সে। মা ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সন্তানের সবচেয়ে কাছের এবং আপন মানুষ হন। দুনিয়ার সবাই পর করে দিলেও মা পারেন না। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়েছিল মেয়েটি। নিজেকে গুছিয়ে স্বাভাবিক করতে ভার্সিটিতেও যাওয়া আসা শুরু করেছিল। যে সময়টা প্রয়োজন ছিল মায়ের মমতামাখা ভালোবাসার। ঠিক তখনই পেয়েছে নিষ্ঠুর ব্যবহার। এ কি করে ভুলবে সে? পারতো না কাছে টেনে নিয়ে মমতা নিয়ে ভালো মন্দ বোঝাতে? মালিহার মাঝেমধ্যে মনে হয় পৃথিবীতে নারী লোক অসুখী হওয়ার প্রধান ও অন্যতম কারণ হচ্ছে অপর নারী। ঘরের কোণে একটি নারী কাঁদে আরেকটি নারীর জন্যই। পুরুষ নারীদের দূর্বল ভাবলেও খুব যত্ন নিয়ে দুঃখ দেয় নারীকে তার সমজাতিই।
মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে আসে রিপ্তি। মালিহা কাছে টেনে বসায় রিপ্তির মেয়েটিকে। সে এসেছিল মালিহাকে খেতে ডাকতে। মালিহা তাকে বসতে বললে বসে সে। রিপ্তির ছোট্ট মেয়েটি তখন মালিহার কাছ ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা ক্রিম, মশ্চরায়জারের কৌটা এলোমেলো করতে ব্যাস্ত। রিপ্তি ব্যস্ত হাতে মেয়েকে আটকাতে গেলে মালিহা নিষেধ করে। বলে, “ওর অ্যাক্টিভিটিতে বাধা দিয়েন না। ওকে ওর মতো থাকতে দিন। এরপর আর এ রুমে আসতে চাইবে না। বাচ্চারা যেখানে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না সেখানে যেতে চায় না। ওর জন্য খেলনা এনে রাখব। পরবর্তীতে এলে সেগুলো নিয়ে খেলবে।”
রিপ্তি ওপরে বিরক্তিভাব দেখালেও জায়ের এই কথাটি ভালো লাগলো তার। মায়েদের চোখে সবচেয়ে আপন ব্যক্তি হয় যে তার সন্তানের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে, ভালোবাসে, আদর করে। সন্তুষ্ট হয় মালিহার প্রতি। মেয়েটি আসলেই ভালো। রিপ্তি হাসিমুখে বলে, “জানো আমি কত খুশি হয়েছি তোমার প্রেগনেন্সির কথা শুনে। এবাড়িতে যখন এসেছিলাম বিয়ের ঝুট ঝামেলা শেষে নিরিবিরি হয়ে গেল বাড়িটা। জাওয়াদ চাকরিতে। শশুর বাবা তখন রিটায়ার্ড হননি। ব্যস্ত থাকেন। এক সপ্তাহ ছুটি শেষে বাবুর বাবা ওনার ভার্সিটির কাছের বাসায় চলে গেলেন। আগে আমি মাঝেমধ্যে ওখানে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসতাম।
এছাড়াও তিনি সপ্তাহে দুদিন এখানে এসে থেকে যান। বাড়িতে শুধু আমি আর মা। মা স্থায়ী কাজের বুয়া পছন্দ করেন না বিধায় এ বাড়িতে একাধারে কোন কাজের লোক থাকে না। শুধু দারোয়ান চাচা বাদে। নিজের কাজ করে চলে যেতে হয়। মা ঝামেলা পছন্দ করেন না। চুপচাপ স্বভাবের হলেও ওনার সাথে মিশে গেলাম সহজেই। আমাদের একমাত্র ননদ তো বিদেশেই স্বামী নিয়ে। একদিন এক প্রতিবেশিনী আন্টি মাকে বললেন, বউকে এতো মাথায় উঠিও না। পরে মাথায় কাঠাল ভেঙে খাবে। সময় থাকতে কড়া নজরে রেখো। পরে পস্তাবে নাহলে। আমি তখন কিচেনে ওনাদের জন্য চা করছিলাম। মা প্রতিত্তোরে বলেছিলেন, হাটুর বয়সী মেয়েটির সাথে আমার প্রতিযোগিতা চলে না।
সংসার এখন আমার হাতে দুদিন পরে ওকেই করতে হবে। এটাই তো নিয়ম। সারাজীবন কেন আমার মত চলবে? আমি হলে কি সেটা হতে দিতাম? বড় সংসারে গিয়ে বুঝেছিলাম স্বাধীনতা কি জিনিস! অজস্র দায়িত্ব কর্তব্য থাকলেও থাকতো না অধিকার। একটি নিজের সংসারের প্রয়োজনীয়তা খুব করে অনুভব করেছিলাম। আমি চাই না আমি পুত্রবউদের এমন হোক। প্রাণ খুলে বাঁচুক। এবাড়িকেও নিজের বাড়ি মনে করতে শিখুক।
প্রতিবেশিনী আন্টির মুখে সেদিন ঝামা ঘষে দিয়েছিলেন মা। সদ্য মা-বাবা ছেড়ে আসা আমি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম। শ্রদ্ধা ঝরে পড়ছিল মানুষটির প্রতি। এমন মানুষকে যদি প্রতিটি নারী শাশুড়ি হিসাবে পেত তাহলে শশুর বাড়ি দোজখ খানা না হয়ে বেহশত হতে পারতো। এজন্যই সুযোগ থাকা সত্বেও আমি বাবুর বাবার কাছে গিয়ে থাকি না। যাই কিন্তু আবার চলে আসি। এ বাড়ির প্রতিটি আনাচকানাচে মায়া জড়িয়ে আছে। প্রবল মায়া ঘিরে আছে মধ্যবয়স্ক ওই নারী মুখটির মধ্যে। মন খারাপ করো না মালিহা। আস্তে ধীরে তুমিও মায়ার বন্ধনে আটকে পড়বে। অনুরাগে আবদ্ধ হবে এ সংসার, সংসারের মানুষগুলোর। শুধু সময়ের প্রয়োজন।”
মালিহা প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। বিয়ের ছোটখাটো এক মাসে সে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে শাশুড়ি নামক মহিলাটি মানুষ হিসাবে খারাপ নন।
মালিহাকে নিয়ে খেতে গেল রিপ্তি। রাতের খাবার হিসাবে ছিলো, ঝরঝরে সাদা ভাত, ঢেড়শ ভাজি, বেগুন ভাজি, ডিম ভুনা আর মসুরের পাতলা ডাল। মালিহার জন্য আলাদা করে মাংসের কাবাব করা হয়েছে। কাবাবে কামড় দেওয়ার পরেও সে কোনরকম মাংসের উটকো গন্ধ টের পাইনি। শাশুড়ি মা না বললে হয়তো বুঝতেই পারতো না কাবাবে মাংস ছিল। রাতের খাবারটা তৃপ্তি নিয়ে খেল মেয়েটি। শরীর মন ঝরঝরে লাগলো কিছুটা। খাওয়া শেষে দুই বউমা এবং শাশুড়িমা মিলে গল্প করলো কিছুক্ষণ। রিপ্তি দুধ চা করে আনলো। মালিহা সেটাও খেল। চায়ের এলাচ ও চা পাতার মিষ্টি ঘ্রাণে দুধের গন্ধটাও চাপা পড়ে গেল। ফলে মর্নিংসিকনেস চলা মালিহার খেতে তেমন অসুবিধা হলো না।
রাতে জাওয়াদ ফোন করলো। কিছুক্ষণ খুচরো আলাপ চলতে লাগলো স্বামী স্ত্রীর। মালিহা শুধু হু হা করে কাটিয়ে দিলো। উৎফুল্লতা ছিল শুধু জাওয়াদের কথায়।
জাওয়াদ বলে, “জানো মালিহা আমার এখন ম”রতে ভিষন ভয় করে। দেশের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত আমরা। সেই শপথ গ্রহন করেই চাকরিতে ঢুকেছিলাম। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে আমাদের ভয় করে না। বরং বীরের বেশে ম”রতে পারাটাই আসল অর্জন।
রাগে অনুরাগে পর্ব ১২
কিন্তু আজকাল বড় ভয় হয়। এইযে আমার ছোট্ট জীবনে তুমি এসেছো, আমাদের ছোট্টমনি আসছে। তোমাদের সাথে বহু বছর বাঁচার বড় স্বাদ হয় আমার। জানিনা সৃষ্টিকর্তা কপালে কি রেখেছেন। আমাকে ক্ষমা করিও। দোয়ায় রেখো মালিহা।”
প্রতিত্তোরে মালিহা বলে, “আপনি ফিরবেন জাওয়াদ। বীরের বেশেই। দায়িত্বে অটল থাকুন। আমাদের আবার দেখা হবে।”