রাগে অনুরাগে পর্ব ২

রাগে অনুরাগে পর্ব ২
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

নত মস্তকে সকলের মধ্যে মনি হয়ে বসেছিল মালিহা। ঠিক তখনই আসল খবরটি পাওয়া গেল। জাওয়াদ তার কর্মস্থলে ফিরে গিয়েছে। বাড়ির সকলেই অবাক হয়েছে। কারণ বিয়ের জন্য তার ছুটির আরও একটি সপ্তাহ বাকি ছিল। সেখানে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে কাউকে না জানিয়ে চলে যাওয়ায় বাড়ির সকলের অবাক হওয়ার পাশাপাশি রেগেও আছে। এ কেমন কান্ডজ্ঞানহীন ছেলে! যাওয়ার আগে কাউকে বলার প্রয়োজনবোধ করলো না? রাগে ফুসতে লাগলেন জাওয়াদের বাবা। বিরবির করে ছেলেকে গালমন্দ করে চলেছেন।

জাওয়াদের চলে যাবার কথা শুনে অবাক হয়নি শুধু মালিহা। সে যেন ধরেই নিয়েছিল এমন কিছুই হবে। ওই ছেলের দ্বারা কোন কিছুই অসম্ভব নয়। জাওয়াদের কথা যতবার মনে পড়ছে ঠিক ততবারই ঘৃণায় দেয়াল পুরু ও শক্ত হচ্ছে। সে মানুষটাই এমন যাকে শুধু ঘৃণা করা যায়। ভালোবাসা নয়। যে প্রবল রাগের কারণ হলেও গেলেও অনুরাগের কারণ হতে পারে না। মালিহা তার বাবা চাচাদের অপেক্ষায় আছে। তাদের সাথে এবাড়ি থেকে একেবারে বিদেয় হবে সে। কখনও এই নীড়ে ফিরবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নতুন জামাই বউকে একসাথে নাইওর যেতে হয়। জাওয়াদ নেই। মালিহা কার সঙ্গে যাবে এ নিয়ে চিহ্নিত বাড়ির বড়রা। জাওয়াদ কবে আসবে তারও কোন ঠিক নেই। এতদিন নতুন বউকে আটকেও রাখা যায় না। সবে পিত্রালয় ছেড়ে আশা সদ‍্য বিবাহিত মেয়েটি স্বামীকে ছাড়া কিভাবে কাঁটাবে এতগুলো দিন?
সকালে ব্রেকফাস্ট টাইমে মালিহা খাবার মুখে না তুলে নাড়াচাড়া করতে লাগলো শুধু। সকলে ভাবলো হয়তো স্বামী যাওয়ায় মন খারাপ। একমাত্র রিপ্তি এবং ইমা ই মালিহার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও জানে বোঝে। রিপ্তি এগিয়ে এসে বললো, “হাত ধুয়ে ফেল। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

মালিহার হাত ধোয়ার অপেক্ষা করলো না রিপ্তি। একটা বোলে পানি ঢেলে দিয়ে বললো, “ধুয়ে ফেলো।”
মালিহার হাত ধোয়া শেষ হলেই রিপ্তি গরুর কলিজা ভুনা দিয়ে পরোটা খাইয়ে দিতে লাগলো। পেটে ক্ষুদা থাকলেও মালিহার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না। পেট থেকে রির্টান আসতে চাইছে তারা। কোনরকম একটা পরোটা খাইয়ে আর খাওয়ানো গেল না মালিহাকে।

খাওয়া শেষে মালিহাকে নিয়ে সোজা রুমে চলে এলো ইমা। মেয়েটির শরীর দূর্বল। এরমধ্যে সকলের মাঝে পুতুলের মতো বসে থাকাটা তার জন্য যেমন কষ্টের, তেমনই অস্বস্তির।
মালিহাকে নিয়ে রুমে এসে ইমা জিজ্ঞাসা করলো, “শরীর এখন কেমন লাগছে? খুব খারাপ কী?”
মালিহার ইমার সাথে একটি কথাও বলতে মন চাইলো না। নিরব রইলো।

ইমা ভাবলো হয়তো লজ্জায় বলতে পারছে না। সে আরেকটি প‍্যারাস্টিমল খাইয়ে দিল মালিহাকে। বললো, “তিন দিনের দিন নাইওর যেতে হয়। গতকাল এলে, আজ দ্বিতীয় দিন। আগামীকাল তোমার বাড়ি থেকে সবাই আসবে। যাওয়ার কথা তো ছিল জাওয়াদেরও।অথচ দেখ! কি বেক্কল ছেলে। কি আর করার। একটি দিনের ই তো ব‍্যাপার। জানি তোমার খারাপ লাগছে। লাগারই কথা। এমন সবার হয়। আজকের দিনটা কষ্ট করে কাটিয়ে দাও। কাল তো যাবেই। ঠিক আছে?” শেষে কথাটি বলে ইমা মালিহার থুতনিতে হাত ছোয়ালো।

ইমা বেরিয়ে গেলে মালিহা গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এলো। পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে জানালার কোন ঘেঁষে বসলো। নিজেকে নিয়ে তার ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ভাবতে মন চায় না জাওয়াদকেও। নতুন সম্পর্কটাকে নিয়েও তার মনে কোন আশার প্রদীপ জ্বলছে না। মানসপটে শুধুই ভেসে উঠছে গতকাল শেষ রাতের ভয়াবহ দৃশ্য। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে তার। ছোট বেলা থেকেই মালিহা কিছুটা বদমেজাজি স্বভাবের। অল্পতেই রেগে যায় সে। রেগে গেলে মুখের ব‍্যবহারেও আসে ভিন্নতা। জাওয়াদকে সে যখন ছবিতে দেখেছিল তখনই পছন্দ হয়েছিল। পছন্দ না হওয়ার কিছু ছিল না।

অমন সুদর্শন লম্বা, চওড়া ছেলেকে কোন মেয়ের বা অপছন্দ হবে? বিয়ের আগে মুখদর্শন হলেও কথাবার্তা তাদের এগোয়নি মোটেও। তবে শুনেছিল জাওয়াদও নাকি তার মতো রাগী। শুনে অবশ‍্য তখন খারাপ লাগেনি। সে নিজেও রাগী লাইফ পার্টনারও হবে রাগী। এ আর এমন কী? কিন্তু রাগে অন্ধ হয়ে ছেলে যে তার সাথে অমন ধর্ষকের মত আচরণ করবে কে জানতো? একুশ বছরের যত্নে গড়া জীবন, যৌবন সবই তো ওই একটি মানুষের জন‍্যই নির্ধারিত ছিল। জাওয়াদ যদি তার সাথে জোরজবরদস্তি না করতো তাহলে হয়তো বিয়ের একটি দিন যেতে না যেতেই তাকে এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। কিন্তু কি করার আছে তার? যাকে আকড়ে ধরে বাঁচার কথা সেই যখন গলা টিপে মারতে চায় তখন সেখানে না থাকাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। মালিহা সিদ্ধান্ত নিলো, একটি দিন সে এ বাড়িতে পার করবে। কাউকে কিছু জানতে দিবে না। তারপর বাড়ি গিয়ে সময়মতো স্টেপ নিবে।

জানালার দিকে তাকিয়ে এমন হাজারো চিন্তা ভাবনা ঘিরে রেখেছিল মালিহা। দরজায় কড়াঘাতের শব্দে ধ‍্যান ভাঙে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। রিপ্তি এসেছে। মালিহাকে দেখে একগাল হাসলো সে। মুঠোফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “কথা বলো। তোমার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।”

মালিহা সাথে সাথে ফোন হাতে নিল। রিপ্তি দরজা থেকেই সরে গেল। মালিহা সোজা ব‍্যালকনিতে গিয়ে ফোন কানে ধরলো। ওপাশে কলে রয়েছেন মালিহার আম্মু। আবেগজড়িত কন্ঠে মালিহা বলে, “আম্মু ভালো আছো তুমি?”
ওপাশ থেকে ধরা গলায় প্রতিত্তোর করেন, “আছি রে মা। তুই তো ভালো আছিস?”
মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো মালিহার। সে কেমন আছে? যাকে রাতে স্বামীর হাতে নির্যাতিত হতে হয়, স্বামী ছাড়া শশুর বাড়িতে দিন কাটাতে হয় সেই মেয়ে ভালো থাকে কি করে? নাক টেনে জবাব দিল, “ভালো আম্মু।”
“হ‍্যারে মা, জামাই কিছু বলেছে কবে আসতে পারবে? শুনেছিলাম ছুটি আরও আছে। কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে চলে গেল কেন?”

মায়ের এতসব প্রশ্নের জবাব নেই তার কাছে। কি বলার থাকতে পারে তার? শরীরের সাথে সম্পর্ক ঠিকই হয়েছে। কিন্তু মনের সাথে মনের দূরত্ব যে হাজার মাইল। মালিহা বললো, “এ বিষয়ে আমি কিছু জানিনা আম্মু। তুমি খেয়েছো সকালে? আর প্রেসারের ওষুধটা? দাদু ভালো আছে তো!”
“হ‍্যাঁ সবাই ভালো। আমাদের নিয়ে চিন্তা করিস না। তোর আব্বুর সাথে কথা বল।”

“না আম্মু। আব্বুর সাথে এখন কথা বলতে মন চাইছে না। পরে বলব। রাখছি তাহলে!” কল কেঁটে দিল মালিহা। বলার সুযোগ দিল না। এতক্ষণ কান্না গিলে গিলে কথা বলেছে মেয়েটি।
বরাবরই বাপ পাগল মেয়ে সে। মায়ের ধমকে, শাসনে মায়ের সামনে নিজেকে কিছুটা সামলে চললেও বাবার কাছে সে ননির পুতুল। স্পর্শ লাগলেই গলে যায়। এখন শুধু আব্বুর কন্ঠস্বর তার কানে গেলেই আটকে রাখা কান্নার নদীর স্রোতের ন‍্যায় বইয়ে থাকতো। নিজেকে সামলে রাখা মুশকিল হতো। কিন্তু সে বাবা-মাকে টেনশনে রাখতে চায় না। সময় সুযোগ তার হাতে আসুক। তারপর সে তার কেরামতি দেখাবে।

বিকেলের একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনায় মালিহার হিসাবে কিছুটা গড়মিল হলো। কিন্তু হিসাব সে বদলালো না।
বড়সর একটি ফুলের তোরা নিয়ে জাওয়াদের এক বন্ধু হাজির হলো বাড়িতে। নতুন বউকে দেখে ফুলের তোরা এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে কুশলবিনিময় করলো। মালিহা কথার প্রতিত্তোরে হু, হা, করে উত্তর দিলো।
জাওয়াদের মা নাস্তার ট্রে সাজিয়ে এনে বললো, “বিয়েতে আসোনি কেন? বউমা, তোমার ছেলেটা কেমন আছে?”

“আসতেই তো চেয়েছিলাম খালাম্মা। রাস্তায় গাড়ি এক্সিডেন্ট করলো। ছেলেটা মাথায়, হাতে, পায়ে বেশ আঘাত পেয়েছে। ওর মায়ের কনুই ছিলে গিয়েছে শুধু। অথচ দেখুন আমি দিব‍্যি সুস্থ! হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে ছেলের অবস্থার অবনতি হচ্ছিলো। ব্লাড গিয়েছে অনেকটা। ওর ব্লাড গ্রুপের সাথে মিলছিল তার কারো। তারপর বাধ‍্য হয়ে জাওয়াদকে ফোন দিয়েছিলাম। একবার একসাথে ব্লাড দিয়েছিলাম জন্য জানা ছিল ওর ব্লাড গ্রুপ। তারপর ও হাসপাতালে গিয়ে আমার ছেলেকে ব্লাড দিয়ে আসে। ও সম্ভাবত বিয়ে থেকে এসেই আমার ফোন পেয়ে চলে গিয়েছিল। গায়ে বিয়ের সাজপোশাক দেখলাম।”

জাওয়াদের মা মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো, “সে কি! এত বড় দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে কিছুই জানতে পারলাম না।”
“বিয়ের ব‍্যাস্ততার মধ্যে আপনাদের বিরক্ত করতে চাইনি। এজন্যই বলিনি। দোয়া করবেন ওদের জন্য।”
“তাতো অবশ্যই করব। ওরা সুস্থ হলে একবার নিয়ে এসো। নতুন বউকে দেখে যাবে।”

রাগে অনুরাগে পর্ব ১

কথোপকথন চলতে লাগলো। মালিহার কেমন মাথা ঘুরতে লাগলো। তারমানে জাওয়াদ বন্ধুর ছেলেকে রক্ত দিতে গিয়ে দেরি করে ফিরেছিল? মালিহার মস্তিষ্ক আর কিছু ভাবতে পারলো না। এমতাবস্থায় তার কি করা উচিত সেটাও বুঝতে পারলো না মেয়েটি।

রাগে অনুরাগে পর্ব ৩