রাগে অনুরাগে পর্ব ৩

রাগে অনুরাগে পর্ব ৩
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

মালিহা গোটা একটা রাত দিন কাটিয়ে দিল চিন্তা করতে করতে। সে তার কঠিন ব‍্যবহারের জন্য অনুতপ্ত হতে চেয়েও কোথাও থেকে তীব্র একটা বাধার সম্মুখীন হয়। আবেগী মন বলে, ভুল তারও ছিল। পরক্ষণেই আবার বিবেকবান মস্তিষ্ক ঘোর বিরোধীতা করে বলে ওঠে, তার ভুল হলেও জাওয়াদ যেটা করেছে সেটা জঘন্যতম অন‍্যায়। এ অন‍্যায়ের শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে।

মালিহা সেদিন না বুঝে জাওয়াদকে কটা কঠিন কথা বলে ফেলেছিল, ঠিক। কিন্তু, বিনিময়ে জাওয়াদ তার সাথে পশুর মতো আচরণ করেছে। স্বামীর কাছে বৈধ ভাবে ধর্ষণ হতে হয়েছে তাকে। কেন দেরিতে ফিরেছিল সেই কারণ সহজভাবে ব‍্যাখা দিতে পারতো জাওয়াদ। কিন্তু সে কি করলো? বাসর রাতকে মধুর রাত বলা হয়। অথচ মালিহার জীবনে নেমে এসেছিল কালো অন্ধকার। যে অন্ধকারে ক্রমেই নিজেকে হারিয়ে ফেলছে মেয়েটি।
পরদিন বাবা চাচা তাকে আনতে গেলে ফিরে এলো সকলের সাথে মালিহা। শাশুড়ি মা যাওয়ার আগে বারবার করে বলে দিয়েছেন, “শোন বউমা, বিয়ের পরে নাইওর থাকার নিয়ম তিনদিন। সেখানে আমার ছেলে যেহতু নেই, তুমি এক সপ্তাহ থেক। তোমার শশুর গিয়ে নিয়ে আসবে। ঠিক আছে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রতিত্তোরে মালিহা একটি টু শব্দও করেনি। যতক্ষণ এ বাড়িতে ছিল কথার প্রতিত্তোরে জি, আচ্ছা ছাড়া কিছুই বের হয়নি তার মুখ। আর না নিজ থেকে কারো সাথে আলাপ বাড়িয়েছে। জাওয়াদের প্রতি হওয়া প্রবল ঘৃণার ছিটেফোটা তার পরিবারের মানুষের ওপরও পড়েছে কিছুটা। তাছাড়া যেখানে থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে সেখানে মিছে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? যার অনুরাগে আবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল সেই যখন ছুড়ে ফেলে দিয়েছে সেখানে তার পরিবার দিয়ে কি করবে সে?

বাড়ির চৌকাঠ পেরনোর সময় মালিহার চিবুক বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দুফোটা। শাড়ির আচল দিয়ে কেউ দেখে ফেলার আগেই মুছে ফেললো। কত স্বপ্ন, আশা নিয়ে পা রেখেছিল এই বাড়িতে। অথচ ফিরতে হচ্ছে এক বুক ঘৃণা আর হতাশা নিয়ে। সে তো এমন কিছু চায়নি। তাহলে….!

মালিহা বাড়িতে প্রবেশ করতেই তাকে দেখে আঁতকে উঠলেন তার মা। আহাজারি করে বলে উঠলেন, “একি অবস্থা আমার মেয়ের! দুটো দিনে কি হাল করেছে চেহারার? হ‍্যারে মালিহা, খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করিসনি তাই না? এভাবে চললে হবে? শশুর বাড়ি গিয়েছিস। সেখানেই থাকতে হবে। কে তোকে যত্ন করে খাওয়াবে বল! নিজেরটা তো নিজেরই দেখতে হবে তাই না?”

মায়ের একের পর এক প্রশ্নে বিব্রত বোধ করে মালিহা। মায়ের কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, তাকে শশুর বাড়ি ফিরতে হবে এবং সেখানেই থাকতে হবে। অথচ সে একেবারে ফিরে এসেছে। একথা জানার পরে মায়ের মুখ থেকে কি এভাবেই মিষ্টি কথা বের হবে? চোখ ভিজে ওঠে মালিহার।
“তোমার কি কোন বুদ্ধি হবে না বউ? মাইয়াডা কেবল আইলো। অহনি শুরু কইরা দিলা ফ‍্যাচফ‍্যাচানি। বলি বোধ বুদ্ধি কবে হইবো শুনি? তিন পোলা মাইয়ার মা হইয়াও এহনো ভেরা রইয়া গেলা!”
ঠকঠক আওয়াজ করে লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে পুত্রবউকে গালমন্দ করতে থাকেন মালিহার দাদু।
মায়ের একটি প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে মালিহা এগিয়ে যায় দাদুর দিকে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে শুধায়, “ভালো আছো দাদু?”

গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রতিত্তোরে বলেন, “আল্লাহ রাখছে ভালো। তুমি তো ভালো আছো বুবু? দেখি আসো তো। ফ‍্যানের নিচে একটু আরাম কইরা বসো। ঘাইমা গেছে শইলডা।”

মালিহাকে টেনে নিয়ে সোফায় বসালেন। ফ‍্যান ছেড়ে দিয়ে বউমার উদ্দেশ্যে বললেন, “সঙ এর মতো দাড়ায় থাইকো না। যাও ঠান্ডা কিছু কইরা নিয়া আসো। ওরে খাইতে দাও। বাস গাড়ি কইরা আইছে। ক্ষুদা লাগছে তো!”
মালিহার মায়ের ধ‍্যান ভাঙে শাশুড়ি মায়ের কথায়। তিনি মেয়ের দিকেই পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন। মায়ের মন। সন্তানের মন খারাপ, দুঃখ, কষ্ট আগেই টের পেয়ে যায়। নারীর টান বলে একটা কথা আছে না? সেটাই হয়তো। ভদ্রমহিলার মনের মধ্যে খুতখুত করতে থাকে।

অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুক। শাড়ির আচল কোমরে গুজে এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে। মেয়ের তার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। অথচ কিছু খেতে দিবে বেমালুম ভুলে গিয়েছেন তিনি। তাড়াতাড়ি করে চুলায় প‍্যান বসিয়ে দিলেন। গরম প‍্যানে তেল ঢেলে দুটো ডিম পোচ করলেন। ফ্রিজে থাকা ভাত গরম করলেন। বাটিতে করে দু পিস রোস্ট রেখে দিয়েছিলেন সেখান থেকে এ পিস নামিয়ে সেটাও গরম করে নিলেন। লেবু চিনির এক গ্লাস ঠান্ডা শরবতও করলেন। তাড়াহুড়ো করে করতে গিয়ে হাতে আগুনের ছ‍্যাকা লেগে পুড়ে গেল কনিষ্ঠ আঙ্গুলের এক কোনা। পাত্তা দিলেন না তিনি। সিংকে হাত ধুয়ে খাবারগুলো প্লেটে উঠিয়ে ট্রেতে সাজিয়ে ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

মালিহা ততক্ষণে ফ্রেস হয়ে এসেছে। পরনের ভারি স্বর্ণ কাতান শাড়ি বদলে বাসায় পড়ার কটনের কামিজ পড়েছে। চোখেমুখে পানি দিয়ে সাজ ধুয়ে ফেলেছে। এখন কিছুটা হালকা লাগছে নিজেকে মালিহার। আসার সময় জোর করে রিপ্তি সাজিয়ে দিয়েছিল। মালিহা মনে মনে আপত্তি করলেও মুখ ফুলে কিছু বলতে পারেনি। সে চায়নি যতক্ষণ ও বাড়িতে থাকবে এমন কোন ব‍্যবহার করবেনা যার জন্য কেউ তাকে সন্দেহ করুক। বা তাকে নিয়ে কথা হোক। সে রাগী মানুষ ঠিক আছে। কিন্তু নিজেকে নিয়ে কোন প্রকার কন্ট্রোভার্সি তৈরি হোক। তাছাড়া দোষ করেছে জাওয়াদ। তার জন্য কেন তার পরিবারের অন‍্যদের সাথে রাগ দেখাবে বা খারাপ ব‍্যবহার করবে! ছেলেকে নিশ্চয় শিখিয়ে দেয়নি এমন জানোয়ারের মত ব‍্যবহার করতে।

দাদুর শরীরের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে বসেছিল মালিহা। দাদু পান খান। মিষ্টি ফুলের সুবাসের আতর ব‍্যবহার করেন প্রায়শই। মালিহার কাছে সবমিলিয়ে দাদুর গায়ের ঘ্রাণ দারুণ লাগে। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল সে।
মেয়ের পাশে বসে বড় লোকমা দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলেন মেয়েকে মালিহার আম্মু। পেটে খিদে জমে ছিল মালিহার। বিনাবাক‍্যে সবগুলো খাবার পেটে চালান করলো।

বিকেলে পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে মালিহার আব্বু মোমো কিনে আনলেন মেয়ের জন্য। গরম গরম মোমো সসে ঢুবিয়ে খেতে দারুণ স্বাদ! শেষ বিকেলে মালিহা ভাইবোন দুটোও ফিরে এলো। তারা গিয়েছিল কচিংয়ে। পরিক্ষা চলছে। সমানে পড়াশুনা চলছে দু ভাইবোনের। এজন্য বোনকে আনতে তারা যেতে পারেনি। জমজ দুজন। এবার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। মালিহাকে দেখে ঝাপিয়ে পড়লো বুকে আনিশা। অনিম একটু দূরে দাড়িয়ে কথা বললো। সে কোন এক অজানা কারণে যখন তখন মালিহাকে জড়িয়ে ধরতে পারে না।

সংকোচ বোধ করে। এটুকু বয়সেই বেশ ম‍্যাচিয়ুর। চাল চলনে যুবা পুরুষের ভাব গাম্ভীর্য বিদ‍্যমান। তার দশ বছরের ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝতে শিখেছে সে এখন বড় হচ্ছে। যখন তখন বোনকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না, না বলে তার রুমেও ঢুকতে পারবে না। কিঞ্চিত মন খারাপ হয় তার। কেন সে আনিশার মতো মেয়ে হলো না! তাহলে তো সেও কাছাকাছি থাকতে পারতো। অবশ‍্য এসবের পেছনে দায়ী তাদের দাদু। তিনি বাচ্চা বয়স থেকেই নাতি নাতনিদের শিখিয়েছেন কার কি করণীয়। কোথায় তাদের সীমাবদ্ধতা। শুধু কমাতে পারেননি মালিহার জিদ আর রাগ।

তিনদিন পার হয়ে গেলেও জাওয়াদের কোন ফোনকল এলো না মালিহার বাড়িতে। কিন্তু তার শশুর বাড়ি থেকে বিভিন্ন সময়ে শশুর, শাশুড়ি, জা ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন। কিন্তু জাওয়াদের দিক থেকে কোন কল বা বার্তা আসেনি। খটকা লাগে মালিহার মায়ের। শাশুড়ি মায়ের সাথে তার টক ঝাল মিষ্টি সম্পর্ক। এই এখন রাগারাগী। একটু পরেই আবার একে অন‍্যের গায়ে হেসে লুটোপুটি খায়। শাশুড়ি মা কে ডেকে বললেন, “আম্মা বিষয়টা কিছু বুঝলেন? জামাই তো একবারও ফোন দিল না। মালিহাকেও কিছু বলতে শুনিনা জাওয়াদের ব‍্যপারে। আমার যেন কেমন কেমন লাগে আম্মা।”

বিচলিত শোনায় কন্ঠস্বর। চিন্তায় পড়েন মালিহার দাদু জামিলা বেগমও। তিনিও বিষয়টি খেয়াল করেছেন। বউমাকে অভয় দিয়ে বললেন, “অত চিন্তা কইরা লাভ আছে? আমি জিগামু মালিহারে। তুমি যাও তো। অত চিন্তা টিন্তা কইরো না। শইল খারাপ হইবো। এরপর আমার পোলার টাকা যাইবো ডাক্তারের পিছনে।”
শাশুড়ি মায়ের খোচা কথায় মনে মনে ভেংচি কাটেন। সামনে সাহস হয় না।

রাগে অনুরাগে পর্ব ২

মালিহা ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো। ঠকঠক আওয়াজ করে জামিলা বেগম আসে তার রুমে। কোনরকম ভনিতা না করে গম্ভীর স্বরে শুধায়, “সত‍্যি কইরা ক তো কি হইছে? নাত জামাই একটা ফোন পর্যন্ত দিল না তুই আসার পরে। আর না তোর মুখে একটা কথা শুনলাম তোর ব‍্যপারে। কি হইছে মালিহা?”
মালিহা মুখে কিছু বললো না। মাথা থেকে হিজাবের পিনটা খুলে মাথাটা এগিয়ে দিলো দাদুর দিকে। এক গোছা চুল ওঠা। আঁতকে উঠলেন জামিলা বেগম।

রাগে অনুরাগে পর্ব ৪