রাগে অনুরাগে পর্ব ৫
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
“মালিহারে ওই বাড়িতে পাঠাইও না বউ।”
শশুর মায়ের গম্ভীর কন্ঠস্বরে মুখের হাসি মিলিয়ে গেল মালিহার আম্মু মিসেস মায়া বেগমের। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “হঠাৎ এ কথা বলছেন কেন আম্মা? মেয়েকে শশুর বাড়ি পাঠাব না এ কেমন অলুক্ষণে কথা!”
“আমাদের ইসলাম ধর্মে সুলক্ষণ, অলক্ষণ বলে কোন কথা হয় না। সবটা মহান আল্লাহ প্রদত্ত। তোমার মেয়ে ওখানে গেলে ভালো থাকবোনা। ওর একদিনে যে হাল করছে তাতে তুমি কোন আক্কেলে সেইখানে পাঠাইতে চাও? তোমার জামাই একটাবার খবর নিছে মাইয়াডার? মনে প্রশ্ন জাগে না বাসর রাইতে মাইয়াডারে থুইয়া সে কেন বাড়ির বাইর হইলো? এহন সে নিতে আইবো আর তুমি কোন বাচ বিচার না কইরা সেইখানে পাঠাইবা!”
শাশুড়ি মায়ের কথায় কপালে ভাজ পড়ে মায়া বেগমের। ভুল তো কিছু বলেননি তিনি। তবুও মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। এইটুকু একটা ব্যাপারে মেয়েকে শশুর বাড়ি পাঠাবে না? লোকে শুনলে কি বলবে! বিয়ের দুদিন যেতে না যেতেই মেয়েকে রেখে দিচ্ছে। ছিঃ ছিঃ করবে না পাড়ার মানুষজন! জামিলা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন, “কি হয়েছিল আম্মা? আপনাকে কিছু বলেছে ও? আমাকে তো কিছু বলেনি। কি এমন ঘটলো যে বাসর রাতে বাড়ি ছাড়তে হলো জাওয়াদের!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শুকনো ঢোক গিললো মালিহা। সে এক কোণায় হাত পা গুটিয়ে বসেছিল। মায়া বেগমের প্রশ্নে উত্তর দিতে সময় নিলেন না জামিলা বেগম। গড়গড়িয়ে বলতে লাগলেন, “রাইত পার কইরা শেষ রাইতে আইসা উপস্থিত হইছে জমিদারের পোলা। অচেনা অজানা জায়গাই মাইয়াডা একলা কেমনে থাকে কও? সে ফিরলে মালিহা দুইডা কঠিন কথা কইয়া দিছে। কইবোও ই তো। কওনের কাজ করছে না? তোমার জামাই দুইটা কথার ভার সহ্য করতে না পাইরা মাইয়াডার সাথে জানোয়ারের মতো ব্যবহার করছে। দেহ তো ওর মাথাডা! গোছা ধরা চুলগুলো কি করছে। স্বামীর অধিকার সে তো অবশ্যই ফলাবো। কিন্তু এমন জানোয়ারের মতো ব্যবহার কেমনে করে কও বউ? আমার পোলাডা যদি পেত্থম রাইতে তোমার সাথে এমন করতো তুমি বুঝি এমনি এমনি ছাইড়া দিতা?”
জামিলা বেগমের সোজা সরল লাগামহীন বাক্য তীরের ফলার মতো বুকে বিধছিল মায়া বেগমের। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তার আদরের মেয়ের সাথে এমন কিছু হতে পারে। সভ্যতা, ভদ্রতার আড়ালে তাদের পছন্দ করা পাত্র এমন করতে পারে। ফুল ভলিউমে ফ্যান চললেও ঘামতে লাগলেন তিনি। বুকের মধ্যে ধরফর শুরু হতে লাগলো। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো। বিরাট আয়োজন করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর সব সঞ্চয় গুছিয়ে মেয়ের বিয়েতে খরচ করেছেন। কিছু টাকা ঋনও নিতে হয়েছে।
গতকালও পাওনাদার ফোন করে টাকা চেয়েছেন। স্বামীর ক্লান্ত মুখখানা চোখে ভাসলে অথৈয় জলে পড়েন মায়া বেগম। মেয়ের এ দূরাবস্থার কথা শুনলে মানুষটা নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবেন। এলোমেলো হয়ে যাবে তার সাজানো সংসার। মুহূর্তের মধ্যেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। সংসার সমরঙ্গনে গা ভাসালে মাঝেমধ্যে ভারি কঠিন হতে হয়। যেমন এখন সে শাশুড়ি মা ও নিজের মেয়ের কাছে হবেন। তবুও তাকে করতে হবে। এছাড়া মধ্যবিত্ত গৃহিণীর আর কিইবা করার থাকতে পারে! গা এলিয়ে দিয়ে বললো, “এই একটা দিকের জন্য মালিহা শশুর বাড়ি যাবে না? এক রাতের জন্য একজন মানুষকে বিচার করা যায় না। আমার মেয়েই বা কম কিসে? সে উল্টাপাল্টা কথা বললো কেন? মানছি জামাই যা করেছে অন্যায় করেছে। এজন্য তাকে বোঝাবো, ভবিষ্যতে যেন এমন ভুল না করে। কিন্তু মালিহা শশুর বাড়ি যাবে। কাল নিতে আসলে তাকে যেতে হবে। এটাই ফাইনাল কথা।”
মায়ের কথা শুনে হাত পা অসাড় হয়ে আসতে লাগলো মালিহার। মনে হলো তার পায়ের তলায় মাটি নেই। হাঁটতে গেলেই পিছলে পড়বে। অশ্রুসিক্ত চোখে মায়ের উদ্দেশ্যে শুধু বললো, “একথা তুমি বলতে পারলে আম্মু?”
“পারলাম। তোমাকে বারবার বুঝিয়েছি যেখানে সেখানে মেজাজ দেখাবে না। কোথায় কি বলতে হয় এখনো শিখলে না। কে তোমাকে কঠিন স্বরে কথা বলতে বলেছিল? তোমাকে সাগরে ভাসিয়ে দেওেয়া হচ্ছে না। তুমি জানোনা তোমার আব্বুর অবস্থা? দুটো ছোট ছোট ভাইবোন আছে তোমার। ওদের দিকটাও তো দেখা উচিত। একা শুধু নিজের কথা স্বার্থপরের মতো ভাবলে চলবে কি করে? কাল জাওয়াদ আসুক, তার পরিবারের মানুষেরা আসুক সব কথা শুনব, বলব। আগেকার দিনে শাশুড়ি, ননদ, স্বামী সকলের অবহেলা অনাদর নির্যাতন সহ্য করে নারীরা যুগের পর যুগ সংসার করে গিয়েছে। আর তোমরা হয়েছো সব ননীর পুতুল। পান থেকে চুন খসলেই ছেড়ে দিতে হবে। এসব আমার সংসারে চলবে না। বিয়ে হয়েছে শশুর বাড়িতেই থাকতে হবে তোমাকে।”
মায়ের অনর্গল বলা কথা কানে গেল না। কেবল একটি কথাতেই আটকে র ইল মালিহা। নিজের কথা ভাবছে সে স্বার্থপরের মতো? সত্যি সে স্বার্থপর? কান্নারা বাধ মানছে না। গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে। জামিলা বেগম বউমার এমন কঠিন ব্যবহারের সাথে অভস্ত নন। তিনি অবাক হয়েছেন বটে। নাতনির কান্না তার ভঙ্গুর হৃদয়ে আচর কাঁটলো। মেয়ে বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “তুমি যেমন কারো স্ত্রী, কারো মা তেমনই মালিহা তোমার পেত্থম সন্তান ভুইলে যাইও না। কঠিন হইতে হইতে স্পাত হইও না। বিবেক বুদ্ধি সব হারাইতাছো দিন দিন। কেমন মা তুমি?”
মায়া বেগম মায়া দেখালেন না মেয়ে কিংবা শাশুড়ির প্রতি। যন্ত্রের ন্যায় বললেন, “আপনি যা বুঝবেন না তা নিয়ে কথা বলবেন না আম্মা। বয়স হয়েছে। খান, ঘোরাফেরা করেন কিন্তু আমার সংসারে নাক গলাবেন না। আমার মেয়েকে আমি কি করব না করব সবটা আমার বিবেচনা। এখানে কারো কথা শুনতে ইচ্ছুক নই আমি। আর একটি কথা, এসব কথা যদি তিনজন ব্যতীত আর একটা কাকপক্ষিও জানে আমি এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ব বলে দিলাম।”
অপমানে চোয়াল ঝুলে পড়লো জামিলা বেগমের।
তার বয়সে এ পর্যন্ত এত কঠিন কথা বলার সাহস করেনি কেউ। বয়স হলে মানুষ হয়ে যায় খড়কুটোর মতো। কেউ আর দাম দেয় না। লজ্জায় অপমানে মালিহার দিকে তাকানোর সাহস করলেন না তিনি। লাঠি ভর দিয়ে ঠকঠক করতে করতে নিজের রুমের দিকে এগোলেন। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া এক ফোটা পানি মুছে ফেললেন সজতনে। পাছে কেউ দেখে ফেলে! আজ বড্ড মনে পড়ছে তার বুড়ো মানুষটাকে। তিনি থাকলে হয়তো ছেলের বউয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনতে হতো না তাকে।
দাদু চলে যেতেই মালিহা উঠে বসলো। যাওয়ার আগে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে গেল, “দাদুর সাথে আজ যে ব্যবহার করলে এর কোন ক্ষমা হয় না। আমি যাব সেখানে। এ নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। নিশ্চিন্তে থেক। আব্বুও জানবেনা কিছু।”
গটগট শব্দ তুলে চলে গেল মালিহা। সবাই চলে যেতেই কঠিন চোখদুটো ঝাপসা হলো। মায়া বেগম খুব ভালো করেই জানেন নিজের মেয়ে এবং মায়ের মতো শাশুড়ির কাছ থেকে আজীবনের মতো ভালোবাসা, স্নেহ, সম্মান হারালেন। কিন্তু তিনি যে নিরুপায়!
জামিলা বেগম ছোট ছেলের কাছে ফোন করলেন। ওপাশ থেকে কল কেঁটে দেওেয়া হলো। কিছুক্ষণ বাদেই আবার ফোন এলো। জামিলা বেগম কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করলেন। বললেন, “আমারে নিয়ে যাবি ছোট খোকা?”
ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে আসলো, “মালিহা কাল চলে যাবে তাই মন টিকছে না বুঝি? কাল আমাদের যেতে বলেছেন ভাবি। তখন নাহয় নিয়ে আসব অবশেষে তুমি যে আসতে চাইছো তাই তো অনেক। ছেলেমেয়েরা সবসময় তোমার কথা বলে।”
জামিলা বেগমের কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না। ছোট্ট করে বললেন, “আচ্ছা, রাখ তাহলে।”
মালিহা দরজায় দাড়িয়ে সবটা শুনলো। তার দাদু অভিমান করে চলে যেতে চাচ্ছেন। চোখ মুছে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো দাদুকে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন জামিলা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গেছে মালিহার। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্ট কন্ঠে শুধালো, “মেয়ে মানুষের বুঝি কোন বাড়ি হয় না দাদু? যার যতদিন ইচ্ছে ততদিন থাকতে দিবে। ইচ্ছে হলে আবার তাড়িয়ে দিবে। এমন জীবন কি হওয়ার কথা ছিল দাদু?”
নাতনির কথার উত্তর নেই সত্তুর পেরনো বৃদ্ধার কাছে। তিনি নিজেই যে খড়কুটোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছেন।
কিচেনে ব্যাস্তহাতে রান্নাবান্না করছেন মায়া বেগম। জামিলা বেগম দরজায় খিল এটে বসে আছেন। অন্য সময় হলে শাশুড়ি বউমা খুনশুটিতে মেতে উঠতেন। এইতো কিছুদিন আগে মালিহাকে দেখতে আসবে জন্য কত আয়োজন করলো শাশুড়ি বউমা মিলে। সকলে কত হাসিখুশি ছিল। সেসব সুন্দর সময়ের কথা মনে পড়তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মায়া বেগমের। হঠাৎ চোখ পড়লো ড্রয়িং রুমের দিকে। কাধে ব্যাগ চাপিয়ে মালিহা দ্রুত পায়ে কোথাও যাচ্ছে। চুলায় রান্না রেখে ছুটে এলেন মায়া বেগম। পিছন থেকে মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় যাচ্ছো সকাল সকাল?”
“ভার্সিটি।”
“তুমি জানো না আজ তোমার শশুর বাড়ি থেকে মেহমান আসবেন।”
“জানি।”
“তবুও কেন পা বাড়াচ্ছো?” ধমকে ওঠেন মায়া বেগম।
মায়ের ধমকে এখন আর ভয় পায় না মালিহা। শুধু বললো, “সেখানে গেলে নিশ্চয় আমার মর্জিমতো ভার্সিটি যেতে পারবো না। যেহেতু চলেই যেতে হবে তাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু নোটস নিয়ে আসব বান্ধবীদের থেকে। এত ভয় পাওয়ার কি আছে? পালিয়ে যাচ্ছি না তো!”
রাগে অনুরাগে পর্ব ৪
“মালিহা!” চিৎকার করে ওঠেন মায়া বেগম।
মালিহা তোয়াক্কা করলো না। গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল। মায়া বেগম ছুটলেন শাশুড়ি মায়ের রুমে। দরজায় কয়েকবার কড়া নাড়তেই জামিলা বেগম দরজা খুললেন। মায়া বেগম অভিযোগ করলেন, “দেখলেন আম্মা আপনার নাতনির কাণ্ড! দুপুর বেলায় মেহমান আসবে তার শশুর বাড়ি থেকে অথচ এখন সে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। তারা এসে ওকে না দেখলে কি ভাববে বলুন তো?”
জামিলা বেগম অল্প কথায় উত্তর সারলেন, “তোমার মেয়ের ব্যপারে আমাকে কিছু বলতে আসবে না।”