রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১২

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১২
সিমরান মিমি

বিকেল সাড়ে চারটা।রাজাপুরের রাস্তায় মাত্র চাকা রাখলো ড্রাইভার।পরশ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।শরীরে যেন কোনো সার নেই।বিশ্বাস’ই হচ্ছে না তার ছোট্ট ভাইটা আর নেই।এইতো পেছনের এম্বুলেন্সেই রাখা আছে পিয়াশের অস্ত্রচালনা করা ছিন্নভিন্ন শরীর’টা।হয়তো স্টিচ করা কিন্তু তারপরেও ভয়ঙ্কর সেই লাশ।পরশ নির্বাক হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে।

গতকাল ই পাভেল বাড়িতে চলে গেছে।সেই থেকে চাচা থেকে শুরু করে পরিবারের প্রতিটা সদস্য একের পর এক ফোন করে চলেছে তাকে।কিন্তু সেই পরিজন দের ভয়ঙ্কর আর্তচিৎকার পরশ নিতে পারবে না। যার কারনেই ফোন ধরেনি।নিজের উপর এক অপরাধবোধ জন্মালো।নাহ,সে পারেনি।সে পারেনি চাচার কথা রাখতে।পারেনি মা-বাবার দেওয়া দায়িত্বের বোঝা নিতে। ছয় বছরের ছোট্ট ভাইটাকে সেই তো নিজের কাঁধে নিয়েছিলো পঞ্চম শ্রেণি থাকাকালীন।পাভেলকে যতটা শাসন করতো, তার শিকেটুকুও পিয়াশকে করেনি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অবাধ স্বাধীনতা-আমোদ-ফুর্তিতে মোমের মতো মানুষ করেছে।পাভেলকে রাজনীতিতে জড়ানোর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও পিয়াশকে এসবের ধারে কাছেও ঘেষতে দেয় নি।এই নিরাপত্তাহীন ঝুঁকিপূর্ণ জীবন -যাপন থেকে রেখেছে অনেক দূরে।যাতে গায়ে আঁচড় টুকুও না লাগে।অথচ আজ সামান্য এক মেয়ের ফাঁদে পড়ে নিজের জীবন টাকেই শেষ করে দিলো।
ভাবনার মধ্যেই আবারো ফোন বেঁজে উঠলো।ফোন ওঠাতেই অবাক হয়ে গেলো।মনের মধ্যে থেকে বলে উঠলো,’ও কি করে ফোন দেবে?
স্ক্রিনের উপর জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো”অসভ্য মেয়ে”নামটি।মুহুর্তেই রিসিভড করলো ফোন।বললো,

“জেলের ভেতর ফোন কি করে পেলে তুমি?”
দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করলো স্পর্শী।শান্ত কন্ঠে বললো,”আমি জামিন পেয়েছি।আপনাদের পক্ষ থেকে তো কোনো শক্ত প্রমাণ দিতে পারেন নি, তাই কোর্ট থেকে আমায় ছেড়ে দিয়েছে।এ-কদিন হাজিরা দিতে হবে থানায় গিয়ে।
রাগে সারা শরীর টা গিজগিজ করে উঠলো পরশের। বললো,
“খুব শীঘ্রই আবার জেলে ঢুকবে তাও আজীবনের জন্য।আমায় কেন ফোন করেছো?জানাতে।”
স্পর্শী কম্পিত কণ্ঠে বললো,’শুনুন,দেখুন আপনি ফোন কাটবেন না প্লিজ!আমার কথা আছে।বেশীক্ষণ লাগবে না।মাত্র পাঁচ মিনিট।প্লিজ!

ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না।স্পর্শী পুনরায় বললো,’দেখুন আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই।ইনফ্যাক্ট আপনার ভাইয়ের সাথেও ছিলো না।কিন্তু পিয়াশের এই উগ্র কাজকর্ম গুলোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে একটাসময় এমন হয়ে গেছে যে আমি কেন?ভার্সিটির কেউই ওকে সহ্য করতে পারে না।ও ভার্সিটিতে আসা প্রতিটা নতুন মেয়ে স্টুডেন্ট দের র‍্যাগিং করতো।প্রতিটা মেয়েকে উত্যক্ত করতো।আর বিশ্বাস করুন,আর্শির সাথে ওর কোনো সম্পর্ক ছিলো না।আমার বোনতো ওকে চিনতোই না।মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে ও।একদম বাচ্চা।ভীষণ ভীতু।

আপনার ভাই আমায় পছন্দ করতো।কিন্তু আমি ওর প্রোপোজালে কখনো রাজী হই নি বরং ওকে অপমান করেছি বারবার আমায় বিরক্ত করায়।শেষে ও আমার উপর ক্ষোভ মেটাতে আমার বোনকে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো সেদিন। ওর বন্ধুবান্ধব সাথে ছিলো।যার কারনে আমি ওকে পিটিয়েছিলাম ক্যাম্পাসে।আর ওটা কে ভিডিও করেছে আমি জানি না।আমি এগুলো সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না।বরং চ আমি ওইদিন ডিপার্টমেন্ট এর গ্রুপে ভিডিও টা যেই ছাড়ুক সেটা ডিলিট করার ব্যাপারে একজন সাইবার এক্সপার্ট এর সাথে কথা বলছিলাম।কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি মাঝখানে পিয়াশ হুট করে এমন একটা কাজ করে বসবে।প্লিজ!বোঝার চেষ্টা করুন।এতোকিছুর মধ্যে আমার বোন একদম নির্দোষ। ও কিছু জানেই না।ছেড়ে দিন ওকে।প্লিজ!আচ্ছা ঠিক আছে আপনি ঠিকানা টা বলুন, আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।প্রমিস,আপনার নাম আমি কাউকে বলবো না।আপনার পলিটিক্সে কোনো প্রভাব পড়বে না।আমার বোনকে দিয়ে দিন।আমিই তো মেরেছি পিয়াশ কে।আপনি যা করার আমার সাথে করুন।ওকে ছেড়ে দিন।ভীষন ভয় পায় ও।

থেমে কান্না আটকে বললো,’আপনি আমার বড় ভাইয়ের মতো।প্লিজ আর্শির ক্ষতি করবেন না,ভাইয়া।
পরশ সব শুনলো।তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“আমার ভাইয়ের লাশ পেয়েছি।নিজের হাতে ওকে নিয়ে যাচ্ছি।এম্বুলেন্সের শব্দ শুনছো?ও আমার পেছনেই আছে।তুমি খুব দায়িত্বের সাথে ওর লাশটা আমার হাতে তুলে দিয়েছো, তাই না?চিন্তা করো না।আমিও খুব যত্নের সাথে তোমার বোনের লাশটা তোমার হাতে পৌছে দিবো।হিসেব বরাবর। ওকে?
চমকে উঠলো স্পর্শী।রাগে/জেদে হাতের ফোনটা ছুঁড়ে মারলো বিছানার উপর।রাগে মাথার চুলগুলো খামচে ধরলো।নিজেকে ভীষণ অসহায়ের মতো লাগছে।ছোটা বাচ্চাদের মতো হাটু ভর করে এগিয়ে গেল ফোনের কাছে।চিৎকার করে বললো,

” কু*ত্তার বা*চ্চা!তোকে আমি খুন করবো আমার বোনের ক্ষতি করার চেষ্টা করলেও।তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি নাতো।তোর ওই ভাই আর জানোয়ার বন্ধুগুলার কথা শুনলি তো।খুব পস্তাবি।আমার বোনের ক্ষতি করবি না।তোর ভাই আরো একটা আছে না তোর?প্রথম টাকে খুন না করলেও পরের টাকে করবো।একদম বিনা অপরাধে।আর শোন,তোর সাহায্য আমার কক্ষনো লাগবে না।থুঁঃ।আমি আমার বোনকে নিজে খুঁজে নিবো।
মুহুর্তেই পরশ ফোন কেটে দিলো।কেননা পিরোজপুরে এসে গেছে গাড়ি।
পিরোজপুরের মধ্যে ঢুকতেই পরশের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো।কি করবে সে?কি উত্তর দিবে সবার কাছে?মাথায় কিচ্ছু আসছে না।শুধু বাঁজছে এম্বুলেন্সের সাইরেন এর শব্দ।

শিকদার মহলে গাড়ি ঢুকতেই কান্নার রোল পড়লো পুনরায়।গাড়ি থেকে বের হলো না পরশ।যেন পাথর সমান বোঝা বয়ে এনেছে সে।চোখ বন্ধ করে সিটের সাথে হেলিয়ে বসে রইলো।সবাই লাশ নিয়েই ব্যস্ত।পিয়াশা বেগম হাউমাউ করে কাঁদছে।পেটে না ধরলেও প্রায় আড়াই বছর নিজের বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছে।দেবরের সদ্য মা মরা ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজের কোলের দুই বছরের ছেলেকে মাটিতে সরিয়ে রেখেছে।আদর করে নিজের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে পিয়াশ।

এতো মায়া,এতো ভালোবাসা কি আজকের এই লাশ দেখার জন্য জন্মেছিলো।এর থেকে জন্মের সময় মারা গেলেই তো হতো।আমজাদ শিকদার কে ধরে অঝোরে কাঁদছে ছোট ভাই মতিউর শিকদার।গত চব্বিশ বছর আগে প্রিয় স্ত্রী চলে গেল।মায়ের অভাব ভোগ করাবে না বলে বাবা হয়েও আজীবন ছেলের থেকে চাচা ডাক শুনে হজম করেছে এই দিনের জন্য।ছেলেটা এভাবে চলে যাবে কে জানতো।জানলে এক বারের জন্য হলেও ওই মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য মরিয়া থাকতো সে।কেন হলো এমন?দুহাত দিয়ে অভিভাবক রুপি বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“ভাইজান,আমার আর কেউ রইলো না।ছেলেটা এভাবে অকালে কেন চলে গেল?আমায় কে দেখবে?”
আমজাদ শিকদার ভীষণ শক্ত মানুষ।ছোটবেলা থেকেই তুখোর রাজনীতিবিদ ছিলেন তিনি।তার রেশ ধরেই আজ ছেলেদুটো সেই পথেই হাটছে।তিনিও আজ মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।ভেঙেচুরে গেছে ভেতর থেকে।পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,

“অকালে মৃত্যু বলতে কিচ্ছু নেই।হয়তো ওর ভাগ্য এমনভাবেই নির্ধারণ করা ছিলো যে” আত্মহত্যা করেই প্রাণ যাবে।”নিজেকে সামলা।আমার ছেলেরা কি তোর ছেলে নয়?ওরা কি তোকে ফেলে দেবে?শান্ত হ,ছেলেকে কবর দিতে হবে।মর্গ থেকে বের করে বেশীক্ষণ লাশ রাখা যায় না।
পাভেল অনেকক্ষণ ধরে ভাইকে খুঁজছিলো।গাড়ির কাছে আসতেই দেখলো নিস্তেজ হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।দরজা খুলে ধরে বের করলো।এরপর ধীর পায়ে হেটে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল।আর কিছুক্ষণের মধ্যে ই গোসল করিয়ে জানাযা পড়াতে হবে।ভাই ঢাকায় নানা ঝামেলায় থাকায় বিধায় নিজেও হয়তো গোসল করেনি।বাথ্রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে গোসল করতে বলে নিজেও বাইরে চলে গেল।

বিশাল জনসমাবেশ দ্বারা জানাযা সম্পন্ন হলো।একে একে কাঁধে চড়ে পিয়াশ গিয়ে পৌছালো তার চির ঠিকানায়।স্বভাবগত ভাবেই একে একে ফাঁকা হয়ে গেল স্থান টি।রয়ে গেল শুধুমাত্র চির আমিটা।যার হিসেব নিকাশ শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।রুমের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে কবরের দিকে তাকিয়ে আছে পরশ।এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভাইটার নতুন ঘরটুকু।ঠান্ডা চিত্তে তাকিয়ে আছে সেদিকে।অথচ ভেতরে তার আত্মচিৎকারে ফেঁটে যাচ্ছে কলিজা।এফাঁড়-ওফাঁড় হয়ে ছিড়ে যাচ্ছে কলিজা।

কেন ভাইটাকে সাথে নিয়ে আসলো না।কেন রেখে আসলো একাকী।কেন দেখা হলো ওই বেইমান মেয়েটার সাথে।যার কারনে ভাই আজ চিরনিদ্রায়।এতটা ভালোও কি কাউকে বাসা যায়?যদি পরশ জানতো, তাহলে পায়ে ধরে এনে হলেও বিয়ে করিয়ে দিতো।কেন বলেনি তার কাছে পিয়াশ।কেন এভাবে লজ্জায় নিজেকে বলি দিলো।নাহ,এখানে ওই ছোট্ট মেয়েটার থেকেও বেশী দোষী স্পর্শী।পরশ ক্ষমা করবে না ওকে।পুলিশ কিছু না করলে সে ছাড়বে না।প্রয়োজনে খুব কাঁছে এনে তারপর আঁছড়ে ফেলতে হবে।তিল তিল করে যত্ন সহকারে মারবে ওকে।

রাত দেড়টা।পুরো পৃথিবীটা এখন নিস্তব্ধ অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর পর বাতাসের দমকা ঠান্ডা হাওয়াগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে সারা পিঠময় চুল।চোখ গুলো তার কোনো এক নিস্তব্ধ দিঘি।চোখে নেই ঘুম।কিভাবে ঘুমাবে সে?পাতা দুটো বন্ধ করতেই কানে বাজে আর্শির বেদনার্ত চিৎকার।মন বলছে এই বুঝি কোন জানোয়ার তার বোনের ছোট্ট শরীর টা ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে।উফফফ!যন্ত্রণা।নাহ,এমনটা কেন হলো?তার জন্য হয়েছে সবটা।সবকিছুর জন্য সে দায়ী।আচ্ছা এখন কি কি আর্শি কাঁদছে?

ওই পিশাচগুলোর অপবিত্র ছোঁয়াগুলো কি কাঁটার মতো বিধঁছে না তার ছোট্ট শরীর টায়।চিৎকার করে থামতে বলছে কি তাদের।অনুরোধ করছে কি ছেড়ে দিতে তাকে।আর্তনাদ করে কি স্পর্শীর উদ্দেশ্যে বলছে না,’আপু,এ কোন নরকে ফেললে আমায়।তুমি তো সুখেই আছো?কেন তোমার কর্মের ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমার এই ছোট্ট পবিত্র শরীরটাকে।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১১

কেন আজ আমার প্রাণ টুকুও অনিশ্চয়তায় ভুগছে?’হাটু ভেঙে ছাদের ফ্লোরে বসে পড়লো স্পর্শী।কান্নায় ভেঙে পড়লো ধরণীকুল।উফফফ!কি সেই কান্না।এই নিস্তব্ধ রাত্রির এই বোবাকান্না যেন আশেপাশে থাকা বোবা বৃক্ষ গুলোর অন্তর ও নাড়িয়ে দিচ্ছে।বাতাসের সাথে নিজেদের ডালপালাকে নাঁড়িয়ে স্পর্শীর সাথে সায় মিলিয়ে বলছে,’তুমি ভয় পেয়ো না,আমরা আছি।’

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১৩