রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৩
সিমরান মিমি
জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। ভ্যাবসা গরমের মধ্যে বৃষ্টিকে আহ্বান করা ঠান্ডা পুবালী হাওয়া নিমিষেই হৃদয় জুড়িয়ে দেয়।দুহাত দুপাশে মেলে কিছুক্ষণ সেই হাওয়া কে গায়ে মাখলো স্পর্শী।তার তৃপ্তির প্রয়োজন।এতো এতো ঝামেলা,চিন্তা শরীর কে ক্রমশ কাবু করে দিয়েছে।কিন্তু সে হতে চায় না।এই দুর্বলতাকে ছুঁড়ে দিয়ে আকাশ ছুঁতে চায়।দুর্বলতার সামনে ওই হিমশিখরের মতো মস্তক খাঁড়া করে দাঁড়িয়ে থাকতে চায় যাতে দুর্বলতা তার বাকাঁনো শিরদাঁড়া না দেখে পালিয়ে যায় দেশান্তরে।
ঠান্ডাকে উপভোগ করার পর হাত তুলে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো।রাত দশটাকেও পেরিয়ে গেছে।গা ঝাড়া দিয়ে বারান্দা থেকে রুমের ভেতর চলে এলো সে।আর্শি উপুড় হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে।পাশেই প্লেটদুটো এটো অবস্থায় রাখা।আজ আর ডাইনিং এ জায়গা হয় নি তাদের।কোনো না কোনো ঝামেলা হবে পুর্ব আন্দাজ করেই সোনালী রুমের মধ্যে খাবার দিয়ে গেছে।স্পর্শী তাতে মোটেই রুষ্ট নয়।বরং সন্তুষ্ট। যেটুকু বাবা সম্পর্কে জানার ছিলো, সেটুকু এখন ত্র বক্ষস্থলে প্রতিনিয়ত হাতুড়ি পেটাচ্ছে। এখন বাকিটুকু মায়ের উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকবে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
খাটের ডানপাশে ছোট্ট টি-টেবিল টার উপরে প্লেটদুটো অযত্নে পড়ে আছে।সেগুলোকে হাতে নিয়ে দরজা চাপিয়ে বের হলো বাইরে।ড্রয়িং রুমে কেউ নেই।এ বাড়ির রাতের খাবার সম্পন্ন হয় সাড়ে ন’টার আগেই।তবে এই নিয়মের ধার ও ধারেন ন সোভাম সরদার।তিনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।তবে এই ব্যস্ততা টা ঠিক কোন কাজে সে সম্পর্কে এখনো অবগত নয় স্পর্শী।শুধু জানে , সরদার বাড়ির সকল নিয়ম কানুনের উর্ধ্বে সোভাম ভাই।তিনি দুপুর দুইটায় উঠে সকালের নাস্তা করলেও এবাড়ির কাছে তখন সকাল আট’টা।গভীর রাত ছাড়া বাড়ি ফেরে না কখনো।তার সোনা’মা অর্থাৎ সোনালী বেগম খাবার রেখে দিয়ে আসেন তার কক্ষে।কখনো তৃপ্তি নিয়ে খান আবার কখনো দেখা যায় সকাল বেলা বাসি খাবার সহ প্লেট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসেন সোনালী।
প্লেট দুটো প্রথমে এঁটো ফেলে রাখতে চাইলেও মস্তিষ্ক সাড়া দিলো না স্পর্শীকে।এরপর আলতো হাতে সেগুলো কে ধুয়ে উপুড় করে রাখলো। গায়ের ওড়নায় হাত মুছে উপরে তাকাতেই দেখলো শামসুল সরদারের রুমে দরজা খোলা।বকা খাবে জেনেও স্পর্শী দমলো না।এ দুদিন সত্যিটা জানার জন্য বেশ খামখেয়ালিপনা আচরণ করেছে স্পর্শী।তাও নিজের বাবার সামনে।এই লোক’টা যখন জানবেন, তার মেয়েই সে তখন ভীষণ কষ্ট পাবেন মেয়ের আদব-কায়দার এই পরিণতি ভেবে।পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলো।সিঁড়ির বাম দিকের চার তিন রুম পরেই বাবার ঘর।স্পর্শী দেখেছে সকালে ওই ঘর থেকেই বের হতে।লম্বা করে শ্বাস নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো।বাবার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কন্ঠে শুধালো,
“আংকেল,খুব বেশী রাগ না করলে আমি কি একটু ভেতরে আসবো?ব্যাস দু মিনিট।”
চমকে দরজার দিকে তাকালেন শামসুল।চোখ দুটো তার লাল হয়ে আছে।হাতের শাড়িটাকে দ্রুত চেয়ারের উপর রেখে অন্যদিকে তাকালেন।এভাবে কেউ ডাকলে ফেরানো যায় না।কন্ঠে গাম্ভীর্যতা এনে বললেন,
“ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্ন না করলেই খুশি হবো।আসতো পারো।”
দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেল স্পর্শী।শামসুল সরদার চেয়ার টায় বসলেন ডার্ক খয়েরী রঙের শাড়িটাকে ঢাকার জন্য।স্পর্শী কিছুক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পুণরায় খাটে বসতে বসতে বললো,
“আমি একটু বসি।”
শামসুল সরদারের কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।তিনি একদৃষ্টিতে রুমের পুর্বকোনের বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছেন।বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে ফেললো স্পর্শী।শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,
“আমি জানি আপনি আমার উপর রাগ করে আছেন।করাটাই স্বাভাবিক।আমি একটু বেশীই অনধিকারচর্চা করে ফেলেছিলাম।বিশ্বাস করুন,এতে আমার একটুও খারাপ লাগছে না।আমি নিজেও তো আমার পারিবারিক ব্যাপারে অন্যকারো কাছে কিছুও শেয়ার করি না।এতে নিজের কাছে অপমানিত হই।”
থেমে বিছানা থেকে নেমে শামসুল সরদারের হাটুর কাছে বসলো।হাটুর উপরে রাখা তার একটা হাত নিজের দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।চমকে উঠলো শামসুল।হঠাৎই স্পর্শীকে পায়ের কাছে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন।তাকে পুণরায় চমকে দিতে স্পর্শী বললো,
“আমায় ক্ষমা করে দেবেন আংকেল।আমি আপনাকে অজান্তেই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।আসলে আমার ভাবনার মধ্যেই ছিলো না, আপনার রাগের পেছনে এতটা করুন কাহিনি আছে।আমি হুট করেই জোরপূর্বক বোনকে নিয়ে এখানে ঢুকেছি।তার উপর নানা সময় আপনাকে রাগিয়ে দিয়েছি।প্লিজ আর রাগ করে থাকবেন না।আমি বিকেলেই যেতাম শুধুমাত্র কিছু কারনে রয়ে গেলাম।বোন টাও একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে।”
হা হয়ে গেলেন শামসুল।দ্রুত হাতে পা থেকে তুললেন স্পর্শী কে।অসস্তিতে ভেসে গিয়ে বললেন,
“আরে আরে এটা কি করছো?আমি কষ্ট পাই নি তো মামুনি।।আমি তোমার উপর রাগ ও করিনি।ছাড়ো, এখানে বসো তো।”
বলে খাটে বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসলো।এরপর শান্ত কন্ঠে বোঝানোর স্বরে বললো,
“তোমার পারিবারিক সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে তুমি ঠিক যতোটা রাগ করেছিলে;আমিও তেমনি অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলাম।আসলে পুরোনো ঘটনাগুলো নিয়ে আমি বেশী ভাবতে চাই না।একপ্রকার ভুলেই গেছিলাম।হঠাৎ তুমি মনে করিয়ে দেওয়ায় অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলাম।ব্যাস এটুকুই।”
স্পর্শী মাথা নাড়িয়ে শুনলো।এরপর আলতো হেসে বললো,
“আংকেল,মিথ্যা কেন বলছেন?আপনার পেছনের শাড়িটা দেখেই তো বোঝা যায় কতটা ভুলে গেছেন।”
ভ্রুঁ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতেই অসস্তিতে পড়লেন শামসুল। পরক্ষণেই হো হো করে হেসে উঠলেন।বললেন,
“তোমার চোখ এড়াতে লুকালাম ;তাও দেখে ফেললে।তীক্ষ্ণ নজর।”
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে এরপর স্পর্শী চলে এলো নিজের রুমে।বাবাকে ছোঁয়ার লোভ ছিলো ভীষণ। আজ ক্ষমা চাওয়ার অজুহাতে ছুঁয়ে নিলো।আরো কিছুক্ষণ কাছে বসে গল্প করতে ইচ্ছা করলেও বাবার অসস্তি মাখা মুখ দেখে চলে এলো।নিজের কাছে বাবা হলেও তো বাবার কাছে অচেনা একটা মেয়ে।
রাতের শেষ প্রহর।এইতো আর মিনিট বিশেকের মধ্যেই আজান দিবে। চারপাশে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। মাঝে মধ্যে বাতাসের কিছু প্রবল হাওয়া ছুয়ে দিচ্ছে শরীর।সারারাত চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিয়েছে শামসুল।স্ত্রীয়ের শাড়ি জড়িয়ে বসে ছিলো আজ দেড় যুগ পর।ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো শেষরাতে।হঠাৎই কলিং বেলের শব্দ কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল।চমকে উঠলেন তিনি।ঘরের আলো জ্বলছে এখনো।সামনের ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো চারটা বেজে গেছে।আশ্চর্য হয়ে গেলেন।এতো রাতে কে এলো?মুহুর্তে’ই মনে পড়লো সোভামের কথা।গত রাতে তার ছেলে কি ফিরেছিলো?গটগট পায়ে নেমে এলেন নিচতলায়।সদর দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ত্রস্ত হাতে দরজা খুলে ফেললেন।মুহুর্তেই একঝাপটা ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে ভেসে উঠলো অতি পরিচিত এক মুখ।থমকে গেলো শামসুল।একধ্যানে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।কিয়ৎক্ষণ পর চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললেন।মনে মনে আওড়ালেন,
“নাহ,এটা স্বপ্ন।এটা কখনো বাস্তব হবার নয়।”
ওভাবেই পিছু ঘুরে এগিয়ে এলেন ড্রয়িং রুমের দিকে।শরীর টা দুর্বল হয়ে পড়েছে ক্রমশ।বুকে ব্যাথা উঠছে চিনচিন করে।বসে পড়লেন সোফায়।এরপর পুনরায় তাকালেন দরজার দিকে।পিপাসা এখনো ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো তার ফ্লোরের দিকে।শামসুল কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না এই মুখকে।এটা কি কল্পনা,নাকি স্বপ্ন।উফফ!মস্তিষ্কে চাপ পড়ছে প্রবলভাবে।চিৎকার করে উঠলেন সোনালীর নাম ধরে।
শিউরে উঠে বসলো স্পর্শী।দ্রুত মোবাইল হাতড়ে দেখলো মায়ের অনেক গুলো কল।লাস্ট দু ঘন্টা আগে কথা হয়েছিলো। নিশ্চয়ই চলে এসেছে এতক্ষণে।দ্রুতপায়ে মোবাইল নিয়ে ছুটে এলেন ড্রয়িংরুমে।বাবাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলো।ঠাঁই হয়ে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো।এরইমধ্যে সোনালী ও খলিল সরদার ছুটে এলেন নিচে।চিন্তিত কন্ঠে নিচে নেমে শামসুলের নিকট যেতেই লক্ষে পড়লো সদর দরজায় দাঁড়ানো মানবীকে।আর্তনাদ করে ছুটে গেল সোনালী।দুহাত দিয়ে হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,
“পিপাসা,কোথা থেকে এলে তুমি? এতদিন কোথায় ছিলে?”
এরপর শামসুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভাইজান,ও কখন এসেছে?আপনার সাথে কি যোগাযোগ ছিলো? ”
শামসুল উঠে দাঁড়ালো। ইতোমধ্যে পিপাসাকে ভেতরে নিয়ে এসেছে সোনালী।তার সামনে গিয়ে চোখের দিকে তাকালো।কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে বললেন,
“আমার মেয়ে কোথায়?”
অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে তাকালো পিপাসা।মুহুর্তেই গরম জলের স্রোত বেয়ে পড়লো ফ্লোরে।শামসুল চেঁচিয়ে উঠে বললো,
“আমার মেয়ে কোথায়?
থেমে,
” সোনালী ওকে জিজ্ঞেস করো আমার মেয়ের কথা।ও কোথায় ছিলো,কেন ছিলো,কি করেছে এতোদিন,কেন গেছিলো সেসব কিচ্ছু জানতে চাই না আমি।আমার ভাগ্যে যা ছিলো হয়েছে।কিন্তু আমার মেয়েকে আমার চাই।কোথায় আমার স্পর্শীয়া।জিজ্ঞেস করো এক্ষুণি।”
গতকাল দুপুর থেকে না খেয়ে আছে পিপাসা।অনবরত কেঁদেই চলেছে।সারাটা রাত বাসে বমি করতে করতে এসেছে।মনে হচ্ছিলো এই যেন সে পড়ে যাবে অজ্ঞান হয়ে কিংবা প্রাণ টা বুঝি চলে গেল এভাবেই।সারাটা পথ আল্লাহর কাছে একটাই চেয়েছে “যা হোক বাড়ি গিয়ে হোক,অন্তত মেয়ে দুটো পরিচয় পাবে।হয়তো কবুল হয়েছে দোয়া। কিন্তু এখন তো আর শরীর সায় দিচ্ছে না।এতো এতো প্রশ্নের চাপে অস্থির হয়ে পড়লো পিপাসা।চোখের সামনে সবকিছু অস্পষ্ট হতে লাগলো।আচমকা’ই পড়ে গেল ফ্লোরে।মুহুর্তে’ই ধরে নিলো সোনালী।
শামসুল শিকদার দু-পা এগিয়ে এসে ধরলো স্ত্রীকে।ঘাবড়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো,
“তৃষ্ণা!”
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২২
চমকে গেল স্পর্শী। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েই দেখছিলো বাবা-মায়ের রিয়াকশন। কিন্তু হঠাৎই এমন পড়ে যাওয়াতে ভয় পেয়ে গেল।ছুটে গেল ড্রয়িংরুমে।ইতোমধ্যে সোনালী আর শামসুল মিলে পিপাসা কে সোফায় শুইয়েছে।স্পর্শী মায়ের পাশে গিয়ে দুগাল ধরে ঝাকিয়ে বললো,
“আম্মু,কি হলো তোমার?আম্মু?আনটি,একটু পানি আনুন না।”
চমকে দাঁড়িয়ে পড়লো শামসুল।শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল তার।স্পর্শির দিকে তাকিয়ে কম্পন রত কন্ঠে বললো,
“কি ডাকলে তুমি ওকে?