রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৩ (২)

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৩ (২)
সিমরান মিমি

চারদিক তখন আজানের মধুর সুরে মাতোয়ারা হয়ে গেছে।পাখির কিছু পিছনে কিচিরমিচির ডাক প্রকৃতিকে করে তুলেছে আরো ছন্দময়।ভোরের আলো এখনো না ফুটলেও পূর্বাকাশ ছেয়ে গেছে লাল আভার আস্তরণে।চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে গুটি শুটি পাঁকিয়ে বিছানার এক কোণে বসে আছে আর্শি।চুল তার এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে কাঁধের দুই পাশে।সামনেই বিছানায় পড়ে আছে মা। তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।মাঝেমধ্যে চোখের কোল ভেসে বেরিয়ে আসছে অশ্রুকণা।তার ডান পাশে বসেই মায়ের হাত শক্ত করে ধরে আছে স্পর্শী।আর্শির মাথায় কিছুই ঢুকছে না।এই যে এত্তোগুলো মানুষ এখন এই ঘরে উপস্থিত হয়ে আছে এর কোনো কারন খুঁজে পাচ্ছে না এই মুহুর্তে। রুমের পশ্চিম কোনায় একটা কাঠের চেয়ার।তার উপর বসে থমথমে মুখ নিয়ে স্পর্শীর দিকে চেয়ে রইলো শামসুল সরদার। খলিলুর রহমান ও তার স্ত্রী পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

“এতো বছর পর বুঝি বাবার কথা মনে পড়লো?”
একদৃষ্টে তাকিয়ে উদাস কন্ঠে বললো শামসুল।স্পর্শী চমকালো।অশ্রুসিক্ত চোখে একবার বাবার দিকে তাকিয়েই আবার মাথা নিচু করে ফেললো।চোখ খুললো পিপাসা। শুয়ে শুয়েই কাতর কন্ঠে বললো,
“ওদের কোনো দোষ নেই।আমিই কখনো আপনার কথা ওদেরকে বলি নি।”
শামসুল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।পুণরায় স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“জানতে চাও নি কখনো বাবার কথা?নাকি প্রয়োজন পড়ে নি বাবাকে।মা’ই যথেষ্ট ছিলো?”
স্পর্শী এবারেও নিরুত্তর। এইসকল কথাবার্তা বাবা-মায়ের ভেতরকার।তারা নিজেরা আলোচনা করবে।শুধুমাত্র মায়ের উপর জেদ দেখিয়েই তাকে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করছে বাবা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আর্শির ভীষণ রাগ হলো।বাবা শুধুমাত্র আপুর সাথে কথা বলছে। তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।আর আপুও ঢং করছে।তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো বলে দিতো”মা বলেছিলো বাবা মারা গেছে, তাই তারা আর খোঁজ নেয় নি।”ধুর!
স্পর্শী মাথা নোয়ালো।মায়ের দিকে নিচু হয়ে বললো,
“তোমার শরীর’টা কি এখন ভালো লাগছে?”
অসস্তিতে পড়লো পিপাসা।মেয়ের কানে কানে বললো,
“কাল থেকে না খেয়ে আছি।খিদে পেয়েছে অনেক।”

দুম করে উঠে বসলো স্পর্শী।এখন সবাই তার পরিচয় জানে।নিশ্চয়ই নিজে গিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার আনলে কেউ চোখ কুঁচকে দেখবে না।পিপাসা আবারো স্বামীর দিকে তাকালো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“ওরা জানে ওদের বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।আর এসব কথা আমিই ওদের বলেছি।নিজের বাবা সম্পর্কে ওদের কম কৌতূহল ছিলো না।কিন্তু আমি রাগ করি বলে সেই ভয়ে জানতে চাইতো না।ওদের কোনো দোষ নেই।ভুল যদি করে থাকি সেটা সম্পূর্ণ দায় আমার।আপনার মেয়েরা আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।সেই জন্যই হয়তো আজ উনিশ বছর লালন -পালন করার পরেও নিজের বাবা সম্পর্কে জানা মাত্রই ছুটে এসেছে।আমি জানি, আমি আসায় আপনি অনেক রেগে গেছেন।চিন্তা করবেন না, আমি কখনো আপনাকে জোর করবো না।আর নাতো বাধ্য করবো। শুধুমাত্র মেয়েদেরকে একটা পরিচয় দিতে এসেছি।একটা আশ্রয়।যেখানে ওরা সুরক্ষিত থাকবে।”

উপস্থিত সবাই বাকহারা হয়ে গেলেন।শামসুল সরদার তড়িৎ গতিতে স্ত্রীর পানে চাইলেন।সে মরে গেছে।একথা তার তৃষ্ণার বলতে একটুও বুক কাঁপলো না।এই যে এতো বছর ধরে তৃষ্ণা নিখোঁজ। সে তো এক মুহুর্তের জন্যেও এসব কথা কাউকে বলতে পারে নি।তার তৃষ্ণা যে মৃত এটা ভাবতেই তো কলিজাটা ছিঁড়ে এফাঁড়-ওফাঁড় হয়ে যায়।তাহলে
তৃষ্ণা কি করে পারলো?মাথাটা আপনা-আপনি নিচু হয়ে গেল।এখানে আর এক মুহুর্ত ও থাকা যাবে না।চোখ গুলো ভরে এসেছে তার।দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো প্লেট হাতে স্পর্শী ঢুকছে রুমে।সে ফিরে এসেছে দুটো পোঁচ ডিম হাতে।আপাতত হাতের কাছে কিছুই পায়নি যেটা স্বল্প সময়ে খাওয়ার উপযোগী।রুটি পেলেও বাটার খুঁজে পায়নি।তাই বাধ্য হয়েই ডিম পোঁচ করেছে। মায়ের সামনে গিয়ে প্লেট রেখে তাকে ধরে উঠালো। পিপাসার ভীষণ লজ্জা করছে খেতে।কিন্তু স্পর্শীর চোখ রাঙানোর সামনে দমে গেলেন।সোনালী অবাক হয়ে গেল।আলতো চেঁচিয়ে বললো,
“তোমার খিদে পেয়েছে আমাকে তো বলবে?”

আর দাঁড়ালো না।দ্রুত ছুটলো রান্নাঘরের দিকে।ভোরের আলো ফুটে গেছে অনেকক্ষণ।সকালের নাস্তা বানাতে হবে। এইতো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মালতীর মা এসে যাবে।তখন কাজের চাপ অনেক’টা কমবে।
মাকে খাইয়ে দিচ্ছে স্পর্শী।মাঝেমধ্যে বাবার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখে নিচ্ছে।শামসুল গেল না রুম থেকে।মেয়ের প্রতি আকাশ সমান অভিযোগ তার।কেন এসেই পরিচয় দিলো না বাবার কাছে।ইশশ!কতটা অপমান করেছে সে তার রাজকন্যাকে।বাড়ি থেকে এ যাবৎ কতবার বের হয়ে যেতে বলেছে। অভিমানী চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এসেই পরিচয় দিলে না কেন?এই নাটকের কি কোনো প্রয়োজন ছিলো?”
স্পর্শী মাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,

“মা জানতো আপনি আপনার প্রথম স্ত্রীকে আবারো বিয়ে করেছেন।সেই কারনেই কোনো খোঁজ খবর নেয় নি।এমনকি নিজেও ধরা ছোয়াঁর বাইরে ছিলো।কিন্তু আমরা দু-বোন হয়তো সেটা পারি নি।বাবা নামক ঐ মানুষ টাকে খুব কাছ থেকে দেখার সাধ ছিলো বলেই পিরোজপুর এসেছিলাম।ভেবেছিলাম, আপনার সংসারে কোনো অশান্তি করবো না।ব্যাস দূরে থেকেই দেখে যাবো।কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো এখানকার রাজনৈতিক কোলাহল।শেষে বাধ্য হয়ে উঠলাম এ বাড়িতে।কিন্তু আপনার স্ত্রী নামে কাউকে না দেখে কৌতূহল বেড়ে গেল।সে কি বেড়াতে গেছে,নাকি তার সাথে মনমালিন্য হয়েছে এসব প্রয়াস করতেই দেখলাম আপনি রেগে যাচ্ছেন।তখন আর থেমে থাকতে পারলাম না।আপনাকে প্রতিনিয়ত বিরক্ত করতে করতে জেনেই নিলাম আনটির কাছ থেকে।

মা আপনার কাছে থাকতে আসে নি আব্বু।এতোবছর পর আপনি যে মাকে মেনে নিবেন সে আশাও তিনি করেননি।এমনকি আমি ও না।শুধু মাত্র চাইছিলাম আপনাদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি টা শেষ হোক।আর আপনার কাছে নিজের পরিচয় দেয় নি শুধুমাত্র একটা কারনে।যদি আপনি বিশ্বাস না করে প্রমাণ চাইতেন।সেটা অত্যন্ত কষ্টের ছিলো আমার কাছে।তাই মাকে ডেকেছি।”
শামসুল সরদার ফের দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্ত্রীর পানে চেয়ে মেয়েকে বললো,
“আমার ঘরে একটু আসবে?”

স্পর্শী চকিতে তাকালেন।সরদার আর দাঁড়ালেন না।ত্রস্ত পায়ে চলে গেলেন দোতলায়।কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না পিপাসা।প্লেট রেখে হাত মুছে সেও দোতলায় চলে গেল।বাবার রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে দেখলো বাবা হেলান দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন।আলতো পায়ে তার সামনে দাঁড়াতেই করুন কন্ঠে বললেন,
“মামুনি,আমার পাশে একটু বসবে?”
স্পর্শী ছুটে গেল তার কাছে। মেয়ে পাশে বসতেই আদুরে হাতে জড়িয়ে নিলেন বুকের সাথে।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কান্নার বেগকে রোধ করে বললেন,

“জানো মামুনি,খুব সাধ ছিলো একটা রাজকন্যার।আল্লাহ কবুল করে তোমাকে দিয়ে দিলো।অনেক স্বপ্ন ছিলো।আমার রাজকন্যার এই ছোট ছোট হাত দুটো ধরে আমি চলতে শেখাবো।কাঁধে নিয়ে সারা বাড়ি চড়ে বেড়াবো।স্কুলের প্রথম ইউনিফর্ম টা নিজ হাতে পড়াবো। ওই ছোট্ট মাথাটা বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াবো। কিন্তু জানোতো সোনা মনি,’তোমার বাবার সাধ ছিলো,সাধ্যেও ছিলো,কিন্তু ভাগ্যে ছিলো না।”
স্পর্শী কাঁদছে।প্রাণ খুলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে।নিজের ভেতরকার সকল অসহায়ত্ব তুলে ধরেছে বাবা নামক এই সুরক্ষাকবজের কাছে।

দূর থেকে একজোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তার ওই ছোট্ট হৃদয়টা ভেঙে দুটুকরো হয়ে যাচ্ছে।আর দাঁড়াতে পারলো না।কান্নারত অবস্থায় ছুটতে লাগলো নিচতলায়।মায়ের কাছে যাবে সে।গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। নালিশ করবে বাবার নামে।বাবা তাকে চেনে না।একটু কাছেও ডাকেনি।কথাও বলেনি।সে শুধুমাত্র তার বড় মেয়েকে ভালোবাসে।তার দিকে ঘুরেও তাকায় নি।লাগবে না এমন বাবাকে।এক্ষুনি ঢাকা যাবে সে।কিন্তু বলতে আর পারলো কই।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৩

অশ্রুসিক্ত ঝাপসা চোখ দুটো তাকে লক্ষভ্রষ্ট করে দিলো।সিঁড়ির মাথায় পা দিতেই স্লিপ কেটে গেল।গায়ের ওড়না পায়ের তলায় পড়তেই টান খেয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গেল।মাথাটা গিয়ে লাগলো সিঁড়ির কোনায়।মুহুর্তে’ই নিস্তেজ হয়ে গেল শরীর টা।ছোট্ট দেহখানি গড়াতে গড়াতে পড়ে গেল সিঁড়ির শেষ সীমান্তে।কোমড় থেকে পা পর্যন্ত সিঁড়ির কোনায় ঝুলে থাকলেও মাথাটা পড়ে রইলো ফ্লোরের উপর।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৪