রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৭

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৭
সিমরান মিমি

পার্টি অফিস এখন থমথমে।আবহাওয়া শান্ত। তবে এই নিস্তব্ধতা প্রকৃতির স্বাভাবিকতার জন্য নয়।এটা ঝড় আসার পূর্বাভাস।একে কানাঘুঁষা চলছে রুমের পর রুম।শামসুল সরদারের বড় মেয়ে এসেছে শিকদার দের পার্টি অফিসে।এ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। একে একে দোতলা দিয়ে নেমে আসছে ছেলেপেলে।কেউ কেউ উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছে আসন্ন ঘটনাকে।স্পর্শী ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে পরশের দিকে তাকিয়ে রইলো।হাতদুটো তার বুকে বাঁধা।সামনের চেয়ারেই বসে আছে পরশ।বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাকে স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে ভেতরে সেও নানা অংক কষছে।মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল কিছুক্ষণ আগে বলা সেই মেয়েটার বাক্যগুলো,”ওহ আপনি,আমি আসছি মহাশয়।অপেক্ষা করুন।”

মুহুর্তেই তীর্যক দৃষ্টিতে পাভেলের দিকে তাকালো।এবারের ঝামেলা তো সে সৃষ্টি করেনি তাহলে এই মেয়ে পার্টি অফিস পর্যন্ত কেন চলে আসবে?নিশ্চয়ই পাভেল কোনো গোলমাল পাঁকিয়েছে।উফফফ!যন্ত্রণা। এই ডাকাত মেয়ে তার পেছনে লাগলো কেন?
স্পর্শী একভাবে দাঁড়িয়ে পরশের দিকে বিচক্ষণতার দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সামনের চেয়ার টা দেখিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বসতে পারি?”
পাভেল চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো।এ যেন স্বপ্ন।আহা! সেকি মধুর সুর।গানের ছন্দের মতো শান্ত কন্ঠে বলা”বসতে পারি?”।অদ্ভুত! এই মেয়ে এতো ভদ্রতা শিখলো কোত্থেকে? আচ্ছা, তাহলে কি এই দেখায় কোনো ঝগড়া হবে না?শুধুই কি শুনবে মধুর সুর।
পরশ স্পর্শীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে ইশারায় বসতে বললো।আশেপাশে ছেলেপেলেরা বিভিন্ন ফাঁক ফোঁকর দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে।সুজনের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল।সে যেন এই জগৎ এ নেই।এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে স্পর্শীর দিকে।পাত্তা দিলো না।সামনে বসা ভয়ংকর মানবীর উদ্দেশ্যে বললো,

“কি সমস্যা?”
স্পর্শীর কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।সে অন্যদিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করে বললো,
“আমি তো সেটাই জানতে এসেছি।আপনার সমস্যা টা কি?”
গম্ভীর কন্ঠে পরশ বললো,
“দেখো স্পর্শী,চুপচাপ এখান থেকে বের হয়ে যাও।সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে।আমি নতুন করে কোনো ঝামেলা পাঁকাতে চাই না।বরাবর এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি।তোমার মতো একটা অসভ্য মেয়ের সাথে নিজের নাম জড়িয়ে নিজেকে ছোট করতে চাই না।আশা করছি,লজ্জা থাকলে এরপর আমার আশেপাশেও ঘেঁষার চেষ্টা করবে না।বের হও।”

অবাক হয়ে গেল স্পর্শী।এতক্ষণের রাগটা তরতর করে বেড়ে উঠলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“ওহ হো হো!কি ভালো ব্যক্তিত্বের মানুষ টা আমার।যার সাথে আমার নাম জড়ালে ছোট হয়ে যাবে।এইইই,আপনার কি মনে হয়?আমি প্রেম করতে এসেছি আপনার সাথে।সিরিয়াসলি?নিজেকে কি ভাবেন? গভীর জলের মাছ।ডুবে ডুবে পানি খাবেন আর কেউ টের ই পাবে না।”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল পরশের।যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
“সং/যত হয়ে কথা বলো।এটা আমার অফিস।”
“তো আমি কি করবো?এটা আপনার অফিস বলে আমি আমার কথা বলবো না?মুখ বন্ধ করে রাখবো,কেন?আমাকে কি আপনার বাড়ি নিয়ে যাবেন এসব কথা শোনার জন্য?”
পরশ বিড়বিড় করে বললো,

“অসভ্য! ”
কর্ণগোচর হলো স্পর্শীর।গলার স্বর কে উচ্চে এনে বললো,
“আপনি অসভ্য। চরম লেভেলের অসভ্য। এই আপনি আমার বোনের পেছনে কেন লাগছেন?ওর টিচার হিসেবে পরিচয় দিয়ে ওর সাথে কি কথা বলছেন?কোনো লজ্জার ছিঁটেফোঁটা ও নেই নাকি আপনার মাঝে।আবারো আমার ফোনে ফোন দিছিলেন কেন?আমার বোনের ক্ষতি করতে চাইছেন?চেষ্টা করে দেখতে পারেন।আর্শির গায়ে টোকা লাগার আগেই সেই আঙুল আমি ভেঙে দিবো।শুনুন মিস্টার শিকদার,ক্রিমিনালি বুদ্ধিগুলো অন্যত্র খাটান।আমার ফ্যামিলির ধারে কাছেও আসবেন না।বলে দিলাম। আপনি কি ভেবেছেন,এমপি বলে আপনাকে ভয় পাবো?কুর্ণিশ করে কথা বলবো?মোটেও না।আপনি একটা চরম লেভেলের অসভ্য এমপি।সম্মান পাওয়ার মোটেই যোগ্য নন।বুঝেছেন?”

একাধারে চিৎকার করে ঝগড়া করতে করতে হাঁপিয়ে গেল স্পর্শী।ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে।কাঁশি ও উঠে গেছে।সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো হাতে পানির বোতল নিয়ে স্পর্শির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে পরশ।সামান্য অবাক হলেও পাত্তা দিলো না।এই সময় পানি খাওয়াটা খুবই প্রয়োজন।পরশের হাত থেকে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেল বোতল।মুখ খুলে ঢকঢক করে খেয়ে একবারে নিঃশ্বাস নিলো।পানির বোতল টা টেবিলে রাখতেই পরশের দিকে চোখ গেল।সে ঠোঁট কামড়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।অবাক হয়ে গেল স্পর্শী।আচমকাই এই হাসির কোনো কারন খুঁজে পেল না।পরশ স্পর্শীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে বসলো।এরপর নিচু স্বরে বললো,

“তুমি কি জানো বোতলটা আধখাওয়া ছিলো?আমিই খেয়েছিলাম।তাও বোতলের মুখে ঠোঁট লাগিয়ে।তুমিও সেইম ভাবে খেলে।খুবই রোমান্টিক ব্যাপার!আচ্ছা,পানির স্বাদে কি নতুনত্ব কিছু খুঁজে পেলে?”
বাকহারা হয়ে গেল স্পর্শী।মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।একবার বোতলের মুখে তো অন্যবার পরশের ঠোঁটের দিকে তাকাতে লাগলো।অন্যদিকে হাতের আঙুল দিয়ে অনবরত ঠোঁট ঘষতে লাগলো।সুজন আর বসে থাকতে পারলো না।সোফা থেকে উঠে পরশের উদ্দেশ্যে বললো,

“ভাই এই মেয়েটা কে?আর আপনাকে এভাবে অপমান কেন করছে?আপনিই বা কিছু বলছেন না কেন?”
এতোক্ষণে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো পরশ।পানির বোতল টা হাতে নিয়ে টোকা মারতে মারতে বললো,
“আরে তেমন কিছু না।শামসুল সরদারের বড় মেয়ে। বাবা নির্বাচনে হেরে গেছে শুনে হয়তো মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।ছুটে এসেছে আমার কাছে।অবশ্য এতোটা রাগের ও কিছু নেই।কতদিন’ই বা জাল ভোট দিয়ে জিতবে।তবে তার একটা ভুল হয়েছে।আধপাগল মেয়ে,কোথায় কখন কি করে বসে ঠিক নেই।অন্তত কিছুদিন বেঁধে রাখা উচিত ছিলো।”

তেঁতে উঠলো স্পর্শী। চিৎকার করে বললো,
“আপনি পাগল।আর জাল ভোটে আমার বাবা নয়, আপনি নির্বাচন করেছেন।অসভ্য এমপি।জংলীর মতো চুল।এরকম গুন্ডা, ক্রিমিনাল কে সাধারণ মানুষ কখনো ভোট দিবে না।
থেমে,
এই আপনার রাবার ব্যান্ড তো খুলে যাচ্ছে।ওতো বড়ো মেয়েদের মতো চুলে কি আর এতোটুকু ব্যান্ড আটকাবে।আপনি বরং এক কাজ করুন।এটা দিয়ে চুল গুলো বেঁধে রাখুন।পার্ফেক্ট হবে।”
বলেই নিজের খোঁপায় আটকানো কালো হেয়ার ক্লিপটা পরশের হাতে ধরিয়ে দিলো।ভীষণ অসহ্য লাগছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে।বারবার বোতলের কথা মনে পড়ছে।শেষে থমথমে পায়ে হেটে বাইরে চলে গেল।
পাভেল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।এরপর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,

“এটা কি হলো?”
পরশ হাতের হেয়ার কাঁটা একহাত থেকে অন্য হাতে ক্যাচ নিতে নিতে চেয়ারে বসলো।বললো,
“নতুন কিছুর স্বাদ পেয়েছে তো।তাই খুশিতে উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছে।”
দ্রুত পায়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো পাভেল।অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার মনে হচ্ছে আজকে প্রথম বার ঝগড়ায় আমরা জিতে গেছি।তাই না?”
শান্ত ভঙ্গিতে পাভেলের দিকে তাকালো পরশ।পরক্ষণেই খপাৎ করে মাথাটা টেবিলের নিচে চেপে ধরলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“দ্বিতীয়বার যদি তুই ওই মেয়েকে কোনোরকম কন্টাক্ট করিস;আল্লাহর কসম!সেদিন তোর ফোন আমি চৌদ্দ টুকরা করবো।”

রাগে সারা গা জ্বলে যাচ্ছে স্পর্শীর।সারা গায়ের রক্ত যেন টগবগ টগবগ করে ফুঁটছে।কতটা অপমান করলো ওই শিকদার।তার বাবাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছে।তাকে পাগল বলেছে।এঁটো পানি খাইয়েছে।তার উপর সেটা আবার প্রকাশ ও করেছে সবার সামনে। উফফফফ!ইচ্ছে করছে ঠোঁট দুটোই ছিঁড়ে ফেলতে।পরক্ষণেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,

“নাহ এমন কিছুই হয় নি।ওই লোক তাকে রাগানোর জন্য এসব বলেছে।আর যদি বোতলে মুখ লাগিয়ে খেয়েও থাকে তাতেই প্রবলেম নেই।সে খেয়ে বোতলের মুখ লাগিয়ে রেখেছে অনেকক্ষণ।ঠোঁটের ছোঁয়া নিশ্চয়ই মুছে গেছে।”
স্পর্শীর রাগের উপর তেল ছিটিয়ে দিতে যেন সৃষ্টিকর্তা উঠেপড়ে লেগেছে।সারা রাস্তা হেটেও কোনো রিকশা পেল না।আজব সবাই কি একসাথে প্লান করেছে নাকি তাকে হেনস্তা করার।অদ্ভুত! সব রিকশাওয়ালা কি একসাথেই যাত্রী পেয়ে গেছে।ভাবতে ভাবতেই ফোন বেজে উঠলো।হাতে উঠাতেই দেখলো স্ক্রিনের উপর জ্বলজ্বল করে অনন্দা লেখা টা ভেসে উঠেছে।নিশ্চয়ই ভার্সিটির কোনো খবর জানাবে।নিজেকে শান্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো স্পর্শী।এরপর আলতো হাতে রিসিভড করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে বললো,

“কিরে? তুই কই আছিস?খোঁজ’ই তো নেই।”
-পিরোজপুরে। কেন বলতো?
অনন্দা অবাক হলো।বললো,
“ওখানে কার কাছে উঠেছিস?”
স্পর্শী সময় নিলো।এরপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“বাবার বাড়িতে উঠেছি।আর কোনো প্রশ্ন করবি না।মাথা গরম আছে।কি জন্য ফোন দিয়েছিস সেই পয়েন্টে আয়।”
অনন্দা ভেংচি মারলো।ওপাশ থেকে স্পর্শী দেখলো কি দেখলো না সে ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয় সে।কিন্তু স্পর্শীর এই কথার বিপরীতে অবশ্যই একটা ভেংচি মারা উচিত।এরপর সিরিয়াস কন্ঠে বললো,

“সামনে সপ্তাহে সেমিস্টার।নোটিশ দিয়ে দিয়েছে।পেইজে চেক করে দেখ।এটা জানাতেই ফোন দিলাম।আর তোর মাথা কি কখনো ঠান্ডা ছিলো?আমি তো অলটাইম ই শুনেছি মাথা গরম,মাথা গরম।”
বলেই কেটে দিলো ফোন।হয়তো অভিমান করেছে।করতেই পারে।করাটাই স্বাভাবিক।স্পর্শীর সামান্য খারাপ লাগলো।কিন্তু এই মুহুর্তে ওই অভিমান ভাঙাতে একটুও ইচ্ছে হলো না। যার দরুন ফোন টা পার্সে ঢুকিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো।এর মধ্যেই পেছন থেকে এক রিকশাওয়ালা হর্ণ বাজালো।উঠে গেল স্পর্শী।এই মুহূর্তে হাঁটতে মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না।

বাড়ি ফিরে সরাসরি রুমে চলে গেল।পিপাসা দেখতেই পেছন পেছন এগিয়ে এলো।কোথায় গেছিলি,কেন গেছিলি,কার কাছে গেছিলি, ইত্যাদি নানা সব প্রশ্ন করতে লাগলো অনবরত।মায়ের কথায় কোনোরুপ সাড়া না দিয়েই ঢুকে গেল বাথরুমে।ঠোঁট ধুতে হবে।না না, শুধু ঠোঁট নয়।গোসলই করবে সে।মাথাটা যে পর্যায়ে গরম হয়ে আছে তাতে এই মুহুর্তে গোসল করাটাই শ্রেয়।বেশ ঘন্টাখানেক ধরে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে বাইরে এলো। মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে অলস ভঙ্গিতে বিছানায় গা ভাসালো।এরপর কলাগাছের মতো পড়ে থাকলো সারা দুপুর।
সারা বাড়ি আমেজে ভর্তি। অতিরিক্ত চিৎকার, হৈ-হুল্লোড় এ ঘুম ভেঙে গেল স্পর্শীর।দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো। মাথার তোয়ালে আরো আগেই খুলে বিছানায় পড়ে আছে।সেটাকে বারান্দায় মেলে দিয়ে এলোমেলো ভেঁজা চুলে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।আলতো পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলো উৎফুল্ল আর্শি নতুন ফোন হাতে সারা বাড়ি লাফাচ্ছে আর সবার ছবি তুলছে।বাবা সামনেই সোফায় বসে হাসছে।যেন এক অপূর্ণ তৃপ্তি পাচ্ছেন তিনি।স্পর্শী এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশে বসলো।এরপর ঘুমঘুম কন্ঠে বললো,

“আমার জন্য কি এনেছো?”
বোকা চাহনিতে মেয়ের দিকে চাইলেন শামসুল।এরপর হেয়ালি করে বললেন,
“তোমার তো ফোন আছে মামুনি।তাই তো আনিনি।”
থেমে বললেন,
“এই তো ফুচকা এনেছি প্রায় পনেরো প্লেটের মতো।দু-বোন মিলে খাও।”
স্পর্শী আলতো হাসলো।প্যাকেট খুলে ফুচকা বের করে খালি একটা ফুচকা মুখে দিলো।মুহুর্তেই হো হো করে হেসে উঠলো শামসুল। পাশ থেকে ল্যাপটপ টা বের করতেই চমকে গেল স্পর্শী।অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
“তুমি কি করে জানলে আমার ল্যাপটপ লাগবে?”
ছুটে আসলো আর্শি। হেয়ালি করে বললো,

“আমি বলেছি,আমি বলেছি।আব্বু আমার ফোন কেনার পর বলেছি আপুর জন্য ল্যাপটপ নাও
ও অনেক দিন ধরে একটা ল্যাপটপ কিনতে চাইছে।মায়া করে দায়িত্ব নিয়ে বলেছি।অথচ তুমি কি কখনো আমার কথা বলতে মনে করে?বলতেই না,বরং এই যে ফোন কিনে দিয়েছে তাতেই খুশি নও।”
হাসলো স্পর্শী।মুহুর্ত খানিক কাটার পর শান্ত কন্ঠে মাকে ডাকলো।বললো,
“মা, কাল সকালে আমি ঢাকায় যাচ্ছি।এক্সাম নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন। সামনে সপ্তাহে এক্সাম শুরু।আর্শির পরিক্ষাও এগিয়ে আসছে।ওকেও নিয়ে যাচ্ছি আমি সাথে।”
হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি এতোক্ষণে অমাবস্যার চাঁদের ন্যায় করে ফেললো আর্শি।ছুটে গিয়ে বাবার ডান পাশে বসলো।আহত কন্ঠে বললো,

“আব্বু,আমি যাবো না। আমি তোমার কাছে থাকবো।আমার এক্সাম এখনো দেড় মাস পর।আপুকে বলে দাও ওর এক্সামের পর আমার বই খাতা নিয়ে আসতে।আমি এখানে বসে পড়বো।তারপর গিয়ে পরিক্ষা দিবো।আমাদের সাভার কলেজের এইচএসসিতে বেশিরভাগ স্টুডেন্টের সিট ‘ই তো জাহাঙ্গীর নগরে পড়ে।সমস্যা হবে না।আমি তোমার কাছে থাকবো।আমি আর ঢাকা যাবো না। ”
আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলেন শামসুল সরদার। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার মাকে আমার থেকে দূরে রাখবোই না।আমার মা আমার কাছেই থাকবে।কোথাও যাবে না।”
ক্ষান্ত হলো না স্পর্শী।কিন্তু বাবার সাথে পেরে উঠলো না।শেষে বাধ্য হয়েই একা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। দুপা এগিয়ে সামনে এলো পিপাসা। আলতো হেসে বললো,

“আমিও যাবো তোর সাথে।অনেক তো থাকা হলো তোদের সাথে।এবার নিজের ঠিকানায় চলে যাই।পার্লার টাও বেশ কদিন ধরে বন্ধ আছে।তোদের বাবার কাছে পৌছানোর দায়িত্ব ছিলো,পালন করেছি। এখন চলে যাওয়া উচিত।”
স্পর্শী বাবার দিকে তাকালো।কিন্তু তিনি নিরব।আশাহত হলো স্পর্শী।বাঁধা দিলো না মাকে।তাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে নাক গলানো উচিত নয়। নিজেদের ব্যাপার টা তারা নিজেরাই বুঝুক।মায়ের কথায় সায় দিলো স্পর্শী।মুহুর্তেই পুণরায় থমথমে হলো সরদার বাড়ি।এই থমথমে পরিবেশে দ্রুতপায়ে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সোভাম।ড্রয়িংরুমে সবাই কে উপস্থিত দেখতেই দাঁড়িয়ে পড়লো।নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিলো।এরপ র ত্রস্ত পায়ে সোফায় বসলো।স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“শিকদার দের পার্টি অফিসে কেন গিয়েছিলে তুমি?”
স্পর্শী অবাক হলো না।কারন সে জানতো একথা বাবা-ভাইয়ের কানে অবশ্যই আসবে।সে সমস্ত উত্তর আগেই ভেবে রেখেছিলো।শান্ত কন্ঠে বললো,
“একটু কাজ ছিলো।ব্যক্তিগত। ”
স্তব্ধ হয়ে গেলেন শামসুল।গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“তুমি পিরোজপুর ঢোকার পরেই জেনেছো শিকদার -সরদারদের মধ্যে ঝামেলা চলছে।তাও তাদের অফিসে ঢুকেছো কেন?”
বাবার দিকে তাকালো স্পর্শী।এরপর শান্ত কন্ঠে বললো,

“আব্বু,তোমার রাগ করার কারন অহেতুক।কেননা,আমি মাত্র ক’টা দিন হলো নিজের পরিচয় জেনেছি।শিকদারদের সাথে যে আমাদের শত্রুতা সেটা মাত্র কদিন আগেই জেনেছি।এক্ষেত্রে দোষ টা আমার নয়।”
সন্দেহের দৃষ্টিতে স্পর্শীর দিকে তাকালো সোভাম।বললো,
“পরশ শিকদারের সাথে তোমার কি কোনো সম্পর্ক আছে?প্রেম বিষয়ক।”
স্তব্ধ হয়ে গেল স্পর্শী।চোখের পলক পড়ছে না তার।একদৃষ্টে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনার সন্দেহ শক্তি ভীষণ ই দুর্বল ভাইয়া।কোন আক্কেলে মনে হলো ওই গুন্ডা,জংলী লোকটার সাথে আমি প্রেম করবো। হাস্যকর ব্যাপার!”

কিছুটা শান্ত হলো শামসুল।মন টা যেন কিছুটা তৃপ্তি পেয়েছে।এ পর্যায়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে কি এমন প্রয়োজন পড়লো মামুনি যে তুমি ওর অফিসে গেছো?”
স্পর্শী কথা সাঁজিয়ে নিলো।আর্শির ব্যাপার টা কোনোমতেই তোলা যাবে না।তাহলে দেখা যাবে জল ঘোলা করতে করতে ওকে যে তিন দিন আটকে রেখে ছিলো সেটা ও বের হয়ে যাবে।সাভারের সবাই জানুক।সমস্যা নেই।কিন্তু বাড়ির কাউকে জানাবে না স্পর্শী।এতে তার বোনের সম্মান জড়িয়ে আছে।বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“আব্বু পরশ শিকদারের ভাই পিয়াশ শিকদার।ও আমাদের ভার্সিটিতেই পড়তো।ক্যারেক্টারলেস ছিলো ছেলেটা।আমার পেছনে ঘুরঘুর করতো।নেশাও করতো।ও খুন হয়ে ছিলো রিসেন্টলি।ওর বন্ধুরা করেছিলো খুন।কিন্তু পরশ শিকদার আমাকে দোষী বানিয়েছিলো।ভেবেছিলো আমি ওর ভাইকে ভার্সিটির সবার সামনে মেরেছিলাম বলে পিয়াশ আত্মহত্যা করেছে।সেই থেকে আমার সাথে শত্রুতা।প্রায়সময়েই আমাকে হুমকি দেয়।আর আমিও শাসিয়ে আসি।আজকেও সে জন্যই গিয়েছিলাম।”

চোখের পলক পড়ছে না সোভামের।অবাক হয়ে বললো,
“তুমি পিটিয়েছো পিয়াশ কে।ভয় লাগেনি?ও যদি তোমার কোনো ক্ষতি করতো?কিভাবে পেটালে?”
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো স্পর্শী। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“কিভাবে পিটিয়েছি সেটা তো বলে বোঝানো যাবে না।প্রাকটিক্যালি দেখাতে হবে।”
চেঁচিয়ে উঠলো আর্শি।সোভাম ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৬

“ভাইয়া,আপনি জানেন না।আপুকে আমাদের ওখানের অনেকেই ভয় পায়।সবাই লেডি গুন্ডা বলে।কথায় কথায় সবাইকে মারে ও।ভয়ঙ্কর মহিলা।”
গালে হাত দিয়ে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে রইলো সোভাম।শান্ত কন্ঠে বললো,
“এই শরীর নিয়ে আবার মারামারি ও করো।বাহ!শামসুল সরদারের যোগ্য কন্যা।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৮