রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৮

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৮
সিমরান মিমি

সরদার মঞ্জিল।ঘড়ির কাঁটায় তখন মাত্র সাত’টা।রৌদ্রজ্জ্বল সকালে পুরো বাড়ি যেন নিস্তব্ধ।শুধু শোনা যাচ্ছে রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ।হ্যাঁ, সোনালী টিফিনে খাবার ভরছে স্পর্শীদের দেওয়ার জন্য।আর স্পর্শী সোফার উপর তার ব্যাগ রেখে পাশে বসে নুডুলস খাচ্ছে।দুরেই টেবিলে পিপাসা বসে আছে।খাবার খাওয়ার সাথে সাথে আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে।বড্ড আশা ছিলো,সে যাওয়ার কথা বললে নিশ্চয়ই শামসুল সরদার তাকে আটকে দেবে।হয়তো অধিকার খাটিয়ে বলবে,

“স্পর্শীর নাহয় পরিক্ষা।সে পরিক্ষা দিতে যাবে।কিন্তু তুমি যাচ্ছো কোথায়?তোমার ও কি পরিক্ষা?ওসব পার্লার -টার্লার বিক্রি করে বাড়িতে চলে আসো।বউদের মতো সংসার সামলাতে ব্যস্ত হও।তোমার এতো ইনকাম করতে হবে না।”
কিন্তু নাহ। তার থেকে কোনোরকম টুঁ শব্দটিও পায় নি পিপাসা।ভীষণ লজ্জা লাগছে তার।কেন এলো এই বাড়িতে।এসেছে ভালো কথা,কিন্তু থাকতে কেন গেলো?কোন আশায় থাকলো?লোকটা যে আগের মতো নেই।বদলে গেছে।তার ভালোবাসাও বদলে গেছে।তার তৃষ্ণা থাকলো কি না থাকলো, বাঁচলো কি মরলো এসবে কোনো রকম কিচ্ছু আসে যায় না তার।কিচ্ছু না।
ভাবতে ভাবতেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাড়া দিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তাড়াতাড়ি খা।বাস যে ছেড়ে দেবে।”
চমকে উঠলো সোভাম।বোন আজকে চলে যাবে বলে সে নিজেও বাড়িতে রয়ে গেছে।স্পর্শীর উদ্দেশ্যে বললো,
“সেকি,তোমরা বাসে করে কেন যাচ্ছো?বাড়ি তে গাড়ী আছে, ড্রাইভার পৌছে দিয়ে আসবে।”
শামসুল নিজেও অবাক। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মামুনি,গাড়ি থাকতে বাসে কেন যাবে?”
স্পর্শী কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।সে তো মাকে বলেনি বাসে করে যাবে।বরং বাড়িতে চার চার টা গাড়ি।ড্রাইভার ও আছে দুজন।তাহলে বাসে যাওয়ার প্রশ্নই বা উঠছে কেন?
মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

“মা,বাসে তো অনেক দেরী হবে যেতে।তাছাড়া তুমি নিজেই তো অসুস্থ হয়ে যাও।আমরা বরং গাড়িতেই যাই।”
তৎক্ষণাৎ উঠে বসলো পিপাসা।মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“ওহ,আমি তো ভুলেই গেছিলাম তোদের বাবার অনেক গুলো গাড়ি আছে।এসব থাকতে বাসেই বা কেন যাবি।ঠিক আছে, তুই থাক।ধীরে ধীরে গাড়িতে চলে আসিস।আমি বরং বাসেই যাই।আর তো আধ ঘন্টা বাকি।এরমধ্যে বাস এসে পড়বে।আমি কাউন্টারে চলে গেলাম।”

বলেই নিজের লাগেজ হাতে নিলো।মুহুর্তেই খপ করে হাত ধরলো স্পর্শী।মাকে অনুনয় করে বললো,
“মা প্লিজ।অন্তত যাওয়ার সময় এমন করো না।একটা বার ই তো।আমার সাথে গাড়িতেই চলো।”
শুনলো না পিপাসা।কিছুতেই মানলো না স্পর্শীর কথা।রুষে উঠলো শামসুল।স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার মা হয়তো আমার গাড়িতে যেতে চাইছে না।ওকে,সমস্যা নেই।বাসের ভাড়া আটশো আমার ড্রাইভার কে দিয়ে যেতে বলো।ভাড়া ছাড়া কাউকে গাড়িতে তুলবে না মফিজ।আমার মামুনির জন্য না হয় এক দিন পেসেঞ্জার উঠালো গাড়িতে।”

হাসি পেল স্পর্শীর।কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো।ইতোমধ্যে সোনালী বেগম টিফিন নিয়ে হাজির।যেতে যেতে দুপুর হয়ে যাবে।এতখানি পথ জার্নি করে কিছুতেই রান্না করে কুলাবে না।সেই জন্যই সেই ভোরে উঠে ভাত-মাংস রান্না করেছেন তিনি।সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সদর দরজার সামনে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়লো স্পর্শী।মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“আর্শি কোথায় মা?”
পিপাসা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ঘুমাচ্ছে।বললাম আমরা যাচ্ছি, তুই নিচে আয়।কিন্তু শুনলো না।ওভাবেই শুয়ে রইলো।বললো, নিচে নামলে নাকি তুই ওকে টেঁনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবি।”
চিন্তিত হলো স্পর্শী।তার ভালো লাগছে না মোটেও।কেমন এক অজানা চিন্তা বেঁধে ধরেছে তাকে।বাবার উদ্দেশ্যে অনুনয়ের সুরে বললো,

“আব্বু,ওকে নিয়ে যাই।এখানে থাকলে ওতো পড়বেই না ভালো করে।”
শুনলেন না শামসুল।বললেন,
“সপ্তাহ খানেক’ই তো।থাকুক না আমার কাছে।এরপরেই তো এক্সাম।আমি পড়াতে বসাবো সময় করে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পর্শী।তার চিন্তিটা আব্বুকে কিছুতেই বোঝাতে পারবে না।আর খুলে বললেও বিস্তর এর ঝামেলা হবে।ব্যাগ নিচে রেখে ছুটে এলো উপরে।আর্শির রুমে ঢুকেই দরজা আটকালো।বিছানা থেকে টেনে তুলে কঠোর সুরে বললো,

“একদম ঢং করবি না।আমি জানি তুই জেগে আছিস।সারা রাত ফোন টিপেছিস সেটাও জানি। আমি তোকে লাস্ট বার সাবধান করছি আর্শি,এই পাভেল ভাই আর তার ওই স্পেশাল ভোট চোর পরশ ভাই,কোনো ভাইয়ের সাথেই কোনো রকম কন্টাক্ট রাখবি না।কেউ রঙ নম্বরে ফোন দিলে কথা বলবি না।বাড়ির বাইরে তো বের হবিই না।মনে থাকে যেন।কোনো রকম যদি কোনো গোলমাল পাঁকিয়েছিস না তো তোকে আমি ন্যাড়া করে দিবো চামচিকার বাচ্চা।এইতো এই সপ্তাহ টা।এরপর’ই আসছি আমি।কি ভেবেছিস আব্বু তোকে বাঁচাবে?হুহ,তোর আব্বু আমাকে না চিনলেও তুই ঠিক ভালো করেই চিনিস আমায়।কোনো রকম উলটো পালটা কিছু করলে তোর কি অবস্থা করবো আমি ভেবেও পাবি না।”
থেমে শ্বাস নিয়ে,

“গেলাম আমি।ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবি।রাত বারোটার পর আর জাগবি না।ওকে।বায়!”
বলেই দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে এলো।স্পর্শী যাবার পরমুহূর্তেই ভেংচি মারলো আর্শি।এরপর পুণরায় কাথার মধ্যে ঢুকে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো।
গেটের সামনে আসতেই অবাক হয়ে গেল স্পর্শী।ড্রাইভিং সিটে সোভাম ভাই বসে আছে।আলতো হেসে উঁকি দিয়ে টিটকারি মেরে বললো,
“সরদার বাড়ির ড্রাইভার নাকি আপনি?”
হেসে দিলো শামসুল সরদার। বললো,
“তোমার ভাইয়া ঢাকায়’ই যাচ্ছে।তাই আর ড্রাইভার কে নিচ্ছে না।”

আর কোনো কথা হলো না তাদের মধ্যে।বাবার থেকে দোয়া নিয়ে গাড়িতে বসলো।এরপর চলতে লাগলো চাকা।ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বড় রাস্তার দিকে।
নাস্তার টেবিলে ঠায় হয়ে বসে আছে পরশ।এই মুহূর্তে তার ভীষণ বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে টেবিল ছেড়ে সোজা রুমে চলে যেতে।কিন্তু পারছে না।কেননা,এই মুহুর্তে অস্বাভাবিক কিছু করলেই দাদি সারা বাড়ি মাথায় তুলবে।টেবিলে এই মুহুর্তে সবার আলোচনা পরশের বিয়ে নিয়ে।দাদি হলেন তাদের মধ্যমনি।তিনি খেতে খেতে আমজাদ শিকদারের উদ্দেশ্যে বললেন,

“নাতিডার উপর কিছুর নজর পড়ছে। তা না হইলে যেমনি বিয়ার কথা ওঠে, তেমনি একটা না একটা বাঁধা পড়ে।আইজ প্রায় কয় বছর হইয়া গেছে, কিন্তু এখনো বিয়াডা দিতে পারলাম না।প্রথমে কইলা তোমার ইলিকশন শেষ হইবে তারপর করবা বিয়া।ভালোয় ভালোয় শেষ হইলো ইলেকশন।এরপর কইলা নতুন নতুন এমপি হইছো সময় লাগবে সামলাইতে।দেলাম সময়।এরপর নাতিডা আমার মরলো(করুন কন্ঠে)।যাই হোউক,আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়া গেছে।এখন তো বিয়াডা করা উচিত।”
পরশ আসফাস করে উঠলো।এই বিয়া ব্যাপার টা নিয়ে সে কিছু ভাবতেই চাইছে না।এমন নয় যে সে কাউকে পছন্দ করে বা পুরবীকে অপছন্দ করে।কিন্তু তাও ভালো লাগছে না।মোট কথা এই মুহুর্তে বিয়ে সম্ভব না।মন সায় দিচ্ছে না।

আমজাদ শিকদার মায়ের মুখের দিকে তাকালেন।তার খুব শখ দুই নাতি-নাতনির বিয়ে দিবেন।পুরবীকেও তিনি পছন্দ করেন কিন্তু কিছু একটা বাঁধা দেয় মাঝখানে। পুরবীর মা তার একমাত্র বোন।সে এই বিয়েতে খুশি থাকলেও ভগ্নিপতি খুশি নন।তাকে দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোক পরশ কে পছন্দ করেন না।পরশের এই বেশভূষায় শিক্ষকরুপি ভগ্নিপতি খুবই বিরক্ত হোন।তবে যা বুঝলেন, তাতে মনে হচ্ছে স্ত্রীয়ের সাথে পেরে ওঠেন না তিনি।যার কারনেই বিয়েটা মাঝামাঝি ঝুলে আছেন।তিনি কখনো এই বিয়েতে রাজি সেটা বলেন নি।আর নাতো এই বিয়েতে রাজি না সেটা বলেছেন।দেখা,কথা হলেই ওই আলতো মাথা নাড়িয়েছেন।কিন্তু এই বিষয় টাতে হোঁচট খাচ্ছেন আমজাদ।কিন্তু মাকে বোঝাতে পারছেন না।তার মতে জহরুল আহমেদ স্বল্পভাষী।তাই তেমন একটা আমোদ-প্রমোদে দেখা যায় না।

একটু নড়েচড়ে বসলেন আমজাদ।মনে মনে বললেন,
“নাহ,এইবার যা বলার সরাসরি বলতে হবে।এতো এতো ঝামেলায় জিজ্ঞেস করা হয়নি।কিন্তু এবারে খোলাখুলি কথা বলতে হবে।সারাজীবনের একটা সম্পর্ক ;এভাবে ঝুলিয়ে তো রাখা যায় না।”
মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
“মা,পুরবীর তো আর মাস খানেকের মধ্যেই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের পরিক্ষা।এখনই যদি আবার বিয়ে নিয়ে……আমি বলতে চাইছি এতো ঝই-ঝামেলার মধ্যে কি মেয়েটা পড়ার সময় পাবে?নতুন সম্পর্ক, নতুন মানুষ এর মধ্যে মেয়েটা সামলাতে পারবে না।”
চমকে তাকালো পরশ।কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“প্রেমার থেকেও এক বছরের ছোট?

বাবা মাথা নাড়লেন।মুহুর্তেই মাথা গরম হয়ে গেল পরশের।খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
সিরিয়াসলি?ইন্টারে পড়ে?প্রেমার থেকেও ছোট।আব্বু এই এতটুকু একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলে কোন আক্কেলে?আশ্চর্য! আমার অর্ধেক বয়সের মেয়ে।না মেয়ের কি অভাব পড়েছে?বিয়ে করলে একজন ম্যাচিয়ুর, আমার সাথে মানানসই বয়সের মেয়ে কে করবো।কিন্তু তাই হলে এতো ছোট একটা মেয়ে?মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আমার।ফুপি এতটা মাথামোটা হলো কবে থেকে।ওদের কাছে কি ওদের মেয়ে বোঝা হয়ে যাচ্ছে যে এতটুকু মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।এরকম হলে আজকেই গিয়ে পুরবীকে নিয়ে আসবে।ছোট বোনের মতো করে বড় করবো।প্রেমার সাথে থাকবে,খাবে, বড় হবে।দ্বিতীয়বার আর বিয়ের কথা বলবে না।”
মাথায় বাজ পড়লো মমতাজ বেগমের।আয়হায় করতে করতে বলে উঠলেন,

“এইডা কি কথা কইলা দাদুভাই?তোমারে আংটি পড়াইলো তখন ও তো কিছু কইলা না।”
“হ্যাঁ বলি নি কারন আমি অনেক বছর আগে পুরবীকে সরাসরি দেখেছি।এতো এতো ঝামেলায় কখনো ওর বয়সের দিকে খেয়াল হয়নি।ছবি দেখিয়েছো তুমি।ফটো দেখে কি বয়স বিবেচনা করা যায়?আর আংটির কথা বলছো?ওটা ড্রয়ারে আছে।ফেরত দিয়ে দিবো তোমায়। ”
আশাহত হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন মমতাজ।বললেন,
“আমার কত্ত সাধ ছিলো ছেলের নাতির লগে মাইয়ার নাতির বিয়া দিমু।থাক,দরকার নাই।আমার তো বয়স হইয়া গেছে।আমার কথার কি এখন কোনো মূল্য আছে?তোমরাই তো এখন সব।একজন এমপি,আরেকজন সাবেক এমপি।”

বিরক্ত হলো পরশ।বললো,
“তো ভালো কথা।আমাকে নিয়ে পড়ে আছো কেন?নাতি তো তোমার আরো একজন আছে।পাভেল কে বিয়ে দিয়ে দাও।ওর বয়স মাত্র পঁচিশ।মেয়ের চেয়ে যদিও আট বছরের বড়।কিন্তু তাও মানানসই হবে।দিয়ে দাও বিয়ে।তোমার আশা পূর্ণ হবে।”
বলেই রুমের দিকে হাঁটলো।খুঁক খুঁক করে কেঁশে উঠলো পাভেল।ভাইয়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।দাদি এখনো বিলাপ ছুঁড়ছেন।হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মত পালটে পাভেলের উপর পড়বে। এইবার তিনি ছোট নাতির বিয়ে দিতে আগ্রহী হবেন হয়তো বা।

আমজাদ শিকদার উঠে বসলেন।ভালো লাগছে না তার।এসব কি ধরনের কথা।আংটি পড়ানোর এতোদিন পর হুট করে তিনি কি করে বলবেন বিয়ে ভাঙ্গার কথা?চিন্তায় পড়লেন ভীষণ।
সকাল এগারোটা।ক্রমাগত একটানা বৃষ্টির পর আজকে রোদ উঠেছে।সে কি তেজ সূর্যের?মনে হচ্ছে এ কদিনের সমস্ত উত্তপ্ততা একদিনে প্রদান করছে ধরনীতলে।রাগ,কান্না,অভিযোগ,অভিমান সব কিছুর সংমিশ্রণে মুখখানি করে রেখেছে আফিফা। হনহন করে হেটে গেল শিকদার বাড়ির দোতলায়।একেধারে ডাকতে লাগলো মা,ভাইজান,ভাবি বলে।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পিয়াসা।সামনে তাকাতেই মাথায় আচল দিলেন।জহরুল আহমেদ ও স্ত্রীয়ের সাথে এসেছেন।মনে মনে খুশি হলেও তিনি মুখ খানি গম্ভীর করেই রেখেছেন।পিয়াসা আথিতেয়তার সাথে তাদের সোফায় বসালেন।এর মধ্যেই নেমে এলেন আমজাদ শিকদার। পেছনে মমতাজ বেগম ও আছেন।
তাদেরকে দেখতেই আফিফা বললো,
“ভাইজান,মা এসব কি বলছে?পরশ নাকি পুরবী কে বিয়ে করবে না?সে নাকি মা’র কাছে আংটি ফেরত দিয়েছে?
এরমধ্যেই আঁচলে কোনায় গিট দেওয়া আংটিটা বের করে আফিফার হাতে দিলেন মমতাজ।মুহুর্তেই কান্না করে দিলো আফিফা।রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,

” আমার মেয়েটার জীবন নিয়ে খেলতে আপনাদের একটুও খারাপ লাগলো না ভাইজান।ওকে পছন্দ না হলে শুরুতেই জানিয়ে দিতেন।এইভাবে আংটি পরানোর পর বছরকে বছর আমাদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তারপর বলার কি আছে?আমার মেয়ে কি ফেলনা?ওকে আপনার ছেলের থেকেও ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দেব আমি।দেখে নিয়েন।”
আমজাদ শিকদার নড়েচড়ে বসলেন।সবাই শান্ত হওয়ার পরে আফিফার উদ্দেশ্যে বললো,

“সেরকম কোনো বিষয় নয় আফি।তোরা পরশ কে ভুল বুঝছিস।হ্যাঁ, ছেলেটা একটু রাগী।হুটহাট ডিসিশন নেয়।কিন্তু ভুল কিছু করে নি।ভেবে দেখলাম।তোর মেয়ের বয়স কত?মাত্র ষোলো বা সতেরো।কিন্তু পরশের বয়স উনত্রিশ ছাড়িয়ে গেছে।প্রায় বারো বছরের বড়।ওর সাথে আমি কথা বলেছি কিছুক্ষণ আগেই।যা বুঝলাম ও ভুল কিছু বলেনি।পুরবী আজ অনেক বছর হয়েছে আমাদের বাড়িতে এসেছে।প্রায় বছর পাঁচেক হয়েছে।মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছিস,হোস্টেলে থাকে।সে জন্যই নানা বাড়ি থেকে দূরে থেকেছে এতোবছর।এই জন্যই ফুফাত বোন হওয়া সত্ত্বেও ওর ব্যাপারে পরশ বা পাভেল কিছুই জানে না।

মায়ের ইচ্ছা ছিলো নাতি-নাতনীর বিয়ে দেবে।হুট করেই বিয়ের আলোচনা।পরশের কোনো মেয়ের সাথে সখ্যতা নেই বলেই আমি জানি।যার কারনে বিয়েতে অমত করেনি।মেয়ের ছবি দেখিয়ে আংটি পড়িয়ে গেছিস।এর পরে আবার নানা ঘটনায় বিয়ে পিছিয়ে গেল।পুরবীর বয়স সম্পর্কে পরশের কোনো ধারনাই ছিলো না।সকালে যখন জানলো তখন রেগে গেছে।রাগার ই কথা। আমার’ই বোঝা উচিত ছিলো।তোর মেয়েই বিয়ের ক’দিন পর বলবে বাপ-মা বয়সের দ্বিগুণ একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে।ছেলে বুঝদার অথচ মেয়ে বাচ্চা। সংসারে অমিল হবে,ঝগড়াঝাটি হবে।এরপর ভাইবোনের সম্পর্কে চিঁড় ধরবে।কি দরকার এসবের?যদি বয়স টা ঠিক থাকতো তাহলেও কোনো কথা ছিলো না।”

এতোক্ষণে মুখ খুললেন জহরুল আহমেদ।আমজাদ শিকদারের কথায় সায় দিয়ে বললেন,
“আমিও সেটাই বলতে চেয়েছিলাম ভাইজান।শুরু থেকেই এই সম্পর্কে আমার মত ছিলো না।শুধুমাত্র ওর মা আর আপনার জন্য নিশ্চুপ ছিলাম।যদি রাগ করেন।সেজন্য কিছু বলি নি।একটা মাত্র মেয়ে আমার।এতটুকু বয়সে বিয়ে ভাবতেই খারাপ লাগে।যদি পাভেল হতো তাও একটা কথা ছিলো।”
আনন্দিত হলো মমতাজ বেগম।উৎফুল্ল হয়ে জামাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তাইলে সেই কথাই থাক।আমার নাতনীরে আমি ছোত নাতীর লাইগা এই বাড়িতে আনমু।”
আমজাদ শিকদার ও মত দিলেন।কিন্তু বেঁকে বসলেন জহরুল।বললেন,

“ঠিক আছে।কিন্তু মেয়ে তো আমার অনেক ছোট।আরো বছর দুয়েক আমার কাছে থাকুক।ছেলে মেয়ে তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।মেয়েও আরেকটু বুঝদার হোক।ছেলেও প্রতিষ্ঠত হোক।এরপর বিয়ে।তাহলে এই কথাই রইলো।”
সবাই একপ্রকার পাঁকাপাকি কথা বলে তবেই উঠলো।
ঘড়ির কাঁটা তখন একটাকে ছাড়িয়েছে।সূর্যের অবস্থান এখন সরাসরি মাথার উপর অবস্থান নিয়েছে।সোসাইটি গেটের সামনে গাড়ি থামালো সোভাম।এদিক টা না চিনলেও স্পর্শী চিনিয়ে এনেছে।গাড়ি থেকে নামতেই স্পর্শী সোভামের হাত ধরে টেনে নামালো।বললো,
“বাসায় চলুন ভাইয়া। দুপুরে খেয়ে তারপর না হয় কাজে যাবেন।”
আলতো হাসলো সোভাম।বললো,

“নাহ,থাক।তোমরা যাও।আমি আসছি।”
এগিয়ে এলো পিপাসা।সোভামের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“চলো না বাবা।অনেকক্ষণ তো গাড়িতে ছিলা।ক্লান্ত হয়েছো নিশ্চয়ই।এসো।”
সোভাম অসস্তিতে পড়লো।বললো,
“না থাক আনটি।তার দরকার নেই।”
মানলো না পিপাসা।কিন্তু জোর খাটাতেও কেমন ভয় হচ্ছে।কি না কি মনে করে।কিন্তু তাও চুপ থাকলো না।আদুরে কন্ঠে বললো,

“এসো না।মায়ের কাছে কিছুক্ষণ থেকে যাও।সৎ মা বলে থাকতে খারাপ লাগছে বুঝি।”
হাসলো সোভাম।এরপর দুপা কাছে গেলো পিপাসার।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“সৎ মা তো সৎ মাই হয় আনটি।সৎ ছেলেও কখনো আপন সন্তান হয় না।হলে সেই উনিশ বছর আগে আপনার নিজের সন্তান দের সাথে আমাকে ও সাথে নিয়ে যেতেন।অবশ্য নিবেন ই বা কেন?আপনি তো আমার জন্যই চলে এসেছেন রাগ করে।জানেন তো,এই মা শব্দটাই ঘৃণা করি আমি।যেখানে নিজের মা’ই স্বার্থপর হয় সেখানে সৎ মা হয়ে আপনিই বা কি করবেন?

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৭

সোভামের ঠোঁট কাঁপছে।প্রতিটা কথার সাথে সাথে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।বেশ কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে পিপাসার দিকে ছলছল চোখে তাকালো।করুন কন্ঠে বললো,
” নিজের সন্তানের মতো শাসন,আদর দিয়ে আপনি কি আমায় বড় করতে পারতেন না? আমার মা তো চলেই গেছিলো নিজের সুখ খুঁজতে।আচ্ছা,আমাকে ওতো ছোট দেখে কখনো কি আপনার মায়া হয়নি?কখনো কি ইচ্ছে হয়নি ‘এই ছোট্ট মা ছাড়া ছেলেটার মা হয়ে ওকে সন্তানের মতো বড় করবো?’

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৯