রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৪৩ (২)
সিমরান মিমি
শখের ফোন টা পড়ে আছে অবহেলায়।বিছানার একদম কার্ণিশে চাঁদরের সাথে পেঁচিয়ে। আর একটু হলেই সেটা পড়ে যাবে ফ্লোরে।বালিশের উপর মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে আছে স্পর্শী।চোখ দুটো বন্ধ। কার্ণিশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।তবে সেটা নিঃশব্দে।তার ফোন বন্ধ।আইডি ট্যাগ করে এত্তো এত্তো পোস্ট।এতোগুলো সিম।অথচ সবক’টা বন্ধ।আচ্ছা,সিমগুলো স্পর্শী জানে বলেই কি সে বন্ধ করে রেখেছে।নিশ্চয়ই নতুন সিম ইউজ করছে।যাতে ওই মেয়েটা এসব ব্যাপারে জানতেও না পারে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পর্শী।কিই বা জানবে মেয়েটা?তারা তো প্রেম করছিলো না।প্রথম থেকেই সম্পর্ক টা ছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত,অবাঞ্ছিত।
রাত প্রায় আট’টা বেজে গেছে।আর কিছুক্ষণ পর’ই হয়তো মা এসে যাবে।ফোনটাকে শেষ বারের মতো হাতে নিলো।পরিচিত নাম্বার গুলো আবার ও ট্রাই করতে লাগলো। কিন্তু ফলাফল শূন্য।ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরছে।সময় গড়িয়ে পড়ছে মধ্যরাতে।আর কিছুক্ষণ।আর তো মাত্র কয়েক ঘন্টা।যেখানে বিয়েটা আজ’ই হয়েছে সেখানে নিশ্চয়ই বাসর টাও আজ।এইতো দশটা বেজে যাবে ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই।গত কয়েকদিনে নিজের সবচেয়ে কাছের ভাবা মানুষ টা আজ অন্য নারীর সান্নিধ্যে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অন্যকারো মাঝে হারাতে ব্যস্ত থাকবে সে।আচ্ছা,ওনার কি স্পর্শীর কথা একবার ও মনে পড়বে না?ওই কক্সবাজারে কাটানো সময়গুলোকেও কি মিস করবে না?কখনো কি মনে হবে না স্পর্শীয়া সরদার নামক কোনো নারীকে।যাকে নাকি সে ভালোবেসে ছিলো। নাহ!পড়বেই বা কি করে?আজ বিয়ে হয়েছে,এরপরে বাসর।এরপরের দিনগুলো সুখে শান্তিতে সংসার করবে।নিজের স্ত্রীয়ের জন্য রাজনীতির বাইরে সময় খুঁজতে থাকবে বাড়িতে আসার জন্য।কিছুদিন পর হয়তো কোনো বাচ্চা ও হয়ে যাবে।তারপর?তারপর কি হবে?স্পর্শী নামক কারো অস্তিত্বই থাকবে না।আচ্ছা,মানুষ কি এমনই হয়।মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানেই কিভাবে অস্তিত্ব ই ভুলে যায়।
দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো স্পর্শী।চোখ, নাক লাল হয়ে গেল মুহুর্তেই।অস্ফুটস্বরে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বিরবির করে বললো,
“না না না।উনি হয়তো মজা করছে স্পর্শীর সাথে।হ্যাঁ সেটাই হবে।প্রথমে সেইই তো গার্লফ্রেন্ডের কথা বলে রাগাতে চাইলো তাকে।এরপর রাহুলের কথা বলে স্পর্শী নিজে রাগিয়েছে।এবারে তাহলে তার পালা।নিশ্চয়ই এবার বিয়ের কথা বলে রাগাতে চাইছে।নাহ!স্পর্শী রাগবে না, কাঁদবেও না।এই জ্বালাতনের শোধ নেবে পরশ শিকদারের উপর।”
ভাবতে ভাবতেই ফোন ধরে কেঁদে উঠলো পুনরায়।উনি একজন সাংসদ।একজন গণমান্য ব্যক্তি।যতই ব্যক্তিগত লাইফে তার সাথে ঝগড়া করুক না কেন প্রফেশনাল লাইফে ভীষণই সিরিয়াস।লক্ষ লক্ষ জনগণ তাকে ফলো করে।ছেলেমানুষী করে নিজের ফেসবুক একাউন্টে নিশ্চয়ই মিথ্যা তথ্য ছড়াবে না।তাহলে?তাহলে কি সত্যিই বিয়ে করে নিলো সে।একবার ও জানালো না।জানতে চাইলো না অনুভূতি। এতটা পাষাণ কি করে হলো সে।চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় বিরতিহীন ভাবে পানি পড়ছে স্পর্শীর।কাঁপা কাঁপা হাতে পানি গুলো এক হাত দিয়ে মুছছে আর অন্য হাত দিয়ে পোস্ট গুলো দেখছে।
হঠাৎ গেট ধাক্কানোর শব্দ শুনতেই চমকে উঠলো।ফোন রেখে ছুটলো বাথরুমে।চোখে মুখে পানি দিয়ে ওড়না দিয়ে মুছলো।চশমা টা পড়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।পিপাসা ক্লান্ত শরীরে ভেতরে ঢুকতেই স্পর্শীকে ধমক মারলো।
“তুই না বলছিলি পার্লারে যাবি।তাহলে গেলি না কেন?আমাকে লোক রাখতেও বারন করলি।জানিস বছরের এই শেষের মাস গুলোতে কতটা চাপ থাকে ব্রাইডাল সাজানোর জন্য।”
থেমে,
“পড়ছিলি নাকি?চশমা পড়েছিস যে।”
সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে স্পর্শী আমতা-আমতা করে বললো,
‘হুম।”
পিপাসা ব্যাগ রেখে বাথরুমে যাওয়ার প্রয়াস করতেই থমকে দাঁড়ালো।পাশেই রান্নাঘর।হাড়িপাতিল গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।স্পর্শীর দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে বললো,
“রান্নাটাও করিস নি।করেছিস টা কি সারাটা দিন ঘরে বসে।আমার হয়েছে যত্ত জ্বালা।পার্লার সামলাও, রান্নাবাড়া সামলাও,বাজার সামলাও।এত্তো বড় মেয়ে অথচ এইটুকু বোধ-বুদ্ধি নেই যে মা কাজে গেছে,সারাটা দিন পরে এসে আবার কি করে রান্না করবে।”
“উফফফ! মাথা যন্ত্রণা করছে আমার।তোমার ইচ্ছে করলে রান্না করে খাও।না পারলে না খেয়ে থাকো।আমি কিচ্ছু খাবো না।মাথা ধরিয়ে দিছে আসার সাথে সাথেই।”
বলে ঝাড়ি মেরে দরজা বন্ধ করে রুমে র দিকে গেল।পিপাসা পাতিলে ভাত চড়াতে চড়াতে বললেন,
“এইরকম ঝাড়ি বিয়ের পর দিস শাশুড়ীর সাথে।তখন বুঝবি এর উত্তর কি হয়।নিজের বাড়িতে একটা প্লেট তুলতে কষ্ট হয়।দেখবো বিয়ের পর কিভাবে গাধা খাটুনি খাটিস।
” অবশেষে কল দিলেন।আমি তো ভাবলাম আর মনে হয় কোনো যোগাযোগ’ই রাখবেন না।”
স্পর্শীর ভাঙা গলায় কথাটা শুনতেই চমকে গেল পরশ।বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করে উঠলো।এই কন্ঠ,এই অভিমান,এই রাগ,এই ধমক তো আর শোনা হবে না।শোনার ইচ্ছে হলেও দায়িত্ব তাকে বাঁধা দেবে।নিজের শান্তির জন্য অন্য আরেকটা নির্দোষ নারীকে কখনোই ভোগাতে পারবে না সে।শান্ত কন্ঠে বললো,
“একটু ব্যস্ত ছিলাম কিছুদিন ধরে।এক্টিভ হতেই দেখলাম তুমি অনেকগুলো মেসেজ, কল দিয়েছো।তাই ফোন দিলাম।কিছু বলবে?”
ভেতর থেকে কান্না আসছে ভীষণ। কথাগুলো ওলোট পালোট হিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে বললো,
“এগারোটা বাজে।হিসেব মতো আপনার স্ত্রী তো আশেপাশেই আ ছে।এই সময় ফোন দিয়েছেন, কোনো প্রবলেম হবে না তো?”
অবাক হলো পরশ।”তুমি তারিণের ব্যাপারে জানো?কে বলেছে?”
“ওহহ!তার নাম টা বুঝি তারিণ।খুব সুন্দর নাম।আসলে আপনার আইডিতে দেখলাম অনেকেই বিয়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।ভাবলাম আমারো তো জানানো উচিত।তাই ফোন দেওয়া।আমাকে একবার জানালে কি খুব বেশি প্রবলেম হতো?আপনি কি ভেবেছিলেন?আমি জানলে আপনার বিয়েতে বাঁধা দেবো?”
গম্ভীর হলো পরশ।ত্রস্ত কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার এমন কেউ নই স্পর্শীয়া যে তুমি আমার বিয়েতে বাঁধা দেবে।যাই হোক,আমি পুরোনো কোনো ব্যাপার ঘাটতে চাই না।তুমি সুখী হও।তোমার বিয়ে তো সামনের মাসে।ভাবলাম তার আগে আমি বিয়ে করে তোমাকে সারপ্রাইজ দেই।”
নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো স্পর্শী।ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বললো,
“আমি ভীষণ সারপ্রাইজড। বিশ্বাস করুন আমি আমার পুরো বাইশ টা বছরে এতটা সারপ্রাইজড হইনি।অনেক বড় চমক দিলেন আপনি।এটা আমি কল্পনাও করি নি কখনো।”
পরশ থমকে গেল।স্পর্শীর কন্ঠ ক্রমশ কাঁপছে।এমন অস্বাভাবিক কন্ঠ ঠিক কিসের ইঙ্গিত করছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না একটুও।
“তাও ভালো লাগছে যে তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ চমক টা আমিই দিতে পারলাম।আমি তো ভেবেছিলাম বিষয় টাকে তুমি পাত্তাই দেবে না।যাই হোক,তুমি হয়তো ভেবেছিলে পরশ শিকদার তোমার বিরহে দেবদাস হয়ে নিজের রাজনীতি,ক্যারিয়ার এসব থেকে শতহাত দূরে সরে যাবে। কিন্তু আফসোস!হয়তো পরিবর্তন দেখে অবাক হচ্ছো।তবে তোমার এই কথাগুলো শুনে আমিও অবাক হচ্ছি।কারন এ ধরনের রিয়াকশন আমি তোমার থেকে আশাও করি নি।ভালো লাগছে।তবে ভেবনা তোমার এই কন্ঠের সেই তেজ,আবেগ,অনুভূতির পরিবর্তন আমার উপর কোনো প্রভাব ফেলবে।কারন আমি জানি তুমি গিরগিটি।তুমি রঙ পাল্টাতে পটু।তোমার বর্নের অভাব নেই।যেকোনো সময় যেকোনো রুপ নিতে জানো।দয়া করে আমাকে বশ করার কোনো চেষ্টা করো না।পরশ শিকদার কারোর রুপে প্রভাবিত হয় না।ভালো লেগেছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে,তাকে বিয়ে করছো, আমাকে অপছন্দ করো,বেশ ভালো কথা।বলেছো,মেনে নিয়েছি।এবারে আমার লাইফে আর কোনো ঝামেলা ক্রিয়েট করতে এসো না।বিয়ে করে সুখে থাকো।”
স্তব্ধ হয়ে গেল স্পর্শী। কথা বলাই যেন ভুলে গেল।পরশ পুনরায় বললো,
“স্পর্শীয়া,পড়ে কথা বলছি।তারিণ ফোন দিচ্ছে।বায়।”
কলিজাটা যেন মোঁচড় দিলো স্পর্শীর।ভেতরটা হিংসায়,কষ্টে যেন দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
“কেন? আপনার বউ কি কাছে নেই?ফোন দিচ্ছে কেন? ”
পরশ বিরক্ত হলো।কাঠখোট্টা কন্ঠে বললো,
“বিয়ে হয়নি এখনো।আজকে এনগেজমেন্ট হয়েছে।আমি গিয়েই আংটি পড়িয়ে আসছি।বিয়ে পরশু দিনে।রাখছি।বায়”
বলেই কেঁটে দিলো ফোন।অসাড় হয়ে গেলো স্পর্শীর শরীর।ওভাবেই পড়ে রইলো বিছানায়।কানে বাজতে লাগলো অতি পরিচিত লোকটার পরিবর্তনের কন্ঠস্বর।আচ্ছা,স্পর্শী কি কখনো ভেবেছিলো পরশ শিকদার অন্য কোনো নারীকে প্রাধান্য দিয়ে তার সাথে কথা বলার জন্য স্পর্শীর ফোন কেঁটে দিবে।
উফফফ!!যন্ত্রণায় মাথার শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।মিনিট পাঁচেক যেতেই কলিজাটা কেমন ধুকপুক করে উঠলো।বেহায়ার মতো কল লাগালো পরশকে।কিন্তু ঢুকলো না।এখনো ব্যস্ত সে তার নতুন নারীকে নিয়ে।দেখতে দেখতে দশ থেকে পনেরো মিনিট গড়িয়ে গেল।এখনো কি কথা বলছে?ওই মেয়ের সাথে এতোক্ষণ কেন কথা বলছে? কেন বলবে?কই তার সাথে তো বলেনি।দু মিনিটের মধ্যে কেঁটে দিয়েছে।বদলে গেছে মানুষটা।এরা বদলাতে খুব বেশি সময় নেয় না।কেন দূর্বল হলো স্পর্শী।কেন গেল কক্সবাজারে?কেনোই বা থাকলো পাশাপাশি একই রিসোর্টে। আজ যদি কাছাকাছি না থাকতো তাহলে কখনোই এতটা দূর্বল হতো না সে।সারা জীবন টা বেছে এমন একজন বিশ্বাসঘাতকের প্রতিই কেন দূর্বল হলো?কেন?
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৪৩
রাগে, অভিমানে, ঘেন্নায় ফোনটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো দেয়ালের দিকে। ধাক্কা খেয়ে ফ্লোরে পড়লো ফোন।টাচস্ক্রীন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ফোনের।
চোখ জ্বলছে,মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।বুকের ভেতরটা অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে।এই যন্ত্রণা সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে। পুরো বিছানা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে।হাতের নখ গুলো দিয়ে বালিশ খামছে ধরে যন্ত্রণা টাকে নিঃসরণ করতে চাইলো। যাতে আওয়াজ রুমের বাইরে আর না বের হয়।কিন্তু ফলাফল শূন্য।উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তেই লাগলো।গা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। একপর্যায়ে শরীরটা জ্ঞানশূন্য হয়ে ঢলে পড়ে গেল বিছানায়।