রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৫
সিমরান মিমি
স্পর্শী চমকালো,থমকালো।হতভম্বের নেয় চোখের অগ্রসর বাড়িয়ে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো।পিপাসা আর শুনলো না।ছুটে গেল দোতলার উদ্দেশ্য। হৃৎপিন্ড টা দুর্দম গতিতে লাফাচ্ছে।তার ওইটুকু মেয়েটা কিভাবে বাচ্চা জন্ম দেবে?আদৌ তার কি শরীর ঠিক আছে?কই?কাল সকালেও তো কথা হলো।বললো না তো এ ব্যাপারে।ফোন হাত দিয়ে ডায়েল করলো আর্শির নাম্বারে।
দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো শামসুল সরদার।তার শরীর টাও কাঁপছে ক্রমশ।সারাবাড়িতে বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে চলা,আবদার করা মেয়েটার ও নাকি বাচ্চা হবে।ভাবতেই বুকের ভেতর টা মুঁচড়ে উঠলো।আলগোছে সোফায় বসে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।এরপর কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে পরশের উদ্দেশ্যে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো।বললো,
_”এটা যদি আমার নিজ বাড়ি না হতো তাহলে তুমি শামসুল সরদারকে নতুন করে চিনতে পারতে।ভদ্রভাবে বলছি,চুপচাপ বের হয়ে যাও আমার সীমানা থেকে।অপমান করাতে বাধ্য করো না।”
পরশ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো।শামসুল সরদারের চোখের দিকে তাকিয়ে দাম্ভিকতার সুরে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
_”আমার পরিবার কখনো আমাদের পরাধীনতার শিকলে বাঁধে নি।নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য জোর করে কারো উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মতো নিচু মনমানসিকতাও নেই।যদি জানতাম,আমার ভাই আপনার মেয়েকে এতটাই ভালোবাসে তাহলে কখনো ওদের পালাতে দিতাম না।আমি নিজে এসে এই বাড়ি থেকে আমার ভাইয়ের বউকে নিয়ে যেতাম।আমার বোন বা ভাই যদি আমার সর্বোচ্চ শত্রুকেও ভালোবেসে তার সাথে জড়াতে চায়, তাহল্র সেটা সানন্দে মেনে নেওয়ার যথেষ্ট মানসিকতা আমার পরিবারের আছে।ওদের স্বাধীনতায় রাখতে যথেষ্ট আগ্রহী আমি।আশা করছি কিছু শিখবেন।মনে হলো ব্যাপারটা আপনাদের জানানো উচিত তাই এলাম।আর হ্যাঁ, দ্বিতীয় নাতির জন্য অপেক্ষা করবেন।সে আসতেও কিন্তু খুব বেশি দেরী করবে না।”
বলার পরপর’ই বাইরে বের হবার জন্য অগ্রসর হলো পরশ।স্পর্শী এখনো যেন ঘোরের মধ্যে আছে।এই চরম সত্যটা বিশ্বাস করতেই হিমশিম খাচ্ছে।পরশ কে বের হতে দেখতেই বাবাকে অগ্রাহ্য করে পিছু ছুটলো।ফুঁসে উঠলেন শামসুল।হাঁক ছেড়ে ডেকে ডাকলেন,
“স্পর্শীয়া!”
থমকালো স্পর্শী।কিন্তু পিছু ঘুরলো না।ছুটতে ছুটতেই বললো,
_”আব্বু জাস্ট দু মিনিট।আমার কিছু জানা প্রয়োজন।”
“এইই দাঁড়ান।ওখানেই দাঁড়াবেন।”
পা থেমে গেল পরশের।ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলো স্পর্শীকে।পরক্ষণেই আবারো সামনে তাকালো।স্পর্শী দু কদম সামনে অগ্রসর হলো।চোখে-মুখে আশ্চর্যের রেশ ছড়িয়ে বললো,
_”আপনি কি বুঝতে পারছেন আদৌ কি বলছেন?আর্শি প্রেগন্যান্ট মানে কি হ্যাঁ? ওইটুকু মেয়ে।ওর বয়স জানেন?যদি ওর কোনো ক্ষতি হয়?তখন?”
ভ্রুঁ কুঁচকে স্পর্শীর দিকে তাকালো পরশ।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“আরে আশ্চর্য তো!তুমি আমাকে রাগ দেখাচ্ছো কেন?আমি কি করেছি?যা জিজ্ঞেস করার সেটা তোমার বোন আর ভগ্নিপতি কে জিজ্ঞেস করবে।আমাকে কেন?”
চোখ ঘুড়িয়ে অন্যদিকে তাকালো স্পর্শী।ভীষণ অসস্তি লাগছে।ডান দিয়ে বাম হাতের নখ খুটতে খুটতে বললো,
“কি জিজ্ঞেস করবো আমি?আমারতো লজ্জা লাগছে।ভীষণ ‘ই লজ্জা লাগছে।”
_”আমার ও লজ্জা লাগছে।বিশ্বাস করো স্পর্শীয়া, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।লোকজন শোনার পর তো হাসাহাসি করবে।তুমি ভাবতে পারছো আমারই ছোটভাই সে আমার আগে বিয়ে করে নিলো।ব্যাস মেনে নিলাম করতেই পারে।কিন্তু তাই বলে বাচ্চা?বড় ভাইয়ের আগে ছোট ভাইয়ের বিয়ে বাচ্চা সব হয়ে গেছে।আমার লজ্জা করছে।তোমার মনে হচ্ছে না আমরা হেরে যাচ্ছি ওদের কাছে।ওরা আমাদের আগে বাচ্চা নিলো।এটা কতটা পরাজয়ের তুমি ভাবো একবার।চলোনা,বিয়েটা করে ফেলি তাড়াতাড়ি। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারো।ওদের আগে বাবা না হতে পারলেও সাথে সাথে নিশ্চয়ই হতে পারবো।তবুও হারবো না।তুমি কি আমার সাথে একমত?”
হা হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।লজ্জায় হাঁসফাঁস করতে লাগলো চারদিকে তাকিয়ে।এরপর মুহুর্তের মধ্যেই দিক পরিবর্তন করে সে বাড়ির দিকে ঘুরলো।তবে দ্বিতীয়বার আর পিছু তাকানোর মতো বোকামি করলো না।লোকটা তাকে অসস্তিকর পরিবেশে ফেলার জন্যই কথা গুলো বলেছে।এখনো নিশ্চয়ই তার রিয়াকশন দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।চলে গেল স্পর্শী।পরশ ঠোঁট কামড়ে নিরবে হাসলো।স্পর্শীর মুচকি হাসা লজ্জালু মুখ সে দেখেছে।
_”আসবো?”
চমকালো শামসুল সরদার। পা দুটো গুছিয়ে স্ত্রীকে বসার জায়গা করে দিলেন।এরপর শান্ত কন্ঠে বললেন,
_”তোমারই তো ঘর।অনুমতি চাইছো কেন তৃষ্ণা?”
পিপাসা চোখ দুটো বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো।কেননা এখনকার বলা কথাগুলোর পর তার স্বামী আর এতটা নরম অবস্থানে থাকবে না এটা নিশ্চিত।পিপাসা আলতো পায়ে এগিয়ে স্বামীর পাশে বসলো।এরপর আচমকাই হাত দুটো দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।শামসুল অবাক হয়ে গেলো।চিন্তিত কন্ঠে বললো,
_”কিছু কি বলবে তুমি?”
_”হুম।”
_”তাহলে বলো।”
মাথা নাড়ালো পিপাসা।শান্ত কন্ঠে বললেন,
_”বললে যদি আপনি রাগ করেন;ভয় লাগে ভীষণ! আজ এতোগুলো বছর পর এই রুমটাতে স্থান পেলাম।এখন যদি ক-দিনের মাথায়ই আবারো ছুঁড়ে ফেলে দেন।পার্লার টাও তো বিক্রি করে এসেছি।চিন্তা হচ্ছে।”
শামসুল হাসলো।স্ত্রীয়ের হাতদুটো ধরে বললেন,
_”যা বলতে ইচ্ছে করছে বলে ফেলো।রাগ করলেও রুম তোমারই থাকবে।এবারে কিছু হলে আমি নিজেই বাড়ি ছাড়া হবো।”
পিপাসা চিন্তার মধ্যেও মলিন হাসলো।বললো,
_”আমি যা জিজ্ঞেস করবো দয়া করে উত্তর দিবেন।যদি কিছু এর বাইরে বলার থাকে তাহলে পরে বলবেন।আমি শুনবো।”
মাথা নাড়ালো শামসুল।পিপাসা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
_”মেয়েটা অসুস্থ।বয়স ও কম।ভুল করেও বসেছে।এখন সেটা এমনই ভুল যেটা আর শুধরানো যাবে না।এই টুকু বয়সে এতটা রিস্ক।আমার ভয় করছে।অন্তত এই সময়টা মেয়েটাকে আমার কাছে রাখি। ও বাড়ির সবাই ও তো হয়তো আপনার মতোই না মেনে বসে আছে।মেয়েটা কিচ্ছু বোঝেও না।ওকে কি এখানে আনা যায় না?”
ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো শামসুল।কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে বললো,
_”না যায় না।”
_”তাহলে আমি আমার মেয়ের কাছে গিয়ে ক-দিন থাকি।আমার মনটা কেমন ছটফট করছে।”
বুকটা মুঁচড়ে উঠলো শামসুলের।ভালো তো তার ও লাগছে না।মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে।কিন্তু মুখে আনলো না।এবারেও কাঠিন্যতা নিয়ে বললো,
_”না তুমি যাবে না।যেখানে মেয়ের বিয়েই মানি নি।সেখানে মেয়ে জামাই বাড়ি বলে কিচ্ছু নেই।ওটা আমার শত্রুর বাড়ি।ওরা ইচ্ছে করে আমার মেয়েটাকে ফাঁসিয়েছে যাতে আমি ওদের কাছে নত থাকি।”
_”আশ্চর্য! নত থাকার প্রশ্ন এলো কোত্থেকে?আর থাকবেন ই বা কেন?আর ওদের সাথে আপনার রাজনৈতিক ভাবে বিরোধিতা। তাই বলে সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেন নিবেন?ওরা কি কখনো আপনাকে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ভাবে আঘাত বা অপমান করেছে?তাহলে কিসের শত্রুতা?জনগণ যাকে বেশি ভোট দিবে সেইই হবে।এতে শত্রুতার কি আছে?”
_না নেই ব্যক্তিগত শত্রুতা।তো?তাই বলে কি এই বিয়ে মেনে নিবো আমি?”
হতাশ হলো পিপাসা।চিন্তিত কন্ঠে বললো,
_”কেন মানবেন না?ছেলেটা কি খারাপ?ও কি চরিত্রহীন?এর আগে আর্শি বাদে কোনো মেয়েকে নিয়ে কি কিছু রটেছিলো?নাকি খুন/ডাকাতি করেছে?কেন জামাই হিসেবে মানবেন না?”
_”কারন ছেলে রাজনীতি করে।এটা আমার পছন্দ নয়।তাছাড়া বেকার,ভাইয়ের রাজনীতির পেছনে সারাদিন ঘুরতে থাকে।কোনো কাজ কাম নাই। ”
চমকালো পিপাশা।আশ্চর্যের সুরে বললো,
_”আরে আশ্চর্য তো!রাজনীতি করে বলে ছেলে আপনার অপছন্দ।কই সোভাম ও তো টুকটাক রাজনীতি করে।আপনি নিজেই তো রাজনীতির মধ্যে ডুবে বসে আছেন।তাই বলে আপনাকে বা আপনার ছেলেকে কোনো মেয়ের বাপ তার মেয়ের বিয়ে দিবে না?রাজনীতি যদি খারাপ হয় তাহলে আপনি ছাড়ছেন না কেন?আর বাকি রইলো কাজ কর্ম করে না।তো সেটা করে নেবে।সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে।শিক্ষিত,চাইলেই যেকোনো চাকরি নিতে পারবে।তারপরেও এতো অমত কেন?”
বলার জন্য আর কিছু খুঁজে পেলেন না শামসুল।তিনি নিজেও জানেন পাভেল খুব একটা খারাপ ছেলে নয়।কিন্তু তারপরেও এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব।তেজী সুরে ধমক দিয়ে বললেন,
_”এইই তুমি এখন যাও তো।আমার ভালো লাগছে না এসব শুনতে।”
চিৎকার করে উঠলো পিপাসা।বললো,
_”আমার ও ভালো লাগছে না।আমার মেয়েটা সারাক্ষণ পেটে ব্যথায় কাতরাচ্ছে।কিছু খেতে পারছে না মিনিটে মিনিটে বমি করছে।বিছানার মাঝখানে গুটিশুটি পাকিয়ে শুয়ে থাকে।আমি আমার মেয়ের কাছে যাবো।ওর সাথে সকালেই কথা হয়েছে।কাল সকাল হওয়ার আগে আমি শিকদার বাড়িতে থাকবো।মেয়েকে আনবেন না ভালো কথা।কিন্তু আমি নিজে মেয়েজামাই বাড়িতে গিয়ে উঠবো।যতক্ষণ না পর্যন্ত বাচ্চা হয়।”
হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন শামসুল।স্ত্রীর এই তেজ দেখে ভীষণ’ই অবাক হয়েছেন তিনি।ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
_”যাও।তবে ও বাড়িতে গেলে আর আমার সাথে কথা বলবে না।”
চমকে গেল পিপাসা।পরক্ষণেই পূর্বের মতো তেজ বহাল রাখলো। বললো,
“স্বামীও আমার, মেয়েও আমার।কথা বললে সবার সাথেই বলবো।দেখি কে আটকায়?”
এরপর থমথমে পায়ে নিচে চলে গেলো।কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা স্পর্শীর রুমের দিকে গেলো।শুয়ে ছিলো সে।মাকে দেখতেই উঠে বসলো।মাথা চেপে ধরে বললো,
“কিছু বলবে?”
_”হ্যাঁ, কিন্তু তোর আবার কি হলো?”
_”জানিনা,মাথাটা ধরেছে খুব।ঘুমাবো।কিছু বললে তাড়াতাড়ি বলো।”
পিপাসা উঠে নিজের রুমে গেল।ওষুধের পাতা নিয়ে আবারো স্পর্শীর কাছে এলো।দুটো প্যারাসিটামল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
_”দুটোই খাবি।এরপর একটু ঘুমা।ঠিক হয়ে যাবে।”
স্পর্শী ওষুধ দুটো হাতে নিলো।বললো,
_”কিছু বলতে চেয়েছিলে?”
_”আমি কালকে আর্শির কাছে যাচ্ছি।ওখানেই থাকবো।আমার মেয়েটা খুবই অসুস্থ।”
চমকালো স্পর্শী।ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
_”আর আব্বু?যেতে দিলো?”
_”নাহ!বলেছি,কিন্তু রাজী হয়নি।তাতে আমার কি?আমার মেয়েকে আমি দেখতে যাবো না?তুই জানিস?মেয়েটা নাকি কাল থেকে পেটে ব্যথায় কাতরাচ্ছে, কিছু খেতে পারছে না,বমি করছে,বিছানার মাঝখানে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে।কাউকে চেনে না,জানে না,অচেনা জায়গা কি করছে কে জানে?”
বলেই কান্না করে দিলো।স্পর্শীর ভেতরটা কেমন ওলোট-পালোট হয়ে যাচ্ছে।বুকের বা পাশ থেকে সুক্ষ এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো।চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। মায়ের উদ্দেশ্যে শান্ত গলায় বললো,
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৪
_”জানলা টা বন্ধ করে দাও।আলো আসছে ভীষন।”
থেমে,
“আর হ্যাঁ, কাল আমিও যাবো তোমার সাথে।”