রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭০
সিমরান মিমি
বিস্তীর্ণ নীলাকাশ।মাথার উপরে উত্তাপ ছড়ানো অগ্নিপিন্ড।স্বচ্ছ বালুকাময় সমুদ্রের তীরে দু-পা গুটিয়ে হাটুর উপরে থুতনি রেখে বসে আছে স্পর্শীয়া।হালকা ঢেউয়ের সাথে পানিগুলো গড়িয়ে এসে পায়ে লাগছে।সমুদ্রের এই নোনতা জলের সাথে বালিগুলোও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।পানিযুক্ত এই ভেজা বালিগুলো পা ছুঁয়ে সুরসুরি দিয়ে যায়।স্পর্শী নিরব।তার মনপ্রাণ জুড়ে এখন আকাশ কুসুম ভাবনা।দিগন্তের ওই প্রান্তে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।
কয়েকপা দুরেই বুকে হাত বেধে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে পরশ শিকদার। তবে সে ভাবুক নয়।তার নজর সামনের এই অদ্ভুত মানবীর গতিবিধির উপরে।বলেছিলো ছাওনির নিচে বসতে।কিন্তু সে বসে নি।তাকে অগ্রাহ্য করে চলে এসেছে এই বালির আস্তরণের উপর।জামা-কাপড় এর জ ও আনেনি।অথচ কি সুন্দর ভাবে নির্দিধায় বসে আছে মাটিতে।যেন কোনো চিন্তাই তাকে ছুতে পারছে না।স্বীয় গাম্ভীর্যতা এবং দাম্ভিকতার জেড়ে পরশ এখনো বসতে পারে নি।ভেতরের খুঁতখুঁতে সত্তাটা বাঁধা দিচ্ছে বারংবার।কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ?বাধ্য হয়ে হেঁটে গেল স্পর্শীর কাছে।পিঠপিছনে মিনিট খানেক দাঁড়ালেও পিছু ফিরলো না স্পর্শী।পরশ অগোচরে হাসলো।পৃথিবীতে এটাই একমাত্র নারী যাকে সে বুঝে উঠতে পারে না কোনোমতেই।এই রাগ,এই ভালোবাসা,এই অভিমান তো এই ঝগড়া।আজব মুড সুইং! এইতো খানিকক্ষণ আগেই তার সাথে বসে খেল।হাসি -দুষ্টুমিতে যেন বোঝাই যাচ্ছিলো না তাকে জোর করে এনেছে।হুট করেই আবার সমুদ্রের এপাশ টাতে এসে গম্ভীর হয়ে গেল।চুপ করে এপাশ টাতে এসে বসে রইলো মুখে কুলুপ এঁটে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবতী।সমুদ্রের তীড়ে ঢেউয়ের মধ্যে বসে আছে অবলীলায়।বাতাসের তোড়ে কানের দুপাশের চুল উড়ছে অবিরত।তীব্র রোদে তার হলুদ-ফর্সা গলা টা যেন স্বর্ণের ন্যায় চিকচিক করে উঠলো।পরশ নিজের পোশাক ভেঁজার কথা বেমালুম ভুলে গেল।ত্রস্ত পায়ে বসে পড়লো নিজেও।তবে দৃষ্টি তার এখনো পূর্বের স্থানে।চুলগুলো ঘাড়ের কাছে আলগা করে বাঁধা।বেশিরভাগ ছোট চুল-ই ইতোমধ্যে বের হয়ে গেছে বাতাসের তোড়ে।রোদে চকচক করা ঘাড়টার উপর ছোট ছোট চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।হঠাৎ-ই নিজেকে ভীষণ তৃষ্ণার্ত মনে হলো পরশের।শুষ্ক ঠোঁট জোড়া-কে জিভ দিয়ে ভিঁজিয়ে নিয়ে ঢোক গিললো।স্পর্শীর দিকে তাকাতেই দেখলো সে এখনো আনমনা।পরশ চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকালো।কিন্তু মন যেন সায় দিচ্ছে না।ডান হাতের তর্জনী দিয়ে পায়ের কাছের ভেঁজা বালি ছুঁলো।আঙুল টার উপরে ইতোমধ্যে অনেকটা বালি জমাট বেঁধে আছে।পরশ সযত্নে আঙুলটা উঁচিয়ে বালিটুকু লেপে দিলো স্পর্শীর গলায়।মুহূর্তেই চমকে উঠে তার দিকে তাকালো স্পর্শী।ডান হাত দিয়ে বালিটুকু ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো,_”উঁহু!বালি লাগাচ্ছেন কেন গায়ে?”
_”কারন তোমার থেকে এই সমুদ্রের বালি অধিক সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়।”
ভ্রুঁ -যুগল কুঁচকে কপালে তিনভাঁজ ফেললো স্পর্শী। বললো,_”ওহ!তাই বুঝি বালি দিয়ে আমার এই অসুন্দর শরীরটা ঢেকে দিচ্ছেন?”
পরশ হাসলো।ঘোর লাগানো কন্ঠে বললো,_”হুম।দেখছি, বালি দিলে তোমাকে একটুও আকর্ষণীয় লাগে কি-না?”
স্পর্শী চোখ ঘুরিয়ে বিরক্ত মাখা দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকালো।মুখে উচ্চারণ করলো,_”ঢ্যাঁমনা!”
আচমকাই একহাত দিয়ে স্পর্শীর পিঠ জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে আনলো পরশ।হাস্যোজ্জ্বল মুখটাকে কানের কাছে নিয়ে বলল, _”ডার্লিং!ইউ আর সো এট্রাক্টটিভ।”
স্পর্শীও পরশের ন্যায় মুখ টাকে তার কানের কাছে নিলো।ফিসফিস করে বললো,_”হাতটা সরান।আর দুরত্ব বজায় রাখুন মাননীয় অসভ্য এমপি।”
তড়িঘড়ি করে হাত সরিয়ে খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখলো পরশ।সে ভেবেছিলো স্পর্শীও তাকে সায় জানাবে।কিন্তু হুট করেই এমন অপমানে থমথমে হয়ে গেলো মুখ।অসস্তিতে ভেসে গিয়ে টপিক পাল্টাতে বললো,_”কক্সবাজারের কথা মনে আছে? ”
সায় জানালো স্পর্শী। বললো,_”হুম।ভুলবো কি করে?কক্সবাজার গিয়েই তো আপনার মতো একটা অমানুষের প্রেমে পড়েছিলাম।যার কারনে প্রতিনিয়ত লজ্জা, ঘৃনা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরছে।”
পরশ নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শীর মুখের দিকে।কথা অগ্রাহ্য করে হেসে বললো,_”যাক।অবশেষে স্বীকার করলে তুমি আমার প্রেমে পড়েছিলে।”
স্পর্শী একটুও গললো না।বরং বরাবরের মতো চোখেমুখে গাম্ভীর্য নিয়ে বললো,_”আপনার এই নরপিশাচের মতো মুখোশ টা আমার থেকে লুকিয়ে রাখলেও হতো।অন্তত নিজের প্রতি এতটা আফসোস হতো না।যা হতো সেটা আমার আড়ালে হতো।এভাবে চোখের সামনে মেনে নেওয়া যায় না।কেন করলেন এমনটা?”
পরশ স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে স্পর্শীর দিকে চাইলো।বরাবরের মতো শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, _”কি করেছি আমি?”
ক্ষোভের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে হতবিহ্বল হয়ে গেল স্পর্শী।সর্বোচ্চ আক্রোশ নিয়ে খামচে ধরলো বুকের উপর জড়িয়ে থাকা পাঞ্জাবি।ক্রোধ নিয়ে চিৎকার করে বললো,_”লজ্জা করছে না এমন প্রশ্ন করতে?অবশ্য আপনি তো নির্লজ্জ।লজ্জারাও আপনাকে দেখলে লজ্জা পাবে।”
বুকের উপরের আস্তরণ টা থাবা দিয়ে এখনো ধরে আছে স্পর্শী।পরশ হাতদুটোকে টেনে আরেকটু কাছে আনলো।চোখে -মুখে কৌতুহল নিয়ে ফিসফিস করে বললো,_”ঘৃণা করো আমায়?”
পরশের ওই গভীর চোখ দুটোর দিকে সরাসরি দৃষ্টি দিলো স্পর্শী।ওই শান্ত,স্নিগ্ধ চোখ দুটো যেন নিমিষেই ক্রোধানলে দগ্ধ হওয়া চোখ দুটোকে দমিয়ে দিলো।ধীরে ধীরে সে চোখে জমলো অশ্রু।কন্ঠ ভেঙে এলো স্পর্শীর।বললো,_”সেটাই তো পারছি না।যদি ঘৃণা করতে পারতাম তাহলে হয়তো নিজেকে শান্ত রাখতে পারতাম।
অন্ততপক্ষে প্রতিনিয়ত একটা বিশ্রী ঘটনার দায় নিয়ে ঘুরতে হতো না। আমার-ই ভবিষ্যৎ স্বামী,যার সাথে আমি সারা জীবন টা কাটাবো, যার সাথে আমার একটা সুন্দর সংসার হবে,যে আমার সন্তানের বাবা হবে সেই লোক অন্য আরেকটা মেয়ের সম্মান হানীর জন্য দায়ী।তার চোখে গন্ডির বাইরের মেয়েগুলো ভোগের সামগ্রী।তাদের ইজ্জত গেল না প্রাণ গেল এতে কিচ্ছু এসে যায় না।বরং সে অপরাধী দের রক্ষা করার জন্য সর্বদা সচল।আপনার মা আছে,আপনার বোন আছে,আপনার স্ত্রী ও হচ্ছে,এমনকি ভবিষ্যতে কখনো মেয়েও হবে।ভয় করছে না?কিভাবে পারলেন এতটা হিংস্র হতে।এই ঘটনা যে কখনো আপনার বোন বা মেয়ের সাথে ঘটবে না এর নিশ্চয়তা কি?”
হাত ছেড়ে দিলো পরশ সেখান থেকে উঠে হেঁটে গেলো কিছুটা।কন্ঠে গম্ভীরতা নিয়ে বললো,_”তোমার কি ধারণা তুমি খুব-ই মহৎ?আর বাকি সবাই নিষ্ঠুর”
_”কথা ঘোরাবেন না।”
আশ্চর্য হলো পরশ।রাগত্ব স্বরে বললো,_”আশ্চর্য!এখানে কথা ঘোরানোর কি আছে?আর তুমি-ও বা এমন কেন?কোনো কাজ কি আস্তে-ধীরে করা যায় না?নাকি চিল্লিয়ে বিষয়টাকে খিঁচুড়ি’র মতো পাকানোটাই স্বভাব।কবে একটা ঘটনা ঘটেছে সেটা নিয়ে এখনো পড়ে আছো।আরে ধর্ষণ টা করেছে আমার-ই দলের প্রধান।যাকে আমার ডান হাত বলে সবাই জানে।এই ঘটনা নিয়ে এবার লাফিয়ে-ঝাপিয়ে কাজ করলে আমার-ই বিপদ সেটা কেন বুঝতে পারছো না?তুমি কি জানো এ -কদিনে আমি ঠিক কতটা চাপের উপর ছিলাম?প্রেস,মিডিয়া,প্রশাসন,মন্ত্রী, কতজনকে সামলাতে হয়েছে।তার মাঝখানে তুমি গিয়ে ঢুকলে।আর ঢোকা তো দূরে থাক,সরাসরি গোয়েন্দাগিরি করা শুরু করলে।আমাকে জানানোর প্রয়োজন টুকুও মনে করলে না।আমি যতই বিষয়টাকে গোছাতে চাই,তুমি ততোই কেঁচোর মতো খুঁচতে থাকো।এরমধ্যে আবার বিয়েটা নিয়ে নাটক শুরু করলে।ইচ্ছে তো করছিলো সারাজীবনের মতো বোবা বানিয়ে দিতে।তাঁরছিড়া কোথাকার!”
_”তাই বলে আপনার ক্ষতি হবে দেখে নিজ স্বার্থের জন্য একজন ধর্ষককে রক্ষা করবেন?ওকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবেন?”
পরশ ভ্রুঁ কুঁচকে স্পর্শীর দিকে তাকালো।বললো,_”ওকে পালিয়ে যেতে দিয়েছি মানে?”
চমকে তাকালো স্পর্শী।কৌতুহল নিয়ে বললো,_” তাহলে ওরা এখন কোথায়?
_”যেখানে থাকা উচিত।সেখানে।
_”মানে?কোথায় আছে?”
পরশ বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।বললো,_”জেলে।”
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সাথে সাথে।এগিয়ে এসে পরশের কাছে দাঁড়িয়ে বললো,_”না।জেলে তো ছিলো না।আমি অনেকবার গেছি,জিজ্ঞেস করেছি।”
পরশ ভাবলেশহীন ভাবে বললো,_”আজ ভোরেই এরেস্ট হয়েছে।”
উৎফুল্ল কন্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো স্পর্শী। বললো, _”সত্যিই!ওরা কি পালিয়ে ছিলো।পুলিশ খুঁজে নিয়ে এরেস্ট করেছে?”
বিরক্ত হলো পরশ।ধমক মেরে বললো,_”আরে এতো প্রশ্ন করো কেন?তোমার জানার কি দরকার?ওরা ছিলো আমার কাছে।এ কদিন আমি-ই সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমার গোডাউনে।আজ আবার ধরিয়ে দিয়েছি।বুঝেছো?আর প্রশ্ন করবে না।”
কিছু মুহুর্ত হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো পরশের মুখপানে।সেই মুখশ্রীতে নেই কোনো মিথ্যের ছাপ।স্পর্শী ঘুরে বসলো পরশের দিকে।হাতটা নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো, _”দেখুন,আমি জানি সুজনের ভূমিকা আপনার রাজনৈতিক জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওর অনুপস্থিতি ও আপনার দলের মধ্যে অনেক প্রভাব ফেলবে।সামনে উপজেলা চেয়্যারমান নির্বাচন।এই মুহুর্তে দলের গুরুত্বপূর্ণ লোকদের নিয়ে এমন এলোমেলো হওয়ার সম্ভাবনা ও অনেকটা ক্ষতির কারন হবে।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।আমি জানি, ও আপনার খুব-ই প্রিয়।আপনি চাইলেও ওকে বাঁচাতে পারবেন না।যদি ক্ষমতাবলে সেটা পারেন ও তাহলেও তার প্রভাব পরবর্তীতে বিশাল আকার ধারণ করবে।
জনগণ ইতোমধ্যে আপনার বিরুদ্ধে কানাঘুষা করা শুরু করে দিয়েছি।ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই এমন নেতিবাচক দৃষ্টিতে আপনার ক্যারিয়ারের উপর ধুলো জন্মাবে।আজ আমি আপনার বিরুদ্ধে কথা বলছি,কাল আরো দশ জন সেই জায়গায় দাঁড়াবে।একবার যদি জনরোষের সৃষ্টি হয় তাহলে উপরমহল থেকেও প্রচুর চাপ আসবে আপনার উপর।একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন এমপিসাহেব,সুজন ভুল করেনি যে ওকে ক্ষমা করে দেওয়া যাবে।ও অন্যায় করেছে,গুরুতর অন্যায়।একটা মেয়ের জীবন শেষ করে দিয়েছে।আজ আপনি ওকে সাহায্য করছেন।ওর ভরণপোষণ থেকে শুরু করে লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন,চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন।কিন্তু বলুন তো,জীবনে কি এগুলোই সব?ওর সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ একটা সন্ধ্যায় নষ্ট হয়ে গেছে।এই তো আমাকেই ধরুন না।যদি আমি আজ ধর্ষিতা হতাম।আপনি কি আমায় বিয়ে করতেন?একদমই না।ফিরেও তাকাতেন না কখনো।ঘেন্না করতেন।সেখানে ওই মেয়েটা সারাটাজীবন বাইরের লোকের কু-কথা, ঘৃণা নিয়ে বড় হবে।এটা কত বড় ক্ষতি ভেবেছেন একবার-ও?”
পরশ নিশ্চুপ হয়ে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।স্পর্শী আবারো বলতে শুরু করলো।মলিন কন্ঠে বোঝানোর স্বরে বললো,_”শুনুন,আপনি সুজন কে ধরিয়ে দিয়ে অপরাধ কিছু করেন নি।এতে জনগণ খুশি হবে।আপনি একজন অপরাধী কে ধরিয়ে দিয়েছেন।নিজের প্রিয় লোক কেও অপরাধের জন্য ক্ষমা করেন নি।এটা কতটা সম্মানের ভাবতে পারছেন?”
এ পর্যায়ে স্পর্শীর দিকে তাকালো পরশ।মাথা নাড়িয়ে ধীর কন্ঠে বললো,_”হু!”
সুজন সহ বাকি দুজন গ্রেফতার হয়েছে শুনতেই হৃদয় টা যেন পুণরায় সতেজ হয়ে উঠলো।প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্যের মধ্যে এতোক্ষণ যে মলিনতা ছিলো সেটা যেন হারিয়ে গেল নিমিষেই।নিজে থেকেই পরশের কাছে গিয়ে বসলো।কাধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে শব্দহীন হাসলো।একহাত জড়িয়ে ধরে বসে রইলো ওভাবেই।এই এতো আনন্দ,এতো উৎফুল্লতা কিছুই চোখ এড়ালো না পরশের।সব দেখেও নিস্তেজ হয়ে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।হুট করেই মাথা জাগালো স্পর্শী। উত্তেজনা চাপিয়ে বললো, _”আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলুন না।আপনি তো চেয়েছিলেন সুজন কে বাঁচাতে।তাহলে হুট করে আবার ধরিয়ে দিলেন কার জন্যে?”
পরশ এক ভ্রুঁ কুঁচকে স্পর্শীর দিকে তাকালো।এরপর কটাক্ষ করে বললো,_”আবার কার জন্য।যার তোমার মতো একটা বউ আছে তার কি আর কাউকে প্রয়োজন আছে?যে নাটক শুরু করেছিলে তুমি আর তোমার বাপ তাতে তো হাপিয়ে উঠেছিলাম।ভাবলাম আর যাই হোক,আগে পাগল সামলাতে হয়।ওরকম একজন সুজনের জন্য তো আমি বউ হারাতে পারবো না।তাই না?”
স্পর্শী এই উত্তর-ই আশা করেছিলো।অবশেষে সে জিতেছে।কোনো এক দুর্বল কে ন্যায় বিচার দিতে পেরেছে।এর থেকে আর আনন্দের কি হয়?বললো,_”জানেন,আমি এ কদিনে ঠিক কতটা মেন্টালি ডিপ্রেশনে ছিলাম আপনাকে বোঝাতে পারবো না।বার বার মনে হতো,যে লোকের কাছে আমার থেকেও রাজনীতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার সাথে সংসার কিভাবে করবো?কোনো একদিন হয়তো রাজনীতির কারনে আমাকে ছাড়তেও দ্বিধা করবেন না।আমি তো ঠিক করে নিয়েছিলাম-ই।যদি আপনার কারনে সুজন বেঁচেও যেত, তাহলে বিয়ে তো দূর, কোনোদিন মুখ ও দেখাতাম না।হয়তো আমাকে না পেলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।নতুন কাউকে নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবেন।কিন্তু তাও,দিনশেষে আপনাকে ত্যাগ করার অপমান আপনাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত।”
পরশ হাসলো।কন্ঠে প্রখরতা নিয়ে বললো,_”তুমি কি ভেবেছিলে আমাকে বিয়েতে না করে দিলেই আমার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে?অন্য কারো সাথে সুখে-শান্তিতে সংসার করবে।আর আমি চুপচাপ সেসব দেখে মেনে নেব?হাহ!তুমি পুরোটাই ভুল স্পর্শীয়া।যতক্ষণ না পর্যন্ত তোমার ওই শরীর থেকে প্রাণ টা আলাদা হয়ে যায়,ততক্ষণ পর্যন্ত পরশ শিকদার তোমার পিছু ছাড়বে না।মরে গেলেও লাশ টাকে এনে আমার বাড়ির কোনায় পুঁতে রাখবো,তাও অন্যকোথাও দিবো না।শান্তভাবে,সামাজিক নিয়ম অনুসারে নিতে চেয়েছি তোমায় তাই এতো ধৈর্য্য।কিন্তু তাই বলে ভেবো না আমি তুমি বলতে পাগল।উহুম!একদম-ই তোমাতে আসক্ত না।তবে তুমি আদ্যোপান্ত আমার।শরীর,মন থেকে শুরু করে গায়ের একটা লোম ও আমার মালিকানাধীন। এজন্য যে বিয়ে করতেই হবে এমন না।তুমি বিয়ে না করলে করো না।কিন্তু সেই আমার সাথেই থাকতে হবে।শান্ত ভাবে গেলে যাবে নইলে যা করার সেটা আমি করে নেব।তুমি বিয়ে না করলেও তার বিকল্প আমার জানা ছিলো।”
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পর্শী।কথাগুলো তার জন্য হুমকিস্বরূপ হলেও অজানা কারনেই এই অধিকারবোধ তার ভালো লাগছে।শুনতে ইচ্ছে করছে বারংবার। আয়েশ করে বসে বললো, _”তা বিকল্প পদ্ধতি টা কি ছিলো শুনি?”
পরশ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো।ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,_”শোনার ইচ্ছে আছে নাকি?”
_”অবশ্যই আছে।আপনি বলুন।”
পরশ হাসলো।কন্ঠকে খাদে নামিয়ে বললো,_”বেশি কিছু করতাম না।এখন যেমন তুলে এনেছি ওভাবেই আনতাম।এরপর গোটা চারেক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে লাগাম ঢিলে করে দিতাম।তারপর স্পর্শীয়া সরদার কেন শামসুল সরদারের মরা বাপ ও পরশ শিকদারের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো বিয়ের জন্য।”
স্পর্শী দুচারবার পলক ঝাপটালো।যেন এটা খুব-ই মজার কথা।কন্ঠে আকুলতা নিয়ে সিরিয়াস মুখভঙ্গিতে বললো,
_”আমি কি করতাম আপনি জানেন?”
আগ্রহ নিয়ে তাকালো পরশ।বললো,_”বলুন।”
_”আপনার কল্লা ধর থেকে আলাদা করে দিতাম।অসভ্য পুরুষ। ”
হাসলো পরশ।বললো,_”সে তুমি করতেই পারো।আমি বাঁধা দিবো না।তুমি আমাকে গোটা চারেক বাচ্চা দিবে আর আমি তোমাকে সামান্য কল্লা দিতে পারবো না।এটাতো হয় না।তুমি নিয়ে যেও।সমস্যা নেই।”
থেমে মুখশ্রীতে গম্ভীর ছাপ ফেলে বললো,_”স্পর্শীয়া,একটা সত্যি কথা বলবে?”
_”হু। বলুন।”
পরশ স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো।বললো,_”এসব ছেলেমানুষী ছেড়ে এবার কি সিদ্ধান্তে যাওয়া উচিত নয়?কি চাইছো তুমি?আমি সত্যিই তোমাকে পড়তে অক্ষম।কোনো চাপ নয়,নির্দিধায় বলো।হ্যাঁ বা না।”
স্পর্শী সময় ব্যয় না করেই বললো,_”না।”পরশ সূচালো দৃষ্টিতে তাকালো।কপাল কুঁচকে বললো,_”ওহহ!বিয়ে ছাড়াই থাকার ইচ্ছে বুঝি।সেটা তুমি আগে জানাবে তো।”
বলেই উঠে দাঁড়াতেই স্পর্শী হাত চেপে ধরলো।চাপা আর্তনাদ করে বললো,_”উফফফ!আস্তে কথা বলুন।শুনবে তো।আর আমি মজা করেছি।আপনি করলে কিচ্ছু হয় না, আর আমি করলেই দোষ?”
থেমে আবার বললো,_”বিয়ের মত তো সেই কবেই দিয়েছি।এখন আবার নতুন করে জানার কি আছে।মাঝখানে এসব না ঘটলে তো কিচ্ছু হতো না।যাই হোক, এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ।এবার আপনি বিয়ে যেদিন করতে চান সেদিন-ই রাজি।”
পরশ গম্ভীর কন্ঠে বললো,_”আমি বললেই রাজি?যেদিন বলবো সেদিন-ই করবে?”
মাথা নাড়লো স্পর্শী।পরশ পুণরায় বললো,_”ভেবে বলছো তো।যখন বলবো, যেভাবে বলবো সেটাই মানবে?”
_”হুম।আমি রাজী।”
মুহুর্তেই উঠে দাঁড়ালো পরশ।স্পর্শীর হাত ধরে স্বজোরে টেনে উঠালো।ফোন হাতে নিয়ে কল লাগালো ড্রাইভারের নাম্বারে।গাড়িতে তার অতিরিক্ত পোশাক থাকলেও স্পর্শীর নেই।দ্রুত পোশাক আনাতে হবে।ড্রাইভারের সাথে কথা বলার পর পর-ই ফোন লাগালো পাভেলের নম্বরে।ওপাশ থেকে রিসিভড করতেই কন্ঠ নিচুতে নিয়ে বললো,_”ফেঁসেছে।দ্রুত আয়।”
এরপর ফিরে এসে আবারো স্পর্শীর হাত ধরলো।এগিয়ে যেতে লাগলো তীরের দিকে।স্পর্শী কৌতূহল নিয়ে বললো,_”এক্ষুনি বাড়ি যাবেন?আমি তো সূর্যাস্ত দেখতে চেয়েছিলাম।প্রয়োজনে বাড়ি ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি যে আমি আপনার সাথে আছি।”
গমগমে কন্ঠে পরশ উত্তর দিলো।বললো,_”তার কোনো প্রয়োজন নেই।আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পিরোজপুর যাচ্ছি।সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত খুব তাড়াতাড়ি -ই দেখাবো।তুমি চাইলে কুয়াকাটা বা সাজেক নিয়ে যাবো।যেখানে ভালো লাগে বলবে।কিন্তু আজকে আর দেরি করা যাবে না।কাজ আছে।”
স্পর্শী মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে বললো ‘ওহ।আচ্ছা।”পরক্ষণেই উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,_”আমার অনেক জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে।
থেমে বললো,_বিয়ের পর তো আপনি সারাক্ষণ-ই ব্যস্ততা দেখাবেন।আদৌ নিয়ে যাবেন কি না জানিনা।শুধু বড় বড় কথা।”
পরশ তাকালো।যেতে যেতে আদুরে গলায় বললো,_”তা ম্যাডামের কোন কোন জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে?”
_”উমমম…প্রথমেই কাশ্মীর।এরপর জাফলং,সিলেটের চা বাগান,শ্রীমঙ্গল, সাজেক,কুয়াকাটা আরো অনেক জায়গা।বাদ দিন আপনি হাপিয়ে যাবেন শুনতে শুনতে।”
গায়ের টপস টা অনেকটা টাইট হয়েছে।একদম মাপগোছ ছাড়া যে শরীরে ঢুকেছে এটাই অনেক।সতেজতা নিয়ে জানলা থেকে বাইরের দৃশ্য দেখছে স্পর্শী।যাবার সময় ঠিক যতটা হৃদয় ভেঙেছিলো,বিরক্ত লেগেছিলো, আসার সময়টা তার ও অধিক প্রিয় ঠেকছে।গাড়ি যত সামনে এগোচ্ছে পরশের মধ্য টা ঠিক ততটা অসস্তি কাজ করছে।স্পর্শীকে এখন পর্যন্ত জানানো তো দূর,কোনো আকার ইঙ্গিত ও দেওয়া হয়নি।যদি লোকসমাগমের মধ্যে গিয়ে হুট করে বেঁকে বসে।তখন?এর থেকে সবটা খোলামেলা করা প্রয়োজন গাড়িতে বসেই।অনেকক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সাজিয়ে নিলো।এই মাথামোটা রমনিকে বোঝানোর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।নিজেকে সাজিয়ে স্পর্শীর দিকে তাকাতেই স্পর্শী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।বললো,
_”আচ্ছা আমরা কোন কাজি অফিসে যাচ্ছি?পিরোজপুর
নাকি এখানকার-ই কোথাও?ঝালোকাঠি বা বরিশালের নাকি?”
চমকে উঠলো পরশ।নিষ্পলক ভাবে হতভম্বের নয় স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।অবিশ্বাসের সুরে মুখে আওড়ালো,_”তুমি কিভাবে জানলে আমরা কাজি অফিসে যাচ্ছি?”
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৯
চমৎকার ভাবে হাসলো স্পর্শী।পরশকে অবজ্ঞা করে কোনো উত্তর না দিয়েই বাইরের দিকে তাকালো।এরপর বেশ কিছুক্ষণ পর ভেতরে এসে পরশের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
_”এমপিসাহেব, কে ফেঁসেছে বলুন তো?আপনি আমাকে ফাঁসিয়েছেন নাকি আমি আপনাকে?”