রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭১

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭১
সিমরান মিমি

দুপুর দুইটা।সূর্য তখন মাথার উপরে অবস্থান নিয়েছে।কালো রঙের বিলাসবহুল গাড়িটির চাকা তখনো চলছে।গাড়ির গতিসীমা তখন খুব বেশি নয়।নরম সিটের উপরে মাথা হেলিয়ে কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে পরশ শিকদার।সম্পুর্ন মনোযোগ এখন ভাবনাতে।পাশের সিটেই স্পর্শী নিশ্চিন্তে ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছে।হুট করে তার এই নিরবতা মেনে নেওয়া মোটেই সম্ভবপর হচ্ছে না।অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার টা নিয়ে বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করলেও উত্তর পাওয়া যায় নি।বরং বিষয়টাকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য উত্তর দিয়েছে স্পর্শী।নিরলস ভঙ্গিতে বলেছে,_”আরেহ তেমন কোনো ব্যাপার না।আপনার কথার মধ্যেই আমি বিয়ের আভাস পেয়েছি।আর আসার আগেই তো বললেন আজ বিয়ে করবেন।বাদ দিন।আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানে চলুন।”

এই উত্তর মোটেই পছন্দ হয়নি।কিন্তু ঘটনাটা নিয়ে খুব ঘাঁটাঘাঁটি করাও পরবর্তী ঘটনার উপর প্রভাব ফেলবে।এর চেয়ে আগে বিয়েটা শেষ হোক,এরপরে সবটা জানা যাবে বলেই মনস্থির করলো।নির্দিষ্ট স্থানটাতে পৌছাতে আরো মিনিট দশেক লাগলো।কাজি অফিস টার সামনে থামতেই ভেতর রাস্তার ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকজন যুবক।তাদের সম্মুখেই পাভেলের অবস্থান।তার চোখেমুখে স্পষ্ট প্রফুল্লতা।পরশ বের হতেই তার সাথে পরামর্শ করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।স্পর্শী গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালো।এরমধ্যেই দুটো স্যালোয়ার কামিজ পরিহিত মেয়ে এগিয়ে এলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এরা সম্ভবত দলের কোনো লোকের বোন অথবা গার্লফ্রেন্ড টাইপ কিছু।কিন্তু এই ব্যাপার টা নিয়ে ভাবলো না স্পর্শী।তাদের সাথে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আশেপাশে তাকালো।স্থানটা রুপাতলি।জায়গা টা তার পরিচিত।ঢাকা থেকে আসা যাওয়ার পথে বেশ কয়েকবার এখান থেকে গাড়ি বদল করতে হয়েছিলো।কিন্তু এই কাজি অফিস টা পরিচিত নয়।হুট করেই স্পর্শীর মন বিরোধিতা করে বসলো।তারা স্বজোরে বলে উঠলো,কেন সে কাজি অফিস টাকে পরিচিত জানার জন্য ভাবছে।সে কি বারবার বিয়ে করছে নাকি?মস্তিষ্কে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা আসতেই হেসে দিলো।দূর থেকে এই হাসি চোখ এড়ালো না পরশের।সন্দেহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে তাকিয়ে রইলো স্পর্শীর দিকে।পাভেলকে ইশারা দিয়ে চাপা স্বরে বললো,_”ওর চাল-চলন আমার মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না।এখানে আসার আগে বিয়ে করতেই নারাজ ছিলো।সেখানে এখন হাসছে।কতটা অদ্ভুত! ”

আমলে নিলো না পাভেল।ভাইকে বোঝানোর স্বরুপ হেলা করে বলল,_”আরে ধুর!এসব নরমাল ব্যাপার।আজকাল বিয়ের আগে কেউ-ই রাজী থাকে না।অথচ বিয়ের দু তিনমাসের মধ্যে শুনি সে প্রেগন্যান্ট। সে হিসেবে সামান্য হাসি মোটেও বিপদ জনক না।ভাবিস না কিছু।”
চোখ দুটো কুঁচকে ছোট ছোট করে চাইলো পরশ।এরপর কটাক্ষ করে বললো,_”এটা আর্শিয়া শিকদার না।অযথাই তুই বংশবিস্তার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিস।বিয়েটা আদৌ ঠিকঠাক ভাবে হবে কি-না সেটা নিয়ে চিন্তা কর।হুট করে বিয়ের আগে বেঁকে না বসে।”

সমস্ত গোছগাছ লেখালেখি সম্পুর্ন হয়েছে ইতোমধ্যে।যখন সাইন করার নির্দেশ দিলো তখন-ই গলা শুকিয়ে গেল পরশের।বার বার মনে হতে লাগলো কিছু একটা অঘটন ঘটবে।স্পর্শীয়ার ওই থমথমে মুখের গড়ন দেখে হৃৎপিন্ড দুর্বার গতিতে লাফাতে লাগলো।হয়তো এখন-ই বলে বসবে,-সে এভাবে বিয়ে করবে না বাবা-মাকে ছাড়া।’কিন্তু তাকে পুরোপুরি অবাক করে দিয়ে নির্দিধায় বিনাশর্তে সাইন করে দিলো স্পর্শী।হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো পরশ।তার হাত কাঁপছে। সাইন করার পর্ব শেষ হতেই হুজুর দোয়া পড়তে লাগলেন।সুমধুর কন্ঠের কালেমা শেষ হতেই কবুল বলার পর্ব এলো।বরাবরের মতো সবাই-কে অবাক করে দিয়ে স্পর্শী ‘আলহামদুলিল্লাহ!’ বললো।

ঢকঢক করে পানি খেতে লাগলো পরশ।হাত-পা এখনো অসাড় মনে হচ্ছে।মস্তিষ্কের মধ্য টা ফাঁকা হয়ে আছে যেন।বাহ্যিক পরিস্থিতি প্রত্যেকটা অপরিচিত ঠেকছে।আচ্ছা এটা স্বপ্ন নয়তো?নিশ্চিত হলো পরশ।এটা অবশ্যই স্বপ্ন।নাহলে স্পর্শীয়া সরদার কখনোই এতটা বিনয়ের সাথে সবকিছু মেনে নিতো না।আচ্ছা,তারা কি এখনো গাড়িতে আছে?হয়তো সেই সিটে দুলতে দুলতেই ঘুমিয়ে পড়েছে পরশ।আর সেই ঘোরেই এসব আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখছে।ভাবতে পারছে না।প্রতিক্ষণে চিন্তাশক্তি যেন ফুরিয়ে আসছে।কিছুটা দুরের ওই টেবিলের পাশেই স্পর্শী বসা।তার পাশেই নিরলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে পাভেল।হঠাৎ -ই অন্যরা কিছুটা দূরে সরে যেতেই চাপা স্বরে কটাক্ষ করে বললো,_”জানতেই তো আজ বিয়ে।ভালো করে একটা শাড়ি-চুরি পড়ে সেঁজে আসতে।এভাবে অনুভূতিহীনের মতো থাকো কেন?”

স্পর্শী তাকালো।এরপর আলতো হেসে বললো,_”শাড়ি পড়লে তো আপনার ভাই বুঝেই যেতো বিয়ে করতে যাচ্ছি।”
দ্রুত মাথা নাড়িয়ে নিজের বোকামি স্বীকার করলো পাভেল।এরপর কিছু বলার প্রয়াস করতেই স্পর্শী বললো,_”আপনার কিন্তু আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।”
ভ্রুঁ কুঁচকালো পাভেল।বললো,_”উলটো আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।তোমার জামাইকে বাঁচাতে হেল্প করলাম যে।”

স্পর্শী হাসলো।কটাক্ষ করে বললো,_”জামাই হয়েছে মাত্র ছয় মিনিট।এর আগে কিন্তু আপনার ভাই ছিলো।”
_”বুঝেছি, বুঝেছি।মেয়েদের সাথে তর্কে পারা যাবে না।আমি হার মানলাম।আমার ভাইকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ও দিলাম।হয়েছে?”
কোনো উত্তর দিলো না স্পর্শী।উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে।কিছুটা দুরেই পরশ বসে আছে অন্যমনস্ক ভাবে।তাকে দেখতে অস্বাভাবিক লাগছে।সেদিকে এগোতে দুপা সামনে গিয়েও ফিরে আসলো।চাপা স্বরে পাভেলের উদ্দেশ্যে বললো,_”একটু দুরত্ব রাখবেন।যা বিগত দিনে ঘটেছে সেটা যেন কখনো আপনার ভাইয়ের সামনে প্রকাশ না পায়।আমি চাইনা আপনি বা আমি কেউ-ই তার সামনে অবিশ্বাসী হই।”

এরপর ত্রস্ত পায়ে হেঁটে গেলো ভেতরের দিকে।অফিসের এদিক টা একদম লোকশূন্য।হয়তো এখানে বিবাহ করতে আসা প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের জন্য জায়গাটা আলাদা করে তৈরী করা।তবে ধারণা ভুল ও হতে পারে।স্পর্শী পরশের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।আলতো করে ঘাড় ছুঁতেই চমকালো পরশ।পেছনে ফিরে স্পর্শীকে দেখতেই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো।হাত দিয়ে টেনে নিজের কাছে বসালো।ডান হাতটা দু হাতের মুঠোতে নিয়ে শক্ত করে ধরে অস্বাভাবিক কন্ঠে বললো,_”আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কিছু।কেমন অতিরঞ্জিত লাগছে সবকিছু।মনে হচ্ছে কল্পনায় ভাসছি।”
ঠোঁট টিপে হাসলো স্পর্শী।বললো,_”আচ্ছা।তারপর?”
স্পর্শী যে হাসছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।পরশ মুখচোখ গম্ভীর করে বললো,_”হাসবা না।আমি সিরিয়াস।সত্যিই খারাপ লাগছে।”

থেমে চাপা স্বরে বললো,_”তুমি চাইলে আমায় কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরতে পারো স্পর্শীয়া।হয়তো এতে ভালো লাগবে।”
বলে হাত বাড়িয়ে দিতেই তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো স্পর্শী।আশেপাশে বারকয়েক তাকিয়ে চোখ গরম করে বললো,_”অসভ্য!লজ্জা-সরম কিচ্ছু নেই।

কালো রঙের গাড়িটি পুণরায় গতিশীল।এবারের গতি ধীর নয়।বিকেল তখন সাড়ে তিনটা।চলন্ত গাড়ি,অর্ধখোলা জানালা থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস ছুয়ে দিচ্ছে শরীর।এই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পরিবেশ টাতে নির্মল এই বাতাস টা নিমিষেই ঘুমের জন্য পায়তারা করছে।সদ্য বিবাহিত দম্পত্তি বসে আছে সিটে।পরশের পাঞ্জাবির বোতামদুটো খোলা।সেই প্রশস্ত বুকটার উপরে রাখা আছে স্পর্শীর মাথা।বাতাসের তোড়ে চুলগুলো উস্কোখুস্কো। ছোট ছোট চুলগুলো উড়ে পডছে পরশের মুখের উপর।দুহাতে সান্নিধ্যে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেল।স্পর্শী চোখ বন্ধ করে নিলো নিমিষেই।ঘোর লাগানো কন্ঠে বললো,_”বিয়ে করেছি বলে ভাববেন না যে যা বলবেন তাই শুনবো।শুনুন,যতক্ষণ না পর্যন্ত বিয়ে হচ্ছে ততক্ষণে যেন বাইরের কেউ না জানে?আব্বু কষ্ট পাবে।”

_”তুই তো গেলি অন্য একটা জামা পড়ে?এটা পেলি কই?”
মায়ের প্রশ্ন শুনতেই কিছুটা অসস্তিতে পড়লো স্পর্শী।আমতা-আমতা করে বললো,_”আরে বলেই তো ছিলাম শপিং করতে যাচ্ছি।এটা পছন্দ হয়েছে তাই পড়ে দেখছিলাম।এরপর আর খুলি নি।”
সন্দেহী চোখে তাকালো পিপাসা।বললো,_”তুই তো বলছিলি তাড়াতাড়ি আসবি।এতো দেরি হলো কেন?”
উত্তর দিলো না স্পর্শী।কথা ঘুরিয়ে বললো,_”খিদে পেয়েছি।খাবার টা দেও।গোসল সেরে আসছি।”

_”তোর আব্বু খেয়ে রুমে গেছে।তোকে ডেকেছে।কি যেন বলবে।”
_”আচ্ছা।”
শান্ত কন্ঠে সায় দিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল।আলতো হাতে দরজা খুলতেই সোভামের রুমের দিকে তাকালো।মুহুর্তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।নিজের কক্ষে যাওয়ার আর ইচ্ছে হলো না।ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল সোভামের রুমের দিকে।দরজা ভেতর থেকে চাপানো।আলতো খুলে আছে।ভেতর থেকে স্পষ্ট রাগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।কারো সাথে রেগে কথা বলছে।স্পর্শী নিঃশব্দে ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।দেয়ালের সাথে হেলিয়ে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে রইলো।সোভাম এখনো কথা বলছে।আচমকাই পেছন থেকে আফসোসের ন্যায় ‘চ’ শব্দ শুনলো।চমকে পেছনে তাকালো।স্পর্শী এখনো ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময়ী হাসছে।সোভামকে তাকাতে দেখে কটাক্ষ করে বললো,_”আড়ালে বসে গুটি নাড়িয়ে ঘটনা উপভোগ করার মজাই আলাদা।তাই না ভাইয়া?”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭০

চমকে তাকালো সোভাম।স্পর্শী আবারো হাসলো।বললো,_”কিন্তু সুজনকে তো পরশ শিকদার ধরিয়ে দিলো।এবার কি করা যায় বলোতো?”
এতোক্ষণের কুঁচকে রাখা কপাল টা ধীরে ধীরে প্রসারিত হলো।ফ্যাকাসে মুখটাতে ধীরে ধীরে হাসি ফুটলো।সোভাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্পর্শীর দিকে চেয়ে রইলো।ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,_”তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। সোভাম সরদারের বোন হওয়ার যথেষ্ট যোগ্যতা আছে তোমার।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭২