রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৯
সিমরান মিমি
কুয়াশা-মাখানো ভোর।ঘড়ির কাঁটায় তখন সাতটা।তবে এখনো দেখা দেয় নি সূর্য।যেন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে বসে আছে সেই কুয়াশার আড়ালে।দেখ মনে হচ্ছে সূর্য কোনো নতুন জামাই আর এই কুয়াশা হচ্ছে তার লজ্জা লুকানোর রুমাল।নতুন জামাই নামটি মস্তিষ্কে আসতেই মনে হলো এটা পরশ শিকদার । হ্যাঁ, সেও তো সরদার বাড়ির নতুন জামাই।তবে এর মধ্যে লজ্জার ছিঁটেফোঁটা ও নেই।সামান্য আদব-কায়দার ও চিহ্ন দেখা যায় না।নাহলে কেউ এই কুয়াশামাখা ভোরে রওনা দেয় শশুর বাড়ি থেকে।
সেটাও সকালের নাস্তা না খেয়ে।এতোবার করে বলার পরেও বসলো না টেবিলে। বরং সবাই ধমকে-ধামকে না খাইয়েই রওনা দিয়েছে।শেষে বউয়ের ঝারি খেয়ে না বসেই টেবিল থেকে একটা পোঁচ ডিম মুখে নিয়ে ভদ্রতা বজায় রেখেছে।এটা ভদ্রতা?মোটেও না।এটা একরোখামি,গোঁড়ামি,জেদ, অসভ্যতা। আর এর শোধ ও নেবে স্পর্শী।দুনিয়া উলটে যাক তাই বলে সে না খেয়ে আসবে?অসহ্য!স্পর্শী নিজেও কোনো না কোনো দিন এভাবেই অপমান করবে।ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা পরশ সচেতনতার সাথে গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে তাকাচ্ছে মিররের দিকে।স্পর্শীর ওমন ফোলানো মুখ দেখে কটমট করে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-মুখটা ওমন ভোঁতা করে বসে আছো কেন?খেয়েছি তো না-কি?
ক্রোধ মিশ্রিত চোখে পরশের দিকে তাকালো স্পর্শী। এটা সাধারণভাবে তাকানো নয়।এ যেন অগ্নিপিন্ডের দগ্ধ কোনো মনি।যার দিকে তাকানোর সাথে সাথে ছাঁই হয়ে যাবে সব।খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বললো,
-ওটাকে খাওয়া বলে?কুয়োর মধ্যে ডিম টাকে ছোঁড়া মানেই খাওয়া না।খাওয়ার মধ্যে একটা ভদ্রতা আছে।
থতমত খেয়ে গেলো পরশ। গাড়ির স্পিড সামান্য কমিয়ে আহাম্মকের মতো বললো,
-হোয়াট!!কুয়ো মানে?আমার মুখ টাকে তোমার কুয়ো মনে হচ্ছে?
-হ্যাঁ হচ্ছে। কুয়োই তো।মুখ হলে তো ঠিকই চেয়ারে বসে ভদ্রভাবে দুটো মিনিট সময় নিয়ে খেতেন।ওভাবে ফিঁকতেন না।
দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলো পরশ।বিড়বিড় করে বললো,
-আমি ওভাবেই খাই।তোমার কোনো সমস্যা?
-না না। আমার সমস্যা হবে কেন?তবে আপনার হতে পারে।ওভাবেই খাবার খান তাই না?বেশ!দেখবো আমি।আজীবন ওভাবেই দাঁড়িয়ে মুখে ছুঁড়তে হবে খাবার।চেয়ার আর পাবেন না বসার জন্য।
গাড়ি থেমেছে শিকদার বাড়ির সামনে।চাকা থামার সাথে সাথেই প্রেমার হাত ধরে টেনে হুরহুর করে হেঁটে গেল স্পর্শী। বাকিদের জন্য কোনোরকম অপেক্ষা না করেই ঢুকে গেল বাড়ির মধ্যে।পরশ ঠোঁট-মুখ বিকৃত করে ফেললো।দাঁতে দাঁত চেপে পাভেলের উদ্দেশ্যে বললো,
-দেখেছিস?একে দেখে মনে হচ্ছে ও নতুন বউ।পরশু বিয়ে হয়েছে এর মধ্যে পা দেখেছিস?যেন উড়ছে।একটু তো মুখে লাগাম থাকা উচিত।নতুন বউ তুই-ধীরে ধীরে নিজের রুপ দেখা।তা-না কবুল বলার পর থেকেই শুরু করে দিয়েছে।কি বিয়ে করলাম এটা?
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো স্পর্শী। পা থেমে গেলো মুহুর্তে’ই। ঘাড় ঘুরিয়ে শান্ত চোখে তাকালো পরশের দিকে।স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো পরশ।পাভেল কন্ঠকে চাপিয়ে বললো,
-এবারে সামলা।
শুকনো ঢোক গিললো পরশ।বললো,
-আমার মনে হচ্ছে কিছু শোনেনি।আস্তেই তো বললাম।
চলে গেল স্পর্শী।ড্রয়িং রুমে গায়ে চাঁদর পেঁচিয়ে সোফায় বসে ধোঁয়া ওড়া চা খাচ্ছেন আমজাদ শিকদার।পাশেই বসে আছেন পিয়াশা।দুজনের’ই মনযোগী দৃষ্টি টিভির দিকে।হঠাৎই অসময়ে বাড়ির ভেতর স্পর্শীদের প্রবেশ করতে দেখতেই উঠে দাঁড়ালো পিয়াশা।দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে মেয়ে-বৌমাকে দেখলেন।চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
-একি!তোমাদের না আরো দু-দিন পর ফেরার কথা ছিলো?গতকাল সন্ধ্যায়-ই তো গেলে।এরমধ্যেই-কি হয়েছে?চোখ-মুখ ফ্যাকাশে কেন?
স্পর্শী প্রেমার দিকে তাকালো।মেয়েটা যেন ভয়ে গুটিশুটি পাঁকিয়ে দলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বললো,
-আম্মু,প্রেমা একটু ক্লান্ত।আমিও ব্যাগ টা রেখে আসি।আপনার ছেলেরা পেছনেই আছে।আসুক সবাই,আসছি।
এরপর ননদকে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো স্পর্শী।প্রেমার রুমে ঢুকে দরজা চাপিয়ে বিছানায় বসলো।পাশে বসিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
-আব্বু আম্মুকে আমি বুঝিয়ে বলবো।তবে, তুমি কোনো উল্টো-পাল্টা কিছু করবে না। চুপচাপ রুমে বসে থাকবা।
প্রেমার রুম ত্যাগ করে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো স্পর্শী। ব্যাগ রেখে ধীর পায়ে আবারো নিচে নেমে এলো।ড্রয়িংরুমে এখন পিনপিনে নিরবতা বিরাজমান।স্পর্শী সুচতুর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে দেখলো।পাভেল নিচু কন্ঠে কিছু বলছে তার বাবার উদ্দেশ্যে। হঠাৎই দিশেহারা হয়ে উঠলেন আমজাদ শিকদার। রেগেমেগে আগুন হয়ে গেলেন নিমিষেই।পুরো মুখশ্রী জুড়ে রক্তিম আভা বিরাজমান। তেড়ে উঠতে লাগলো সিঁড়ির দিকে।মুহুর্তে ‘ই সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো স্পর্শী।ক্রুদ্ধ হয়ে ছেলে বউমার দিকে চোখ গরম করে তাকালেন আমজাদ।কিন্তু স্পর্শী সরলো না।তিনি পাশ কাঁটিয়ে চলে গেলেন।দুটো সিঁড়ি পেরোতেই হাত ধরে বসলো স্পর্শী।কাকুতি নিয়ে নরম গলায় শুধালো,
-আব্বু দয়া করে রাগের মাথায় এমন কিছু করবেন না যাতে পরবর্তীতে সেটা নিয়ে আফসোস করতে হয়।
ঘুরে পেছনে তাকালেন আমজাদ।ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাতেই স্পর্শী তার দিকে এগিয়ে বললো।বললো,
-আব্বু,প্রেমা যেটা করেছে সেটা একশোবার ভুল।কিন্তু এটা নিয়ে এমন চিল্লাচিল্লি, রাগারাগি, মারামারি করলে কি কোনো সমাধান আসবে?গতকাল রাতে পাভেল মেরেছে ওকে।আপনার বড় ছেলে বারবার তেড়ে গেছে,অপমান করেছে, বকেছে।একটা বার ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, ও ছোট না।তবে অবুঝ।কাল সারারাত ঘুমাইনি।ওকে পাহারা দিতে হয়েছে।কারন ও খুব-ই আবেগপ্রবণ ছিলো।আপনিই বলুন রাগের মাথায় ওকে মারলে বা বকা দিলে তার পরে যদি কিছু উল্টাপাল্টা কাজ করে তখন কিভাবে নিজেদের সামলাবেন?
আমজাদ শিকদার চোখ ঘুরিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন।সাথে সাথেই স্পর্শী আবারো বলতে শুরু করলো।
-আব্বু,ও এমনিতেই অনেক লজ্জা পেয়ে আছে।আপনি বরং আম্মুকে পাঠান।ও ঠিক কি চায়, কি জন্য এমন বোকামি করেছে সেটা জানুন।এরপর ওর চিন্তা যদি সৎ হয় তাহলে আপনি সেই বিষয় নিয়ে ভাবুন,দেখুন,সিদ্ধান্ত নিন।কিন্তু এভাবে মাথা গরম করে কিছু করলে উলটো বিষয়টা বিদঘুটে ভাবে ছড়িয়ে যাবে।
থেমে,
আমি বরং প্রেমার কাছে যাই।ওকে একা ছাড়া ঠিক হবে না।মাত্রই দেখলাম ভেতর থেকে দরজা আটকেছে।আপনি ঠান্ডা মাথায় ভাবুন।আপনার ছেলেদের বয়স কম,মাথা খারাপ,রক্ত গরম ;কিন্তু আপনি ছেলেমানুষ নন।আপনার মেয়ের ব্যাপারে,তার ভালোর ব্যাপারে নিজের মন দিয়ে যাচাই করবেন,রাজনীতির ট্রিকস দিয়ে নয়।
স্নিগ্ধ দুপুর।শীতের এই মৌসুমে কাঠখোট্টা, চৌচির হওয়ার মতো তাপ দেওয়া সূর্যটার আলোটাও যেন নরম, স্নিগ্ধ।চারপাশে তার জালের মতো বিস্তার করছে উষ্ণ রশ্নি।যেগুলোর প্রতিফলনে মানবজীবন হচ্ছে আরামপ্রদয়ক।এমনই এক শান্ত দুপুরে নিজের শুষ্ক,রাগী,গ্রীষ্মের চৌচির হওয়া মাঠের ন্যায় উত্তপ্ত মেজাজ নিয়ে সোভামের রুমে হাজির হলেন শামসুল সরদার। বারুদের মতো জ্বলে উঠে আগেপিছে কিছু না বলেই বললেন,
-তো এখন তোমার উদ্দেশ্য টা কি?মেয়েটাকে তো এই বয়সেই হোঁচট খাওয়ালে নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।এখন এর প্রভাব আমার মেয়ে দুটোর উপরে পড়ছে।
সোভামের মন-মেজাজ আজ অকারণেই ভালো নেই।কেন ভালো নেই সেটা সে জানে না।তবে ভালো নেই।এমন রুক্ষ,শুষ্ক মেজাজের মধ্যে বাবা এসে যেন ঠান্ডা পানি ছেড়ে দিলেন। মুহুর্তে’ই ফুসে উঠলো সে।বিরক্তি নিয়ে বললো,
-আমি আবার কি করেছি?উল্টাপাল্টা কিচ্ছু বলো না।ভালো লাগছে না।
-মেয়েটা খুব ছোট।তোমার লজ্জা হওয়া উচিত।এই শিক্ষা কি দিয়েছি আমি?
চমকে তাকালো সোভাম।কিছু বলার প্রয়াস করে উঠতেই আবারো শামসুল বললো,
-এমন একটা কাজ করার আগে এর নেগেটিভ সাইড ভেবে রাখা উচিত ছিলো। মেয়েটা কাল রাত থেকে গম্ভীর হয়ে আছে।যদি সুইসাইড করে বসে তোমার রিজেকশন পেয়ে?তখন?
সোভাম চমকালো।পরক্ষণেই শান্ত কন্ঠে বললো,
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৮
-এমন কিচ্ছু হবে না।
-হলে তখন কি করবে?আমার একটা সম্মান আছে।অপরাধ যেহেতু করেছো তাহলে প্রাশ্চিত্য করা উচিত।তুমি বিয়ে করবে ওকে।এটাই ফাইনাল।
-ওর বিয়ে ঠিক আব্বু।আর এসব আলতু-ফালতু কথা কে মাথায় ঢুকিয়েছে তোমার?প্লিজ!পরে কথা বলো।রাতে ঘুমাতে পারি নি, ঘুমাবো।
