রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৮০

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৮০
সিমরান মিমি

বিষয়টা গুরুতর।এটা নিয়ে ছেলেমানুষী বা হুটহাট কোনো কাজ করার ফল মোটেও সুবিধাজনক হবে না।মস্তিষ্ক ঠান্ডা করে বেশ অনেকক্ষণ বসে বিষয়টা নিয়ে ভাবলো।নানা রকমের ছক কষে সেটার অভিসম্ভাব্য সমাধান এবং ভবিষ্যৎ ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক গুলো নির্ণয় করলো।এরপর সময় নষ্ট না করেই ত্যাগ করলো কক্ষ।ত্রস্ত পায়ে গম্ভীর ভংগীতে গিয়ে বসলো সোফায়।বাবা শামসুল সরদার সেখানেই বসে আছেন।ছেলেকে দেখতেই তিনি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন।কিছু মুহুর্ত তাকিয়ে বাবাকে দেখে বুঝে নিলো তার মনোভাব।এরপর শান্ত আওয়াজে বললো,

-আব্বু,টিভিটা বন্ধ করো।কথা বলতে এসেছি।
শামসুল সরদার ছেলের দিকে না ফিরেই গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন।বললেন,
-বলো।
নড়েচড়ে বসলো সোভাম।এরপর কন্ঠে নমনীয়তা এনে বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো।বললো,
-তোমার কি মনে পরশ শিকদারের উপর শোধ তুলতে ওর বোনের সাথে এধরণের কোনো ঘৃন্য কাজ করবো?
জবাব দিলেন না শামসুল। কিছু মুহুর্ত চুপ থেকে বললো,
-আমি জানি তুমি এ ধরণের কিছু করো নি।কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী দোষী তুমি-ই।মেয়েটাকে নিয়ে দরজা আটকেছিলে কেন?আর কেনো-ই বা প্রতিটা কথায় আর্শি-পাভেল কে টানো?এজন্যই তো সন্দেহ হয় সবার।
-পাভেল শিকদার কোনোরকম কথাবার্তা ছাড়াই আমার সামনে মেয়েটার গায়ে হাত তুলেছিলো।সহ্য হয় নি,সেজন্যই ওর ভুল টা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-আচ্ছা,বুঝলাম।তবে বোন হচ্ছে পাভেলের।ওকে মারলে তোমার কেন সহ্য হবে না?
খুক খুক করে কেশে উঠলো সোভাম।বাবার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গমগমে সুরে বললো,
-তোমার উদ্দেশ্য টা কি?যেটাই বলি সেটাতেই নেগেটিভ কথাবার্তা বলো।আজব!ঐ টুকু মেয়ে,আমার হাটুর বয়সী।এ ধরণের চিন্তা-ভাবনা ও তো আনতে পারি না। মেয়েটার বয়স শঙ্কাজনক,আবেগী।আমি যথেষ্ট বুঝিয়েছি,ইগনোর করেছি।কিন্তু তাও থামাতে পারেনি।আমি ওইদিন ভাবতেই পারি নি ও আমার রুমে এসে যাবে।কেউ যাতে না দেখে সেজন্যই রুমে নিয়ে দরজা আটকে দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো ওকে ভালোভাবে বোঝাবো।কিন্তু এর আগেই যা ঘটার ঘটে গেলো।
শামসুল সরদার সবটা শুনলেন।এরপর বিচক্ষণতা নিয়ে বললেন,

-কিন্তু এটা কেউ বুঝতে চাইবে না।সবার দ্বিমত এটাই যে,প্রেমা তোমার রুমে ভুল করে অবুঝের মতো গেলেও তুমি কেন একটা বুঝদার ছেলে হয়ে তাকে নিয়ে দরজা আটকেছো।শোনো বাবা,কলঙ্ক দুজনের গায়েই লেগেছে।তুমি ভেবোনা,ছেলে বলে তোমাকে কলঙ্ক ছুঁতে পারবে না।অবশ্যই ছোঁবে।তোমার সামনে কেউ না বললেও পেছনে ঠিক-ই বদনাম করবে।মেয়েটাকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় কথা বলবে।হয়তো পরে তোমার নিজের ও আফসোস হবে যে তোমার কারনে কেউ আজ খোটার সম্মুখীন।
মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে সোভাম। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বললো,
-আমি চাই না এমন কিছু ঘটুক।আমজাদ আংকেলের সাথে কথা বলতে চাই এ বিষয়ে।তুমি কি যাবে?
-অবশ্যই!

ছায়াচ্ছন্ন বিকেল।শীতের নরম,নিস্তেজ আবহাওয়ার থেকেও বেশি নিরব হয়ে আছে শিকদার বাড়ির ড্রয়িংরুম টা।সেখানে চুপচাপ বসে আছে দুই বাড়ির গুরুজন রা।মানুষের সংখ্যা যে খুব বেশি সেটাও নয়।সরদার বাড়ি থেকে উপস্থিত আছে শামসুল সরদার, খলিল সরদার এবং সোভাম।আর শিকদার বাড়ি থেকে উপস্থিত আছেন শুধুমাত্র আমজাদ শিকদার, আলতাফ শিকদার। এতো কিছুর মধ্যে অনুপস্থিত রয়েছে দু ভাই।তাদের দেখা যাচ্ছে না বাড়ির কোনো কোনাতেও।দুজনেই বাড়ি ছেড়েছে দুপুরের আগেই।খাওয়া-দাওয়ায় বাদ দিয়ে চলে গিয়েছে রেগে-মেগে।ড্রয়িং রুম টা এখন ছোটো-ছোটো একটা বিচারালয় হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।নিস্তব্ধ,গুমোট পরিবেশে কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে নিলো সোভাম।কন্ঠে বিনয়ী ভাব নিয়ে আমজাদের উদ্দেশ্যে বলল,

-আংকেল,আমি জানি আপনি বিষয় টা নিয়ে খুব-ই রেগে আছেন।তবে ঠান্ডা মাথায় শান্ত হয়ে ব্যাপার টা একটু ভেবে দেখবেন,এখানে আমার কিছু করার ছিলো না।স্পর্শীর বিয়ের পর থেকেই প্রেমার মধ্যে আমি কিছু পরিবর্তন দেখতে পাই।প্রথম দিকে ব্যাপার টা নিয়ে না ভাবলেও পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি ও আমার প্রতি দুর্বল।আমি ওকে এ নিয়ে বুঝিয়েছি ও। হুটহাট আমার রুমে চলে আসা,যে-চে কথা বলতে চাওয়া এসব দেখে একদিন এখানে থাকার কথা থাকলেও সন্ধ্যায়’ই চলে যেতে বাধ্য হয়েছি কাজের বাহানা দেখিয়ে।ভেবেছিলাম দুরত্ব বাড়লেই প্রেমা ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না।এরমধ্যে ও সাথে গেল।ওইদিন সারাদিনে বাড়িতে ছিলাম না।রাতে ফিরেছিলাম ও অগোচরে।কিন্তু বুঝতে পারি নি কখন ও আমাকে দেখে ফেললো। এরপর তো অবুঝের মতো কাজ টা করে ফেললো। ও নিজেও হয়তো বুঝতে পারেনি এর পরিণাম কি হতে পারে।
থেমে,

আমি যখন রুমের সামনে দেখলাম তখন মুহুর্তের জন্য চমকে গেছিলাম।বাড়ি ভর্তি মেহমান,কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে ভেবেই রুমে নিয়ে দরজা আটকেছিলাম।ভেবেছি হয়তো কিছু ধমকে-ধামকে বুঝালেই ও শুধরে যাবে কিন্তু এরমধ্যেই পাভেল সেটা দেখে ফেললো।আর ওর রাগারাগি চেঁচামেচি তেই পুরো বাড়ির সবাই মাঝরাতে জেগে গেলো।আংকেল,আমি বলছি না এখানে প্রেমার দোষ।আসলে ভুল টা আমার-ই ছিলো।প্রথমদিকেই বিষয়টা আপনাদের জানানো উচিত ছিলো।
আমজাদ শিকদার পুরোটা শুনলেন।তবে কিছু বলার খুঁজে পেলেন না।আলতাফ শিকদার অবাক হয়ে গেলেন।আশ্চর্যের সুরে বললেন,

-সেকি!আমাদের প্রেমা তোমাকে পছন্দ করে?এটাই কি বাকি ছিলো।বড় ভাইদের আদর্শের মান রেখেছে।
বলেই হেসে দিলো।শামসুল সরদার নিজেও হাসলেন।এরপর খেয়ালি মনে বললেন,
-খারাপ কি?আমার বাড়ি খালি করে মেয়ে দুটোকে দিয়েছি, এখন তো আমার বাড়ি ভর্তি করতে হবে।দু-দুটো মেয়ে দিয়েছি, আমি তো মেয়ে একটা পেতেই পারি। কি বলেন বেয়াই?
আমজাদ শিকদার তখনো গম্ভীর।বললেন,
-এটা সম্ভব নয়।দোষ আমার মেয়ে করেছে।বদনাম ও হয়েছে।কিন্তু এসবের জেরে আমি সোভামের উপর অবিচার করতে পারি না।ও তো আর প্রেমাকে পছন্দ করে না।
থেমে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বললো,
-সমস্যা নেই বেয়াই।আপনি ভাববেন না আমার মেয়ের জন্য আপনার মেয়েদের কোনো অযত্ন বা অবহেলা হবে।আমি প্রেমাকে বোঝাবো।ও নিশ্চয়ই এই ভুল আর দ্বিতীয়বার করবে না।আপনারা নাস্তা করুন।
চমকে তাকালো সোভাম।তার চোখে-মুখে অবাকের রেশ ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে।সে আশা করে নি,মোটেও এই ধরণের প্রত্যুত্তর আশা করে নি।এসব পছন্দ ও না তার।কিন্তু কেন পছন্দ হচ্ছে না সেই কারন খুঁজে পেল না।হুট করেই মুখ ফুঁটে বলে বসলো,

-আমি একটু প্রেমার সাথে কথা বলতে চাই।
সবাই আচমকাই সোভামের দিকে দৃষ্টি দিলো।এমন একসাথে এতোগুলো চোখ সহ্য করতে পারলো না সে।অসস্তি হলো।পুণরায় আমতা-আমতা করে বললো,
-ও যেন কোনো উল্টোপাল্টা কিছু না করে…….. ব্যাস দু মিনিট কথা বলবো।
মাথা নাড়ালো সবাই।স্পর্শী এগিয়ে আসলো নাস্তার ট্রে হাতে।সবাইকে দিতে দিতে শশুরের দিকে এক ঝলক তাকালো।এরপর চোখে-,মুখে উৎফুল্লতা নিয়ে বললো,
-একটা খুব বেশিই সুন্দর সিদ্ধান্ত ছিলো।
আমজাদ আলতো হাসলেন।এরপর বললেন,
-সোভাম একটু প্রেমার সাথে কথা বলবে।নিয়ে যাও।
মাথা নাড়িয়ে ভাইকে ইশারা করে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল স্পর্শী। প্রেমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সোভাম কে অপেক্ষা করতে বলে নিজে ঢুকে গেল।এরপর প্রেমাকে শান্ত কন্ঠে বললো,

-বাড়ি থেকে সবাই এসেছে।আব্বুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব ও দিয়েছি।কিন্তু তিনি রাজি হননি।সোভাম ভাই তোমাকে পছন্দ করে না।আর আব্বু চান না জোর করে তার ঘাড়ে তোমাকে চাপিয়ে দিতে।ভাইয়া , বাইরে আছে।তোমার সাথে দু-মিনিট কথা বলতে চাইছে।হয়তো বোঝাবে।তা প্রেমা,তুমি কি এ বিষয়ে আগ্রহী?তাকে কি ভেতরে ঢুকতে দিবো?
টলমলে চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো প্রেমা।ধীরে ধীরে ঠোঁট কাপছে,নাকের আগা লাল হচ্ছে,চোখ দুটো টইটম্বুর হয়ে পড়েছে প্রায়।দু ফোঁটা গড়িয়েও পড়লো।কানের কাছে এখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,“সোভাম ভাই তোমাকে পছন্দ করেন না” কথাটি।আচমকাই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। ক্রোধমিশ্রিত গলায় চিৎকার করে বললো,
-আমি কারো সাথে কথা বলতে চাই না।ভুল করেছি,শুধরে নেব।কারো বোঝানোর দরকার নেই।আমি যথেষ্ট বুঝি।বের হও আমার রুম থেকে।আর আসবে না। প্লিজ!
স্পর্শী বেরিয়ে এলো।সাথে সাথেই স্ব-জোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা আঁটকে দিলো প্রেমা।শব্দ গুলো ড্রয়িং রুমে থাকা প্রত্যেকের কানে গেলো।আমজাদ শিকদার আলতো হেসে বললো,

-চিন্তার কিছু নেই।আমি সামলে নেব।
স্পর্শী বের হয়ে আফসোসের দৃষ্টিতে সোভামের দিকে তাকালো।এরপর আহত সুরে বললো,
-সরি!দেখলেই তো ও কথা বলতে চাইছে না তোমার সাথে ।হয়তো বুঝতে পেরেছে।আমার মতে এটা ঠিক আছে।কি দরকার এমন ছেলেমানুষী করার।বুঝতে পারছি না, মেয়েটা আবার জেদের বশে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দেয় কি-না?
সোভাম চমকে তাকালো।ভ্রুঁ কুঁচকে দৃষ্টি দিতেই স্পর্শী বললো,
-ওহহো!সরি,তুমি তো জানো না আবার।আসলে আমার খালা শাশুড়ীর ছেলে আছে একটা, ইঞ্জিনিয়ার। ওর ব্যাপারেই বিয়ের কথা চলছিলো।সমস্যা নেই,দুটো দিন নিজেকে সামলে নিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিবে।প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে সুইসাইড করার মতো মেয়ে আমার ননদ না।কি বলো?
দাঁতে দাঁত চেপে স্পর্শীর দিকে তাকালো সোভাম।চোয়াল শক্ত করে বললো,

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৯

-নাটকবাজ!
এরপর কোনোরকম কিছু না বলেই গমগমে পায়ে হেঁটে গেলো নিচে।ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো শিকদার বাড়ি থেকে।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৮১