রাজবধূ পর্ব ২৭

রাজবধূ পর্ব ২৭
রেহানা পুতুল

পরেরদিন সকালে শিখা আংটির মালিককে গোপনে খুঁজতে লাগল। যখন আবিষ্কার করলো তাকে। তখন শিখা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। পিতার বয়েসী একজন মানুষের চরিত্র এত কদর্য! এত ভয়ানক!
কে এই পুরুষ? সে কি আদৌ বেঁচে থাকবে? নাকি খু*ন হবে? কে হবে সেই খু* নী? শিখা? রাজ? জুবায়ের? বাদশা? আমেনা? নাকি এর বাইরেও অন্যকেউ?
ঘটনার বাকি রাত শিখার ঘুম হলো না আর। একটা জগদ্দল পাথর যেন কেউ তার বুকের উপর চাপা দিয়ে রেখেছে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় বিষিয়ে এলো মন। রাজের উপর জমলো ঘোর অভিমান ও অনুযোগ। কেন সে শিখা কোথায়, কিভাবে ঘুমাবে খোঁজ নিল না? এই ভালোবাসা?এই তার প্রজাপতি?এই দায়িত্ব? কেবল মন ভুলানো কথা দিয়ে জীবন চলে? মানুষটা এসব জানে না?

শিখা মনস্থির করলো রাজের সঙ্গে আর কথাই বলবে না। নিয়তি তার কপালে যা রাখছে তাই হবে। এই তালুকদার বাড়িতে আজ অবধি তার কোন সুখকর অভিজ্ঞতা হলো না। যতটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো সবই তিক্তকর! লাঞ্চনার! হেনস্তার! শিখা আক্ষেপের স্বাস ছাড়ে। সকালে উঠে কলতলায় চলে যায়। অজু করে নেয়। এসে রুমের নিচে মেঝেতে তার একটা শাড়ি বিছিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে। স্রস্টার কাছে তার শরীর ও মনের হেফাজত প্রার্থনা করে অশ্রু বিসর্জন দেয়। তারপর আংটিটাকে লুকিয়ে মুঠোবন্দী করে বেরিয়ে যায়।
এত বিদঘুটে বিষয় দু’কান করা যাবে না। রাতের গোপন চোরকে গোপনেই ধরতে হবে। এই বাড়িতে সে ভরসার মানুষ একজনই পেয়েছে। তিনি মতির মা। তার প্রাণের জামিলা খালা।
মতির মা কাপড়ের আঁচল দিয়ে নাকমুখ বেঁধে রান্নাঘরের ত্রিমুখী মাটির চুলা থেকে ছাঁই তুলছে। এখন ঘরভর্তি অতিথি। বেলায় বেলায় হাঁড়ি হাঁড়ি রান্না হয়। তাই ছাঁই ও তুলতে হচ্ছে দু’বেলাই। নয়তো চুলায় আগুন দিতে অসুবিধা। শিখাকে দেখেই ইশারায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” সরো মাইয়া। গা ভইরা যাইবো ছাঁই উইড়া গিয়া।”
শিখা একটু চেপে দাঁড়ায় দরজা থেকে। মতির মা টিনের গামলা ভর্তি ছাঁই বাইরে নিয়ে একটি পরিত্যক্ত স্থানে ফেলে দেয়। হাত ধুয়ে দাঁড়ায়। শিখাকে নিয়ে অদূরে নিরব স্থানে যায়। ঘরের সবাই ঘুমে বিভোর। কেউই উঠেনি এখনো।
“কি হইছে মাইয়া? কোন সমস্যা?”
শিখা হাতের মুঠি মেলে ধরে। ফিসফিসিয়ে ব্যথিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“খালা এই আংটি কার? কইতে পারবেন?”
মতির মা আংটিটা নিজের হাতের তালুতে নিলো। দেখলো হালকা ধূসর রঙের চকচকে একটা পাথরের আংটি। সে শান্ত ভঙ্গিতেই বলল,
” এইটা ত তোমার চাচা শ্বশুরের আঙ্গুলের। কই পাইলা? ক্যামনে হারাইলো? দামী আংটি এইটা। দিয়া দিয়ো। খুশী হইবো তোমার উপর।”
বিস্ময়ে,ঘৃণায়,ক্রোধে,শিখার গা গুলিয়ে এলো। যেই মানুষটা দিনের আলোয় নিজের পা ছুঁতে মানা করলো শিখাকে। ঠিক সেই মানুষটারই পুরুষালী হাত রাতের গভীরে
শিখার বুকে চলে গেলো? কি জগন্য! কি পৈশাচিকতা! এর শাস্তি অবধারিত।
শিখা বলল,

“খালা দিয়া দিমু। তবে আপনে উনারে বা কাউরে বইলেন না কিছু। আমি পরে আপনেরে কিছু জানানু।”
শিখার কথায় রহস্য খুঁজে পেলো মতির মা। তবুও সরল গলায় বলল,
“আমরা কামের মানুষ। রাইতদিন গতর খাটাই আমগো কাম। বাড়তি কথা কওনের সুযোগ নাই আমগো।”
শিখা আংটিটা নিজের কাছে লুকিয়ে রাখলো সাবধানতা অবলম্বন করে।
আজ সন্ধ্যায় আদুরীর গায়ে হলুদ। সকালে নাস্তা খাওয়ার পর সবাই গায়ে হলুদের ম্যাচিং করা শাড়ি,ব্লাউজ ও অনান্য জিনিস দেখা আরম্ভ করলো। শিখা ভিখারির মতো দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের এগুলো দেখছে। কেউ তারসঙ্গে যেচে কথা বলে না সেই আগের মতই। তারা সবার মত বিনিময় করছে। এটা পরবে,এই স্টাইলে পরবে, এভাবে, ওভাবে সাজবে।

তখন রাজ বাইরে থেকে ঘরের ভিতর এলো। দেখলো সবাই বৈঠকখানায় হলুদের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। শিখাও মাঝখানের দরজায় দাঁড়িয়ে সেগুলোর দিকে চেয়ে আছে। রাজকে দেখেই শিখা আড়াল হয়ে গেলো। রাজ ব্যতিব্যস্ত গলায় সুফিয়া বিবিকে বলল,
“মা বিয়ের গেইট সাজানো হচ্ছে। তারপরে খাওয়ার জন্য প্যান্ডেল দুটো হবে। একটা গ্রামের সাধারণ গেস্টদের জন্য। আরেকটা বরপক্ষের জন্য। বরের জন্য স্পেশাল স্টেজ তৈরি হবে। গায়ে হলুদের স্টেজ উঠানের কোনপাশে করবে? ডেকোরেশনের যাবতীয় কাজ এরাই করে দিবে স্টেপ বাই স্টেপ।”
“বামপাশে বরইতলায় করতে কইস।”

রাজ তখন স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলো,
” শিখার গায়ে হলুদের কাপড়চোপড় কই?”
তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। কেউ কিছু বলছে না। রাজের প্রশ্নাতীত চাহনিটা সবার মুখের উপর ঘুরছে। সুফিয়া বিবি বেজার কন্ঠে বলল,
“তার লাইগা ত কেনা হয়নাই। সে কি শাড়ি পইরতে পারে? বৌভাতের দিন শাড়ি পিন্দা কিভাবে উষ্ঠা খাইয়া পড়লো? আর সে আইবো কি আইবো না কে জানে?”
রাজ থ বনে গেলো। অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
“এটা কেমন কথা মা? শিখা কি এই ঘরের মানুষ নয়? সে থার্ড পারসন মা? সে শাড়ি পরতে না পারলে এতগুলো মানুষের মধ্যে কেউ পরিয়ে দিতে পারবে না? আদুরীর বিয়ের উৎসবে তার আনন্দ করার অধিকার নেই? এটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।”
সুফিয়া বিবি নিমরাজি কন্ঠে বললেন,

“বাবারে হইছে। থাম। আমাগো ভুল হইছে। এখন আইনা দে সব যা।”
“এগুলো কোন মার্কেট থেকে কেনা হয়েছে?”
উত্তর দিলো ডলি। বলল,
“ছোট ভাইয়া, গায়ে হলুদের এগুলো জুবায়ের ভাইয়া ব্যবস্থা করছে। উনার কাপড়ের দোকান। তাই আমরা এই দায়িত্ব উনারেই দিছি।”
“আচ্ছা, আমি লোক পাঠাচ্ছি জুবায়েরের দোকানে। আর মা, শিখার পরিক্ষা শেষ। ও এখন এখানেই থাকবে। ওর জন্য কোন রুম বরাদ্দ হয়েছে? গত রাতে কোথায় ঘুমালো শিখা?”
“এখনো কোন রুম ঠিক হয়নাই ছোট মিয়া। ঘরে এমনেই ঝামেলা এখন। এক জায়গায় ঘুমাইলেই হইলো। রাতে মনে হয় তার থাকার আগের রুমটায় ঘুমাইছে।”
মুরুব্বীভাব নিয়ে বলল রানী।

“সেই রুম ছাড়া অন্য কোন রুম যেন আজকের মধ্যেই তার জন্য বরাদ্দ হয়। তোমাদের রুমের মতো। আমার রুমে একবারে সে বধূবেশে প্রবেশ করবে। নয়তো আমার রুমেই ঘুমাতে পারতো।”
গমগমে স্বরে আদেশ দিয়ে বলল রাজ। সুফিয়া বিবি চনচনে গলায় ছেলেকে বলল,
“গলা উঁচাইয়া তুই মায়ের সামনে কথা কস? বউ একলা মানুষ। কোনরকম একটা রুম হইলেইত হয়। পরেতো তোগে দুইজনের একইরুম হইবো। সইরা যা কইলাম।”
“যদি তাই হয়,বড় ভাবিতো এখন বিধবা। একজন। সে অন্যরুমে ঘুমাক তাহলে?”
বাক্যটি দরাজ কন্ঠে বলেই রাজ ভারি ভারি পা ফেলে দোতলায় চলে গেলো। কাগজ কলম নিয়ে বসলো। কিছু লিখলো। ঠাস ঠাস পায়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে এলো। উঠানে গিয়ে বরকতকে ডাক দিলো হেঁড়ে গলায়। বরকত হুমড়ি খেয়ে রাজের সামনে এসে পড়লো।
“মার্কেটে যা। জুবায়েরের হাতে এই কাগজটা দিবি। ট্যাম্পু করে চলে যা। রিকশায় লেট হবে।”
বরকত বিলম্ব করল না। চলে গেলো। জুবায়ের দোকানে বসে ল্যান্ডফোনে কথা বলছে কোথাও। টেলিফোন রেখে বলল,

“কিরে বরকত? কোনটা কেনাকাটা করতে হবে আর?”
“ছোট ভাইজান এইটা আপনারে দিতে বলছে। ধরেন।”
জুবায়েরে কাগজটি নিলো। পড়লো ভালো করে।
“জলদি বরকতের কাছে শিখার জন্য গায়ে হলুদের সেইম শাড়ি,পেটিকোট, ব্লাউজ, (সাইজ ৩৪) গলার মালা,কানের দুল, চুড়ি এসব কিনে পাঠা। তুই কেমন জানে দোস্ত আমার জুবায়ের? তোর কি একবারও শিখার কথা মনে হয়নি? সবার জন্য কিনলি আর শিখা বাদ রয়ে গেলো? শিখা চোখের সামনে ছিল না বলে ভুলেই গেলি তাকে? সে কি তালুকদার পরিবারের বাইরের মেম্বার? অথচ আমার পরিবর্তে শিখার দায়িত্ব আমি তোকে দিয়ে রেখেছি। যেহেতু আমি গ্রামে থাকি না। আজ বড় কষ্ট পেলাম সবার উপরে। তোর উপরেও।”
জুবায়ের হাসলো একচোট। বরকতকে দোকানে বসিয়ে নিজেই উঠে গেলো। সব কিনে এনো বরকতের হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। বরকত বাড়িতে এসে দোতলায় গিয়ে রাজের পালংকের উপরে প্যাকেট রাখলো। নিচে এসে রাজকে জানালো। রাজ তার রুমে গেলো। প্যাকেট খুলে দেখলো সব ঠিকাছে। জুবায়েরের উপর সন্তুষ্ট হলো বেশ।

রাজ প্যাকেট হাতে নিয়ে নিচে এলো। শিখাকে নিজেই ডেকে আনলো একরুমে। দরজা বন্ধ করে দিলো। প্যাকেটটি হাতে দিয়ে বলল,
“গায়ে হলুদের এসব তোমার জন্য। নিদিষ্ট সময়ে সেজেগুজে রেড়ি হয়ে যাবে। বিয়ের মেকাপ বক্স আছে না? ”
“হুম আছে। ”
“ওকেহ। কাউকে না পেলে আনন্দে করবে আমার সঙ্গে।”
“কই থেইকা আইলো এসব? কে আইনা দিলো?”
অসহায়ের মতো করে বলল শিখা।

“আমার বাল্যকালের বন্ধু ও ভাই। জুবায়ের। বরকতের কাছে সে কিনে দিয়েছে। তোমার ব্লাউজের সাইজ আমি জানি না। আন্দাজ করে চৌত্রিশ বলছি। ঠিক আছে প্রজাপতি?”
“চৌত্রিশ ঢিলা হয় গায়ে। আইচ্ছা সমস্যা নাই।”
রাজ দূরত্ব রেখে শিখার গালে নিজের আঙ্গুলগুলোর পিঠ ছোঁয়ালো আলতো করে। পরক্ষনে নিজের আঙ্গুলগুলোকে নিজের গালের একপাশে বুলিয়ে নিলো। বলল,
“ঢিলাটুকু কয়মাস পর থাকবে না। ঠিক করে দিবো। তোমার জন্য রুম ঠিক হবে আজই। মন খারাপ করো না। তোমার আমিতো আছি।”
রাজ চলে যায়। শিখা বুদ্ধিমান। মায়ের মতই। তাই রাতের বিষয়টি রাজকে জানাল না। কারণ সে চিন্তা করলো যেখানে বৌভাতের দিন সীমান্ত তার আঁচল ছুঁয়েছে, তাতেই রাজ ক্ষেপে গেলো। সীমান্তকে নাস্তানাবুদ করে ফেলল গায়ে হাত তুলে৷ আর গত রাতের বিষয় জানলে বিয়েবাড়ি মাথায় উঠবে। খু* ন খারাবিও হতে পারে। আদুরীর কপাল পুড়বে পরে। যে বাড়িতে বিয়ের একদিন আগে হ* ত্যা হয়,সে বাড়ির মেয়েকে কেউই বউ করে ঘরে তুলে নিবে না।

পুরো বাড়ি নানা রঙ বেরঙের মরিচ বাতি দিয়ে আলোকৌজ্জ্বল করা হয়েছে। বর্ণিল আলোচ্ছটা ঠিকরে পড়ছে সবার চোখেমুখে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো উঠানে। বরের পক্ষ আসেনি। কারণ দুপক্ষ নিজ নিজ বাড়িতে নিজেদের মতো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করবে। এটাই সমঝোতা হয়েছে। এর কারণ দুই গ্রামের দূরত্ব অনেক।
হলুদে সবাই গান গাইছে। দুষ্টমি করছে। হলুদ লাগাচ্ছে বউকে। এ ওর গালে। শিখাও অন্য অতিথিদের সঙ্গে দুষ্টমি করছে। তার পর একটা খেলা শুরু হলো। যারা মেরিড তাদের চোখ বেঁধে দেওয়া হলো। সবাই সবার বরকে গিয়ে ছোঁবে। সব বরেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে উপবিষ্ট উঠানের মাঝে। শিখা দেখছে রাজ কোথায় বসে আছে। সে আস্তে আস্তে হেঁটে গেলো। গিয়েই রাজের বসা চেয়ারের সামনে দাঁড়ালো। মানুষটির মুখ,পিঠ, হাতড়ে নিয়ে হাত পেঁচিয়ে ধরলো সুখ সুখ মনে। শিখা পড়ে যেতে লাগলে সেও শিখার হাত ধরে ফেলল। তখনই সাউন্ডবক্সে বেজে চলছে সেই গান,

“আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে/ আমি ছুঁয়েছি তোমায়।
প্রজাপতি ছুঁয়েছে ফুল/ তুমি ছুঁয়েছ আমায়.
সাগরিকা বেঁচে আছে/তোমারই ভালো-বাসায়..”
শিখা রাজের কথা শুনতে পেলনা। চোখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। সেই মানুষটি শিখার বাঁধন খুলে দিলো। শিখা তাকে দেখেই আৎঁকে উঠলো। ভড়কানো কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনে এই চেয়ারে ক্যান? উনি কই গ্যালো? আমি আপনারে ধরেছি?”

রাজবধূ পর্ব ২৬

গানের সুরে ও কথায় মানুষটি মমন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শিখার মুখপানে চাইলো। বলল,
“স্রস্টার ইশারা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না। এটা বিশ্বাস করো তুমি?”
“হ খুব করি।” বলেই শিখা এলোমেলো পায়ে ঘরের ভিতরে চলে গেলো। মানুষটি শিখার চলে যাওয়ার দিকে মোহাবিষ্ট চোখে চেয়ে রইলো।
তার খানিক পরেই,

রাজবধূ পর্ব ২৮