রাজবধূ পর্ব ৬০
রেহানা পুতুল
ভাবতেই প্রখর রোদ্দুরের মাঝেও শিখার সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেলো কনকনের শীতের রাতের ন্যায়। তবে এই কবরের রহস্য সে আবিষ্কার করেই ছাড়বে।
শিখা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করলো কার কবর হতে পারে এটা? ঘরে গিয়ে কি সুমনাকে জিজ্ঞেস করবে? নাকি জুবায়েরকে? নাকি সরাসরি তার স্বশুরকে? নাকি রাজকে? উমমম! এটা বোধহয় ঠিক হবে না। কিন্তু তাহলে কিভাবে জানবে সে?
শিখা গোলাপজাম গাছের নিচে গেলো। নিচে ঝুঁকে থাকা একটি শাখা টেনে ধরলো হাত উঠিয়ে। একথোকা পাকা টসটসে গোলাপজাম ছিঁড়ে নিলো। বেতুইন নিল না আর। পুকুরঘাটে নেমে সবগুলো ধুয়ে নিলো। নিজের রুমে গিয়ে বসে বসে সবগুলো খেয়ে নিলো। মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে কবরের বিষয়টা। থেকে থেকে কবরটা দৃশ্যমান হচ্ছে তার মনের আরশীতে। তার মনে কু ডাকছে। এই কবরটা সেই মনসুর চাচার বাবা আজগর আলীর নয়তো? তিনি বলল তার বাবা নিঁখোজ।
সেইরাতে শিখার ঘুম এলো না। যেন তার কাঁধে বিশাল দায়িত্ব পড়ে গিয়েছে। যেন কোন অদৃশ্য ছায়া তাকে অনুরোধ করে বলছে, তালুকদার পরিবারের যত অনাচার,অমানুষিকতা,নিষ্ঠুরতা সব যেন শিখা নিজ হাতে দমন করে। এবং নিজের পায়ের তলায় মাটিকে মজবুত ও উর্বর করে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তারপর শিখা কলেজে গিয়ে চুপিচুপি একটা ছেলে ক্লাসমেটের মাধ্যমে জেনে নিলো,কবরের বয়স ছয়মাস পার হয়ে গেলে সেই মৃত ব্যক্তির হাড় ও দাঁত থেকে ডিএনএ টেস্ট করা কিছুতেই সম্ভব নয়। শিখা বুঝলো তাকে নতুন চাল করে বের করতে হবে এটা কার কবর। ঘরের কাউকে জিজ্ঞেস করলে তারা জানলেও স্বীকার করবে না। দায় এড়ানোর জন্য নিজেদের কারো বলে চালিয়ে দিবে।
দুইদিন পর হাসপাতাল থেকে তালুকদারকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন তিনি। তার এক সপ্তাহ পর রানির রিলিজ হয়ে গেলো ঢাকা মেডিক্যাল থেকে। জুবায়ের তার দোকানের ল্যান্ডফোন থেকে টেলিফোন করে রাজকে বলে দিলো,সে যেতে পারবে না। রাজের গাড়ি দিয়ে যেন রানি ও ডলিকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। রাজ তাই করলো। নিজে গেল না রানিকে দেখতে। তার ড্রাইভার গিয়ে রাজের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী হাসপাতালের সবকিছু করলো। বিল মিটিয়ে রানি, ডলিকে নিয়ে বাড়িতে চলে গেলো।
তালুকদার পরিবারের পরিবেশ গতিহীন নদীর মতো। নিঃশ্চল! স্থির! শান্ত! যার যার অবস্থানে সবাই মনোবেদনায়,যাতনায় গোপনে তিলে তিলে পুড়ে মরছে। কেউ কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না। তারা ধীরে হাঁটে,ধীরে চলে,ধীরে বলে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। একেকজন যেন নিশিরাতের ক্ষয়ে আসা চাঁদ। কিংবা কোন দুঃখীনি ডাহুক।
পর পর কিছু পারিবারিক ন্যাক্কারজনক ঘটনায়, জয়নুল তালুকদার মানুষিকভাবে কাবু হয়ে গিয়েছেন। বয়সকে আশ্রয় করে কিছু রোগ বাসা বেঁধেছে ন্যুব্জ হয়ে আসা দেহখানিতে। সংসারের হাল আর ধরে রাখতে পারছেন না। এটা আর তিনি চানওনা।
স্মিত হয়ে এলো সুফিয়ার ঝাঁঝালো বদরাগী কণ্ঠস্বর। নড়বড়ে হতে লাগলো তার শাসিত রূপ।
আদুরীর ঠমকমারা চলন বলন কোথায় যে মিলিয়ে গেলো বাতাসার মতন। মন্থর হলো দুপদাপ করে চলা তার চরণ গতি। প্রায়শই নিজেকে করে রাখে গৃহবন্দী।
খালেদ ও আসলাম শহরে থাকলেও সবকিছু অবগত। তাদেরকে বোন আদুরী টেলিফোন করে সব জানিয়েছে। তারা হাসপাতালে গিয়ে রানিকে দেখে এসেছে। তারপর হতে তারা দু-ভাইও ঘাবড়ে গেলো।
রানি হয়ে গেলো চিরবোবা ও ঘরের কোণের আরশোলা। সুমনা ও ডলি প্রতি কদম ফেলে সতর্ক হয়ে। যেন কারো নজর বন্দী তারা।
ফুফু জাহানারাও, রানির বিষয় শোনার পর হতে নিজের দম্ভনীয় মেজাজকে বরফ করে ফেললেন।
এই নারীগুলোর অহমিকার তেজ ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো। ঠিক বেলাশেষে অস্তমিত হয়ে আসা ডুবু ডুবু সূর্যটার মতো।
আমেনার মাঝে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ তিনি কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। আগের মতোই আছেন নিজের সমস্ত সারল্যতা নিয়ে।
জুবায়ের, সেতো রাজ শিখার অকৃত্রিম বন্ধু। ফুলের মতো সুবাস বিলিয়ে একসময় ঝরে যাওয়াই হবে তার কাজ।
সবার জীবনের এই অভূতপূর্ব পরিবর্তিত প্রলয়ের কেন্দ্রবিন্দু একজনই। শিখা। সে কিন্তু এমন কিছু চায়নি। রঙিন প্রজাপতির ন্যায় উড়ে চলা ও চঞ্চল মেয়েটি চেয়েছে সবার আপন হয়ে থাকতে। তা হয়নি। অথচ সম্পর্কগুলো রূপ নিলো গ্লানিতে,প্রতিশোধে, হিংসায়, অভিযোগে,রেষারেষিতে। যেন মরা বিকেল। সবাই শীতল আচরণ করছে শিখার সঙ্গে।
এদিকে শিখা রাজের আদেশে আলাদা রান্না করে খায়। কলেজে যাওয়ার আগের সময়ে রান্না করে রেখে যায়। যেদিন পড়াশোনার চাপের জন্য রান্নার সময় হয় না। সেদিন মতির মা তার জন্য ছোট হাঁড়িতে রান্না করে রাখে।
জোছনারও বিয়ে হয়ে গেলো ঠিক করা সেই পাত্রের সাথেই। জোছনারাও উজানপুর গ্রামের বাসিন্দা। তাই মতির মায়ের ছুটি নিতে হয়নি মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে। তালুকদার বাড়ি থেকে যাওয়া আসা করেই অতি সাধারণভাবে বিয়ে সম্পন্ন করেছে। তিনি কয়েকবছর ধরে তালুকদার পরিবারে শ্রম দিচ্ছেন। তার বিনিময় হিসেবে জোছনার বিয়ের সম্পূর্ণ খরচ তালুকদার পরিবার বহন করলো। জোছনা স্বশুর বাড়িতেই থাকছে। তাই তালুকদার বাড়িতে তার আর কাজ করতে হচ্ছে না মায়ের সঙ্গে। ঘরের কাজ রানি,সুমনা,ডলি,আদুরী, মতির মা করছে। শিখাও বসে থাকে না। সময় সুযোগ পেলেই ঘরের কাজে হাত লাগাচ্ছে। বাগানের কাজ বরকত করছে।
জুবায়েরের নানী হারিছা খাতুন ক্রমশ বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। চিকিৎসা চলছে। তবুও উন্নতি হচ্ছে না। বিছানা চাটাই নষ্ট করে ফেলছেন যখন তখন। তার অবস্থা বেগতিক শুনে তালুকদার মনে মনে ঘাবড়ে গেলেন। বুঝি তারও পরপারের ডাক চলে আসবে। তাই তিনি এক নিরিবিলি সকালে শিখাকে তার রুমে ডাকলেন।
শিখা গিয়ে মধুর গলায় বলল,
“বাবা ডেকেছেন আমায়?”
“হ মা। বসো।”
শিখা বসলো। তালুকদার ঘোলাটে চোখে শিখার দিকে তাকালো। কাতর স্বরে বলল,
“মারে, আমার শরীর মন ভালো ঠেকছে না। কখন ওপারের ডাক আসে বলা যায় না। তোমার মায়েরে কইয়ো আমারে মাফ কইরা দিতে কোন ভুল কইরা থাকলে। তুমিও নিজের বাপ মনে কইরা আমার উপর কোন ক্ষোভ পুইষা রাইখো না মনের ভিতর। তুমি একরত্তি মাইয়াটারে কত আউস কইরা ছোট ছেলের বউ করে আনলাম। কিন্তু কত বড় বড় ঝড় তুফান তোমার উপর দিয়া গেলো মা। তোমার উপর আমার দোয়া রইলো। একদিন তুমি অনেক বড় কিছু হইবা। এই উজানপুর গ্রামের মানুষ তোমারে মাথায় তুইলা রাখবো। ইজ্জত করবো।”
বলতে বলতে তালুকদারের গলা ধরে এলো। চোখদুটো টলটলে হয়ে উঠলো। স্বশুরের মুখে হৃদয় হরণ করার মতো কথাগুলো শুনে শিখা আবেগাপ্লুত হয়ে গেলো। কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে।
স্বশুরের হাতদুটো ধরে বলল,
“বাবা আপনি এত বিপর্যস্ত হবেন না। আপনি বেঁচে থাকবেন। আপনার উপর আমার কোন অভিযোগ নেই। বরং আমি চির কৃতার্থ, আপনার চেষ্টায় আমি এত বড় মনের একজন মানুষের জীবনসঙ্গিনী হতে পেরেছি। নয়তো কোনদিনও এটা সম্ভব হতো না।।আপনি পছন্দ করেছেন বলেই উনিও আমাকে পছন্দ করেছেন। আপনার এই মহানুভবতা আমার হৃদয়ে অম্লান রবে চিরটাদিন বাবা। আপনি আমার সাহস ও ভরসার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। বরং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমার জন্যই মায়ের অনেক ঝাড়িঝুড়ি,চোখ রাঙানি, রুক্ষ আচরণ সহ্য করতে হয়েছে আপনাকে। আপনি বর্তমানে শুধু আপনার সুস্থ থাকা ও ভালো থাকা নিয়ে ভাববেন। আমি যতক্ষণ পারি,যা পারি অবশ্যই আপনার প্রতি যত্নশীল থাকবো।”
তালুকদার রুগ্ন হাতখানা বাড়িয়ে শিখার মাথায় পিতৃস্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলো প্রাণ উজাড় করা ভালোবাসা ও আশীর্বাদ ঢেলে।
নূরী উঠানে নিরালায় বসে বসে বটি দিয়ে নারকেল পাতা থেকে শলা নিচ্ছে। আর বেসুরা সুরে নিজের বানানো গীত গাইছে।
‘আমার মাইয়া সোনার পুতলা, কাইন্দা কাইন্দা কয়,
মাগোওও…তোমার লগে হইবো গো দেখা অন্য দুনিয়ায়।’
শিখা পিছন থেকে নূরীকে জড়িয়ে ধরে আম্মা ডেকে উঠলো। দুই হাঁটু ভেঙ্গে বসে মায়ের দুই পা ছুঁয়ে সালাম দিলো। নূরী হতচকিত হয়ে গেলো আচম্বিতে আদরের ছোট মেয়ের মুখখানা দেখতে পেয়ে।
” কিরে মা, একলা যে তুই? জামাই কই?”
“আমার আম্মার যা কথা। মেয়ে বাবার বাড়িতে যতবার আসবে,ততবার জামাই আসা লাগবে?”
গাল ফুলিয়ে আহ্লাদী ঢংয়ে বলল শিখা
নূরী বলল,
“ঘরে গিয়ে ব্যাগ রাইখা আয়। ওইটা আবার কি?”
“কি আবার? তোমার পছন্দের খাবার আনলাম কিনে। আম্মা জানো, তাদের বাড়ির বাগান ভর্তি ফল পাকড়া। তারাও খায়। পাখিও খায়। অন্য বাড়ির মানুষও খায়। মন চাইলো তোমার জন্য দুটা আতাফল আনি। কিন্তু খারাপ দেখায়। ধরে নিবে বেশী কতৃত্ব ফলানো শুরু করেছি। তাই আপাতত আনলাম না।”
“সবাই খায়। তুই খাস না গাছে চইড়া?”
মুচকি হেসে জানতে চাইলো নূরী।
“হ খাই।”
নূরী বুঝলো,নিজে না উঠলে মেয়েও তাকে ছেড়ে যাবে না। নূরী হাতের কাজ একপাশে ঠেলে রাখলো। ঘরে গেলো। শিখাও মায়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে ঘরে গেলো। কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগ ও হাতের ব্যাগ রাখলো টেবিলের উপরে। হাতমুখ ধুয়ে এলো। নূরী একটি টিনের কৌটা থেকে ঝালনাড়ু বের করে দিলো মেয়েকে। শিখা কয়েক কামড়ে খেয়ে ফেললো। এক গ্লাস পানি খেয়ে অমৃত খাওয়ার মতো করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো।
নূরী রান্নাঘরে মাটির চুলোয় রান্না করছে। শিখা মায়ের পাশে পিঁড়ি টেনে বসলো। এই ভিতরে ঘটে যাওয়া সবকিছু মাকে বলল গল্পের মতো করে গুছিয়ে গুছিয়ে। নূরী বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো মেয়ের স্বশুর বাড়ির হাল হকিকত শুনে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। নিমিষেই হাতের কাছে থাকা সিলভারের পানির জগটিতে মাটির কলসি থেকে পানি ঢেলে নিলো। ঢকঢক করে জগভর্তি সব পান করে নিলো। বাষ্পরুদ্ধ গলায় শিখার বিয়ের ঘটক ছেরু মিয়া ও তার স্বশুরকে ইচ্ছেমতো ঝাড়লো। শিখা মাকে থামালো।
“আহ! আম্মা থামো। সালুন পোড়া যাবে। উনাদের কি দোষ? কপালের লিখন যায়নাকো খণ্ডন! এটাতো তোমার বুলি। তারপরেওতো তোমার মেয়ে দিব্যি আছে স্বামী সোহাগী হয়ে। আলো আপারে দেখতে যাবো। বিকেলে চলো আম্মা।”
আকস্মিক নূরীর তাতিয়ে উঠা মেজাজ স্তিমিত হয়ে এলো। বিকেলেই নূরী মেয়েকে নিয়ে বড় মেয়ের বাড়ি গেলো। রাতে রয়ে গেলো। আলো ও শিখা গলাগলি করে এক বিছানায় ঘুমালো। দুজন সারারাত্রি ধরে অনেক গল্প করলো। পরেরদিন সকালে চলে এলো নিজেদের বাড়ি।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলো। শিখা তারবিহীন রেডিওটা হাতে নিয়ে চালু করলো। চট্রগ্রাম স্টেশন ধরলো সুচ ঘুরিয়ে। খবর ছাড়া কোন স্টেশনে এখন গান নেই। ‘অনুরোধের আসর’ নামক গানের অনুষ্ঠান শুরু হবে রাত নয়টায়। শিখার সব অনুষ্ঠানের নাম মুখস্থ। তাদের দুঃখক্লিষ্ট সংগ্রামমুখর জীবনে বিনোদনের একমাত্র অন্যতম মাধ্যম ছিলো এই রেডিওটি। তাই শিখা সব জানে। কখন কোন প্রোগ্রাম শুরু হবে। তারা মা মেয়ে মনোযোগ সহকারে খবর শুনছে। এই রেডিওটা শিখার এক মামা তাদের উপহার দিয়েছে কয়েক বছর আগেই।
বাড়ির ভিতরে মোটরসাইকেলের গমগমে শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দগুলো তাদের ঘরের নিকটবর্তী হয়ে আসছে। একসময় থেমে গেলো। শিখা দরজা ফাঁক করতেই দেখলো জুবায়ের বাইক থেকে নামছে।
“আরেহ জুবায়ের ভাই? হঠাৎ? এই সময় এলেন যে? আসেন আসেন।”
জুবায়ের অমলিন হাসলো শিখার দিকে চেয়ে।
ঘরে প্রবেশ করলো শিখার পাশ ঘেঁষে। টেবিলে ফলমূলের বড় দুটো ব্যাগ রাখলো। নূরীকে সালাম দিয়ে বলল,
” দেখলেন খালাম্মা আপনার মেয়ের কথা? আত্মীয়স্বজন আসতে সময় মেইনটেইন করে আসতে হবে?”
মশা আসে বলে শিখা দরজা চাপিয়ে দিলো ভিতর থেকে। মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। নূরী সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
“বাবা বসো তুমি। কুটম বাড়ি কুটুম আসবে। এতে রাত কি দিন কি। যখন মন চাইবে তখন আসবে। শিখার কথায় মনে কিছু নিও না। ও এমনিতে চঞ্চল। দিল একদম খালি। কিচ্ছু নাই। আর এভাবে তুমি কখনো আমাগো বাড়ি আসনাই তো। তাই একটু ভিমরি খাইছে তোমারে দেইখা।”
” তা বুঝতে পেরেছি খালাম্মা। শিখা আমাদের সংসারে দুই বছর ধরে বউ হয়ে আছে। ওর সম্পর্কে আমিও বেশ জানি।”
নূরী ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে যায় জুবায়েরের জন্য নাস্তা তৈরি করতে। শিখা ব্যাগ দুটো নিয়ে ভিতরের রুমে মাকে দিয়ে আসে।
শিখা হেয়ালী করে দুষ্ট দুষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“এমনি তো আপনি আসেন নি। আসার বিশেষ হেতু কি? বলে ফেলেন?”
“রাজ পারছেনা আর, তাই আমাকে পাঠালো পারার জন্য।”
তামাসার ছলে না হেসেই বলল জুবায়ের।
“বুঝিনি? কি বিভ্রান্তিকর আনসার দিলেন?”
“কোন বিভ্রান্তিকর নয়। তুমি প্রশ্ন যেমন করলে,তার জবাবও তেমন পেলে। রাজ দুপুরে টেলিফোন করে বলল, তুমি বাবার বাড়িতে আছো। কয়দিন নাকি থাকবে। কিন্তু তোমার হাতে টাকা নেই। দুই হাজার টাকা তোমাকে যেন আজই বাড়িতে যাওয়ার আগে দিয়ে যাই। বুঝলে? ধরো। গুনে নাও।”
“ওহ হো! বুঝলাম।”
টাকা গুনে নিতে নিতে উচ্ছল হেসে বলল শিখা।
জুবায়ের নাস্তা খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প করলো নূরী ও শিখার সঙ্গে। নূরী জুবায়েরকে রাতে থাকতে জোর করলো। শিখা না পারতে মাত্র দু’ একবার বললো। সে চায়না জুবায়ের রাতে থাকুক। ইদানীং জুবায়ের কেমন করে যেন তার দিকে তাকায়। যদিও সেই তাকানোয় কোন অশালীনতা নেই,বাজে কোন ইঙ্গিতও নেই। কেমন খাঁ খাঁ করা শূন্যতা তার চোখজুড়ে। কেমন হাহাকার! না পাওয়ার তৃষ্ণা! যেন কোন বিরানভূমি!
জুবায়েরও থাকল না। তবে তাকে রাতের ভাত না খাইয়ে ছাড়ল না নূরী ও শিখা। জুবায়ের যেতে যেতে খেদ ঝেড়ে বলল,
শিখা আজ আমার মনটা ভারাক্রান্ত! বিষাদে ছেয়ে আছে হৃদয়ের পুরো ক্যানভাস! বুকের গিরিখাদে স্তুপাকারে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে এক আশাহত প্রেমিকের এক পাক্ষিক প্রণয়ের ইতিকথা ও দুঃখগাঁথা। চলে যাবো তোমাদের উপচানো সুখের আসর ছেড়ে। ভালোথেকো তোমরা সবাই।
কলেজ ছুটির পর কোচিং থাকে। তাই বেলা পড়ে যায় বের হতে হতে। শিখা বরাবরের মতো কলেজের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা রিকশার। কলেজের খোলা সবুজ প্রাঙ্গণে মৃদু সমীরণ দুলে দুলে শীতের আগমনী ধ্বনি জানান দিচ্ছে সগৌরবে।
পরিশ্রান্ত শিখা রিকশায় উঠে যাচ্ছে। ঠিক তক্ষুনি তার সামনে এসে দাঁড়ালো একজন লোক। তার মুখ ভর্তি কালো কুচকুচে দাঁড়িগোঁফ! পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি পরা লোকটির।
সে শিখার দিকে চেয়ে ভৃত্যের ভঙ্গিতে বলল,
রাজবধূ পর্ব ৫৯
“রাজবধূ!”
শিখার কাছে কণ্ঠটি আধো চেনা আধো অচেনা লাগলো। সে গলায় এক সমুদ্র বিস্ময় ঢেলে জিজ্ঞেস করলো,
“কে? কে আপনি?”