রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫১
রিক্তা ইসলাম মায়া
সন্ধ্যা সাতটা সতেরো। চাঁদ বিহীন আকাশটা অন্ধকার বটে। শহর জুড়ে কৃত্রিম আলোর মেলা। রাস্তার দু’ধারের হলুদ আলোর ল্যাম্পপোস্ট থেকে শুরু করে উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে শুধু যান্ত্রিক আলোয় চোখে পড়ছে মায়ার। সাততলা ভবনের তৃতীয় ফ্লোরে দাঁড়িয়ে সে। খোলা ব্যালকনি জুড়ে মুক্ত হাওয়ার আভাস। যান্ত্রিক শহরে টিংটং শব্দ তুলে পারাপার হচ্ছে হুট তুলা রিক্সা গুলো। অল্প সল্প শীতের আভাসে গায়ের ওড়নাটা টেনে চাদরে মতোন জড়াল মায়া। হাতে মায়াদের পারিবারিক ফোন। অথচ দৃষ্টি অদূরে রাস্তায়। মন খারাপের মায়ার উদাসীনতা ওর চেহারায় দৃশ্যমান। দুপুরে রিদের সঙ্গে মুরাদপুরের এই ফ্ল্যাটে উঠেছিল মায়া।
তখন থেকে এখন অবধি এই ফ্ল্যাটেই আছে সে। মায়াকে নিজের ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে যায় রিদ নির্বাচনের কাজে। বলেছিল জলদি ফেরবে কিন্তু এখনো অবধি লাপাত্তা সে। কোথায় আছে মায়া জানে না। তবে মায়ার তদারকি জন্য একজন বয়স্ক মহিলা আছে এই ফ্ল্যাটে। উনার নাম সম্ভব স্বপনা আপা। মায়া শুনেছিল রাহাতকে এই নামে ডাকতে মহিলাটিকে। বর্তমানে তিনি রান্না করছেন হয়তো। আর মায়া রিদের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশের লুকায়িত তাঁরার সন্ধানে করছে। জুই মায়া দুজনের হাতে যে ফোনটা আরিফ দিয়েছিল সেটা বর্তমানে মায়ার হাতে আছে বলেই জুইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না মায়া। আর না নিজ বাড়ির খবর পাচ্ছে কোথাও থেকে। মায়ার মন ভিষণ ছটফট করছে বাড়ির খবর জানতে। মায়া বিয়ের খবরটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবার কানে পৌঁছে গেছে? মুক্তা নিশ্চয়ই জানিয়েছে সেটা। কিন্তু মায়া সবার সাথে যোগাযোগ করবে কিভাবে? জুই ছাড়া আপাতত মায়া কারও সাথে যোগাযোগ করার সাহস করতে পারছে না। আরিফ তো পূর্ব থেকেই মায়ার উপর রাগান্বিত ছিল আর আজ থেকে মুক্তা সেইদলে যোগ হলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আর এখন নিশ্চয়ই মায়ার পুরো পরিবারও মায়ার উপর ভিষণ রেগে আছে। যার জন্য মায়া চাইলেও সাহস করে কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। বাড়িতে কার কি পরিস্থিতি সেটাও জানতে পারছে না যার জন্য মায়ার মনটা ভিষণ ছটফটে ব্যাকুল হয়ে আছে জুইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। জুইতো মায়ার থেকে বেশি একটা দূরত্বে নয়, মাত্র দশমিনিটের রাস্তা। ওদের মুরাদপুরের বাসাতেই আছে জুই। আর মায়া আছে রিদের বাসায়। দুটো বাসার দূরত্ব বেশি না মাত্র দশ মিনিটের রাস্তা। রিদের অনুপস্থিতিতে মায়া বেশ কয়েকবার চেয়েছিল নিজেদের বাসায় চলে যেতে কিন্তু রিদের ভয়ে যেতে পারিনি। তাছাড়া এই মূহুর্তে আরিফের সামনে বা কিভাবে দাঁড়াবে মায়া? সেই মুখ তো অনেক আগেই হারিয়েছিল ওহ। আজ আবার নতুন করে হারালো মায়ার জন্য মুক্তাকে সবার কাছে অপমানিত হতে দেখে। আজকে যাবতীয় ঘটনা নিশ্চয়ই আরিফের কানে গেছে। এখনতো মায়া আরও খারাপ হয়ে গেল আরিফের চোখে। বিষাক্ত মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় মায়ার মন বিষিয়ে উঠলো তিক্ততায়। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো গ্রিল চেপে। বাস্তবতা এতো কঠিন মায়ার জানা ছিল না।
মায়ার না চাইতেও নিজের পরিবারের মানুষকে বারবার আঘাত করছে অজান্তে। মায়ার ফুঁপানো কান্নার মাঝেই হাতের ফোনটা ভোঁ ভোঁ শব্দ করে কেঁপে উঠলো। চমকে উঠার মতোন তাড়াহুড়ো গ্রিল থেকে মাথা তুলে ফোনের দিকে তাকাতে চোখে পড়লো স্কিনে থাকা আরিফের নাম্বারটির দিকে। আজ তিনমাস পর আরিফের সঙ্গে কথা হবে ভেবে মনটা যেমন খুশিতে নেচে উঠলো ঠিক তেমনই ভয়ার্ত হলো যদি কোনো খারাপ সংবাদ শুনতে পাই সে ভয়ে। মায়া এক মূহুর্তে জন্য মনে মনে দোয়া করলো যাতে ওর পরিবারের কারও কিছু না হোক। তাহলে মায়া নিজেকে কক্ষুনো ক্ষমা করতে পারবে না। আতঙ্কিত মায়া দু’হাতে মুঠোয় ফোন চাপল ভয়ে। কম্পিত হাতের কম্পন দৃঢ় হলো যখন প্রথমবার কল কাট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতোন ফোনটা তৎক্ষনাৎ কেঁপে উঠলো হলো তখন। মায়া ভয় দৃঢ়তা পৌঁছাল। দুঃসংবাদে আভাসে ভয়ে ভয়ে ফোন কানে তুলে কম্পিত স্বরে বলতে চাইল…
‘ হ্যালো ভাই!
মায়ার কথা শেষ করার আগেই জুই তাড়াহুড়ো অস্থির ভঙ্গিতে বলল….
‘ ভাই না আমি রিতু! জুই!
জুইয়ের গলায় যেন জান ফিরে পেল মায়া। প্রাণ ভরা নিশ্বাসে অস্থিরতায় বলল…
‘ জুই! কই তুই? তোর সাথে যোগাযোগ করার জন্য জান বেড়িয়ে যাচ্ছি আমার। বাড়ির সবাই….
মায়া অস্থির কারণ বুঝতে পেরে জুই মায়ার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল…
‘ তুই বাড়ির জন্য টেনশন করিস না। আপাতত সব ঠিক আছে। এখনো বাড়িতে কিছু জানানো হয়নি। আরিফ ভাই বা মুক্তা আপু কেউ বাড়িতে এখনো জানাই নি তোর বিষয়টা।
জুইয়ের কথায় মায়া ভিষণ আশ্চর্য হলো। আজকের ঘটনার পর অন্তত মায়ার বিয়েটা ওর পরিবার থেকে লুকিয়ে থাকার কথা না। অন্তত মায়ার বড়ো বোন মুক্তা দ্বারা তো নই। মায়া জন্য সবাই কতো মুক্তাকে অপমান করলো অথচ মুক্তা এখনো মায়ার বিষয়ে চুপ? তাছাড়া আজকের ঘটনার পর মায়া আশা করিনি ওর বড়ো ভাই-বোন চুপ থাকবে এই বিষয়ে। মায়া ভারি আশ্চর্যের নেয় চোখের পানি মুছতে মুছতে অবিশ্বাস্য গলায় ফের জুইকে শুধিয়ে বলল…
‘ আরিফ ভাই, মুক্তা আপু কেউ বাড়িতে কিছু বলেনি?
‘ না।
‘ সত্যি?
‘ মিথ্যা বলবো কেন?
‘ আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না জুই।
‘ বিশ্বাস না হওয়ার কি আছে আজব? যা সত্যি তাইতো বললাম। তবে মুক্তা আপু অনেক কান্না করছিল। আরিফ ভাইকে সবটা জানায় তোর বিষয়ে। আপু আমাদের বাড়িতেও তোর বিয়েটা জানাতে চেয়েছিল কিন্তু আরিফ ভাই নাকি না করেছেন এখন কোনো কিছু জানাতে।
মায়া দ্বিতীয়বারের মতোন আশ্চর্য হলো জুইয়ের কথায়। আরিফ পরিবারের কাউকে জানাতে নিষেধ কেন করছে সেটা বুঝতে না পেরে মায়া বলল…
‘ কেন?
মায়ার কথায় জুই দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে রয়েসয়ে বলল…
‘ নিহাল আঙ্কেল নাকি আমাদের বাড়িতে যেতে চেয়েছেন বড় চাচার(মায়ার বাবা) সাথে কথা বলতে। কিন্তু আরিফ ভাই নাকি নিহাল আঙ্কেলের থেকে দুইদিন সময় চেয়েছেন। তোর বিয়ের খবরটা এখনো বাড়িতে জানানো হয়নি তারপর চেয়ারম্যান বাড়ির সঙ্গে তোর বিয়েটাও পুরোপুরি ভাঙ্গেনি। সেজন্য আরিফ ভাই চাচ্ছেন আগে আমাদের বাড়িতে তোর বিয়ের ব্যাপারটা সবাইকে জানাবে তারপর সকলকে বুঝিয়ে-বাঝিয়ে প্রস্তুত করে নিহাল আঙ্কেলকে আমাদের বাড়িতে নিতে। কারণ নিহাল আঙ্কেল সম্মানিত মানুষ, উনার সাথে কোনো রকম বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি হোক সেটা ভাই চাইনা বলে এজন্য মূলত মুক্তা আপুকেও বলেছেন আপাতত চুপ থাকতে। অন্তত আরিফ ভাই বাড়িতে না যাওয়া অবধি। তুই তো জানিস আব্বা চাচা কেমন জেদ্দি মানুষ।
জুইয়ের কথায় মায়া চুপ করে গেল। মায়ার সাথে আরিফ কথা বলে না আজ বিগত তিনমাস। মন কষাকষির পর্বটা এখনো চলিত ভাই বোনের মাঝে। অথচ আরিফ সবদা ভাইয়ের দায়িত্ব থেকে একবিন্দুও পিছুপা হয়নি। বড় ভাইয়ের মতোন মায়াকে সকল বিপদ থেকে আগলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। গুমোট মায়া গ্রিলের পাশ থেকে সরে বসলো সোফায়। খোলা বারান্দার জয়েন্ট সোফায় বসতে বসতে আরিফের খোঁজ নিয়ে বলল…
‘আরিফ ভাই কই জুঁই?
‘ ভাই নিচে গেছে খাবার আনতে। সেই ফাঁকে তোকে আমি ভাইয়ের নাম্বার থেকে কল দিলাম। তুই কি এখন থেকে রিদ ভাইয়ের সঙ্গেই থাকবি রিতু?
মায়া হতাশতায় ডুবে বলল…
‘ জানি না। উনি তো বলছেন আমাকে নাকি সঙ্গে নিয়ে যাবেন ঢাকা। এখানে আর রাখবে না। কলেজও নাকি ট্রান্সফার করাবে ঢাকায়।
মায়ার কথায় জুই অস্বস্তি বোধ করলো। দুজন হুটহাট একত্রে থাকার সিদ্ধান্তটা কেমন জানি লাগল জুইয়ের। মায়াকে হুট করে রিদ নিয়ে যাবে ভাবিনি জুই। তাছাড়া মায়াও নিজ পরিবারের পারমিশন ছাড়া এইভাবে রিদের সঙ্গে চলে যাবে সেটাও ভাবিনি ওহ। অন্তত ওদের পরিবারের ঝামেলা মিটে গেলে তখন দুই পরিবারের সম্মতিতে একত্রে বসবাস করলে বিষয়টা আরও সুন্দর দেখাত এমনটা জুইয়ের ধারণা। কিন্তু মনের অস্বস্তিতে জুই মায়াকে বিষয়টা খোলাসা করে বললো না। বরং ভিতরে চেপে গেল। মায়া জুইকে চুপ করে যেতে দেখে ফের বলল…
‘ আরিফ ভাই আমার খোঁজ করেছিল জুই?
‘ না।
জুইয়ের কথায় মায়া আবারও অবিশ্বাস্যের নেয় শুধিয়ে বলল….
‘ ভাইয়া জানতে চাইনি আমি কোথায় আছি?
জুই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল…
‘ না! ভাইয়া মনে হয় জানে তুই রিদ ভাইয়ার সঙ্গে আছিস সেটা।
জুইয়ের কথার মায়া উত্তর করতে পারলো না। তাই ছোট শব্দে বলল…
‘ ওহ!
‘ আচ্ছা শুন! রিতু? কাল কলেজে যাবি না? আমার তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।
মায়া তৎক্ষনাৎ উত্তর আসলো তক্ষুনি..
‘ যাব যাব।
জুই খানিকটা সন্দেহ নিয়ে বলল…
‘ রিদ ভাইয়া দিবে?
‘ উনাকে বলেই যাব।
‘ আচ্ছা আয়। আমি অপেক্ষা করবো কলেজে।
জুইয়ের কথাটা মায়া তাড়াহুড়োয় শুধিয়ে বলল…
‘ তুই কলেজে না আমার কাছে আসবি জুই। আমার এখানে কোনো জামা-কাপড় নেই। তুই সকালে আসার সময় আমার জন্য কাপড় আর বই গুলো নিয়ে আসবি কেমন? আমি অপেক্ষা করবো।
‘ আচ্ছা আসব। এখন রাখি বাই।
‘ আচ্ছা।
টুট টুট শব্দে কল কেটে যেতেই মায়া কান থেকে ফোন নামিয়ে কোলের উপর রাখল। স্বাভাবিক নেয় শ্বাসরুদ্ধের গুমোট নিশ্বাসটা যেন স্বস্তিতে ছাড়লো। প্রথমে বাড়ির কথা ভেবে মনটা যেমন অস্থির ব্যাকুল হচ্ছিল সেটা এখন আর নেই। অনেকটাই স্বস্তির হালকা হলো জুইয়ের সাথে কথা বলে। মায়া অন্ধকার খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির আর ভালো লাগা খোঁজে পেল। কয়েক পল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে অচিরে ভাবনায় হঠাৎ করে রাফার খেয়াল আসলো। মায়ার স্বাভাবিক মুখটা রাগের প্রকাশ পেল। চট করে কোলের ফোনটা উঠিয়ে কন্টাক্ট নাম্বারে রাফার খোঁজ করলো। খোজাখুজি করে রাফার নাম্বার পেয়ে কল মিলানোর আগেই কেউ বলল…
‘ কি ম্যাডাম? কি করেন?
মায়া চমকে উঠার মতোন তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পাশে। বারান্দার দরজায় রিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়হুড়ো রাফার কল কেটে ফোন লুকালো পিছনে।
‘ আমি কিছু দেখিনা, দেখিনা।
মায়ার কথায় রিদ কপাল কুঁচকাল। দরজার সামনে থেকে মায়ার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল…
‘ কি দেখবেন? আমি বললাম কি করেন আর আপনি সোজা দেখাদেখিতে চলে গেলেন? কি ব্যাপার মুডে আছেন মনে হয়?
নিজের কথায় মায়া নিজেই ফেঁসে গেল। হঠাৎ রিদের উপস্থিত ছিল ওর কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত। সেজন্য মায়া রিদকে দেখে সেই দুপুরের কথা মনে করে ভুল উত্তর করে ফেললো। মায়া নিজের কথা শুধাতে চেয়ে মিনমিন করে বলল…
‘ আসলে আমি ভুলে কিছু দেখিনা বলে ফেলেছি।
‘ তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি মুডে নেই?
মায়া অবুঝের নেয় মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দিতেই রিদ আবছা আলো মায়ার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। গায়ে তার এখনো সকালের পোষাকটা জড়িয়ে। ব্যস্ততা এমন যে দুই মিনিটের স্বস্তির নেই। তারপরও রিদ মায়ার টানে বাসায় ফিরল শতকাজ ফেলে। দুজন একত্রে কিছুটা সময় কাটবে বলে। নিচে আসিফসহ আরও বেশকিছু ছেলেপেলে বসে অফিসে। রিদ হাতের ঘড়িটা খোলে সোফার সামনে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল…
‘ সমস্যা নেই ম্যাডাম, আমি আপনার মুড চালু করতেই আসলাম। আমার উপর ছেড়ে দিন আপনার মুড।
রিদের কথায় মায়া সিটিয়ে গেল। দুপুরে কথা মনে করেই ভয়ার্তও হলো। রিদ হাতের ফোনটা একই ভাবে ঘড়ির পাশে রাখতে রাখতে পুনরায় বলল…
‘ ফোনটা দাও।
মায়া রিদের কথায় জড়সড় হয়ে পিছনে লুকিয়ে রাখা ফোনটা বের করে দিল রিদকে। রিদ আনলক করা ফোনের গ্যালারিতে না গিয়ে সোজা ঢুকল গুগল ওয়েবসাইটে। গুগল সার্চ হিস্ট্রি স্ক্রল করতেই দেখতে পেল অসংখ্য বাংলিশ লেখা সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু বাংলা টাইপিংও আছে সেখানে। রিদ সচারাচর বাংলা পড়তে পারে না। জড়তা কাজ করে বাংলা পড়তে। তার পড়াশোনা থেকে শুরু করে সবটাই ছিল বাহিরে যার জন্য বলতে গেলে তার বাংলা নিয়ে পড়াশোনা হয়নি তেমন। তবে তার বাংলিশ পড়তে সমস্যা হয়না। যার জন্য গুগল সার্চ হিস্ট্রিতে থাকা মায়ার যাবতীয় বাংলিশ লেখা পড়তে রিদের কপাল কুঁচকে আসে তীক্ষ্ণতায়। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত লেখা সব। জামাইকে কিভাবে পটাতে হয় তার পদ্ধতি কি কি? জামাইর রাগ কিভাবে ভাঙ্গতে হয় তার পদ্ধতি? জামাইকে বউয়ের ভালোবাসায় পাগল বানানোর পদ্ধতি কি কি? জামাইর মন পাওয়ার পদ্ধতি কি? এসব লিখে লিখে পুরো গুগল সার্চ হিস্ট্রি ভরপুর। রিদের জানা ছিল না এত সকল পদ্ধতির মাধ্যম যে গুগল বহন করে থাকে। জানলে অবশ্যই রিদ নিজের বউয়ের ব্রেনও গুগলে খোঁজ করতো। রিদ ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতের ফোনটা দেখিয়ে বলল…
‘ এসব কি? কি লেখেছো এসব? গুগল জামাইকে বউয়ের ভালোবাসায় পাগল বানানোর পদ্ধতি কি কি বলো? জামাইর মন পাওয়ার পদ্ধতি কি কি বলো? তারপর জামাই….
রিদের বাকি কথা শেষ করার আগেই মায়া চেঁচিয়ে উঠলো তক্ষুনি। লাফিয়ে উঠে রিদ থেকে ফোন কেঁড়ে নিতে চেয়ে উত্তেজনায় বলল….
‘ এই আমার ফোন দিন! ফোন দিন বলছি। বাজে লোক মানুষের ফোন দেখেন কেন? ফোন দিন।
মায়া রিদ থেকে ফোন কেঁড়ে নিতে চাইলে রিদ হাতটা উপরে তুলে নিলো। ছোট্ট মায়া রিদের নাগাল না পেয়ে তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সোফায়। রিদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করতেই রিদ নিজের একহাত থেকে অপর হাতে ফোন সরাতে সরাতে বলল…
‘ এসব করে বেড়াও তুমি ফোনে?
মায়া একই ভাবে রিদের থেকে নিজের ফোনটা নিতে চেয়ে জোড়াজুড়ি করে বলল…
‘ আমি যা খুশি তাই করবো তাতে আপনার কি? আমার ফোন দিন। দিন বলছি।
‘ আমার বউ! আমারই তো সব। তাই আমার দেখার দরকার আছে না? আমার বউ আরও কি কি সন্ধান করে বেড়ায় গুগলে?
রিদর কথায় মায়া আরও অধৈর্য্যের নেয় হয়ে উঠে বলল…
‘ এই না না প্লিজ। আর দেখার দরকার নেই প্লিজ প্লিজ। আমার ফোন দিন নাহহ প্লিজ ।
রিদের কাছে ধরা পরে যাবার ভয়ে মায়া ছটফট বাড়ল। বিষয়টা বুঝতে পেরেই রিদ দুষ্টু হাসলো। বউকে হেনস্ত করতে তার দারুণ লাগছে। রিদ একহাতে মায়াকে বাঁধা দিয়ে অপর হাতটা উপরে তুলে ক্লিক করলো মায়ার সার্চ করা হিস্ট্রিতে ‘ জামাইকে বউয়ের ভালোবাসায় পাগল বানানোর পদ্ধতি কি কি, লেখাটিতে ক্লিক করতেই সঙ্গে সঙ্গে রিদকে সাজেস্ট করলো বাংলা লেখার সঙ্গে আরও কিছু রোমান্টিক হেলদি ভিডিও। সবগুলো সাংসারিক ব্লগ ভিডিও টাইপের ছিল। তাতে খারাপ কিছু নেই। তবে রিদ যেহেতু বাংলায় দূর্বল সেহেতু সে বাংলা লেখাটা স্কিপ করে ইংলিশে চোখ বুলিয়ে ক্লিক করলো একদম নিচে থাকা একটা ভিডিও ক্লিপে। বিশ সেকেন্ডের ওষ্ঠমিলের ভিডিওতে ক্লিক করেই রিদ মায়ার চোখের সামনে ধরে বলল…
‘ চলো কয়েক বার ট্রাই করি।
রিদের হাতের ভিডিও প্লে দেখেই মায়া লজ্জা সিটিয়ে গেল। রিদ থেকে ফোন না নিয়ে বরং পালাতে চাইল রিদের মতিগতি বুঝে। রিদকে ঠেলে নিজের থেকে দূরে সরাতে চেয়ে ধাক্কা দিতে দিতে বলল…
‘ ছিঃ! কতো খারাপ আপনি? দূরে সরুন। সরুন।
মায়ার কথায় রিদ কপাল কুঁচকে বলল…
‘ আপনি লিংক পাঠাতে পারেন, বসে বসে ভিডিও দেখতে পারেন আর আমি প্রাক্টিক্যালি দেখাতে চাইলেই দোষ? মজা যখন নিচ্ছেন তখন আমার থেকে নিলে দোষ কি? আমি পুরা ফিল দিব আপনাকে। ট্রাই করেই তো দেখুন। একবার ভালো না হলে দ্বিতীয়বা ট্রাই করুন। দ্বিতীয়বার না হলে তৃতীয় বার। আমিতো বারবার রিপিট করতে ইচ্ছুক।
রিদের লাগামহীন কথায় মায়া লজ্জা আর ভয়ে চুপ করে গেল মূহুর্তে। রিদের থেকে পালাতে চেয়ে লাফিয়ে সোফা থেকে নামতে নামতে বলল…
‘ আমি বাড়িতে যাব।
মায়া দৌড়ে পালাতে চাইলে রিদ তৎক্ষনাৎ পিছনে থেকে মায়া পেট পেঁচিয়ে ধরতে ধরতে বলল…
‘ আমি আসলাম আপনি চলে যাবেন সেটা কিভাবে হয় ম্যাডাম। আগে লেনদেনটা শেষ করি। তারপর যাইয়েন।
বলতে বলতে রিদ দু’হাতে মায়ার পেট পেঁচিয়ে নিজের কাছে টানল। মায়া রিদ থেকে বাঁচতে চেয়ে লাফালাফি করতে গিয়ে উল্টো বাঁধা পরলো রিদের হাতে। শক্তপোক্ত রিদের সঙ্গে শক্তিতে পেরে উঠতে পারলো না। বরং রিদ মায়াকে দুহাতে পেঁচিয়ে সোফায় চেপে ধরলো বক্ষতলে। মূহুর্তে মাঝে রিদের একহাতে বন্দী হলো মায়ার দুহাত। অপর হাতে মায়ার গায়ের ওড়নাটা টেনে নিচে ফেলতেই মায়া ছটফট করলো রিদের থেকে ছাড়া পেতে। অধৈর্য্যের নেয় বলল…
‘ প্লিজ প্লিজ আমাকে ছাড়ুন! ছাড়ুন!
মায়া দুহাত মাথা উপর আড়াআড়ি ভাবে আঁটকে রিদের একহাতে। রিদ সেই হাতে চাপ দিয়ে ঝুঁকে পড়লো মায়ার উপর। অপর হাতে মায়ার গাল চেপে ঠোঁট দু’টো উঁচিয়ে ধরে বলল…
‘ সরি বউ! মাত্র ধরলাম। আর এক্ষুনি ছেড়ে দিলে বিষয়টা পুরুষত্বে চলে আসবে আমার।
বলতে বলতে রিদ মায়ার ওষ্ঠে মন্ত হলো। পাঁচ কি দশ সেকেন্ড যেতেই রিদের রোমাঞ্চকরের বাঁধা দিয়ে উচ্চো স্বরে ফোনের রিংটোন ভেজে উঠলো তক্ষুনি । মন্ত পরিবেশ মূহুর্তে বিরক্তকর হয়ে উঠলো। তিরতির মেজাজে রিদ মায়ার ঠোঁট ছেড়ে তাকাল টেবিলের উপর থাকা ফোনটির দিকে। স্ক্রিনে আসিফের নামটি দেখতেই ক্ষিপ্ত মেজাজ আরও ক্ষিপ্ত হলো। এমন একটা সময়ে রিদের মোটেও পছন্দ হয়নি কেউ ওকে ডিস্টার্ব করুক। রিদ ঐ অবস্থায় হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়েই রিসিভ করে কানে ধরল। তিরতির মেজাজে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল….
‘ হারামির বাচ্চা আর সময় পেলিনা কল দেওয়ার?
রিদের কথায় আসিফ তাড়াহুড়ো বলল…
‘ ভাই! জসিমের লোক আমাদের দু’টো ছেলেকে মেরে রাস্তা ফেলে গেছে মাত্র। ছেলে দুটোকে হসপিটাল পাঠাচ্ছি। আপনি যদি একটু আসতেন তাহলে ভালো হতো। একটা চিঠি পাঠিয়েছে আপনার আব্বা নামে। চিঠিতে লেখা ওরা নাকি খান বাড়ির র’ক্ত চাই।
জসিম নামক উটকো ঝামেলা নামটা শুনতেই রিদ বিরক্ত হয়। দুইদিন পরপর একই কাজ করে জসিম নামক লোকটা। রাজনৈতিক দন্ড কারণের রিদের বাবা বিরুদ্ধে কাজ করে সবসময়। তবে এতোদিন ছোটখাটো ঝামেলা করলেও আজকাল বড়বড় ঝামেলা করতে চাচ্ছে সে। হয়তো সামনে ইলেকশন বলে রিদের বাবার সম্মান নষ্ট করতে চাইতে জনগণে কাছে। মূলত এজন্য রিদের রাজনৈতিক করা পছন্দ না। নেতাদের নামে সামান্য কিছু শুনলে ভোট চলে যায় অন্যদিকে। পা চেটে দুইদিনের পদ নিতে ইচ্ছুক নয় সে। তার যা দরকার আপোষে না পেলে জোড় করে আদায় করার ক্ষমতা রিদ খানের আছে বলেই সে প্রথমেই চেয়েছিল জসিম নামক লোকটাকে ঠিকানায় লাগাতে কিন্তু নিজের বাবার মহানতার কারণে পারছে না। আর এতে অতিষ্ঠ রিদ। বিরুদ্ধি দলের প্রতি উদারতা দেখানোর কারণ সে বুঝে না।
এই জসিমের ছেলেই তো ফাহাদের গায়ে হলুদের রাতে রাদিফের উপর হামলা করেছিল, ভাগ্য সহায় থাকায় সে যাত্রায় রাদিফ বেঁচে যায়। কিন্তু রিদও জসিমের ছেলেকে ছেড়ে দেয়নি। দু’পা কেটে এখনো পঙ্গু হাসপাতালে ফেলে রেখেছে সেজন্য হয়তো জসিম লোকটা ছেলের পঙ্গু হওয়ার প্রতিশোধে রিদের ছেলেপেলেদের আঘাত করছে। তবে বিষয়টা এবার বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে রিদের কাছে। এবার জসিমকে ঠিকানা না লাগালেই নয়। বিরুক্ততে রিদ আসিফকে কিছু বলবে তার আগেই বেখেয়ালি দৃষ্টি পড়লো নিজের বক্ষতলে শায়িত মায়ার দিকে। রিদের কুঁচকানো কপালের ভাঁজ মূহুর্তে সোজা হলো। দৃষ্টি ঘুরাল বউয়ের নিষ্পাপ মুখে। রিদ হাতের ফোনটার আলো মায়ার মুখে ধরলো। মূহুর্তে চোখে পড়লো মায়া ঘাড় বেঁকে ঘনঘন নিশ্বাসে ফেলছে এক পাশে মুখ করে। অপর পাশের গাল হতে গলা অবধি মায়ার ঠোঁটের ছড়ানোর লিপস্টিক লেপ্টে আছে। অতি ছোট দৃশ্যটা যেন রিদের বুকে আঘাত করলো। অজানা ভালো লাগায় তার ক্ষিপ্ত মেজাজ মূহুর্তে শীতল হলো। কিছু জায়গায় রিদ চাইলেও রাগ করতে পারে না। তার বউয়ের সামনে তো নয়ই। রিদ মায়ার উপর ঝুঁকে পড়তে পড়তে পুনরায় ফোনটা কানে নিয়ে আসিফকে শুধালো…
‘ এক কাজ কর আসিফ! তুই গাড়ি বের কর। আমি আসছি। আজ জসিমের বাসায় দাওয়াত খেতে যাব আমরা কি বলিস?
‘ জ্বি ভাই!
রিদ ফের শুধালো আসিফকে…
‘ আমি নিচে না আসা অবধি যেন তোর দ্বিতীয় কল না আসে আমার ফোনে মনে রাখিস।
‘ জ্বি ভাই।
আসিফ কল কেটে দিতেই রিদ মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হাত ফোনটা আস্তে করে রাখল টেবিলে উপর। পুনরায় একই ভাবে মায়ার উপর ঝুঁকে গলায় ডুবে মায়াতে মন্ত হতে হতে বলল…
রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫০
‘ সরি বউ! তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো অনেক কঠিন মনে হচ্ছে! কাছে পেয়েও যেন হারিয়ে ফেলছি তোমায়। আমার হয়েই থেকো বউ। আমার তোমাকেই চাই একবার নয় বারংবার।