রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৪ (২)

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৪ (২)
রিক্তা ইসলাম মায়া

রাত তখন দশ-টার ঘরে। আরিফ ক্লান্তিতে বাসায় ফিরলো সবে। চোখে মুখে উদাস আর ব্যর্থতার গ্লানি। বাসার কলিংবেল বাজাতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিলো নিজের অজান্তে। দরজায় কপাল ঠেকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো পরপর। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো তিক্ততায়। কিছু ভয়ংকর অনুভূতি হচ্ছে আরিফের এই মূহুর্তে। সময়টা কোথায় থেকে কোথায় এনে দাঁড় করালো। দরজার ওপাশে আদুরের ছোট বোন বেহুশ অবস্থায় পরে। আর দরজার এপাশে আরিফ অপরাধীর নেয় দাঁড়িয়ে। যখন মায়ার জ্ঞান ফিরবে আর জানতে চাইবে ওর স্বামী কোথায়? ঠিক আছে কিনা তখন আরিফ কি উত্তর দিবে? কি বলবে?

যে আরিফ গিয়ে ছিলো হসপিটালে রিদের খবর নিতে অথচ মানুষের ভিড়ে সে কারও সাথে দেখা করতে পারেনি এমনটা বলবে? আসলেই আরিফ দেখা করতে পারেনি নাকি অন্য কিছু ছিল? রিদের এক্সিডেন্টের পর সবাই যখন রিদকে হসপিটালে নিয়ে যায় তখন আরিফ অজ্ঞানরত মায়াকে বাসায় নিয়ে আসে। ডাক্তার দেখায়। মায়ার হুশে ফিরার অপেক্ষা করে। একবার মায়া হুশে ফিরে আসলে তখন মায়াকে বুঝিয়ে শুনিয়ে হসপিটালে যাবে এমনটা আরিফের চিন্তা ভাবনা ছিলো। সেজন্য ডাক্তার দেখিয়ে মায়ার হুশে ফিরার অপেক্ষা পর্যন্ত করেছিলো আরিফ। অবশেষে দেখা যায় ঘন্টা খানিকের ভিতর মায়ার হুশ ফিরে আসলেও মায়া তখন মানসিক ভাবে স্টেবল ছিল না। বরং অতিরিক্ত পাগলামি আর চিল্লাচিল্লি করতে করতে দশ মিনিটের মাথায় আবারও জ্ঞান হারায় মায়া স্বামী,স্বামী করতে করতে। মায়ার অবস্থা দেখে আরিফ আবারও ডাক্তার ডাকলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মায়ার ব্রেইন শান্ত থাকার জন্য ঘুমের ইনজেকশন দিলো মায়াকে। আরিফ বাধ্য হয়ে মায়াকে ঘুমে রেখে ওহ একাই হসপিটালে গিয়েছিলো রিদের খবর নিতে। আরিফ হসপিটালে যেতে যেতে দেখলো বিশাল ভিড় জমে আছে হসপিটালের চত্বরে। খান বাড়ির সকলের হাহাকার আর আর্তচিৎকারে উপস্থিত সকলের চোখে পানি। আরিফ আজ প্রথমবারের মতোন রিদ খানের মাকেও দেখেছিলো সে। সেকি দারুণ তেজ মহিলার। এমন শক্ত পার্সোনালিটির মহিলা আরিফের দেখা এই প্রথম ছিলো সুফিয়া খান। চোখের পলকে ছেলেকে ঢাকা ট্রান্সফার করান। কারও কোনো কথা বা কাউকে ভিড়তেও দেয়নি ছেলের আশেপাশে। হসপিটালের আরিফ ছিল তৃতীয়পক্ষ। সবে একদিন হয়েছিলো রিদ-মায়ার সম্পর্কে কথাটা সবাই জেনেছিল। এখনো কেউ খান বাড়িতে মায়ার সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে, এমনটা বলেনি অথচ এই ধোঁয়াশায় অবস্থায় রিদের এক্সিডেন্ট হওয়াতে আরিফ আগ-বাড়িয়ে বোনের স্বামী হিসাবে রিদের খবর জানতে পারছে না।

কেমন একটা সংকোচবোধ ছিল আরিফের মনের মধ্যে। তারপরও আরিফ সকল সংকোচবোধ পা ঠেলে আগ বাড়িয়ে গিয়েছিলো রিদের খবর জানতে। কিন্তু খান বাড়ির কেউ আরিফের সঙ্গে কথা বলার মতোন মনমানসিকতা দেখায় নি। আর না আরিফের কোনো কথায় কেউ উত্তর দেয়। বলতে গেলে আরিফ যাদের কাছে রিদের খবর জানতে গিয়েছিল তারা সবাই আরিফকে নীরবতা দেখিয়ে এরিয়ে গেছে। বারবার একই কাজ হওয়াতে আরিফ আর কারও কাছে না গিয়ে রিদের ছেলেপেলেদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু নিরব চোখে দেখল রিদের মায়ের তোলপাড় করা কান্ড গুলো। তিনি মূহুর্তে মাঝে আসিফ, রাদিফ, আয়নকে দিয়ে রিদকে ঢাকা ট্রান্সফার করান ডাক্তারসহ। আরিফ অনেক চেয়েছিল আসিফ, আয়ন বা রাদিফের মধ্যে কারও সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু সেই সুযোগটায় সে পেলো না। সবাই কেমন তাড়াহুড়ো করে রিদকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরছিল। ব্যস্ত হওয়াটাও স্বাভাবিক। রিদ খানের জীবন মরণ নিয়ে কথা। ব্যস্ত তো হবেই। রিদকে নিয়ে ঢাকার যেতে যেতে নিহাল খান, আসিফ দুজন ক্যাশ টাকায় ইয়ার এম্বুলেন্স বোকিং করলো।

আরিফ যতটুকু জেনেছে রিদের সঙ্গে নিহাল খান, সুফিয়া খান, আয়ন, রাদিফ আপাতত এই চারজনই গিয়েছে পরবর্তী হয়তো আরাফ খান সুস্থ হলে হেনা খান, আরাফ খানকে নিয়ে লন্ডনে যাবে। আসিফ দেশেই থাকবে রিদের ব্যবসা আর খান বাড়ির তদারকি করতে। আরিফের হসপিটালের যাওয়ার ঘন্টা খানিকের ভিতর রিদকে নিয়ে খান বাড়ির সকলেই ঢাকা চলে যাওয়াতে আরিফ হসপিটালের চত্বরের আরও ঘন্টা খানিক বসে ছিল দুশ্চিন্তায়। বাসায় ফিরে সে মায়াকে কি উত্তর দিবে? রিদ খান ভালো নেই সেটাতো আরিফ নিজের চোখেই দেখে এসেছে। রিদকে নিয়ে পরদেশে পাড়ি দেওয়ার বিষয়টাও সে দেখেছে। হয়তো এতক্ষণে ফ্লাইটে উঠে পরেছে সবাই। অথচ মায়ার খবর কেউ জানতে চাইলো না। আর না শেষবারের মতো মায়া নিজের স্বামীকে দেখতে পেল।

পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে মায়ার খোঁজ খবর নেওয়া তো দূর মায়াকে খান বাড়ির কেউ চিন্তে পারছে না এমনটা খান পরিবারের মনোভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু আরিফ এই মূহুর্তে নিজের বোনকে কি জবাব দিবে সেই চিন্তায় দরজায় কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা সময়। পকেটের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠতেই আরিফ ঐ অবস্থায় পকেটে থেকে ফোনটা বের করে কানে তুলতেই উদ্বিগ্নতায় গলা শুনা গেল রাকিবের। আরিফের সঙ্গে রাকিবও হসপিটালের ছিল। আরিফ বাসায় আসার সময় রাকিবকে বলে আসেনি সেজন্য হয়তো রাকিব কল দিচ্ছে আরিফের খোঁজ নিতে। আরিফ কল রিসিভ করতেই রাকিব উদ্বিগ্নতায় বলল….

‘ কই তুই?
দীর্ঘ শ্বাসে আরিফ মন্ত হয়ে ভাঙ্গা গলায় অল্প আওয়াজে বলল….
‘ বাসায় আয় তুই।
আরিফ সচারাচর নিজের বাসায় বন্ধুদের কাউকে আনে না কখনো। নিজের বাসায় দুবোন থাকাতে সে বন্ধুদের বাসার বাহিরের রাখে সবসময়। কিন্তু আজ এই পরিস্থিতিতে আরিফ নিজের মনোবল পাচ্ছে না সবকিছু সামলাতে সেজন্য রাকিবকে বলল নিজের বাসায় আসতে। রাকিব আরিফের কথায় পুনরায় নিশ্চিত হতে আবারও একই ভাবে জিজ্ঞেসা করলো…
‘ তোর বাসায় আসব?
‘ হুম।
‘ এখন?
‘ আয়।

কথাটা বলেই আরিফ কল কেটে দিল। কথা বলতে ভালো লাগছে না ওর। কেমন ক্লান্তি আর দূর্বল লাগছে। দরজা হতে সরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আরিফ কলিংবেল বাজাতে তৎক্ষনাৎ দরজা খোলে দিলো জুই। সে যেন দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ অপেক্ষা করে। তাড়াহুড়ো করে জুই দরজা খোলে উদ্বিগ্নতায় পরপর প্রশ্ন করলো আরিফকে রিদের খবর জানতে..
‘ রিদ ভাইয়া কেমন আছে ভাই? উনি ঠিক আছেন? ডাক্তার কি বলেছে? বেশি ব্যথা পেয়েছে?
আরিফ দরজার বাহিরে জুতা রেখে বাসায় ঢুকলো। জুইকে এরিয়ে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে তাকালো মায়ার রুমের দরজার দিকে। ক্লান্তিতে মায়ার খবর জানতে চেয়ে বলল আরিফ…
‘ মায়ার হুশ ফিরেছে?
জুইয়ের কথার উত্তর না করে আরিফকে পাল্টা প্রশ্ন করতে দেখে অস্থির হলো জুই। নিজের কথার উত্তর না পেয়ে তারপরও আরিফের কথার উত্তর দিয়ে বলল জুই।

‘ না।
‘ ওহ
আরিফ উদাসীনতায় গিয়ে গা এলিয়ে বসল ড্রয়িংরুমের সোফায়। জুই দরজা লাগিয়ে আরিফের দিকে এগোতে চাইলে আরিফ সোফায় গা এলিয়ে কপালে হাত ঠেকাতে ঠেকাতে বলল…
‘ ভাইকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়াতে পারবি জুই? খুব ক্লান্ত লাগছে।
‘ এক্ষুনি আনছি।
অস্থির উত্তেজিত জুই এই শীতের মাঝেও আরিফের জন্য ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি গ্লাসে করে নিয়ে আসল। আরিফ সেটা এক টানে খেয়ে জুইয়ের হাতে গ্লাসটা দিতে দিতে আবারও বলল…
‘ আরেকটা গ্লাস খাওয়াতে পারবি?
জুঁই চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে পুনরায় গ্লাস ভরতি ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলো। আরিফও আগের নেয় ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানির গ্লাস খালি করলো এক চুমুকে। তীব্র পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল তার। ভিতরটা হাহাকার করছিলো তৃষ্ণায়। এতো পানি খেয়েও যেন তৃষ্ণা মেটেনি আরিফের। আরিফ পানির গ্লাসটা টি-টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল…

‘ তুই কিছু খাবি জুই? দুপুর থেকে না খাওয়া তুই। অর্ডার করবো?
আরিফের কথায় জুঁই খানিকটা অসন্তুষ্ট গলায় তৎক্ষনাৎ উত্তর করে বলল…
‘ আমি কিছু খাব না ভাই। এই পরিস্থিতিতে আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আগে বলো রিদ ভাইয়া কেমন আছে? ডাক্তার কি বলেছে।
জুঁইয়ের কথায় আরিফ রয়েসয়ে বলল…
‘ রিদ খানের অবস্থা ভালো নেই জুঁই। ডাক্তার বলেছে মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছে সে। বাংলাদেশের চিকিৎসা রিদ খানের জন্য যথেষ্ট হবে না। সেজন্য রিদ খানের পরিবার রিদ খানকে দেশের বাহিরের লন্ডন নিয়ে যাচ্ছে আজ রাতের ফ্লাইটে। খুব সম্ভবত এতক্ষণে ইয়ার এম্বুলেন্সের উঠে যাওয়ার কথা তাদের।
আরিফের কথায় জুই আতঙ্কিত ভঙ্গিতে বলল…
‘ আল্লাহ! কি বলো ভাই? রিদ ভাইয়াকে লন্ডন এ নিয়ে যাচ্ছে? আল্লাহ জানে কি হয়। আল্লাহ রিদ ভাইয়ার হেফাজত করুক। মায়ার কথা কেউ জানতে চাইনি? মায়াকে ছাড়া সবাই চলে গেলো?
জুঁইয়ের কথায় আরিফ আগের নেয় বলল…

‘ না
‘ কেন?
‘ আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না জুঁই। আমি অনেকবার চেয়েছিলাম খান পরিবারের সবার সাথে কথা বলতে কিন্তু কেউ আমার কথা উত্তর দেয়নি। অপরিচিতর মতোন চুপ থেকেছে সবাই। এখন আমি বুঝতে পারছি না তাঁরা কি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে ইগনোর করলো নাকি রিদ খানের এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে তাঁদের মন মানসিকতা ঠিক নেই বলে কথা বলতে পারেনি। আমি আপাতত কিছু জানি না জুঁই। তবে আজ কেউ মায়ার কথা জানতে চাইনি। তবে এতটুকু বলতে পারি রিদ খানের ঠিক হয়ে দেশে না ফিরা পর্যন্ত মায়ার খেয়াল আমাদের রাখতে হবে জুঁই।
আরিফের কথায় জুঁই চুপ করে যায়। এতো কিছুর মাঝে সবে খান পরিবারের সবাইকে মায়াদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছিল। এখনো মায়ার পরিবারের জানানো বাকি। দুই পরিবারের সম্মতি দেয়নি রিদ-মায়ার সম্পর্কে। এরমধ্যে রিদের এক্সিডেন্ট হওয়াতে এই পরিস্থিতিতে মায়া আবারও একা হয়ে গেলো। যেখানে মায়ার একমাত্র বিশ্বাস আর ভরসার জায়গায় ছিল রিদ খান। এখন মায়া একা এই পরিস্থিতির মোকাবেলা কিভাবে করবে আল্লাহ জানে। জুইকে চুপ থাকতে দেখে আরিফ পুনরায় বলল…
‘ মায়ার কাছে যাহ জুঁই। ওর সাথে থাক। যা হবার হবে সেটা দেখা যাবে। আল্লাহ ভরসা। আমি আছি মায়ার পাশে। বোনকে কখনো একা ছাড়বো না ইনশাআল্লাহ।
জুঁই কথা না বাড়িয়ে মায়ার কক্ষে গেল। নিস্তব্ধ ঘরে মায়াকে নিস্তেজ অবস্থায় খাটে শুয়ে থাকতে দেখে জুঁই গিয়ে মায়ার মাথার কাছে বসলো। সবে মাত্র দশ-টা পাঁচ। মায়াকে প্রায় পাঁচ ঘন্টা যাবত ইনজেকশন দিয়ে ঘুমিয়ে রেখেছে। ঘুম থেকে জাগ্রত হলে কি হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সকলে।

রাত তখন বারোটা ঊর্ধ্বে। মায়াকে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে হসপিটালের ছুটছে আরিফ। সঙ্গে জুঁই আর রাকিব। মায়ার অবস্থা খুবই সূচনীয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপে প্যানিক অ্যাটাক করেছে মায়া। হাত-পা সর্বাঙ্গ খিঁচে কাঁপুনি দিচ্ছে বারবার, ধরধর ঘাম সঙ্গে রেসিং হার্টবিটের ধড়ফড় ক্রমশয় বেড়ে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট সঙ্গে বুকে ব্যথা বা অস্বস্তিবোধে বমি বমি ভাব। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অতিরিক্ত ভয়ে অস্থির উত্তেজনায় মায়া শ্বাস নিতে পারছে না বলে মা*রা যাচ্ছে এমনটা মনে হচ্ছে। সচরাচর প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণ এসবই হয়ে থাকে। মায়াকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দেখে প্রথমে জুই-ই পাগলের মতো চিল্লাতে লাগলো ভয়ে। আরিফ পাশেই ছিল। এই অসময়ে বন্ধুর মতোন রাকিবও ছিল আরিফের সঙ্গে। আরিফ মায়াকে পাঁজর কোলে তুলে এতো রাতে চারতলা হতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো দৌড়ে। জুঁই তাড়াহুড়ো বাসার তালা বন্ধ করে সেও দৌড়াল আরিফের পিছন পিছন চিল্লাতে চিল্লাতে। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের সকলেই ততক্ষণে ঘুম ছেড়ে বাসা হতে বেড়িয়ে আসল জুঁই এর চিল্লাচিল্লিতে। রাকিব সকলের আগে বাসা থেকে বেড়িয়ে এতো রাতে গাড়ির খোঁজ করলো।

ততক্ষণে আশেপাশে সকল মানুষজন আরিফদের ঘিরে দাঁড়ালো মায়াকে দেখতে। আরিফের দু-চোখ ভিজে আছে বোনের দুর্দশা দেখে। মায়ার শ্বাস পরছে না। মুখ থেকে সাদা ফেনা ফেনা ঝাঁঝ বের হচ্ছে। জুঁইয়ের চিৎকারের আশেপাশে সকলেই এগিয়ে এসে ভিড় জমাচ্ছে মায়াকে দ্রুত হসপিটালের নিয়ে যেতে। মধ্যেরাতে সিএনজিতে করে মায়াকেও সেই একই চট্টগ্রাম মেডিকেল হসপিটালের নিয়ে যাওয়া হলো। ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসাও দেওয়া হলো। একদিকে রিদকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হলো তো অন্য দিকে রাতভর মায়া চিকিৎসা চলল হসপিটালের বেঁডে শুয়ে। দিন গেল রাত পোহাল। অতিরিক্ত মানসিক চাপে মায়াকে টানা তিনদিন হসপিটালের বেঁডে শুধু ইনজেকশন দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখল ওর বেইন শান্ত রাখার জন্য। কারণ এই তিনদিনে মায়া যতবার হুশে এসেছিল ঠিক ততবারই রিদের কথা জানতে চেয়ে পাগলামো করেছে বারবার। তৃতীয় দিনে মায়া অবস্থা ছিল সূচনীয়। হঠাৎ হঠাৎ করে মায়া আগের সবকিছু ভুলে যায়।

এক মূহুর্তের জন্য নিজের নাম, এমন কি পরিচিত মানুষকে পর্যন্ত চিন্তে পারে না। আরিফকে? জুই কে? ওদের নাম কি? ওদের সাথে মায়ার কি সম্পর্ক সেই সবকিছু মায়া এক মূহুর্তের জন্য ভুলে যায়। সামান্য টাকা চিনার মতোন স্মৃতিশক্ত মায়ার মস্তিষ্ক ধারণ করে রাখতে পারে না। ডাক্তার দেখানো সামান্য টাকাকে মায়া পাতা বলে আখ্যায়িত করে। ডাক্তারের ভারসাম্য মতে মায়া অতিরিক্ত মানসিক চাপে কারণে মেন্টাল ট্রমায় আছে সেজন্য হঠাৎ হঠাৎ সবকিছু ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু মায়ার মস্তিষ্ক যখন শান্ত থাকে তখন আবারও সবকিছু মনে করে পাগলামো শুরু করে রিদের জন্য। এই তিনদিনে আরিফ খান বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারলেও আসিফের সঙ্গে ফোনের যোগাযোগ হয়েছিল একবার। সেখান থেকে জানা যায় আগামী সাপ্তাহর ভিতরের আরাফ খান আর হেনা খানকেও লন্ডনে পাঠানো হবে আয়নদের বাড়িতে। আপাতত খান পরিবারের সবাই সেখানেই আছে। তবে দুঃখজনক বিষয়ে হলো রিদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।

অলরেডি রিদের মাথায় সার্জারী করা হয়েছে কিন্তু রিদের হুশ ফিরেনি এখনো। সহজে ফিরবে বলে মনেও হয়না। কোমায় চলে গেছে রিদ। রিদ হুশে কখন ফিরবে কেউ বলতে পারে না। দিনদিন অবস্থা নাকি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে রিদের। আসিফের কাছ থেকে রিদের এসব খবরের কথা জেনে আরিফের মনে হয়নি আগ বাড়িয়ে মায়ার কথাটা আসিফকে জানানো উচিত। আর না আসিফ মায়ার কথা জানতে চেয়েছে আরিফের কাছে। তাছাড়া আসিফ মায়ার কথা জানলেও বা কি করতে পারবে? এখানে কারও কিছু করার নেই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। তিনি ভালো জানেন আগামীতে কি হবেন। পাঁচদিনের মধ্যে মায়াকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসল আরিফ। বাসায় আনতে চাইনি সে। কারণ মায়ার অবস্থার তখনো ভালো ছিল না।

আরও কয়েক দিন হসপিটালের রাখতে চেয়েছিল আরিফ কিন্তু হুট করে চট্টগ্রামে আরিফের বাবা আর চাচার উপস্থিতি দেখতে পেয়ে বাধ্য হয়ে মায়াকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হয় আরিফকে। হঠাৎ করে আরিফের বাপ-চাচার চট্টগ্রামের উপস্থিত হওয়ার কারণটা ভালো করেই জানা ওর। না জানার কিছু নেই। মায়া রিদ খানের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে এমনটা আরও দুইদিন আগেই পরিবারের জানিয়েছিল মুক্তা। কিন্তু রিদের এক্সিডেন্টের পর মায়ার অবস্থা কি হয়েছে সেটা পরিবারের কারও জানা ছিল না। মূলত আরিফই কাউকে জানাই নি। তবে মায়ার প্রেমের সম্পর্কের কথাটা শুনে রেগেমেগে আগুন হয়ে আরিফকে ফোন দিয়েছিল বাপ-চাচা দুজনই। মায়াকে নিয়ে দ্রুত আশুগঞ্জ ফিরতে আদেশও করেছিল তারা। কিন্তু আরিফ কারও কথা কানে তুলে নি। আর না মায়ার অবস্থার কথা জানিয়েছে পরিবারের। মূলত আরিফকে আশুগঞ্জ ফিরতে না দেখে উনারা দুজন রেগেমেগে চট্টগ্রামে উপস্থিত হয় মায়াকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।

কিন্তু এখানে এসে মায়ার সূচনীয় অবস্থা দেখে তারা দুজন থমকে যায়। উনাদের মেয়ের এতো অসুস্থতার কথাটা পরিবারের জানাই নি কেন? সেটা নিয়ে আগুন হয়ে যায় দু’ভাই। বিশেষ করে মায়া কথা বলার মতোন পরিস্থিতিতে নেই এই বিষয়টা তাদের মনে আঘাত করে বেশি। সেজন্য মায়ার উপর থাকা সকল রাগ গিয়ে পরলো আরিফের উপর শফিকুল ইসলামের। জুইয়ের বাবাও কম নই। এতোসব কিছু ঘটে যাচ্ছে আর সেইসব তাদের অবগত করেনি বলে তিনি প্রথমবারের মতোন জুইয়ের গায়ে হাত তুলেন। রাগের তোপে জুইয়ের গাল বেড়িয়ে থাপ্পড় মারলো জড়সড়ে। পারছে না সেই রাগটা আরিফের উপর দিয়ে তুলছে জুইয়ের বাবা।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৪

সেই রাতের মধ্যে প্রাইভেট কারে করে শফিকুল ইসলাম সপরিবারে আশুগঞ্জ ফিরেন সঙ্গে আরিফকেও নিয়ে। বাসায় ফিরে যেন মায়ার জন্য মানসিক চাপ আরও বাড়লো। হাহাকার বয়ে গেল পরিবার জুড়ে। মায়ার বাপ-চাচা মায়ার অবস্থা দেখে চুপ করে গেলেন ভয়ে। উনারা আপাতত মায়ার সুস্থতা চাচ্ছেন। অথচ আত্মীয়দের মাঝে বদনাম রটে গেল মায়া বড়লোক ছেলের পিছনে ঘুরে প্রেমে পাগল হয়ে গেছে।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৫