রেড রোজ ২ পর্ব ১৭
ফারহানা নিঝুম
কাঠ পোড়া রোদ্দুরে ব্যাগ হাতে হেঁটে চলেছে উৎসা। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে,এর মধ্যে মাথাটাও গরম হয়ে আছে তার।সে পরাগের উপর ভীষণ রেগে আছে , হ্যা পরাগ মিহির স্বামী। সকাল সকাল বেরিয়েছিল ওই বাজে লোকটার সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু লোকটা তো তাকে গুরুত্বই দিলো না! উল্টো নিজে কী হম্বিতম্বি দেখালো। উৎসা এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছে,সে পুলিশের কাছে নিয়ে যাবেই যাবে।
এক সময় পরাগ আর উৎসার মধ্যে কথা কা’টাকা’টি হয়।
“অস’ভ্য কোথাকার আমি ওকে দেখেই ছাড়ব ,এই উৎসা কে চেনে না। আমার বোনের সঙ্গে ওমন করার ফল পেতেই হবে।”
নিজ মনে বিড়বিড় করে এগিয়ে যেতে লাগলো উৎসা। এখন আবার মামার বাড়িতে যাবে।নিকির সঙ্গে কথা বলতে হবে, এমনিতেই সেদিন নিকি তার উপর রাগ করেছে। উৎসা ভালো মন্দ শুনিয়ে দিয়েছিল তাকে , এখন নিজেরই ভীষণ খারাপ লাগছে।
ভাবনার মাঝখানে অনুভব করলো তার পরণের গোল জামায় টান পড়ছে। উৎসা পিছন ফিরে তাকিয়ে চিৎকার করে ছুট লাগালো। প্রাণপণে দৌড়ে পালাচ্ছে সে , এখন যদি না পালায় তাহলে আর কখনোই পালাতে পারবে না।
দৌড়াতে দৌড়াতে আচমকা কারো সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল উৎসা।লোকটা সম্ভবত উৎসার ভার নিতে না পেরে নিচে পড়ে গেল।মুখ থেকে বেরিয়ে এলো অস্ফুট স্বরে “আহ্” শব্দটি ।
“প্লিজ হেল্প করুন আমাকে বাঁচান।”
উৎসা রিতিমত কাঁপছে , পিছনে আসা কুকুর টা নিজেই কিছুক্ষণ লেজ নাড়িয়ে চলে গেল। উৎসা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচল , তৎক্ষণাৎ চিরচেনা পুরুষালী কন্ঠস্বর কর্ণ স্পর্শ করলো তার।
“মিস বাংলাদেশী!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
উৎসা চমকে মুখ উঁচিয়ে ডান দিকে তাকালো। জিসান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিসান কে দেখে চক্ষু চড়কগাছ বলতে গেলে! জিসান এখানে কেন?সে কী জার্মানি থেকে চলে এসেছে? যদি জিসান এসে থাকে তাহলে অবশ্যই ঐশ্বর্য এসেছে! উৎসা অনুভব করলো তার মেদহীন পে’টে কারো কোমল স্পর্শ। উৎসা সামনের দিক তাকাতেই আরেক দফা চমকে উঠে। ঐশ্বর্য! উৎসা নির্বাক ,কী বলবে বুঝতে পারছে না। হ্যা সে ঐশ্বর্য কে এক প্রকার জড়িয়ে ধরে আছে , দুজনের মুখ প্রায় কাছাকাছি। ঐশ্বর্যের শ্বাস প্রশ্বাস আঁ’চ’ড়ে পড়ছে উৎসার মুখে।
“আপনি!”
উৎসা বোকার মতো প্রশ্ন করছে , ঐশ্বর্য খানিকটা বিরক্ত বোধ করলো।
“জাস্ট শাট আপ!”
ঐশ্বর্যের রেগে যাওয়ার কারণ বোধগম্য হলো না উৎসার , তবে সে নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছে।ছিহ্ কী অবস্থা এটা তার? উৎসা ঐশ্বর্যের দু পায়ের মাঝখানে ঠিক মাটিতে ডান হাত দিয়ে ভর দিয়েছে। অন্য হাত বগল তলা গলিয়ে ঐশ্বর্যের গলা জড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ত্বরিতে উঠে দাঁড়ালো উৎসা। জিসান হাত বাড়িয়ে ঐশ্বর্য কে উঠতে সাহায্য করলো।
“ব্রো আর ইউ ওকে?”
“ইয়া অ্যাম ফাইন।”
ঐশ্বর্য হাতের সাহায্যে গায়ে লাগা ধুলোবালি ঝেড়ে নিল , এদিকে উৎসা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।সে এখানে কী করে?
“চোখ কী আকাশে নিয়ে ঘুরো?নাকি বাড়িতে রেখে এসেছো?”
এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল উৎসা।
“আমি আসলে? ওই আপনি… এখন স্বপ্ন..
উৎসা ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। বারংবার মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।
“ইডিয়ট।”
ঐশ্বর্য দ্রুত গতিতে গাড়িতে গিয়ে উঠলো , চোখের সামনে ভ্যা’নিশ। ঐশ্বর্য আর জিসান দু’জনেই চলে গেল , উৎসা তখন তাকিয়ে আছে।কী বা বলবে? কিছু বলার ভাষা নেই তার! ঐশ্বর্য দেশে ফিরেছে ভাবতেই পারছে না।
উৎসা ত্বরিতে অটোরিকশা নিয়ে ছুট লাগালো মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে।সে স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি সব কিছু ওখানেই পরিষ্কার হবে।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে , ঐশ্বর্যের দৃষ্টি সম্পূর্ণ সামনের দিকে। এদিকে জিসান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
“ব্রো কিছুই তো বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে এসব?তুই এসেছিস মিস বাংলাদেশীর জন্য কিন্তু এখন ওকেই ফেলে চলে এলি!”
ঐশ্বর্য বাঁকা হাসলো ,সে বাংলাদেশে এসেছে শুধু মাত্র উৎসার জন্য।তার যে অনেক হিসেব বাকি আছে , সব কিছু শো’ধে আসলে তুলবে সে। আফসোস ওদের সঙ্গে কেয়া আসেনি , মেয়েটা হোমের কাজে শহরের বাইরে গিয়েছে। ফলস্বরূপ জিসান আর ঐশ্বর্য চলে এসেছে। ঐশ্বর্য ড্যাম শিওর উৎসা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের বাড়িতে আসবে। আসতেই হবে তাকে ,কারণ ঐশ্বর্য যে তাকে কারণ ঐশ্বর্য যে উৎসা পাটোয়ারী কে কনফিউজশনে ফেলে এসেছে। ঐশ্বর্য ভেবে হেসে ফেলছে।
শহীদের সম্মুখীন হয়েছে ঐশ্বর্য ,এত গুলো বছর পরেও সেই একই আছে দু’জনে। ঐশ্বর্যের তার বাবার প্রতি বিরক্ত আর শহীদের নিজের ছেলের প্রতি দীর্ঘ শ্বাস ছাড়া আর কিছুই নেই।
ঐশ্বর্য আজও আফসানা কে নিজের মা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। আফসানা কে যখন বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল সেদিন ঐশ্বর্য রিতিমত বাড়িতে ঝ’ড় উঠিয়েছিল ।সেদিন আফসানাও বেজায় রেগে গিয়ে ঐশ্বর্য কে কিছু কথা শুনিয়ে দেয় ,ঠিক তেমনি ঐশ্বর্য আফসানা কে অনেক ক’টু কথা বলে। ঐশ্বর্য মূলতঃ নিজের মায়ের জায়গা কাউকেই দিতে চায় না আর না কখনও দিতে চেয়েছে। সেখানে শহীদ অজান্তেই বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল আফসানা কে। সেদিন শহীদ একটাই কথাই বলেছিলে ঐশ্বর্য কে।
“আমি তো তোমার জনেই বিয়ে করেছি ঐশ্বর্য! তাহলে তুমি এমন করছো কেন? তুমি ছোট তোমাকে সামলানোর জন্য কাউকে না কাউকে তো প্রয়োজন!”
ঐশ্বর্য সেদিন সাফ সাফ জানিয়ে দিল।
“বিয়ে আপনি আমার জন্য করেন নি , নিজের জন্য করেছেন।আর আমি যথেষ্ট ম্যাচিউর , পনেরো বছর আমার। আমি নিজেকে সামলাতে পারি বুঝেছেন?তাই আমাকে রাম সাম বুঝাতে আসবেন না।”
শহীদ চরম পর্যায়ে অবাক হলো , ছেলে তাকে বাবা বলে পর্যন্ত ডাকেনি উপরন্তু আপনি আগগে করছে।
আজও ওদের মধ্যে সেই আগের ন্যায় সম্পর্ক নেই।
ঐশ্বর্য বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথে রুদ্র এসে তাকে ম্যানলি হাগ করলো।
“কেমন আছো ভাই?”
ঐশ্বর্য মৃদু হাসলো।
“ভালো ,তুই বল কেমন আছিস?”
“এই তো ভালো আছি। তুমি আসবে একবার জানালে না!”
ঐশ্বর্য ফিচলে হাসে , জিসানের সঙ্গেও সৌজন্য মূলক কথোপকথন করে রুদ্র।নিকি সবে অফিস থেকে ফিরেছে, সদর দরজার কাছে এত মানুষ দেখে কিছুটা অবাক হলো।
“ভাইয়া!”
আহ্ তার বোনের কন্ঠস্বর, ঐশ্বর্য শুনলো তবে খুব একটা ভাবান্তর দেখা দিল না।সে উপরন্তু মুখের গম্ভীর ভাবটা আরেকটু গম্ভীর করে নিলো। নিকি নিজের বড় ভাইকে সামনে দেখে রিতিমত থমকে গিয়েছে।
“ভাইয়া তুমি! সত্যি?”
ঐশ্বর্য নিশ্চুপ , এদিকে ঠোঁট টিপে মিটিমিটি হাসছে জিসান।
“না মিথ্যে আসিনি আমি!”
ঐশ্বর্যের কথায় নিকি কি রিয়ে’কশন দিবে বুঝতে পারছে না। আচমকাই জড়িয়ে ধরে ঐশ্বর্য কে।
“ভাইয়া ভাইয়া ভাইয়া অ্যাম সো হ্যাপি। তুমি চলে আসবে জানাবে না? উফ্ সত্যি বলছি বিশ্বাস হচ্ছে না।”
ঐশ্বর্য মিহি হাসলো।
“হয়েছে ছাড়, তবে আমি এখানে একটা কাজে এসেছি।”
রুদ্র তৎক্ষণাৎ শুধোয়।
“কী কাজ ভাই?”
“পরে বলব।”
নিকি ঐশ্বর্য কে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র সম্মুখীন হলো আফসানার।
“চলে এসো তবে!”
আফসানার এহেন প্রশ্নে বাঁকা হাসলো ঐশ্বর্য।সেও বেশ ভাব দেখিয়ে বললো।
“কেন আপনার পা’কা ধানে মই পড়েছে বুঝি!”
আফসানা দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
“বেয়াদব কোথাকার।”
ঐশ্বর্য বেশ আয়েশ করে সোফায় গিয়ে বসে,চোখ দুটো বুজে বলে উঠে।
“বেয়াদবের থেকে আদব আশা করবেন না মিসেস মহিলা! জানেনই তো আমি ঠিক কতটা বেয়াদব!”
ঐশ্বর্য শব্দ করে হেসে উঠলো,সেই হাসি রিতিমত গা জ্ব’লে উঠলো আফসানার।
তিনি গঢগঢ করে দুতলায় চলে গেলেন। ঐশ্বর্য অপেক্ষা করছে , উৎসা কখন আসবে?
নিকি কিচেনের দিকে ছুট লাগালো। নিশ্চয়ই তার ভাই এত দূর জার্নি করে এসে ক্লান্ত হয়ে গেছে!এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে ওর হাতে দিল , বেচারা জিসান অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে।এই মেয়েটা কী তাকে দেখেনি? এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও আর চুপ থাকতে পারলো না। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠে।
“আমিও এখানে আছি দেখতে পাচ্ছো না না কি?”
নিকি আড় চোখে তাকায় জিসানের দিকে , রুদ্র শব্দ করে হেসে উঠলো। ঐশ্বর্য এক কাঠি এগিয়ে , ছেলেটা কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে!
“নিকি ইয়ার আমার ফ্রেন্ড কে একটু দেখ। বেচারা এত ধুর থেকে এসেছে।”
নিকি ঐশ্বর্যের দিকে তাকাতেই ঐশ্বর্য বাঁকা হাসলো , সবাই মজা নিচ্ছে। জিসানের দিকে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টি নি’ক্ষে’প করলো নিকি। লোকটা এত নির্লজ্জ কেন?
আচমকা সবাই চমকে উঠে,কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলো সবাই। কেউ অপেক্ষা না করে বাইরের দিকে ছুট লাগালো,নিকি চিৎকার করে উঠল।
“উৎসা!”
উৎসা কাঁদায় লেপ্টে আছে,এই তো কিছুক্ষণ আগেই মালি এই জায়গাটা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে যাচ্ছিল , অনেক শেওলা জমে গিয়েছিল তাই। কিন্তু উৎসা তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে হোচট খেয়ে ঠাস করে পড়ে গেল।
সবাই উদগ্রীব হয়ে এগিয়ে এলো এদিকে উৎসা আহা’ম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সবার পিছনে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে ঐশ্বর্য, দৃষ্টি তার সম্পূর্ণ উৎসার দিকে। জিসান এগিয়ে এলো।
“হোয়াট দ্যা হেল?মিস বাংলাদেশী তুমি ঠিক আছো?”
উৎসা এক নজর জিসানের দিকে তার পরক্ষণেই নিজেকে দেখছে। কাঁদায় মাখো মাখো অবস্থা তার ,ছিহ্ কী লজ্জাজনক পরিস্থিতি!
“তুই এখানে কেন?চলে যা তোর সাথে কথা বলতে চাই না আমি।”
নিকির গম্ভীর স্বরে বলা কথা গুলো শুনে টনক নড়ে ওঠে উৎসার।
“শুনো না আপু অ্যাম স্যরি কিন্তু আমার তোমার সাথে কথা আছে।”
নিকি ইচ্ছে করে বেঁকে বসলো।
রেড রোজ ২ পর্ব ১৬
“শুনব না আমি।”
“প্লিজ।”
“নট।”
‘প্লিজ….
উৎসা আচমকা এগিয়ে আসতে গিয়ে আবারো পিচ্ছিল করে পড়তে নিল। তৎক্ষণাৎ সামনে দাঁড়ানো সবাই সরে গেল ,সে হুমড়ি খেয়ে ঐশ্বর্যের উপর পড়ল।
“ও মা গো!”
ঐশ্বর্য আর উৎসা একে অপরের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার অবস্থা। নিজের সাথে সাথে ঐশ্বর্য কে কাঁদায় মাখো মাখো করেছে সে।
“ষ্টুপিড!”