রোদরঞ্জন পর্ব ৩৫ (২)
আসরিফা মেহনাজ চিত্রা
‘আপনার সাথে জেহফিলের কী শত্রুতা?’
তাজবীর জবাব দেয়, ‘কী শত্রুতা আবার? আমি ভালো মানুষ ভাই, কারো সাথে সাপে নেউলে সম্পর্ক নেই আমার।’
‘নইলে জেহফিলের সম্পর্কে বাজে কথা বলছেন কেন?’
হতাশ শ্বাস ফেলে বাইরে তাকায় তাজবীর। ঝুমঝুম শব্দে ধরণীর বুকে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে। ইনানদের দোতলার বাসা অন্ধকার। কারেন্ট চলে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে বিজলি চমকানোর আলোতে রাস্তার ধারের জঙ্গল গুলোকে দানবদের বাসস্থানের মতো দেখায়, দেখলেই গা ছমছম করে। যেন এক্ষুনি ভয়ানক আকৃতির বিদঘুটে দানব এসে খুবলে খাবে। এরকম একটা ভয়ানক জায়গায় জেহফিল একা কীভাবে থাকতো? ভয় লাগতো না? আশেপাশে কোনো পাড়া প্রতিবেশীও নেই। ম’রে পড়ে থাকলেও তো কেউ জানবে না। এখন এই মেয়েটাও কীভাবে পারে থাকতে!! এদের কি একটুও ডরভয় নেই??
‘লিসেন ইনান। তোমার লাইফে ইন্টারফেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো না, আর নেইও। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে আমার না চাইতেও তোমার উপর পাহারাদারি করতে হচ্ছে।’
‘পাহারাদারি?’ কিছুটা বিস্মিত হলেও কণ্ঠে প্রকাশ করল না ইনান, ‘তা জেহফিল কি আপনাকে আমার পাহারাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে নাকি?’
‘আশ্চর্য! তুমি কীভাবে জানলে?’ অবাক হওয়ার ভান ধরল তাজবীর। মুখ চেপে হাসছে সে।
ইনান চোখ উল্টিয়ে বলল, ‘ওহ ওয়েট, জেহফিল কেন দিবে, আপনারা কেউ কাউকে তো দেখতেই পারেন না। তাহলে আপনি কার কথায় আমার উপর নজর রাখছেন?’ হাত বুকের কাছে নিয়ে ভাঁজ করে বলল সে।
রহস্য নিয়ে হাসলো তাজবীর। ইনানের কাছে এক পা এগিয়ে আসে, পিছু হটে ইনান। তার এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না আর। এমনিতেই গত কাল এই ছেলের চাহনি তার ভালো লাগেনি, তার উপর এখন অদ্ভুত ধরনের কথা। তাজবীর হাঁটুতে হাত রেখে ইনানের মুখ বরাবর ঝুঁকল, মেয়েটা এতো ছোটো!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘এই, দূরে। দূরে যান, দূরে যেতে বলেছি। খ্যাক করে উঠে ইনান। বুকে সাহস জোগাড় করার চেষ্টা করতে লাগল সে। ভয় পাবে না, কিছুতেই না।
কিছুটা বিরক্ত হয় তাজবীর,
‘তুমি নিজেকে কী ভাবো বলো তো?’
‘পরী।’
‘আজব একটা মেয়ে!’ বিড়বিড় করে বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে, ‘যাইহোক। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই ইনান। আমি তোমার ক্ষতি করবো না। বিনা বেতনের কামলা খাটতে আসছি। তা-ই খেটে চলে যাব সময় আসলে। সুতরাং আজাইরা ভয় পাওয়ার নাটক করবা না আমার সামনে।’
অপমানিত বোধ করল ইনান, ‘নাটক করলাম কখন? অচেনা মানুষ এমন অদ্ভুত বিহেভ করলে যে কারোরই ভয় লাগবে।’
‘আর একটা অচেনা মানুষের কাছে নিজেকে যে স্বেচ্ছায় সারাজীবনের জন্য বিলিয়ে দিলে তাতে ভয় লাগল না?’
‘জেহফিল অচেনা নয়। ওনার সম্পর্কে সবই জানি আমি।’
‘শুধু পারিবারিক, আর্থিক অবস্থা জানলেই চলে না। একটা মানুষের সাথে সারা জীবন কাটাবে আর তার সম্পর্কে ভালো মতো না জেনেই বিয়ে বসবে?’
ইনান ধারণা করল, তাজবীর জানে না যে সে কী অবস্থায় বিয়ে করেছে। মেবি তাজবীর মনে করেছে ইনান পারিবারিকভাবে জেহফিলকে বিয়ে করেছে। যদি জানতো তাহলে এই কথা বলতো না। তাও সে বলল,
‘কী জানার কথা বলছেন বলেন তো?’
‘জেহফিল তোমার সাথে যেই বিহেভ করে, মানে যেমনটা একাডেমিতে দেখলাম, তার সম্পূর্ণ বিপরীত সে। ও অ্যাগ্রেসিভ। লাইক, নিজের পছন্দ মতো কোনো জিনিস না হলে ও খুব হিংস্র হয়ে যায়, আমার অনেকগুলো স্কাল্পচার ভেঙেছে ও, সামান্য ত্রুটি থাকলেও। স্যার বলে কিছু বলতে পারি না। আর ওকে দেখে যা মনে হয়, ওর আর কোনো হিংস্র জন্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’
‘জানি।’ নির্বিকার জবাব।
‘জানো!’ যেন আকাশ থেকে পড়ল তাজবীর, ‘জেনেবুঝেও কীভাবে ওর মতো একটা মানুষকে বিয়ে করলে।’
‘শুনেন ভাই, কীভাবে বিয়ে হয়েছে না হয়েছে, সেটা বড় কথা না। বড় কথা হচ্ছে আমাদের অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে। যা হয়েছে তা আপনি কিংবা আমি তো আর চেঞ্জ করতে পারবেন না, তাই না? সো ওসব নিয়ে কথা বলারও কোনো দরকার নেই। জেহফিল হিংস্র পশু তা প্রথম থেকেই জানি, তাও আমি তাকে ভালোবাসি। আপনার বলা না বলায় কিচ্ছু যায় আসবে না। তাই বলছি, এসব আবোলতাবোল না বকে ভাগেন, ফুটেন এখান থেকে। এমনিতেই অনেক টাইম নষ্ট করেছেন আমার। আর না। জেহফিল অপেক্ষা করছে।’
ইনান ছাতার মাথা দিয়ে তাজবীরের পেটে ঠেলতে ঠেলতে তাকে গেটের বাইরে বের করে দিলো। তাজবীর দ্রুত ইনানের ছাতাটা কেড়ে নিয়ে মেলে ধরল। এই মেয়ে এত নিষ্ঠুর। সে আরো অনেক কিছুই বলতো। তার মনে অনেক খটকা আছে ইনানকে দেখে। কিন্তু এই বৃষ্টির মাঝে আর থাকাটা সম্ভব না। বাতাসে ছাতা ভেঙে যাওয়ার যোগাড়।
ইনানকে উদ্দেশ্য করে শেষ কথা বলল,
‘ইউ গাইজ আর সিক, রিয়েলি ভেরী সিক। তুমিও কম না, মানসিক সমস্যা আছে তোমার। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও। ঠিক হয়ে যাবে।’
সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তখনই পিছন থেকে ইনানের ডাক শোনা গেল।
‘ওয়েট, বললেন না তো কে আপনাকে বিনা বেতনে হায়ার করেছে আমাকে পাহাড়া দেয়ার জন্য?’
তাজবীর পেছনে না ঘুরে শুধু মাথাটা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
‘আছে একজন। একটা হিন্ট দেই। তাকে কিন্তু তুমি চিনো।’
এই বলে দাঁড়ালো না। গটগট পায়ে বিজলির আলোয় হেঁটে চলে গেল।
ইনান যেন বাঁচল। কারেন্ট চলে যাওয়ায় মোবাইলের লাইট অন করে উপরের সিঁড়িতে পা বাড়াতেই কেউ একজন তার কোমর শক্ত করে চেপে ধরে মুখ চেপে ধরল।
অতর্কিত আক্রমণে ইনানের হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়। আগন্তুক তাকে টেনে হিঁচড়ে নিচ তলার গোডাউনে নিয়ে গিয়ে নোংড়া মেঝেতে আছড়ে ফেলে দেয়। ইনান চিৎকারের সুযোগটুকুও পায় না, তার আগেই আগন্তুক চেপে বসে ইনানের পেটের উপর। এক হাতে ইনানের হাতদুটো ধরে আরেক হাতে ইনানের পরনের টপ ছিঁড়তে শুরু করে। মুখ ছাড়া পেয়ে ইনান আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে, কিন্তু হায়! গগণ কাঁপানো বজ্রপাতের আড়ালে তার চিৎকার চাপা পড়ে যায়। যেন আকাশটাও ইনানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইনানের চিৎকারের সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
সেই মুহূর্তে গোডাউনের ভাঙা জানালা দিয়ে বিজলির আলোয় হামলাকারীর মুখ দেখতে পায় ইনান। আত্মা কেঁপে উঠে তার। শরৎ! তার ফ্রেন্ডদের একজন।
ইনান জেহফিলের নাম ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকে। শরৎএর থাবার মধ্য থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দেয়। ইনানের বৃথা চেষ্টা দেখে শরৎ কুৎসিত হাসলো।
‘অনেক দিন পর পাইছি তোরে মা*। এত সহজে ছাইড়া দিমু ভাবছোস? তোর কোন নাগররে ডাকবি ডাক, দেখি আসে কিনা। শুয়োরের বাচ্চা, কম জ্বালাস না আমারে। তোর বাপ আর তুই আমার জীবনটারে নরক বানায় ফেলছোস। আজকে সব শোধ তুলমু। এমন অবস্থা করমু না, তোর অবস্থা দেইখা তোর বাপ ফাঁ’সি দিবো মিলায় নিস।’
শরৎতের চোখ চকচক করছে, জিভ দিয়ে এমন আওয়াজ করছে যেন কোনো সুস্বাদু খাবার তার সামনে। ভয়ে ইনানের চেহেরার রং সরে গেল। চিৎকার চেঁচামেচি করলে কেউ তো আসবেই না বরং তার শক্তি লস হবে। শরৎতের লালসার শিকার থেকে বাঁচতে শেষবারের মতো বলল,
‘শরৎ, ভাই আমার প্লিজ, মাফ করে দে আমাকে। তোর পায়ে পড়ি দোস্ত, প্লিজ কিছু করিস না।’ ইনান আকুতি মিনতি করে বলল।
শরৎ অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল, যেন ইনান কোনো মজার জোকস বলেছে, ‘ওরে শালি, এখন বিপদে পইড়া তোর ভাই, দোস্ত হইয়া গেলাম!’ ইনানের গাল চেপে ধরল দুই আঙ্গুলে, ‘কিন্তু এখন তো আমি ভাইয়ের মতো কোনো কাজ করতাম না ইনান সোনা, এখন করব তোমার হাজব্যান্ডের মতো কাজ।’
ইনানের গালে হাত বুলিয়ে বলল। গা যেন ঘিনঘিন করে উঠল ইনানের। শরৎ ইনানের থেকে হাত সরিয়ে তার শার্ট খুলে ফেলল। ইনানের টপের বুকের অগ্রভাগ টেনে ছিঁড়ে ফেলল সহসা। বক্ষবন্ধনী স্পষ্ট দেখা গেল তার। ইনান ডুকরে কেঁদে উঠল। জেহফিল ছাড়া অন্য পুরুষের ছোঁয়া তার শরীর স্পর্শ করবে ভাবতেই গা গুলিয়ে গেল। শরৎ তার মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে ইনানের বুকের সামনে ধরল, ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজিয়ে লোভাতুর চাহনি মেলে ধরল ইনানের বক্ষভাঁজে।
ইনান ক্রন্দনরত গলায় একাধারে মিনতি করেই যাচ্ছে। এর চেয়ে ম’রে যাওয়াই ভালো আছে।
‘নাহ, এমনে মজা পাইতেছি না। ভালো কইরা দেখতে হইব।’
এই বলে ইনানের ইনার খোলার জন্য কাঁধে হাত দিতেই শরৎ তার মাথায়। উহ্ শব্দ তুলে মাথার পেছনে চেপে ধরল সে। ফ্ল্যাশ অফ হয়ে গেছে। সেই সময় পেছন থেকে কেউ একজন শরৎএর চুলের গোড়া মুঠোয় বন্দী করে তাকে উপড়ে ফেলল ইনানের উপর থেকে। শরৎ কুঁকড়ে গেল ব্যথায়। মাথায় হাত দিয়ে দেখল তার চেপে ধরা চুলগুলো নেই, তার জায়গায় লাল রঙের তরল গড়িয়ে পড়ছে।
রোদরঞ্জন পর্ব ৩৫
‘কোন কুত্তা’র বাচ্চা…’ তার গলার স্বর চাপা পড়ে গেল লোকটি যখন পা দিয়ে তার গলা চেপে ধরল শক্ত করে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তার। হাঁপরের মতো হাঁসফাঁস করতে লাগল সে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় আবছা চোখে চেয়ে দেখল তার যমদূতকে…