রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ১
ফারহানা চৌধুরী
তিন বছর আগে বিয়ের আসরে ফেলে আসা নিজের স্ত্রীকে তিন বছর পর নিজের সামনে দেখে চমকালো শুভ্র। বিস্ময়ে হতবাক সে। বাবা-মায়ের জেদে বিয়ে করলেও বিয়ের পর বাড়ি ছাড়তে সময় নেয়নি সে। বিয়ের পরেই ফ্লাইটে করে দেশ ছেড়েছিলো। মেয়েটার মুখটুকুও ঠিক করে দেখেনি। আজ এতবছর পরে নিজের সামনে স্বীয় স্ত্রীকে দেখে যারপরনাই বিস্ময়ে থ মেরে গিয়েছে সে। তাকে এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তীব্র অস্বস্তি এসে জড়ো হলো অরুর মাঝে। মেয়েটার মুখ এইটুকুন হয়ে এলো। সে চোখ সরিয়ে নিলো। পাশ থেকে শুভ্রর বাবা আশরাফুল তালুকদার বললেন,
-‘কি রে? ভেতরে আসতে দিবি তো আমাদের। সর?’
শুভ্র হুঁশ পেল যেন। সে সরে দাঁড়ালো। আশরাফুল তালুকদার লাগেজ-পত্তর নিয়ে ভেতরে যেতে যেতে স্ত্রী মেরিনাকে বললেন,
-‘মেরি, অরুকে নিয়ে ভেতরে এসো।’
শুভ্রর মনে পড়লো, মেয়েটার নাম অরু। তার চোখ তখনও অরুর উপর। মেয়েটা তার দিকে শুরুতে একবার তাকালেও এখন আর তাকাচ্ছে না। একবারের জন্যও না। শুভ্র অবাক হলো। এরপর নিজেও চোখ সরালো। বাবার হাত থেকে লাগেজ নিয়ে, তাদের বসতে বলে লাগেজগুলো বরাদ্দকৃত ঘরে রেখে এলো। মেরিনা অরুকে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পর শুভ্র এলো। খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে চাইলে মেরিনা বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘কিচ্ছু করতে হবে না। তুই এদিকে আয়। বস তো একটু।’
শুভ্র গিয়ে মায়ের পাশে বসে মাথা এগিয়ে দিল। মেরিনা হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। শুভ্র আড়চোখে তাকাল অরুর দিকে। কখন থেকে গাঁট হয়ে বসে আছে মেয়েটা। এদিকও তাকাচ্ছে না, ওদিকও না। আজব! এমন করার কি মানে? এসব কেমন কাজ? আশরাফুল তালুকদার এবার জিজ্ঞেস করলেন,
-‘ব্যবসার কি খবর? কেমন চলছে?’
শুভ্র বাবার দিকে তাকাল। বাবার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বলল,
-‘ভালো আলহামদুলিল্লাহ।’
আশরাফুল তালুকদারের নিজেদের ব্যবসা রয়েছে। ব্যবসাটা পারিবারিকভাবে। মূল শাখা বাংলাদেশে হলেও, আমেরিকাতে একটা ব্রাঞ্চ আছে তাদের। যার দায়িত্বে শুভ্র রয়েছে।
মূলত এটা একটা ছুঁতো শুভ্রর। ব্যবসা সামলানোর নামে দেশে না ফেরা। অরুর মুখোমুখি না হওয়া। মেরিনা হাজার বলে-কয়েও ছেলেকে বাড়িমুখো করতে পারেনি। শুভ্র আসার সময় বলেই দিয়েছিলো, ‘বিয়ে দিতে চেয়েছো, জোর করেছো যখন; বিয়ে করেছি। এখন বউ কি করবে, তোমরা বোঝো। আমাকে এই নিয়ে বলতেও আসবে না।’ এইসব বলে বাড়ি ছেড়ে আর খোঁজও নেয়নি বউয়ের। তা নিয়ে মেরিনার দুঃখের শেষ নেই। এতোদিন বলে-কয়েও যখন ছেলেকে ফেরাতে পারেননি বৌমার কাছে, এবার বৌমাকেই নিয়ে এসেছেন ছেলের কাছে।
অরু সেই থেকে হাত কচলে যাচ্ছে সমানে। না কিছু করছে না কিছু বলছে। এতো অস্বস্তি হচ্ছে বলার বাইরে। এই লোককে তার কতটা অপছন্দ তা শুধু সে আর উপর ওয়ালা ছাড়া বোধহয় কেউ জানে না। যেভাবে বিয়ের দিন তাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলো, তারপর তাকে কত কথা শুনিয়েছে পাড়া-প্রতিবেশী তা শুধু সে জানে। কেমন মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে, তা তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। এতসবের জন্য এই লোককে অরু মাফ করবে? কখনো না! অরু মরে গেলেও এই লোকের সাথে শান্তিতে থাকতে পারবে না। যাকে দু’চোখে দেখতে পারে না, সহয় করতে পারে না; তার সাথে কিসের সংসার করবে? মরে যাবে সে। অরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
স্কলারশিপে দেশের বাইরে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলো। হোস্টেলে থেকে পড়ার কথা ভাবলেও, আন্টি তার কথা কেন শোনেনি কে জানে। জোর করে তাকে নিয়ে তো এসেছে এখানে, এখন কি করে থাকবে সে শুধু আন্টি জানে। যদি শুভ্র তাকে আঙ্কেল-আন্টি চলে যাওয়ার পরে বের করে দেয়? অবশ্য যদি বের করে দেয়ও, সে বিশেস অবাক হবে না। অরুর মতে—যেই লোক বিয়ের আসরে বউ রেখে দেশ ছাড়তে পারে, সে সব করতে পারে।
-‘অরু?’
মেরিনার আচমকা ডাকে অরু চমকাল। ঘোর কাটল যেন। সে তাকাল মেরিনার দিকে,
-‘হ-হ্যাঁ?’
-‘কি হয়েছে? এতক্ষণ ধরে ডাকছি।’
অরু মাথা নাড়াল,
-‘কিছু না তো।’
-‘ফ্রেশ হবি না?’
-‘হ্যাঁ, হবো তো।’
-‘আচ্ছা, তুই শুভ্রর সাথে যা। ও তোকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দেবে। আমরাও ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। আশরাফ? চলো।’
মেরিনা চোখের ইশারায় কিছু বলল আশরাফুল তালুকদারকে। আশরাফুল তালুকদার বুঝে বললেন,
-‘হ্যাঁ। চলো আমরা যাই। অরু মা, তুমিও যাও। শুভ্র, ওকে নিয়ে যাও।’
আশরাফুল তালুকদার মেরিনাকে নিয়ে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে চলে গেলেন। মাঝ থেকে থ মেরে গেল অরু আর শুভ্র। হুট করে এভাবে বলে এভাবে চলে গেল? আজব! অরু ইতস্তত বোধ করে উঠে দাঁড়ালো।
শুভ্র একবার তার দিকে তাকাল। তারপর গটগট করে হেঁটে গেল ঘরের ভেতরে। অরু হা করে তাকাল। লোকটা কি তাকে কোনোভাবে তাচ্ছিল্য করলো? অরুর মেজাজ খিঁচড়ে এলো। সে উপায়ন্তর না পেয়ে শুভ্রর পিছু পিছু দ্রুত গেল ঘরের ভেতর। হুট করে শুভ্র দাঁড়িয়ে পড়লো। একদম হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ায় শুভ্রকে অনুসরণ করে আসা অরু তাল মেলাতে পারল না। ফলস্বরূপ বেচারি কপালসহ নাক ঠুকে গেল শুভ্রর শক্তপোক্ত পিঠে। অরু নাক ঘষতে ঘষতে দাঁড়িয়ে পড়লো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে পিছে তাকিয়ে অরুকে দেখেই দ্রুত বলে উঠলো,
-‘পিছে পিছে পিছে।’
অরু ভ্রু কুঁচকে তাকায়। দু কদম পিছে গিয়ে দাঁড়ালো। শুভ্রর দিকে তখনও তাকিয়ে আছে সে। শুভ্র গিয়ে একটা তোয়ালে নিয়ে এসে অরুর হাতে ধরিয়ে বলল,
-‘আমার থেকে দূরে দূরে থাকবে তুমি। দশ হাত দূরে তো মাস্ট।’
অরু এবার ভ্রু যুগল আরো কয়েক ডিগ্রি বেঁকে বলল,
-‘কেন ভাই? কিসের জন্য দূরে দূরে থাকব?’
শুভ্র হতবাক,
-‘ভাই?’