লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৯

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৯
Fatima Fariyal

রাতের আধো আলোয় গুলশানের সেই নির্জন এলাকাটা যেন এক মুহূর্তেই জেগে উঠলো উৎসবের মতো কোলাহলে।
মীর হাউজের গেট থেকে শুরু করে ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত ঝুলছে ফুলের মালা আর ছোট ছোট হলুদ বাতির শিকল।
মৃদু বাতাসে বাতিগুলো দুলছে, হলদেটে আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সব কিছু মিলিয়ে মীর হাউজজ একদম রাজকীয় আলোয় রঙিন হয়ে উঠছে। গেট খুলেতেই গাড়িগুলো সারি বদ্ধ হয়ে ডুকলো ভিতরে। হালকা সোরগোল হতেই, আদনান উপর থেকে নিজের রুমের জানালার পর্দার ফাঁকা দিয়ে দৃষ্টি রাখলো সেদিকে। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, চোখদুটো গভীর, অদ্ভুত স্থিরতায় ভরা।

আহাদ গাড়ি থেকে নেমে রিদি জন্য অপেক্ষা করছিলো, যেই রিদি নিচে পা রাখতে যাবে সাথে সাথে আহাদ তাকে আবার নিজের কোলে তুলে নিলো। রিদি বুঝতে পারলো, প্রতিবাদ করেও লাভ হবে না। তাই সে হাতের কজ্বিতে আহাদের গলা পেঁচিয়ে ধরে নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখার চেষ্টা করলো। এটা দেখে আদনানের ঠোঁটের কোণে অজান্তেই একটুকরো মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“অবশেষে তোর মতো পাগলেরও একটা গতি হলো। শত পাগলামি, যুদ্ধ করে জিতে নিয়েছিস নিজের ভালোবাসাকে। আর আমি..! না পারলাম তোর মত পাগলামি করতে, আর না পারলাম তোর থেকে তোর বোন চেয়ে নিতে। সেই চোদ্দ বছরের করা একটা ভুলের জন্য পূর্ণতা থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে আছি আমি।”
শেষ কথাগুলো বলার সময় তার কণ্ঠে হালকা কম্পন হলো। চোখের ভেতর জমে থাকা অতীতের ছাঁয়া যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠলো। হঠাৎ দরজা টোকা পরতেই ঘুরে তাকায় আদনান। আহিয়া দরজার ফাঁকা দিয়ে মাথা ভিতরে এনে উঁকি দিয়ে আছে। আদনানকে দেখেই সাথে সাথে সোজা হয়ে ভিতরে এসে দাঁড়াল। মুখে অদ্ভুত দ্বিধা, যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। আদনান গলায় একরাশ ক্লান্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কী? কিছু বলবি?”
আহিয়া উপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
“হুমম।”
“বল।”
“রিদিকে নিয়ে সবাই চলে আসছে।”
আদনান ভ্রু জোড়া গুছিয়ে নিয়ে বললো,
“তো! আমি কী করবো?”
“আপনি যাবেন না? আমরা তো সবাই ভাইয়ার রুমে ফিতা ধরার প্ল্যান করেছি।”
আহিয়ার এই বোকা বোকা কথা শুনে আদনানের মুখ মুহূর্তেই শক্ত হয়ে গেলো। এক কদম এগিয়ে এসে চোয়াল শক্ত করে বললো,
“মাথা খারাপ তোর? বোকার মতো কথা বলছিস কেনো? ভাসুর হয়ে এখন আমি যাবো বাসর ঘরের ফিতা ধরতে? ডাফার!”

আহিয়া এক সেকেন্ডর জন্য হতভম্ভ হয়ে যায়, নিজকে কোন রকম সামলে নিয়ে গলা কাঁপিয়ে বলে,
“আ… আসলে আমি বুঝতে পারিনি। আমি তো…”
আদনান এবার একটু পিছিয়ে যায়। চোখে হালকা তাচ্ছিল্যের রেখা, ঠোঁটে এক বিদ্রুপ মাখা হাসি দিয়ে বললো,
“হাহ! তা বুঝবি কেনো, তোর থেকে তো ভালো আদিবা বোঝে। তোর এই না বোঝার কারনে, যতসব যন্ত্রণা আমার একা ভোগ করতে হচ্ছে।”
আদনানের শেষের কথাগুলোর সাথে মিশে ছিলো রাগ আর যন্ত্রণার মিশল। আহিয়া আর কিছু বলল না। শুধু ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে রাখলো। আদনান সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ বুঝতে পারলো, সে একটু রুঢ় হয়ে গেছে। নাক টানার একটা ভঙ্গি করে নিচু গলায় বললো,

“স… সরি। আ..সলে আমার মাথা ব্যথা করছে, তাই একটু ঝাঁঝালো কথা বেরিয়ে গেছে। তুই যা এখন।”
আহিয়া সাথে সাথে ধড়ফড় করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আদনান তার চলে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখের আড়াল হতেই নিজের ভিতরে ক্রোধটাকে নিভানোর জন্য সামনে থাকা সোফায় ধেরাম একটা লাথি মারলো। সত্যি সত্যি তার এখন মাথা যন্ত্রণা করছে, তাই দু হাত দিয়ে চুলগুলো টেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে শান্ত থাকার চেষ্টা করলো।

আহাদ রিদিকে নিয়ে মূল দরজায় আসতেই ভিতরে একরকম হুলুস্তুল পরে গেলো। সে এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা উপরে হাটা দিলো। যেন এই কোলাহলের ভেতর থেকে নিজের পৃথিবীটা আলাদা করে নিতে চায়।রিদি আহাদের কোলেই হালকা নড়াচড়া করে মুখ নিচু করে গুজে রাখলো তার বুকে। রিদির কথায় তার সাথে আনিকা, তানভীর, রাইসাও এসেছিল তার সাথে। এখন তারাও আহাদ রিদির পিছনেই হাঁটছে। আহাদ সোজা নিজের রুমের সামনে আসতেই থমকে গেলো সামনের দৃশ্য দেখে। ধীরে রিদিকে নিজের কোল থেকে নামিয়ে রাখলো। রিদি মেঝেতে পা রেখে লাজুক লাজুক মুখে সবার দিকে তাকালো এক ঝলক। আহাদের রুমের দরজায় আগে থেকেই লাল ফিতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আদিল, আহিয়া।শাহীন, নাদিম, শাওনও যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। আহাদের মেজাজ খারাপ হলো এসব দেখে, সব জায়গায় শুধু বাঁধা। কোথায় নিজের প্রেয়সীকে নিয়ে একটু একান্তভাবে মন ভরে দেখবে, তা আর হতে দিলো কই। আহাদের গলা ভারী হয়ে গেল। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে চেঁচিয়ে উঠলো,
“তোরা আমার রুমের সামনে কী করছিস? আর এসব কী? বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার বর্ডারের মতো ফিতা ধরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”

আদিল এক গাল হেসে ফিতা দোলাতে দোলাতে বললো,
“এই বর্ডার পার করতে হলে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে।”
আহাদের চোখ বড় হয়ে গেল,
“হোয়াট! পাঁচ লাখ? আমার কী টাকার গাছ আছে? আর তুই না থাইল্যান্ড ছিলি, তোকে কে আসতে বলেছে?”
আদিল একটু ভঙ্গিমা করে চোখ টিপে বললো,
“তোমার বিয়ে আমি আসবো না? যত যাই হোক, পাঁচ লাখ তো আর মিস করতে পারি না। তাই না বি ভি?”
শেষ কথাটা বলে সে মুখ ঘুরিয়ে রিদির দিকে তাকালো।
রিদি তখন আহাদের কাঁধ ঘেষে দাঁড়িয়ে লাজুক মুখে তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আহিয়া কনুই দিয়ে আদিলকে গুঁতো মেরে বললো,

“বি ভি আবার কী?”
“বি মানে বিউটিফুল, ভি মানে ভাবি! বিউটিফুল ভাবি!”
নাদিম হেসে বলে উঠলো,
“জিনিয়াস!”
সবাই এক জোট হয়ে হেসে উঠলো, কিন্তু আহাদের মোটেও হাসি পেলো না। বরং আরো রেগে গেলো। দু আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“দুই মিনিট, জাস্ট দুই মিনিটের মধ্যে আমার রুমের সামনে থেকে সরে যা। কুইক!”
শাহীন এবার এগিয়ে এসে হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো,
“না ভাই, সে আপনি যতই বলেন। আমরা আমাদের পাওনা না নিয়ে যাচ্ছি না।”
“শাহীইইইনন!”
“সরি ভাই, আজকে কাজ হবে না।”
এই সময় পেছন থেকে আনিকা হেসে বললো,

“রাইসা, এখন কারা চাঁদাবাজি করছে দেখো! আমাদের তো খুব বড় বড় কথা বলছিলো!”
আহাদ এবার চরম আকারে ক্ষেপে গেলো। তার চোখের মণি রাগে কাঁপছে, বুকের ভেতর জ্বালা করছে আগুনের মতো। নিচ থেকে একটানা তাদের হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। আফরোজা শেখ সব শুনছিলেন, কপালে চাপা বিরক্তি। হালিমাকে ইশারা করতেই কাছে এগিয়ে আসলো। আফরোজা শেখের দৃষ্টি লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে আপা, কিছু বলবা।”
আফরোজা শেখের মুখে সেই চিরচেনা স্থির ভাব, কিন্তু চোখে অসন্তোষ স্পষ্ট। তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্ত গলায় বললেন,
“রাত অনেক হয়েছে, হালিমা। এখন সবাইকে নিচে ডেকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমার মাথা ধরেছে, আমি ঘরে গেলাম। তুমি রিদিতাকে যা যা বোঝানোর দরকার বুঝিয়ে দিও। আমি তো শাশুড়ি হয়ে আর এসব বলতে পারিনা।”

হালিমা বেগমের একটু লজ্জা অনূভতি হলো, নিচু গলায় বললো,
“আপা, সম্পর্কে তো আমিও শাশুড়ি হই।”
“তবুও আমার আর তোমার মাঝে তফাৎ আছে হালিমা। আহিয়ার সাথে যখন তুমি ফ্রি, রিদিতার সাথেও নিশ্চয়ই ফ্রি হতে প্রবলেম হবে না।”
“ঠিক আছে আপা, আমি দেখছি।”
হালিমা বেগম স্বামিকে ইশারা করে ডেকে উপরে চলে গেলো। আহাদ তখন রাগে ফুঁসছে, কিন্তু আশ্চর্য! কেউ তাকে এক বিন্দু ভয়ও পাচ্ছে না। তার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেলো এক ঝটকায়, আসফাক মীরকে দেখার সাথে সাথে ফেটে পরলো,
“চাচুউউউ, ওদের আমার চোখের সামনে থেকে যেতে বলো। তা না হলে থাপ্পড়ায়া একেকেটার চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো।”

আহাদের কথাটা শুনে তানভীর কপাল গুছিয়ে নিলো, হঠাৎ বোধোদয় হলো, এই কথাটা তো রিদিও বলেছিলো তাকে। তানভীর রিদির কানে ফিসফিস করলো,
“তাই বলিইইই.. না খেয়েও তোর এতো শক্তি এলো কোথা থেকে।”
রিদি আহাদের পাশ ঘেঁষে চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলো, তানভীরের কথা শুনে মুখের ভিতর রেখেই বিড়বিড় করে বললো,
“চুপ থাক, তা না হলে উনি সত্যি সত্যি তোর চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবে।”
তানভীর দ্রুত চুপ হয়ে গেলো। আসফাক মীর এগিয়ে এসে আহিয়াদের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আহাদকে উদ্দেশ করে বললেন,
“এতো ঝামেলা না করে, ওদের কথা মতো ছয় লাখ দিয়ে দিলেই তো হয়!”
আহাদ চেঁচিয়ে উঠলো,

“ছ… ছয় লাখ! ওরা বলল পাঁচ, এখন তুমি এসে বলতেছো ছয়?”
আসফাক মীর ফিতার নিচে দিয়ে ভিতরে গিয়ে আহিয়া, শাহীনদের সাথে যোগ দিয়ে বললেন,
“তখন তো আমি ছিলাম না। এখন আসছি যখন, আমি ফাঁকা যাবো কেনো? আমাদের ছয় জনকে ছয় লাখ দিয়ে দে, কিপ্টেমি করছিস কেনো?”
আহাদ কটমট করে তাকালো হালিমা বেগমের দিকে, একরকম গর্জন করে উঠলো,
“চাচি আম্মাআআ!”
হালিমা বেগম দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন। নিজের স্বামির দিকে তাকিয়ে রেগে রেগে বললেন,
“তোমর কী লজ্জা শরম সব গেছে। ভাতিজার বাসর ঘরে বাচ্চাদের সাথে ফিতা ধরেছো।”
আসফাক মীর কাঁধ ঝাঁকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,

“আশ্চর্য! আমি কী বুড়ো হয়ে গেছি? আর ভাতিজা টাতিজা আমি চিনিনা। টাকা দিবে, ঢুকতে পারবে, ব্যস!”
তার কথায় সবাই সম্মতি জানালো, কেউ একবিন্দু ছাড়তে নাড়াজ। বুকে হাত ভাঁজ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হালিমা বেগম মাথা নাড়ালো তাদের কান্ডে, মুখে বিরক্তির ছাঁপ। আহাদ শেষমেশ আর কোন উপায় দেখলো না। শাহীন চেক বের করে দিতেই আহাদ চেকে সাইন করে দিলো। এরপর ফিতা কাটতেই তাদের উপর ফুল ছিটিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে দিলো। রুমে পা রাখতেই রিদির ভিতরটা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠলো। আহিয়া এসেই তাকে খুশিতে জোরে ঝাপটে ধরলো। রিদি হালকা হাসার চেষ্টা করে আহিয়ার পিঠে হাত রাখলো, আড় চোখে তাকালো আহাদের দিকে। দৃষ্টি মিলতেই আহাদ এক চোখ টিপে দিলো, এতে লজ্জা পেয়ে দ্রুত নজড় সরিয়ে নিলো রিদি। কিন্তু সেই গোপন মূহুর্তটা দেখে ফেললো আদিবা। সে আহাদের দিকে তাকিয়ে ভ্রুু উঁচিয়ে বললো,

“ভাইয়া! তুমি রিদি আপু.. রিদি ভাবি.. না, আপু ভাবি..”
আদিবা দ্বীধায় পরলো, বুঝতে পারলো না কী বলে সম্বোদন করবে। তার কথায় উপস্তিত সবাই হেসে ফেললো। হালিমা বেগম হেসে মেয়েকে বোঝালেন,
“কী আপু, ভাবি করছিস। ভাবি ডাকবি এখন থেকে।”
আদিবা মাথা নড়িয়ে সংশোধন করে নিয়ে আবারও ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি ভাবিকে চোখ মারলে কেনো?”
“আমার বউকে আমি চোখ মেরেছি, তাতে তোর কী?”
আহাদের এই সহজ স্বীকারউক্তিতে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো রিদির। মুখটা আরও লাল হয়ে গেলো, চোখ নামিয়ে গলা খুসখুস করে কেঁশে উঠলো। হালিমা বেগম দ্রুত রিদির পিঠ চাপড়ে রিতুকে বললেন,
“রিতু পানি নিয়ে আয়।”

রিতু পাশের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে দেয় রিদিকে। রিদি বিছানার এক কোনে বসে ডকডক করে পানিটা খেয়ে নেয়। হালিমা বেগম এবার মিষ্টি নিয়ে মিষ্টি মুখ করায় রিদির। এরপর একে একে সবাই একটু করে রিদির মুখে মিষ্টি দেয়। রিদি মিষ্টি তেমন পছন্দ করে না, তবু শালীনভাবে সবাইকে খুশি রাখতে প্রতিবারই মুখে নিলো একটু করে। কিন্তু মুখে বেশি মিষ্টি পরতেই, মুখটা বিকৃত হয়ে গেলো। সেটাই নজরে পরলো আহাদের, সে কন্ঠ গম্ভীর করে বললো,
“এবার থামো সবাই, আর কত মিষ্টি খাওয়াবে ওকে? পরে দেখা যাবে আমার বউটারে পিঁপড়ার বংশধর তুলে নিয়ে গেছে।”
আসফাক মীর কটাক্ষ করে বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ, পিঁপড়ার তো আর জীবনের মায়া নেই।”

এই কথায় সবাই হো হো করে হেসে ফেললো। আরোও কিছুক্ষণ চলল হাসি ঠাট্টার আমেজ। অবশেষে হালিমা বেগম সবাইকে নিচে পাঠিয়ে দিলেন খাওয়া-দাওয়ার অজুহাতে। সবাই একে একে বেরিয়ে যেতেই ঘরটা ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। রিদিতা তখনও চুপচাপ, বিছানার এক কোনে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। তখন রুমে সে সম্পুর্ন একা, বুকের ভেতর কেমন কেমন করছে তার। সে ধীরে চোখ বুলালো চারপাশে, আহাদর সেই রুমটা সাদা আর লাল গোলাপের সাজে সজ্জিত। মেঝেতে আর সাদা বিছানায়ও লাল পাপড়ি ছড়ানো, রুমের প্রতিটা কোনায় জ্বল জ্বল করে জ্বলছে হলদেটে ক্যান্ডেল। সেই আলোয় রিদির মুখে পড়ছে উষ্ণ ছাঁয়া। মাঝেমাঝে মৃদু বাতাসে গোলাপের গন্ধ এসে তার নাকে সুুড়সুড়ি দিচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে তার কেমন অস্বস্তি অনূভতি হচ্ছে, এমন অনূভতি সে এর আগে কখনই অনূভব করেনি।

হঠাৎ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হতেই কেঁপে উঠলো তার কোমলদেহ খানা। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে আহাদ দাঁড়িয়ে আছে, শুধু দাঁড়িয়ে নেই, কেমন করে চেয়ে আছে তার দিকে। রিদির বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠলো, চোখের পাতা কাঁপছে বারবার, নিশ্বাষ রোধ করে শাড়ির এক কোন মুঠোয় চেপে ধরলো। আহাদ এক দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে নিলো, যেনো বহু প্রতীক্ষার শেষে একটু স্বস্তি পেলো সে। এক মূহুর্ত চুপ থেকে তাকিয়ে রইলো তার প্রেয়সীর সেই লাজুক রাঙ্গা মুখের দিকে, সরু ঠোঁটের কম্পন, নাকের ঢগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, কপালে ঝুলে থাকা চুলের গোছা, সব মিলিয়ে যেনো এ এক পরিপূর্ণ চিত্রকর্ম। সেই মুখ দেখে তার ঠোঁটে পূর্ণতার হাসি ফুটে উঠলো। সে একটু এগিয়ে হঠাৎই ধপাস করে বিছানায় এলিয়ে পড়লো। তার এমন আচরণে রিদি ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। আহাদ ঘাড় কাত করে ভ্রু কুচঁকে তাকালো সেদিকে, গলা খানিকটা ভারী করে বললো,

“কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো?”
রিদি কেমন নিশ্বাষ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে, কোন শব্দ বের হলো না মুখ থেকে। হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছে এক নাগারে। আহাদ আবারও গলা নামিয়ে ডাকলো,
“এদিকে এসো।”
রিদি না সূচক মাথা নাড়ালো, অর্থাৎ সে আসবে না। আহাদ চোখ সরু করে তাকালো, কণ্ঠে কঠোরতা এনে বললো,
“রিদিইই, আমি দ্বিতীয়বার বলবো না।”

কিন্তু রিদি একইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আহাদের এবার মেজাজ খারাপ হলো। আজব! সে তো শুধু একটু কোলে মাথা রেখে শুবে বলেই ডাকছে, এর বেশি কিছু করতো নাকি? তবে এই আল্লার বান্দি তার অবাধ্য অনূভতিগুলোকে জাগিয়ে তুললো। সে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতেই রিদি দরজার দিকে ছুট লাগালো। তবে দরজা খুলে আর বের হতে পারলো না। তার আগেই সেই দরজার সাথে পিঠ ঠেকে গেলো। দুপাশে থেকে আহাদের হাতের বাঁধনে বন্ধি হয়ে গেলো। বাতাসে রিদির নিঃশ্বাস জড়িয়ে আসছে, ঠোঁট শুকিয়ে এলো, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো আহাদের মুখের দিকে। কোন রকম জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
“আমি না আপনার ভাবিজি হই! প্লিজ, দূরে থাকেন আমার থেকে। ক… কাছে আসবেন না।”
রিদির কণ্ঠটা কেঁপে উঠলো, ভয় আর লজ্জা মিলেমিশে অন্যরকম শোনালো। আহাদ হেসে ফেললো, রিদির কন্ঠে এই অনুনয় শুনে। ঝুঁকে একদম কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমি ভাবিজির সাথেই রোমেন্স করবো। আমার আপত্তি নেই। তাছাড়া আপনি আমার বিয়ে করা হালাল ভাবিজি, অধিকার আছে আমার।”

আহাদের ফিসফিস শব্দের সাথে সাথে তার তপ্ত নিশ্বাষ আছড়ে পরলো রিদির কানে। আহাদ মুখ তুলে ধীরেধীরে রিদির মুখমোখি এনে থামালো। রিদি শক্ত করে চোখ বন্ধ করে আছে, এটা দেখে আবারও কিন্চিৎ হাসলো আহাদ। মৃদু ফুঁ দিয়ে বাতাস দিতে লাগলো রিদির মুখে, এতে রিদি আরো শিহরিত হলো। আচমকা আহাদ তাকে তুলে নিয়ে বসালো বিছানার পাশে, নিজেও হাটু মুড়ে বসলো তার সামনে। তার কোমল হাত দুটো নিজের উষ্ণ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। কিন্তু রিদি তখনও চোখ খুলছে না, আহাদ তর্জনী আঙুল দিয়ে রিদির চিবুক হালকা তুলে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“এই আল্লাহর বান্দি এই! তাকাও আমার দিকে।”

রিদি ধীরেধীরে তার কম্পিত চোখ জোড়া খুলতেই দৃষ্টি মিললো আহাদের সেই গাঢ়ো বাদামি ঘন পাপড়িযুক্ত গভীর চাহনিতে। রিদির সরু ওষ্ঠজোড়া তিরতির করে কাঁপছে, সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে এই মূহুর্তের ওজন। এমন সময় আহাদ তার উরুর উপর তুলে নিলো রিদির পা দুটো, রিদি হকচকিয়ে সরিয়ে ফেলতে চাইলে, আহাদ শক্ত করে ধরে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে না সরাতে। রিদির নড়চড় বন্ধ হয়ে যায়, একদম স্থির হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে সেই নির্লিপ্ত মুখটার দিকে। আহাদ পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে এক জোড়া চিকন সোনালী শব্দহীন পায়েল বের করে আনলো। শাড়ির পার উঁচু করে পড়িয়ে দেয় রিদির পায়ে, পায়েলের সোনালি রঙে কেমন ঝলমল করে উঠলো তার ফর্সা পায়ের পাতা। সেই আলোয় আহাদের মুখেও এক অদ্ভুত তৃপ্তি ঝরে পড়লো। রিদির চোখ ছলছল করে উঠলো, ভিজে গেলো চোখের পাপড়িগুলোও। অবচেতনই তার মনের কোনে এক অদ্ভুত লোভ জেগে উঠলো, আহাদের গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো একটু ছুঁয়ে দেখার খুব ইচ্ছে জাগলো। আহাদ সেই চোখের দৃষ্টি লক্ষ করে নরম কন্ঠে শুধালো,

“এভাবে তাকিয়ে কী দেখছো?”
রিদি একটা ঢোক গলাধঃকরণ করে, কন্ঠ কাঁপিয়ে মিনমিন করে বললো,
“আপনার গালের এই খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো খুব সুন্দর! একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি?”
আহাদ এক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো, তার প্রেয়সীর এমন করুন বাসনা শুনে। অতঃপর রিদির ডান হাত তুলে
নিয়ে নিজের গালে ছোঁয়ালো। রিদির আঙুলে সেই দাড়ির খসখসে ছোঁয়া লাগতেই শিরশির করে উঠলো তার শরীর।
আহাদ এবার সেই কোমল হাতটা নিজের তালুর মধ্যে এনে আলতো করে ঠোঁটে ছোঁয়ালো। এতে রিদির ছোটমোটো হৃদপিণ্ডটা আবারও কেঁপে উঠলো। আহাদ হাত বাড়িয়ে রিদির দু গালে স্পর্স করলো, কপালের ছোট ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে একটু ঝুঁকে আসতেই রিদি তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো। আহাদের হাত মাঝপথে থেমে রইলো, মুখটা ফুটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইলো, অতঃপর উঠে রিদির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রিদি দু পা পিছিয়ে গেলো। আহাদ এবার বুঝতে পারলো, তার প্রেয়সী তার কাছ থকে দূরে যেতে চাইছে। বিরক্তিতে কপাল গুছিয়ে এলো, আরেক কদম এগোতেই রিদি আবারও পিছিয়ে গেলো। আহাদ এবার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাগ সংযত করলো। বিরক্তি মুখে রিদির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

“কী সমস্যা তোমার?”
রিদি ইতিস্থ করে শাড়ির আঁচলটুকু কচলাচ্ছে অবিরত। মিন মিন স্বরে বললো,
“খু… খুদা লাগছে।”
আহাদের রাগ আরো দিগুন বেড়ে গেলো, সে এক ঝটকায় রিদির মুখমোখি হয়ে কন্ঠ নামিয়ে বললো,
“এমন একটা সময় খিদে পেয়েছে তোমার?”
রিদি জ্বিব দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট ভিজিয়ে আহাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সংকোচে গলা নামিয়ে বললো,
“আসলে কাল রাত থেকে তেমন কিছু খাইনি, তাই আর কি..”
কথাটা শুনে আহাদের বুকের ভেতর একটা মোচর দিলো। মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো, এক মুহূর্তে রাগ মিলিয়ে গেলো মমতায়। সত্যিই তো! রাতের খাবার খেতে দেখেনি রিদিকে। সে রিদির হাত টেনে এনে আবারও বিছানার কোনায় বসালো। আলতো করে তার গালে দুহাত রেখে শান্ত গলায় বললো,

“তুমি এখানে বসো। আমি খাবার নিয়ে আসছি, কেমন?”
রিদি শুধুু চোখের ইশারায় সম্মতি জানালো। আহাদ আর দেরি না করে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। এতে যেনো রিদি স্বস্তির একটা নিশ্বাষ নিলো। তা না হলে, আহাদের ওমন ভরাট চাহনি, তার সব কিছু কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছিল। আর তাছাড়া রিদির সত্যি সত্যি খিদেও পেয়েছিল।

আহিয়া সবে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসলো। শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মনটা অদ্ভুতভাবে অস্থির। চোখ বন্ধ করেও ঘুম আসছে না। হঠাৎই তার মাথায় ঝলকে উঠলো আদনানের কথা। তখন বলেছিলো, মাথা ব্যাথা করছে। তারপর আর একবারের জন্য তাকে চোখে পরেনি। এখন কেমন আছে? কোথায় গেলো? খেয়েছে তো?
এই ভাবনাগুলো হঠাৎই তার বুকের ভেতর কেমন একটা কাঁপন তুললো। ঠোঁট কামড়ে ধরে আহিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে বসে কিছু একটা চিন্তা করলো। ওড়নাটা কাঁধে তুলে নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা আদনানের রুমের সামনে এসে থামলো। একটু দ্বীধা নিয়ে, দু বার দরজায় শব্দ করলো কিন্তু কোন সারা এলো না। আহিয়া এবার দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিয়ে রুমের চারদিক চোখ বুলালো। রুমটা আধো অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু কোথাও আদনানকে দেখতে পেলো না।

আহিয়া একটু থেমে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে। কেমন একটা উদ্বেগ চেপে বসলো বুকের ভেতর। অতঃপর নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে এসে চারপাশে তাকালো। হঠাৎই দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ছাদের সিঁড়ির দিকে, উপরে থেকে আসছে হালকা বাতাস আর ম্লান চাঁদের আলো। সে এক রকম ভয় নিয়েই ধীরেধীরে ছাদে উঠে আসে। দরজার কাছে পৌঁছে থমকে গেলো আহিয়া। মৃদু বাতাসে ওড়নাটা দুলে উঠলো, আর ঠিক তখনই তার চোখে পড়লো, আদনান রেলিংয়ের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে আধো অন্ধকার, কেবল চাঁদের ম্লান আলো তার মুখে পড়ে এক অদ্ভুত ছাঁয়া তৈরি করছে। এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মুখ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়ছে ধীর ভঙ্গিতে। আহিয়া একদম স্থির হয়ে গেলো এই দৃশ্য দেখে। যেন শরীরের সব শব্দ হারিয়ে ফেলেছে সে। অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো, যে আদনান তার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে এতোটা সচেতন, সে কিনা সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে? বিস্ময়ে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো,

“আদনান ভাই…!”
চমকে ঘুরে তাকালো আদনান। আহিয়াকে দেখে একমূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখে বিস্ময় আর অস্বস্তি। তড়িঘড়ি করে সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিভিয়ে দিলো। চারপাশের ধোঁয়া হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে লাগলো, যেন কিছুই ঘটেনি এমন ভান করছে। আহিয়া বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো। কণ্ঠে বিস্ময় আর অভিযোগ মিশে আছে,
“আদনান ভাই! আপনি… আপনি স্মোক করেন?”
আদনান হালকা নড়েচড়ে দাঁড়ালো। ঘাড় চুলকে এদিক-ওদিক তাকালো, কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। বরং নির্লিপ্ত গলায় উল্টে প্রশ্ন করলো,
“তুই এতো রাতে ছাদে কেনো এসেছিস? ভয় লাগে না তোর?”
“আমি তো জানতাম আপনি ছাদে আছেন। তাই তো এলাম।”
“কেনো?”
আহিয়া এক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,
“একটা প্রশ্ন করবো, আদনান ভাই।”
আদনান এবার চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। চাঁদের আলোয় আহিয়ার মুখটা যেন আরও কোমল লাগছে, চোখে একটু সঙ্কোচ, তবু দৃঢ়তা আছে। সেই চোখে সরাসরি তাকাতে পারলো না আদনান। হালকা দম নিয়ে মুখ ফিরিয়ে বললো,

“না।”
আবারও কিছুক্ষণ নিরবতা, শুধু বাতাসের শব্দ। এবার আহিয়ার মৃদু কণ্ঠ ভেসে এলো, প্রায় অনুনয়ের সুরে,
“শুধু একটা প্রশ্ন, করি না আদনান ভাই!”
সেই কণ্ঠের ভারে আদনানের অনড় মনেও একটু নরম ভাব এলো। গম্ভীর গলায় বললো,
“ঠিক আছে, বল।”
আহিয়া হেসে আদনানের পাশ ঘেঁষে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়াল। দুজনের মাঝখানে হালকা দূরত্ব, কিন্তু বাতাসে ঘন হয়ে আছে অস্বস্তির একরাশ নীরবতা। আদনানের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো,
“আপনি সেদিন বলেছিলেন, আপনি রিদিকে এমনিতেও বিয়ে করতেন না। যদি তাই হয়, তাহলে রাজি হলেন কেনো?”

কথাটা শুনে আদনান চোখ তুলে তাকালো আকাশের দিকে। চাঁদের আলোয় তার মুখে ভেসে উঠলো অদ্ভুত এক হাসি। তাতে ব্যথা আছে, ঠাট্টা আছে, আবার অপূর্ণতার ছাঁয়াও। সে ধীরে বলে উঠলো,
“বাজি জিততে।”
আহিয়া অবাক হয়ে তাকালো, ভ্রুজোড়া কুচঁকে আবারও প্রশ্ন করলো,
“বাজি? কিসের জন্য?”
আদনান নির্দিধায় উওর দিলো,
“তোর জন্য।”
বুকের ভেতর কেমন ধপ করে উঠলো আহিয়ার। চোখ সরিয়ে নিলো তৎক্ষণাৎ, ঠোঁট শুকিয়ে এলো। ছোট করে বললো,

“ওহহ।”
আদনান তাকিয়ে রইলো, চোখে প্রশ্নের আগুন,
“ওহহহ? তুই বুঝতে পেরেছিস আমি কী বলেছি?”
আহিয়া যদিও কিছুটা বুঝতে পেরেছে, তবুও দুই দিকে না সূচক মাথা নাড়ালো। আদনানের চোখ বন্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। নিজের ভেতরের আগুন সামলাতে পারছে না। কণ্ঠে কঠোরতা নিয়ে বললো,
“তাহলে ‘ওহহ’ বললি কেনো?”
আহিয়া অনুভব করলো আদনান রেগে গেছে। বুক কেঁপে উঠলো তার। তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে বললো,
“আমি আসছি…”
এই বলে এক দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আদনান চেঁচিয়ে ডাকলো,
“আহি! আহিইইইই!”
তার গলা কাঁপছে, কিন্তু ততক্ষণে আহিয়া আধো অন্ধকারের ভেতর মিলিয়ে গেছে। আদনান নিজের ক্রোধ সামলাতে না পেরে পাশের একটা ফুলের টবে জোরে লাথি মারলো। মাটির টবটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ছাদের কোণে। আদনান আবারও একখানা সিগারেট জ্বালালো, মুখে পুরে এক দীর্ঘ টান নিলো। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে গেলো মৃদু বাতাসের সাথে।
এদিকে নিচতলায় এখন একেবারে নিস্তব্ধতা। ডাইনিংরুমের বাতিগুলো হালকা জ্বলছে, আহাদ নিচে কাউকেই দেখতে পেলো না। যেহেতু অনেক রাত হয়েছে, আবার সবাই ক্লান্তও ছিলো। তাই যে যার মতো নিজের রুমে চলে গেছে। আহাদ বানিকে কয়েকবার ডাকলো, তবে তার সারা পেলো না। তাই নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে দেখলো খাবার কী কী আছে।

রান্নাঘরে ঢুকতেই হালকা বিরিয়ানির গন্ধ নাকে এসে ঢেকলো। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবকিছু গুছগাছ করে ফ্রিজে তুলে রেখে দিয়েছে। শুধু বড় একটা হাড়িতে বিরিয়ানি ঢেকে রাখা আর সেটা হালকা গরম বলে হয়তো রাখা হয়নি। আহাদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলো কী করবে। অতঃপর একটা প্লেট আর চামচ হাড়ির উপর রেখে হাড়ি সহ তুলে উপরে চলে গেলো। এমন সময় রুম থেকে হালিমা বেগম পানির বোতল নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর চোখো পরে আহাদ হাড়িয়ে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে যাচ্ছে, এদিকে বানিও বেরিয়ে আসে, সে আহাদের ডাক শুনেছিল। তবে সে আসতে আসতে ততক্ষণে আহাদ চলে গেছে। হালিমা বেগম এটা দেখে এগিয়ে এসে অবাক হয়ে বললেন,
“বানি আপা, এটা কী দেখছি আমি। এই পাগল ছেলে কি পুরো হাড়ি নিয়েই উপরে চলে গেলো?”
বানি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছে নিয়ে বললো,

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৮

“আপা, আমি নতুন বউরে খাবার দিতে গেছিলাম। কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় ডাকি নাই। মনে হয়, এখন খিদা পাইছে তাই আহাদ বাবা নিজেই খাবার নিয়া গেছে।”
হালিমা বেগম হেসে উঠে বললেন,
“সে ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে হাড়ি সহ কে খাবার নিয়ে যায় বউয়ের জন্য?”
তার কথা শুনে বানি আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না।
দুজনেই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো।

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here