লোভ পর্ব ৭
সুমাইয়া আফরিন ঐশী
“রেগে আছো কেন? কী হয়েছে? মাথা ঠান্ডা করে বসো একটু। নেও, ঠান্ডা শরবতটা খাও।”
বলতে বলতে শরবতের গ্লাসটা আরেকবার এগিয়ে দিলো মমতা। তোফাজ্জল আচমকা গ্লাসটা হাতে নিয়ে তীব্র তেজে ছু ড়ে ফেললো মমতার সামনের দিকটাতে। মুহূর্তেই কাঁচের গ্লাসটা ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে কত টুকরো হলো, কে জানে! স্বামীর বেপরোয়া রাগ দেখে কয়েকবার কেঁপে উঠল মমতা! ভীত চোখে আশপাশে তাকালো। থেমে নেই আজ তোফাজ্জলও। লোকটা ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে স্ত্রীর গ লা চে পে ধরে ফুঁসে উঠলো,
“বেয়াদব মহিলা!”
মমতা ত্রাসে জড়সড় হয়ে এলো। আশপাশে তাকিয়ে আবারও কাউকে খুঁজলো। এত চেঁচামেচি শুনেও তার হয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। দু’টো ছেলে-মেয়ে দু’জনই ঘরকুনো। মেয়েটা তো জগতের মাঝেই নেই বোধহয়। ছোট ছেলেটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। হারা’মজা’দা মোবাইল নিয়েই বোধহয় রুমে পড়ে আছে। জগতের কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি তার কানের পাশ দিয়েও যাবে না। অন্যদিন হলে মমতাও হম্বিতম্বি দিয়ে ফেলতো এতক্ষণে। কিন্তু এখন তার সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে। মমতা অজানা ভয়ে আরও একটু নরম হয়ে এলো। স্বামীর হাত ছাড়াতে ছাড়াতে কোমল গলায় বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“অধরার আব্বু, শান্ত হও!”
তোফাজ্জল আরও ভয়ানক ক্রোধ নিয়ে স্ত্রীকে ঝাঁকুনি দিয়ে ফেলে দিলো। নিজের রাগ সংবরণ করতে পাশের টি-টেবিলটাতে লা থি মে রে চেঁচিয়ে উঠলো,
“তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছো, মমতা? এরপরও তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছো? আমার সম্মান তুমি কিছু অবশিষ্ট রেখেছো? রাখোনি! তোমার লোভের জন্য ব/’লিদা’ন দিলে আমার মেয়েটাকে!
তুমি কী ভাবছো, তোমার কুকী/র্তি আমি কিছু জানবো না?”
মমতা বাধাহীন চোখের জলস্রোত নিয়ে বললো,
“আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত, অধরার আব্বু। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ! এমন কিছু হবে, আমি বুঝতে পারিনি।”
“কেন বুঝতে পারোনি, কেন? তোমাকে আমি বারবার সতর্ক করেছি, মমতা। বারবার বলেছি, আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মানুষ, আমাদের কাছে সম্মানটাই সবার আগে। তুমি নিজেকে সংবরণ করে নাও। আমরা এভাবেই ভালো আছি।
কিন্তু তুমি বড় লোভী মহিলা! তুমি কী করেছো? কী করেছো? তুমি কোনো মা? কোনো মা যেচে নিজের মেয়ের এত বড় সর্বনা/শ করে? আমি লোকসমাজে মুখ দেখাবো কী করে এখন? কী করে আমি আমার মেয়ের এই বদনাম ঘোচাবো?”
মমতা নিশ্চুপ। নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে তার। নিঃশব্দে কেবল চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। কী-বা বলবে সে? সেই মুখ কি তার আছে? এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, তার করা জগতের সব পাপ একত্রিত হয়ে তাকে চে পে ধরেছে, গি লে খেতে চাইছে! আর মমতা কোনো কূলকিনারা না পেয়ে পাপের সাগরে কেবল হাবুডুবু খাচ্ছে।
তার মধ্যে, একটু থেমে তোফাজ্জল উচ্চ কণ্ঠে আবারও বললো,
“শুধুমাত্র ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবে আমি এতদিন সব সহ্য করেছি, অনেক সহ্য করেছি। কিন্তু আর না। আর এক মুহূর্তও না!
ওদের ভালো থাকার জন্য দিনের পর দিন আমি তোমার কাছে নত হয়েছি, তোমার উচ্চস্বরে করা অপমান সহ্য করেছি, তোমার রাগ, অভিমান, অন্যায়—সব চুপচাপ মেনে নিয়েছি। শুধু চেয়েছি, আমাদের সন্তানরা শান্তিতে থাকুক, ওরা সুখী হোক।
কিন্তু আজ আমার সেই আদরের মেয়েটা তোমার জন্য সব হারিয়েছে। প্রতিনিয়ত অশান্তি আর লাঞ্ছনার আ’গুনে পো/ড়াবে ওকে!
আমার তো সব শেষ হয়েই গেছে। কিন্তু তোমার?
শোনো? তোমার আর আমার সংসারে থাকার কোনো অধিকার নেই, মমতা। তোমার মতো স্বার্থপর, জঘ’ন্য নারীকে আমি আর এক মুহূর্তও সহ্য করবো না।
আজই আমি তোমাকে ত্যাগ করবো! আজই আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো!”
ডিভোর্স… স্বামীর বলা “ডিভোর্স” শব্দটা কানে লাগতেই মমতার শ্বাস আঁটকে এলো। দুনিয়া ঘুরে এলো। এই বয়সে এসে ডিভোর্স? ভাবতেই মানুষটা বুক চেপে ধরে আত’ঙ্কে উঠলো,
“কী বলছো, অধরার আব্বু?”
তোফাজ্জল ভূঁইয়া প্রচণ্ড রকমের তেঁতে আছেন। অনর্গল ঘরের জিনিসপত্র ছোড়াছুঁ’ড়ি করে নিজের রাগ বিসর্জন দিচ্ছে। অফিস টাইমে লোকের বাঁকা দৃষ্টি আর ফিসফিসানি শুনে লজ্জায় তার মুখ লুকানোরও জায়গা হয়নি।
নেহাত লোকটা ভদ্রলোক, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মতো কাপুরুষ নয়। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে মমতার মতো মহিলাকে কয়েক ঘা বসিয়ে বেহুঁশ করে ফেলতো। কিন্তু উনি তা পারছেন না। তাই নিজের ক্ষো’ভ মেটাতে ঘরের ভেতর কালবৈশাখীর তাণ্ডব চালাচ্ছেন।
জগতের কোনো কথাই তার কর্ণগোচর হচ্ছে না। মমতা আর এক মুহূর্তও লোকটার সামনে দাঁড়ানোর সাহস করলো না।আলগোছে মেয়ের রুমের দিকে ছুটে গেলো। একমাত্র মেয়ের কথাতেই তোফাজ্জল ঠান্ডা হতে পারেন। মেয়েটা তার বড় আদরের!
মমতা দূর থেকেই মেয়েকে ডাকলো,
“অধরা? মা, দরজা খোল? দরজাটা খোল, মা?”
অপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। মমতা দৌড়ে গিয়ে দরজায় ধা ক্কা দিলো। দরজা খোলাই রয়েছে। মা দ স্যু বালিকার ন্যায় মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপানো স্বরে বললো,
“তোর বাবা খুব রেগে আছে, অধু। ভেঙেচুরে সব শেষ করে ফেলেছে। তুই গিয়ে তাঁকে একটু আটকা, মা।”
হাঁটুতে মুখ গুঁজে বিছানার দেয়াল ঘেঁষে বসে ছিল অধরা। তার কানে মায়ের বলা কিছু ঢুকলো কি-না বোঝা গেলো না। বরং মেয়েটা মা’কে দেখে কিঞ্চিৎ বিরক্তই হলো। চোখেমুখে একরাশ ক্ষো ভ মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে সে বললো,
“বিরক্ত করো না তো, আম্মু…..”
মেয়ের আচরণে মমতা পুরোপুরি হতাশ হলো! আশাহত হলো! কী বলছে এই মেয়ে? মাথা গেছে ওর? এদিকে তার সংসার ভাঙতে চলছে, আর মেয়ে কি-না তাতে বিরক্ত হচ্ছে! এই দিনও তার দেখতে হলো? সে এতটাই খারাপ মা?
মমতা এবার বেশ শব্দ করেই কেঁদে উঠলো। হাউমাউ করে মেয়ের সামনেই হাঁটু ধ সে বসে পড়লো। কিন্তু তা কিছুই লক্ষ্য করছে না অধরা। সে ভাবছে অন্য জগত নিয়ে…
গতকাল থেকেই তুমুল ভাবে ভাবছে মেয়েটা। দুনিয়ার সবকিছু তার অসহ্য লাগছে। নিজেকে,মা’কে, ঘরদোরকে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। যে প্রেম পেতে একসময় ব্যাকুল হতো মেয়েটা, আজ সেই প্রেম-ভালোবাসার প্রতিও এসেছে বিতৃষ্ণা! ভালোবাসা… এই ভালোবাসা, মোহ-মায়া পুঁষে কি পেলো সে? কিছু পেলো? শেষমেশ সবই তো গেলো। এরথেকে ইরফান ভাইয়ের কথা মেনে নিজেকে সংযত করলেই তো পারতো সে। লোকটা তো তাঁকে বারবার সতর্ক করেছেন। সেবারও বলেছেন,
“সময় থাকতে নিজেকে শুধরে নে, অধরা। বেহায়ামো করে নিজেকে আর ছোট করিস না। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে অন্তত কিছুটা আত্মসম্মানবোধ থাকা উচিত, কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর ভেতর সেটাও নেই।
মানুষ তোকে পুতুলের মতো নাচাচ্ছে, আর তুই সেই ছকের খেলোয়াড় হয়ে যাচ্ছিস! তুই কি এতটাই বোকা? কেন এই পাগলামি করছিস? জোর করে কিছু হয় না, এটা বুঝতে পারছিস না? তোদের এই লোভের জন্য একদিন দেখবি তোরা সব হারাবি।
আমি আবারও স্পষ্ট করে বলছি অধরা—তোকে নিয়ে আমার কোনো অনুভূতি নেই। আমি অন্য একজনের প্রতি আসক্ত। শুধু আসক্ত না, তীব্র ভাবে আসক্ত!”
এতোটুকু ভাবতেই অধরা ভেতরের সত্বাটা কেমন আফসোসে আফসোসে দুমড়েমুচড়ে গেলো। মেয়েটা অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় দু’হাতে নিজের মাথাটা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো,
“আপনার বলা কথা সত্যি হয়েছে, ইরফান ভাই। আমাদের লোভ আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। আমার আর শেষ হওয়ার কিচ্ছু বাকি নেই, কিচ্ছু না! হারানো এই যন্ত্রণা আমাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে, আজীবন….”
চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কাছাকাছি অবস্থিত ক্যাফ ২৪ পার্ক। দুপুরের রোদ যেন চারপাশকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে, গাছের পাতাগুলোও নিঃস্তব্ধ। পার্কে জনসমাগম কম, কেউ কেউ ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। তবে এই নীরবতা খানিকটা দূরে ভেঙে দিচ্ছে তিন উদ্দীপ্ত যুবকের প্রাণবন্ত উপস্থিতি।
লেফটেন্যান্ট ইরফান তালুকদার, আদনান আর জয়।
কঠিন এক মিশনের সফল সমাপ্তি ঘটিয়ে গতকাল রাতে তারা ফিরেছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে এবারের অভিযানে কোনো মায়ের কোল খালি হয়নি, কোনো পরিবার হারানোর বেদনায় কাঁদেনি। মিশন ছিল ভীষণ চ্যালেঞ্জিং, জীবন-মরণের সীমানায় দৌড়াতে হয়েছে, তবু এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটেনি সৈন্যদল। ক্লান্তি, কষ্ট—সব জয় করে বিজয়ের নিশান উড়িয়েছে।
আজকের দুপুরটা ওদের। মেজর বিশ্রামের অনুমতি দিয়েছেন, আর সেই অবসরটাকে প্রাণবন্ত করে তুলতে তিন বন্ধু সিভিল ড্রেসে পার্কে এসেছে। তাদের টগবগে শরীরে বিশ্রামের সময় নেই—বরং শুরু হয়েছে এক মজার বাজি!
“পাঁচ মিনিটে কে সবচেয়ে বেশি পুশআপ দিতে পারবে?”
শর্ত একটাই—যে জিতবে, তাকে বাকি দু’জন আজ জমিয়ে খাওয়াবে।
ব্যস, প্রতিযোগিতা শুরু!
পার্কের এক খোলা জায়গায় প্রথমে আদনান, তারপর জয় পুশআপ শেষ করল। এবার পালা ইরফানের। রোদের উত্তাপ উপেক্ষা করে সে গভীর শ্বাস নিল, শরীর টান টান করল, মাটি স্পর্শ করে প্রথম পুশআপ দিল।
সময় চলছে।
জয় ও আদনানের চোখে উত্তেজনা, মুখে চ্যালেঞ্জের হার-জিতের ছাপ।
তারা গুনছে—১… ২… ৩… ৪…
হঠাৎ করেই ওদের সংখ্যা গোনা বন্ধ হয়ে গেল। একটা রিনরিনে, মেয়েলী কণ্ঠ বাতাসে ভেসে এল—
“হায়, হ্যান্ডসাম!”
লোভ পর্ব ৬
বন্ধুরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। পরমুহূর্তেই তারা ইরফানের দিকে তাকিয়ে কেমন কেমন করে হাসলো। সামনে থাকা মেয়েটিকে কিছু একটা ইশারা করে ওরা দু’জন দ্রুত সরে-ও গেলো।
অপ্রত্যাশিত, মেয়েলী কণ্ঠে ইরফানও স্থির হয়ে গেল, হাতের ভর দিয়ে সামান্য উঠে তাকাল—কে বলল এটা? মুহূর্তেই, তার সামনে দাঁড়ানো হাসি-হাসি মুখের মেয়েটিকে এখানে দেখে সে-ও কিছুটা অবাক হলো। কিন্তু, তা আর মুখে প্রকাশ করলো না। বরং ছেলেটা স্বভাবসুলভ গম্ভীর অবয়বটা বজায় রেখেই, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালো। সামনের মেয়েটার দিকে আর একবারও না তাকিয়ে শুধালো,