লোভ পর্ব ৮

লোভ পর্ব ৮
সুমাইয়া আফরিন ঐশী

“সিদরা তুই? এখানে কি করছিস?”
সামনের মেয়েটা অকপটে দুষ্ট হেসে দাঁত বের করে শুধালো,
“আপনাকে দেখতে এলাম, লেফটেন্যান্ট সাহেব।”
ইরফান ভ্রু বাঁকিয়ে বিরশ মুখে মেয়েটাকে একবার আগাগোড়া পরখ করে নিলো। চোখের দৃষ্টি তার স্বাভাবিক অথচ কোথাও যেন একটু ক্রোধ লেপ্টে আছে। ইরফানের চোখেমুখে বিরক্তি ভাব দেখে সিদরা খানিকটা শুকনো ঢোক গিললো। এরপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললো,
“বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি, ইরফান ভাই।”
ইরফান আগের মতো করেই বললো,

“একা এসেছিস?”
সিদরা মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বোঝালো। ইরফানের বিরক্তিতে কপালে চারটা ভাজ পড়লো। এই মেয়েটা এতো কেয়ারলেস! এতো বোকা! একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের প্রকাশ্যে, গোপনে কতো শত্রু থাকে! যদি ওর কিছু হয়ে যেতো। ইরফান আর নিজেকে বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে পারলো না। ধমকে উঠলো,
“একা কেন এসেছিস?”
সিদরা কিছু বলতে পারলো না আর। এরমধ্যে পেছন থেকে শোনা গেলো শাহেদ ইলিয়াসের গম্ভীর কণ্ঠ,
“কী ব্যাপার, লেফটেন্যান্ট? তুমি আমার মেয়ে’কে ধমকাচ্ছ যে!”
ইরফান চাচার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে শুধালো,
“আপনার কেয়ারলেস মেয়ে’কে যে দু’টো থা’প্পড় দেইনি এটাই ঢেরবেশি!”
শাহেদ ওর দিকে ক’টমট চোখে তাকালো। কিছু বলবে তার আগেই সিদরা এসে বাবা’র বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। আদুরে স্বরে ডাকলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বাবাআআ?”
মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, শাহেদ। আলতো হাতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বাবাও ডাকলো,
“মা!”
বাবা’র আদুরে স্পর্ষ,মিষ্টি স্বরে “মা” ডাকটা শুনে সিদরার আরো একটু গদগদ করে নিজেকে বাবা’র সামনে উপস্থিত করলো। শাহেদ মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফের বলল,
“তুমি একা কেন আসতে গেলে, মা?”
“আজ আমি নিজ হাতে কাচ্চি রান্না করেছি, বাবা। এটাই আমার হাতে করা প্রথম রান্না আর তুমি খাবে না, তাতো হয় না। তোমার তো আর বাসায় যাওয়ার সময় হয় না, তাই আমিই চলে এলাম।”
মেয়ের কণ্ঠে প্রথম রান্না নিয়ে আগ্রহ, কিছু অভিমান। যা দেখে হাসলো, শাহেদ। মেয়ের হাত ধরে, তার সঙ্গে সাথে কথা বলতে বলতে একটা ক্যাফের দিকে এগুলো। সিদরা বাবার সঙ্গে হাঁটলেও তার দৃষ্টি পার্কের আশপাশটায়। তার চোখ দু’টো খুঁজে চলছে একটা পরিচিত যুবককে। গেলো কই লোকটা? এতক্ষণ তো এখানেই ছিলো।
মেয়ের উদ্বেগ দেখে মুচকি হাসলো, শাহেদ। খানিকটা গলা পরিষ্কার করে আচমকা মেয়ে’কে বললো,
“কাচ্চি কি শুধু আমার জন্যই এনেছো, মা? আর কারো জন্য আনোনি?”

বাবা’র রসিকতা বুঝতে অসুবিধা হলো না, সিদরার। মেয়েটা খানিকটা লজ্জাও পেলো। সেভাবে মিনমিন করে বললো,
“ইরফান ভাইয়ের জন্যও এনেছি।”
শাহেদ আবারও মুচকি হাসলো। পিছনে তাকিয়ে ইরফানকে ডাক দিলো,
“আমার সঙ্গে এসো, বেয়াদব ছেলে!”
ইরফান ওদের বাবা-মেয়ের কথার মাঝখান থেকে সরে গিয়ে কেবলই একটা বেঞ্চিতে বসছিলো। আর আশেপাশটায় খুঁজে চলছিলো দুই বন্ধুকে। হা’রামি গুলো আর ভালো হলো না। বন্ধুকে বিপদে রেখে কেমন ভেগে গেলো! ম’রতে গেলো কোথায়? আশপাশটায়ও তো নেই। এরমধ্যে, চাচার অদ্ভুত ডাকনাম শুনে সেদিকে একবার অনিচ্ছা নিয়ে তাকালো। পরপর খানিকটা বেপরোয়া ভাবে হাত-পা মেলে দিয়ে বেঞ্চে আরাম করে বসলো। বললো,
“আমি এমুহূর্তে ছুটিতে আছি, কর্নেল সাহেব। কারো অপ্রয়োজনীয় কথা শুনতে বাধ্য নই!”
ছেলেটার বেপরোয়া ভাবসাব দেখে শাহেদ ইলিয়াস কটমট কণ্ঠে বললো,
“তুমি যতদিন এই পেশায় থাকবে ততদিন তুমি আমার কথা শুনতে বাধ্য, ইরফান তালুকদার। হারি আপ অ্যান্ড কাম উইথ মি, লেফটেন্যান্ট। দ্যাটস অ্যান অর্ডার।”

ইরফানের মধ্যে কোথাও যাবার তাড়া নেই। বরং সে নিজের জায়গাটায় আরেকটু আরাম করে বসলো। চাচার কথা তার কান অব্ধি পৌঁছালো কি-না তাও বোঝা গেলো না। শাহেদ ইলিয়াস নিজের কথা শেষ করে আর ওর ভরসাতে দাঁড়িয়ে থাকলো না। মেয়ে’কে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো। সিদরা বাবা’র সঙ্গে হাঁটলেও তার মনটা বরং পুড়ছে। উনি কি আসবে না? সিদরা তো তার পছন্দের কাচ্চিই রেঁধে ছিলো। কতোটা আগ্রহ নিয়ে এখানে এসেছে সে। লোকটা কি ওর রান্না একবার টেস্ট করবে না? তার মুখে একটু প্রশংসা শুনলেই তো সিদরার জীবন ধন্য। কিন্তু, চাপা স্বভাবের মেয়েটা বাবা’র সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে আর কিচ্ছু বলতে পারলো না। বারকয়েক পিছনে তাকিয়ে আওড়াল,
“আপনিও আসুন না, ইরফান ভাই! ”

পার্কের এক কর্ণারের ক্যাফে বসে আরাম করে সি’গারেট ধরিয়ে টানতে ছিলো, আদনান ও জয়। সেই সঙ্গে দুই বন্ধু ইরফানকে নিয়ে মজা মারছিল।
হালকা বাতাসে চারপাশটা বেশ শান্ত লাগছিল। হঠাৎ দূর থেকে কর্নেল ও তার মেয়ে’কে আসতে দেখলেন ওরা। মুহুর্তেই দু’জন হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আদনান জয়কে তাড়া দিয়ে বললো,
“মামা দৌড় দে।”
জয় হতাশ কণ্ঠে বললো, “উপায় নেই, মামা। স্যার আমাদের দূর থেকেই লক্ষ্য করছেন, এখন দৌড় দিলে ব্যাপারটা ভালো হবে না। দাঁড়া কিছুক্ষণ।”

ছটফট স্বভাবের আদনান এতটুকুতেই বিরক্ত হলো।
“এই ইরফাইন্নার শ্বশুরটা যখন-তখন আসে কই থেকে? দেখা গেলো, আমার বন্ধুর রোমান্সের মধ্যেও এই শ্লায় এসে বলবে “দ্যাটস অ্যান অর্ডার”।
জয় ওকে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বললো। এরমধ্যে, কর্নেল চলে এলো ওদের কাছাকাছি ।
সামরিক নিয়ম অনুযায়ী ডিউটির বাইরে স্যালুট বাধ্যতামূলক না হলেও, ওরা দু’জন ভদ্র বাচ্চাদের মতো তৎক্ষণাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সম্মানসূচক মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন,
“গুড আফটারনুন, স্যার!”
কর্নেল হালকা হাসলেন, মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলেন,
“এনজয়িং ইয়োর টাইম, লেফটেন্যান্ট’স?”
ওরা বিনয়ের সাথে উত্তর দিলেন,
“ইয়েস, স্যার।”

কর্নেল মেয়ে’কে নিয়ে এগিয়ে গেলেন পাশের টেবিলের দিকটাতে। আদনান আর জয় একটু একটু করে ওখান থেকে কেটে পড়ছিলো। তান্মধ্যে, ওখানে এলো ইরফান। ইরানকে দেখেই কিছু একটা ইশারা করে দাঁত বের করে হাসলে, আদনান। ইরফান চোখ কটমট করে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকটাতে। ওদের কিচ্ছু বললো না আর। নিরবে গিয়ে সে বসলো সিদরার মুখোমুখি। আচমকা মানুষটাকে দেখে, সিদরা মেয়েটার এতক্ষণের আমসি মুখটা চকচক করে উঠলো। সে চকচকে হাসিটাও চোখ এড়ালো না ইরফানের। সিদরা হাসি-হাসি মুখে নিজের ক্যারি করা খাবার বের করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। আদনান জয়কেও ডাক দিলো,
“ভাইয়া, আপনারাও আসুন?”
আদনান ও জয় এতে তীব্র অস্বস্তিতে পড়লো। কারো পারসোনাল আড্ডা ও খাবারদাবারে ভাগ বসানো অনুচিত। ওরা আমতা আমতা করে বলছিল,
“তোমরা এনজয় করো, আপু। আমাদের একটু তাড়া আছে, আমরা আজ আসি তাহলে।”
কিন্তু সিদরা ওদের ছাড়লো না। ওদের অস্বস্তি বুঝতে পেরে বললো,
“আমি খাবার বেশি করেই নিয়ে এসেছি। সমস্যা হবে না, আপনারাও আসুন ভাইয়া।”
আদনান ও জয় ওর অনুরোধ আর ফেলতে পারলো না। ওরা দু’জন গিয়েও বসলো। কর্নেল সাহেব ওয়াটারকে ডাক দিয়ে আরো কিছু খাবার-দাবার অর্ডার করলো, সিদরা নিজের সঙ্গে আনা কাচ্চি সবাইকে বেড়ে দিলো। মূহুর্তেই জমজমাট হলো খাবার টেবিল।

মেয়ের হাতের রান্না বেশ আরাম করে খেলো, শাহেদ ইলিয়াস। খেতে-খেতে প্রশংসাও করলো। তার সঙ্গে তাল মিলালো, আদনান ও জয়। কিন্তু, পুরোটা সময়ই ইরফান ছিলো নিশ্চুপ।
এরমধ্যে, শাহেদের ফোন এলো। ইমার্জেন্সি কল, এক্ষুনি তাকে হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে। মানুষটা আর বসতে পারলো না। মেয়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে ইরফানকে বলে গেলো,
“আমার মেয়ে’কে বাসায় পৌঁছে দিও, লেফটেন্যান্ট।দ্যাটস অ্যান অর্ডার।”
ইরফানের প্রত্যুত্তর শোনার অপেক্ষা করলেন না, শাহেদ ইলিয়াস। গটগট পায়ে জায়গা ছাড়লো। তার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আদনান, জয়ও উঠে দাঁড়ালো। ওদের দু’জনকে একান্ত কিছু সময় দিবার জন্যই বললো,
“আমাদের একটু তাড়া আছে, ইরফান। আমরাও যাই!”

লোভ পর্ব ৭

ইরফান স্বাভাবিক ভাবেই বসে রইলো। ওদের কথার প্রত্যুত্তর করলো না। ওদের তাড়া-ফাড়া সম্পর্কে সে জানে। ওদের হালচাল বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। জয়, আদনান আর দাঁড়ালো না। আর কেউ না জানুক, তারা তো জানে বন্ধুর গভীর অনুভূতি!

লোভ শেষ পর্ব