শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২৩+২৪
Nabila Ishq
আষাড়মাসের উদাসীন বৃষ্টি ঝুপঝাপ কিছুক্ষণ পরপর বিরতিহীন ভঙ্গিতে নামছে। বর্ষাবাদলের দিনগুলো এভাবেই যায়। এই দেখা দেয় রোদ্দুর আবার পরমুহূর্তেই মেঘলা হয়ে ওঠে আসমান। অচিরেই নামে পুষ্পবর্ষণ। বিকেলবেলায় অবশ্য পরিষ্কার ছিল আসমান, আবহাওয়া। সন্ধ্যার দিক হিমশীতল বাতাস বইতে শুরু করল। নামল অঝোরে বৃষ্টি। তন্ময় তখনি বেরোল অফিস বিল্ডিং থেকে। আজ সে ছাতা আনেনি। ফোরকাস্ট দেখে এসেছিল, আজ বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা নেই। তাহলে এখন এগুলো আসমান হতে কী নামছে? মধু?
ফোরকাস্টের থেকে জবেদা বেগম আবহাওয়ার বেশ ভালো তথ্যসূত্র জানাতে পারেন। আজ সকালবেলা তিনি অত্যন্ত দৃঢ় গলায় বলেছেন, বৃষ্টি হবে। ছাতা সঙ্গে নিতে। তন্ময় ফোরকাস্টে নজর বুলিয়ে আর তার কথার গুরুত্ব দেয়নি। তন্ময় ভাবছে বৃষ্টির মধ্যেই বাইক টেনে বেরোবে। ওসময় কিছু কলিগস সামনে এসে দাঁড়াল। কথাবার্তার আসর পাতল। তন্ময় অগোচরে হু-হা বলে নিজের মতামত জানান দিচ্ছে। তার পাশে দাঁড়ানো নারী হলো লাবণ্য। তাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এম্পলয়। তন্ময়ের থেকে বয়সে দু’বছরের বড়ো। কিছুটা উগ্রস্বভাবের। আঁটসাঁট পোশাক পরতে পছন্দ করে। আরও পছন্দ করে তন্ময়ের সঙ্গে কথায় কথায় উঠতে-বসতে, হুটহাট গায়ের ওপর পড়তে। এইতো এখনো অস্বস্তিজনক সিচুয়েশনে ফেলেছে তন্ময়কে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অস্বাভাবিকভাবে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়িয়েছে। তন্ময় ভদ্রতাপূর্ণ দূরত্ব বজায় রাখতে সরে এলো। কথা বলাবলির একসময় হঠাৎ করে নজর গেল রাস্তার ওপারে।
ছাতা হাতে কামিজ পরিহিত এক ছোটোখাটো মেয়ে দাঁড়িয়ে। চমকে ওঠে তন্ময়। আঁতকে ওঠে হৃদয়। মেয়েটিকে চিনতে মিনিট খানেকের ও প্রয়োজন পড়ল না তার। চটজলদি পায়ে, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটল। রাস্তা পেরিয়ে সোজাসুজি থামল অরুর সামনে। গলায় থাকা ধমকটুকু গিলে ফেলতে হলো ওই ছলছল নয়ন পানে চেয়ে। ফর্সা লাল আধবোঁচা নাকের পাটা ফুলে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ডান গাল বেয়ে ঝরল একফোঁটা নোনাজল। তন্ময় হাত বাড়াল জলটুকু মুছতে। পূর্বেই অরু ছাতা ফেলে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল। অস্থির তন্ময় ধমকের সুরে ডাকে,
‘অরু!’
অরু থামে না। হাঁটার গতি বাড়ায়। বৃষ্টির জলে ইতোমধ্যে কামিজ লেপ্টেছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। তন্ময় বড়ো বড়ো পায়ের ধাপ ফেলে অরুকে আটকায়।
ওর সর্বশরীরে নজর বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করে শুধায়,
‘তুই এখানে কী করিস? এক চড়ে হয়নি?’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অভিমানিনী অরু চুপ করে রয়। টুঁশব্দ ও করতে রাজি নয়। তন্ময় ছাতা তুলে আনে। ছাতা বন্ধ করে অরুর ডান হাত টেনে রাস্তা পেরিয়ে অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে আসে। কলগদের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে পার্কিংয়ে পৌঁছায়। বাইকে চাবি পুরে উঠে বসে। ভারী গলায় বলে,
‘ওঠ।’
অরু সময় নেয় তবে উঠে বসে বাইকের পেছন ধরে, তবুও তন্ময়কে ধরে না। তন্ময় লুকিং গ্লাসে একবার ওই জেদি মুখটি দেখে বাইক স্টার্ট করে। বাইকের গতি সাধারণ। বৃষ্টি এখনো একই গতিতে ঝরছে। বাতাসের তীব্রতা দারুণ তীক্ষ্ণ। এতক্ষণ ধরে চুপচাপ থাকার মেয়ে তো অরু নয়। এখন অবদি চুপ রয়েছে মানে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট দেবার জন্যই তো তন্ময় মাসের ওপর এই ফাজিল মেয়েকে এড়িয়ে চলেছে, সংযোগ বিচ্ছেদ করেছে। সেদিন রাতের ওই ভয়াবহ অনুভূতি বাধ্য করেছে তাকে এই স্টেপ নিতে। অরুকে শিক্ষা দিতে। এই শিক্ষার কথা মনে থাকলে ভবিষ্যতে এমন করার কথা দ্বিতীয় বার ভাববে না।
বাইক এসে থামে শাহজাহান বাড়ির সামনে। তন্ময় জানে, অরু এখন বাইক থেকে নেমে অভিমানজনিত হৃদয় তুলে ধরবে। কাঁদতে কাঁদতে শুধাবে কেন সে এড়িয়ে বেরিয়েছে! তখন তন্ময় ধমক দিয়ে মিটমাট করে নিবে। ওর পছন্দের বিরিয়ানি ও পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। অরু নির্বিকার ভঙ্গিতে বাইক থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। অন্যদিনের মতো ফিরে তাকাল না। দরজা ধরে উঁকিঝুঁকি ও দিল না। তন্ময় মাথাটা বাড়িয়ে ভালোভাবে দেখে নেয়। সত্যিই চলে গেল? তার বোকাসোকা অরু চলে গেল? তন্ময় কী পরিষ্কার দেখছে? সে কী এবার একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলল? তবে কষ্ট তো আর ও একা ভোগ করেনি। ওর থেকে দ্বিগুণ ভোগ করেছে তন্ময় নিজে। কীভাবে সহ্য করেছে গত দিনগুলো মেয়েটা জানে? তন্ময় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়। অবশেষে বাইকে উঠে বসে। একটানে চলে যায়। তন্ময় চলে যেতেই দোতালার আঁধারে বারান্দায় লুকানো মানবছায়া বেরিয়ে আসে। অপলক দেখে যায় ওই বাইক যাওয়ার রাস্তাটি।
জবেদা বেগম আড়ে-আড়ে কয়েকবার অশান্ত ছেলের পানে তাকালেন। তন্ময় সেলফোন হাতে এদিকওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। বেশ টেনশড দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। একবার ডেকেছে সাঁড়া দেয়নি। কিছুক্ষণ আগে একদম ভিজে জবজবে শরীর নিয়ে ঢুকেছে। জবেদা বেগম তক্ষুনি আদা চা বসিয়ে দিয়েছেন। চা-টা হয়ে এসেছে। কাপে ঢেলে লিভিংরুমে এলেন। তন্ময় এখন সোফায় বসে। মুখপানের সামনে মোবাইল ফোন ধরে রাখা। ভ্রু দ্বয়ের মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ। জবেদা বেগম ডাকেন,
‘আব্বা!’
‘উম।’
তন্ময় মাথা তুলে তাকায়। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নেয়। চুমুক বসিয়ে খেয়াল করে, জবেদা বেগম একইভাবে দাঁড়িয়ে। তাই শুধোয়,
‘কিছু বলবে মা?’
‘কী হয়েছে তোর?’
‘কী হবে?’
‘চিন্তিত দেখাচ্ছে তোকে!’
‘তেমন কিছু না।’
‘তাহলে কেমন কিছু? দেখি, জ্বর টর বাঁধিয়েছিস নাকি!’
বলেই হাতের তালু তন্ময়ের কপালে ঠেকালেন। গরম গরম ভাব। জ্বর আসার সম্ভাবনা আছে। বিচলিত গলায় বলেন,
‘খেয়েদেয়ে ঔষধ নিয়ে তারপর রুমে যাবি। ঠাণ্ডা ও বাঁধিয়েছিস।’
জবেদা বেগম রান্নাঘরের দিক যেতেই তন্ময় পুনরায় সেলফোনে চোখ ফেলে। অরুকে দুটো কল দিয়েছে সঙ্গে একটি ম্যাসেজ। মেয়েটা কল ও ধরল না ম্যাসেজের জবাব ও দিলো না। এমন কখনো হয়নি বলেই বুঝি এতো অশান্তি লাগছে?
আজ বৃহস্পতিবার। কাল তন্ময়ের বন্ধের দিন। অরু এরমধ্যে তাদের বাসায় আসেনি আর ওই কল ম্যাসেজের রিপ্লাই ও করেনি। তন্ময় ভেবেচিন্তে অফিস থেকে বেরোনোর পূর্বে শাবিহাকে কল করে। গলা খাঁকড়ি দিয়ে শুধোয়,
‘ঘুরতে যেতে চেয়েছিলি না সেদিন?’
‘হু, চেয়েছিলাম তুমি তো নিলে না।’
‘আজ বেরো।’
‘এখন? এই সন্ধ্যাবেলা?’
‘হ্যাঁ। মাওয়া নিয়ে যাই। এক ঘন্টার রাস্তা। আর রাতেই ওখানটা বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হয়।’
শাবিহা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করে,
‘কখন বেরোচ্ছি ভাইয়া?’
‘সাতটার পর।’
‘আমি অরুদের বলি গিয়ে। দেখবা খুশিতে এরা নাচবে।’
অফিস শেষ করে তন্ময় বাসায় ফিরে। গোসল নেয়। ড্রাইভার চাচাকে কল করে গাড়িটা তাদের বিল্ডিংয়ের পার্কিংয়ে দিয়ে যেতে বলে, তৈরি হতে শুরু করে। অরু প্রায়শই আকারইঙ্গিত দিয়ে বুঝায় তাকে সাদা শার্টে বেশ মানায়। আজ তন্ময় সাদা শার্ট পরল কালো প্যান্টের সাথে। হাত ঘড়ি পরে অরুর পছন্দের পারফিউমটাই ব্যবহার করল। চুল স্যাট করার সময় শাবিহার কল এলো। তন্ময় রিসিভ করতেই শাবিহা বলে,
‘ভাইয়া অরু তো যেতে চাচ্ছি…’
তন্ময়ের বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। যার জন্য আয়োজন সে না গেলে কীভাবে কী? তন্ময় শাবিহার সম্পূর্ণ কথা না শুনেই বলে ওঠে,
‘যাবে না মানে? সবাই যাচ্ছে ওর কী সমস্যা? ওকে বল এক্ষুনি রেডি হতে। নাহল…’
শাবিহা ঠোঁট চেপে হেসে ওঠে। দুষ্টু স্বরে বলল,
‘ভাই। তুমি তো আগেই হাইপার হয়ে যাচ্ছ। আমার পুরো কথাটুকুও শুনলে না। আমি বলছিলাম অরু যেতে চাচ্ছিল না। আমি ওকে জোরপূর্বক তৈরি করিয়েছি।’
আটকে থাকা শ্বাস টুকু তন্ময় এবার ছাড়ল। গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টারত ভঙ্গিতে বলল,
‘ওহ, আচ্ছা। আয় তাহলে।’
শাবিহা তখনো মিটিমিটি হাসছে। তন্ময় অ্যাম্বারসড অনুভব করল। কল কেটে কপালে আঙুল ঘেঁষে চুপসে রইল। অরু আরও কিছুদিন এমন করলে সে নিশ্চিত হার্টএট্যাক করে বসবে।
জবেদা বেগম যাবেন না। সে বাচ্চাদের মধ্যে যেতে নারাজ। অগ্যত তাকে বাসায় রেখে বেরোতে হলো তন্ময়ের। পার্কিংয়ে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। তন্ময়কে দেখে হাসল। চাবি এগিয়ে টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলে বিদায় নিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর এলো শাবিহা, রুবি, দীপ্ত, আকাশ। আর শেষমেশ ঢুকল অরু। সেই বৃষ্টির রাতের মতো আজও চুপচাপ আছে মেয়েটা। মুখ গোমরা। তন্ময়ের এই প্রথম মনে হলো অরু ভীষণ ভয়ানক। চুপচাপ থেকে তাকে মেরে ফেলতে এই মেয়ের একদিন ও লাগবে না।
ড্রাইভিংয়ে তন্ময় বসল। পাশে আকাশ। পেছনে অরু, দীপ্ত, শাবিহা এবং রুবি। গাড়ি বেরিয়ে পড়ল বিল্ডিং থেকে। আকাশ এফএম চালু করে দিল। এক প্রেমিকের রিকোয়েস্টে তার প্রেমিকার জন্য একটি রোমান্টিক গান প্লে করা হয়েছে। গানটা মৃদু আওয়াজে বেজে চলেছে। ডান কাঁধের ওপরের কর্নারের লুকিং গ্লাসটা তন্ময় কোণা করে স্যাট করল। অরুর মুখটা লুকিয়ে অগোচরে দেখল।
দীপ্ত সন্দিহান চোখে অরুকে আগাগোড়া দেখে নিচ্ছে বারংবার। কিছুক্ষণ পরপর খোঁচা দিচ্ছে। তবুও তাকে কিছুই বলছে না অরু। এক দৃষ্টিতে বাইরেটা দেখছে। দীপ্ত আর থাকতে পারল না। প্রশ্ন করেই বসল,
‘অরু আপু তোমায় কে বকেছে?’
অরু মাথা ঘুরিয়ে ফিরে তাকায়। বলে,
‘কে বকবে?’
‘না বকলে এমন হয়ে আছ কেন? মনে হচ্ছে এই জগৎসংসারে তোমার কেউ নেই।’
অরু বিড়বিড়িয়ে জানায়,
‘নেই তো। কেউ নেই।’
তন্ময় স্পষ্ট শুনল। লুকিং গ্লাসে চোখ নিতেই অরুর সঙ্গে চোখাচোখি হলো। অরু দৃষ্টি ফিরিয়ে পুনরায় বাইরেটা দেখছে। অরুর এমন করুণ অবস্থা দেখে আকাশ ও চিন্তায় পড়ল,
‘আমার বকবকানির রানীর কী হয়েছে? ওর বকবক ছাড়া তো এই ট্রিপ হজম হবে না। কিরে শাবিহা! অরুর কী হয়েছে?’
শাবিহা মিটিমিটি হেসে বলে,
‘অরু অভিমান করেছে। অভিমান ভাঙলে ঠিক বকবক শুরু করবে।’
অরু মুখ ভেঙিয়ে বলল,
‘আমার বয়েই গেছে অভিমান করতে। আমি মোটেও অভিমান করছি না। বরং নিজেকে হাতের মুঠোয় রাখছি। আমি বড়ো হচ্ছি, আমাকে অবশ্যই নিজেকে সংযত রাখতে হবে। এতো ন্যাকামি মেয়েদের মানায় না।’
দীপ্ত পানির বোতলে মুখ দিয়েছিল। অরুর কথায় ও কেশে নাকমুখে পানি ওঠে। কাশতে কাশতে চোখের কোণে জল এসে জমে। কোনোমতে বলে,
‘আপু তুমি ঠিক আছ? জ্বর বাঁধেনি তো?’
তন্ময় কোনোমতে ঠোঁটের হাসিটুকু গিলে নিলো।
‘মাথা ভেতরে নে।’
অরু যেন কথাটুকু শুনল না। সেভাবেই মাথা বের করে চোখ বুঝে আবহাওয়ায় মিশতে মগ্ন। তন্ময় অসহায় অনুভব করল। মেয়েটা তাকে অবজ্ঞা করায় ডিগ্রি নিয়েছে যেন! আড়চোখে তাকিয়ে দেখল শাবিহা টেনে অরুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। কান টেনে শুধাল,
‘একটা গাড়ি পাশ দিয়ে গেলে কী হবে আইডিয়া আছে? কথা শুনছিস না কেন?’
‘আমি খেয়াল রাখছিলাম তো।’
তন্ময় লুকিং গ্লাসে দৃষ্টি রাখে। ওর ভোঁতা মুখটা দেখে মিহি গলায় প্রশ্ন করে ,
‘চোখ বুঝে খেয়াল রাখছিলি?’
অরু মুখ বাঁকায়। জড়ানো গলায় বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে মুখখানা ঘুরিয়ে রাখে। হেসে ওঠে শাবিহা। দু-পাশে মাথা দুলিয়ে বলে ওঠে,
‘তোর সাথে তর্কে পারব না।’
শহরের কোলাহল পেরিয়ে গাড়ি পৌঁছেছে স্থির, শান্ত, শুনশান সড়কপথে। দেখা মিলল গ্রামীণ সৌন্দর্যের। আরও দেখা গেল রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বৃস্তিত ধূঁধূঁ সাদা বালির মাঠ। কিছুদিন আগেই এই বালির মাঠগুলি ছিলো সবুজ ধান খেত। বর্ষায় এই ধান খেত হয়ে যেত স্বচ্ছ জলের বিল। আজ আর সেই বিলের চিহ্ন মাত্র নেই। তবে আছে কিছু গ্রাম বাংলার চিরায়ত প্রাকৃতিক পরিবেশ। যা উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে।
ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালার কাঁচটা তন্ময় নামিয়ে নিলো। হিমশীতল বাতাস ছুঁয়ে দিলো সর্বশরীর। স্পর্শনীয় অনুভূতি যাত্রাপথ করে তুলেছে নিদারুণ সুখময়। ডান হাতে স্ট্রিং হুইল এবং বাম হাতে গিয়ার শিফট কন্ট্রোলে ব্যস্ত। আঁখিযুগল নীরব সড়কপথে ঠাঁই রয়েছে। পাশের সিটে বসা আকাশ সেলফোনে টাইপিং করছিল। হঠাৎ মুখটা এগিয়ে গলা নামিয়ে তন্ময়ের কানের কাছটায় বলল,
‘ভাই, একটা স্মোক করলে ভালো লাগত না? মুখটা ম্যাচম্যাচ করছে।’
‘পড়ে।’
‘গাড়িটা আশেপাশে থামানো যায় না?’
‘যায়। তুই নামবি আমরা এগোব। খেয়ে একাই ফিরিস।’
‘আচ্ছা, খাব না। চিল ব্রো! এভাবে নিজের ভাইকে থ্রেট দিতে তোর বিবেকে বাঁধল না?’
‘বাঁধল না।’
মাওয়া ফেরিঘাট মূলত ন্সিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। ঠিক পদ্ম নদীর তীরে। ঢাকার মধ্যে পর্যটকদের জনপ্রিয় প্রচলিত জায়গা এটি। একদিনের মধ্যে ঘুরেফিরে আসা যায় বলেই হয়তো বেশি আলোচিত। নদী ভ্রমণ এবং ইলিশ ভোজনের ক্ষেত্রে বেশ নামকরা। তন্ময় ভেবেছিল কাল শুক্রবার সকালে বেরোবে ওদের নিয়ে। রাতে ফিরবে ঘুরেফিরে। তারপর বন্ধুদের থেকে জানল মাওয়াঘাট নাকি রাতে ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। তাই রাত করেই বেরোল। ফিরতে ফিরতে ভোর হবে নিশ্চয়ই।
পদ্ম নদীপথ দেখে চোখছানাবড়া হলো অরুর। উজ্জ্বল হলো মায়াবী মুখশ্রী। চাঁদের আবির্ভাব পরা জলের সৌন্দর্য অপলক চোখে দেখল। সেই ডাগরডাগর হরিণটানা চোখে একরাশ মুগ্ধতা। প্রেয়সীর কালো কুচকুচে আঁখি যুগল দেখে তন্ময়ের ক্ষীণ মনটা নিমিষে ফুরফুরে হলো। দৃষ্টি হলো দৃশ্যমান রূপে কোমল।
মাওয়া ফেরিঘাটের সামনে মানুষের আনাগোনা দেখা গেল। ভীড়ের লক্ষণ ও কিছুটা রয়েছে। পদ্মর বুকে বোট করে অনেকেই এপারওপার পারাপার করছে। কেউবা নদীজল ভ্রমণ করছে। উত্তর দিকে নদীর পাড়দিয়ে বড়ো সরু রাস্তা গিয়েছে যার একপাশে রূপালী পদ্ম আর অন্যপাশে সবুজে ঘেঁড়া গ্রাম। চাইলে গ্রামের ভেতরটাও ঘুরেফিরে দেখা যাবে। ছায়া সুনিভির গাছগাছালিতে ঢাকা চমৎকার এই গ্রাম খানা দেখতে ঘন্টাখানেকের ও প্রয়োজন পড়বে না হয়ত। শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিকতা মুক্ত এই গ্রামটি ঘুরার ইচ্ছে অরুর সুশ্রী মুখখানাতে লেপ্টে। সে আনমনে প্রশংসা করে চলেছে। ছটফট নয়নে দেখছে সবকিছু।
রাতে নদীর বুকপিঠে ওঠার ইচ্ছে শাবিহা, রুবি কিংবা আকাশের নেই। দীপ্ত উল্টো ভয় পায় গভীর নদী। শুধুমাত্র অরু ভীষণ আগ্রহী ছিল পদ্ম নদীর নৌকায় চড়ে ঘুরবে বলে। ভাই-বোনদের অনীহা দেখে মন খারাপের চিহ্ন ফুটে উঠল ওর সর্বমুখ জুড়ে। তন্ময় আড়ালে ওর মুখাবয়ব দেখে আকাশের উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোরা হোটেলে ঢুকে খেতে শুরু কর। আমি অরুকে নৌকা চড়িয়ে আসছি।’
অরু আড়চোখে তন্ময়ের পানে চেয়ে অভিমানী গলায় বলে,
‘যাব না।’
তন্ময় অবাক হলো না। এবং আর কী বলে মেয়েটাকে মানাবে তা বুঝেও পেল না। সবসময় অরু তার সঙ্গে একা থাকার সুযোগ কুড়িয়ে বেরিয়েছে। তাকে কখনো এক-পা আগাতে হয়নি। সর্বদা মেয়েটা আগ বাড়িয়ে পাশে ছিল। এই প্রথম সে এমন অবস্থার সম্মুখীন। কীভাবে কী করবে মাথায় আসছে না। তাকে উদ্ধার করতে পদার্পণ ঘটাল শাবিহা। খিদে পাওয়ার বাহানা ধরে বলল,
‘যাবি না বললে হবে? দেখা যাবে বাসায় ফিরে কাঁদতে বসবি। বলবি তোকে নদীতে বোট চড়তে দেইনি। আমরা বরং খেতে যাই। তুই নদী ভ্রমণ করে ভাইয়ার সাথে ফিরে আয়।’
কথাটুকু শেষ করে দ্রুত পায়ে সরে পড়ে বাকিদের নিয়ে। দীপ্ত অবশ্য ভয় নিয়েই যেতে চেয়েছিল তন্ময়, অরুর সঙ্গে। শাবিহা যেতে দেয়নি। হাত টেনে নিজের সাথে নিয়ে নিয়েছে।
অরু দাঁড়িয়ে অন্যদিক ফিরে। তন্ময় পাশেই। অদূরে পদ্মঘাট। সেখানে নৌকা, বোটের অভাব নেই।আসমানে অপূর্ব এক সুন্দরী চাঁদ জ্বলে আছে। আলোকিত করে রেখেছে চারিপাশ। আজ বুঝি জ্যোৎস্নাময়ী রাত? চারিপাশটা কেমন আলোকময়! তন্ময় কোমল স্বরে শুধায়,
‘নৌকা চড়বি না?’
অরুর একরোখা জবাব,
‘না।’
‘কেন!’
‘আমার ইচ্ছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘রাত হচ্ছে! চল।’
তন্ময় হাত বাড়িয়ে ছোটো নরম হাতটা ধরল। টেনে নিতে লাগল নিজের সঙ্গে। অরু আর বাঁধ সাধল না।
ঘাটের সামনে এসে তন্ময় একটা নৌকা ভাড়া করল। আধঘণ্টা ঘুরাবে নদীর বুকে। অরুর হাত ধরে প্রথমে ওকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করল। পিছু সেও উঠল। অরু ইতোমধ্যে জুতোজোড়া খুলে বসে পড়েছে। তন্ময় ঠিক ওর সামনে বসল। নৌকা ছেড়েছে। নদীর বুকে হেলেদুলে এগোচ্ছে। জলের স্রোতের আওয়াজ ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে। নদীর বুকে, আসমানের নিচে বসা চাঁদের স্পর্শী অরুকে আবেদনকারী, মায়াবিনী লাগছে। তন্ময়ের হৃদয়টা কেঁপে উঠল। দৃষ্টি মোহিত হলো। লম্বাটে শ্বাস টেনে নিলো। অরু ওসময় তাকাতেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। তন্ময় তাকিয়ে থাকলেও অরু নজর ফিরিয়ে নেয়। তন্ময়ের ঠোঁট জুড়ে ঢেউ খেলানো হাসি এসে ভীড় জমায়। মিহি কণ্ঠে ডাকে,
‘আরাবী।’
অরু চমকায়। চটজলদি ফিরে তাকায়। সচরাচর তন্ময় ওর পুরো নাম ধরে ডাকে না। হঠাৎ করে নামটা শোনবার ভাগ্য হয়। মোহনীয় ওই আঁখিদুটি দেখে জবাব দিবেনা ভেবেও শেষমেশ দিলো,
‘হু।’
‘রাগ, অভিমান কমেছে!’
‘অভিমান করার আমি কে!’
তন্ময় হাসে। নিদারুণ কোমল চোখে চেয়ে থেকে বলে,
‘কিছুতো একটা।’
‘কিছুই না। আমাকে যে দেখতে চায়না, পছন্দ করে না তাকে আর জ্বালাব না। কাছেও যাব না, কথাও বলব না।’
‘এই তো ভারী কঠিন শাস্তি।’
‘আমি কাছে না গেলে, কথা না বললে বরং সে খুশি। সে বেঁচে যাবে।’
তন্ময়ের দৃষ্টি অশান্ত হয়। হৃদয় অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে। ভীষণ আদুরে স্বরে, ক্ষীণ গলায় সে বলে,
‘বরং সে মরে যাবে।’
অরু এবারো চমকায়। ছলছল নয়নে চেয়ে রয়। অভিমানী মন গলতে শুরু করে। এই সুদর্শন, আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্ববান পুরুষটির সামনে যে সে সর্বদাই অসহায় এবং বেহায়া। তন্ময় হাত বাড়িয়ে ওর অবিন্যস্ত চুলগুল কানের পেছনে গুঁজে দেয়। এসময় বাতাসের তোড়ে, নদীর ঝড়ে নৌকা অস্বাভাবিক ভাবে হেলেদুলে ওঠে। অরু ভয় পেয়ে সরে আসে। তন্ময়ের শক্তপোক্ত পুরুষালি হাত জোড়া অরুকে ইতোমধ্যে জাপ্টে ধরে, বাহুতে সুরক্ষিত রাখে। আসমান হতে নামে একফোঁটা জল। অরু মাথা তুলে আসমানের পানে চায়। জ্বলজ্বল করা চাঁদ মেঘে ঢেকে গিয়েছে। আলোকিত ভাব আর নেই। আঁধারে তলিয়েছে প্রকৃতি। তন্ময় বলল,
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ২১+২২
‘চাচা, দ্রুত ঘাটে নিন।’
‘আচ্ছা।’
ঘাট থেকে বেশ দূরে আছে তারা। কিছু পথ যেতে না যেতেই ঝুম বৃষ্টি নামল। ভিজিয়ে দিল মুহূর্তে।
