শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৫+৫৬
Nabila Ishq
মাগরিবের আজান পড়েছে। হাওয়ার বেগ কমেছে। ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টি রূপান্তরিত হয়েছে রিমঝিম বৃষ্টির ধারাতে। এযাত্রায় কাচটা পরিপূর্ণভাবে নামিয়েছে অরু। সহাস্যমুখে উপভোগ করছে মেঘলা রাতের লং ড্রাইভ। অদূরেই মেইনরোডে একজোড়া কপোত-কপোতী দেখা গেল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাতে-হাত রেখে হাঁটছে –হাসছে, দুলছে আর আলাপে মগ্ন। অরু মুগ্ধ হলো। একচিত্তে খানিকক্ষণ দেখল। ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত তন্ময়কেও ডেকে দেখাল। তন্ময় আড়চোখে পূর্বেই দেখেছে। তবুও অরু দেখাতে চাইতেই সে কপোরেট করল। বেশ আগ্রহী চোখেই দেখে মন্তব্য করল,
‘অসময়ের বৃষ্টিতে ভেজা ভালো না।’
অরু চটে গেল মুহূর্তেই। ভেংচি কাটল, ‘আপনি ভিজবেন না ভালো কথা। এরজন্য কী অন্যরাও ভিজবে না? একই রসকষহীন কথা! কেইবা ভেবেচিন্তে ভিজে?’
তন্ময়ের সাবলীল জবাব, ‘আমরা।’
‘আমরা নই। বলুন আপনি। আমি তো ভিজতে চাই। আপনি দেন না ভিজতে।’
তন্ময় ডান ভ্রু তুলল, ‘কী যেন বলেছিলি? লং ড্রাইভিংয়ে নিলেই হবে। একদম বৃষ্টিতে ভিজতে চাইব না।’
অরুর মুখাবয়ব জুড়ে অমাবস্যা নামে। আহত চোখে চায়। বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি কি বলেছি ভিজব? আমি শুধু ট্রুথ গুলো বলছিলাম।’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
‘বড্ড উপকার হয়েছে আমার।’
অরু গাল ফোলাল। মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় বাইরে নজর ফেলল। তবে অভিমান স্থায়ী রইল না। একপর্যায়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে আবদার ছুঁড়ল,
‘চা খাব। বৃষ্টিতে চা খেতে দারুণ লাগে।’
এই আবদারটুকু তন্ময় মানল। সামনেই পেয়ে বসল একটি টং-এর দোকান। আধো খোলা। সেখানেই থামাল গাড়িটা। অরুকে ভেতরে বসতে বলে নিজেই গেল চা আনতে। ওয়ান টাইম কাপগুলোতে দু’কাপ চা নিয়ে ফিরল। গাড়িতে ঢুকতে-ঢুকতে ভালোরকমের ভিজল। মাথার চুলগুলো, মুখমণ্ডল আর্দ্র। পরনের টি-শার্টের অনেকাংশ ভিজেছে। সিটে বসেই অরুর হাতে চায়ের কাপ দুটো ধরিয়ে দিয়েছে। বাম হাতে ওর গায়ের ওড়নার একাংশ টেনে নিয়ে– মাথা, মুখ দেদারসে মুছে ফেলল। অরু ফ্যালফ্যাল চোখে শুধু দেখল। শুকনো ওড়নাটা মুহূর্তেই ভিজে গেল।
ঘুরেফিরে বাড়ি ফিরতে সেদিন রাতের বারোটা বেজেছিল।
সেদিন ছিল রোববার। তন্ময় অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে আটটা পঞ্চান্নতে। প্রায় নয়টা ছুঁইছুঁই। দোরগোড়া পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই আশ্চর্যান্বিত হয়। লিভিংরুমে বসে সবাই সিলেট ট্যুর সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা করছে। সিলেট ট্যুর সম্পর্কে বাড়ির মানুষ জানল কীভাবে? প্রশ্নের উত্তর সে দু’মিনিটের মাথাতেই পেলো। বাসায় তার বেয়ারা বন্ধুদলবল এসেছিল সন্ধ্যায়। তার পুরো পরিবারের একেকটি সদস্যকে রাজি করিয়ে তবেই বিদায় হয়েছে। পাষাণহৃদয়ের মোস্তফা সাহেব অবদি সমর্থন হতে বাধ্য হয়েছেন। হবেন নাইবা কেন? তার বন্ধুরা একেকটা শয় তানের চাচাতো ভাই। দারুণরকমের পণ্ডিত। তন্ময়কেই ছাড়ে না।
প্রত্যেক সপ্তাহে তিনবেলা হাঁটে তুলে বিক্রি করে টাকা গোনে। সেখানে তার পরিবারকে কনভিন্স করানো ওদের হাতের ময়লা মাত্র। তবে তন্ময়ের জন্য বিষয়টা চমৎকার লাভজনক হলো বটে। দু’দিন ধরেই বেশ চিন্তায় পড়েছিল—অরুকে সাথে নেবার বিষয়টা বাড়িতে কীভাবে বলবে! যেহেতু সে নিজেও চাচ্ছে অরুকে নিতে। এখন আর সেধেপড়ে বলাবলির ঝামেলা করতে হবে না। অরুকে চূড়ান্ত উৎফুল্ল দেখা গেল। আসমানের চাঁদটা যেন ওর আঁচলে এসে পড়েছে। খুশিতে মুক্তোর মত চিকচিক করছে ওর মুখমণ্ডল। তন্ময়কে দেখতে পেতেই দু’লাফে সোফা ছেড়ে চলে এলো কাছাকাছি। গদগদ কণ্ঠে শুধাতেই থাকল ট্যুর সম্পর্কে তথ্যসূত্র। কখন যাবে? কে, কে যাবে! কী দিয়ে যাবে.. ইত্যাদি! তন্ময় সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। অরু ব্র্যিফকেসটা উতলা হয়ে স্বেচ্ছায় নিজ হাতে নিয়েছে। পিছু-পিছু সিঁড়ি বাইছে তন্ময়ের পদচারণের সঙ্গে চরণ মিলিয়ে।
মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে একেরপর এক প্রশ্ন। তন্ময় প্রত্যুত্তর করছে না। তার সত্যিকারঅর্থে জবাব দিতে মন চাইছে না। ওর তোতাপাখির মতন পকরপকর করতে থাকা ওষ্ঠদ্বয়ে চুমু খেয়ে মুখটা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। পরিবারের সম্মুখে তো তা আর সম্ভব না। বসবার ঘরে উপস্থিত সকলের আকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি আপাতত তাদের ওপর। তন্ময় অনুভব করতে পারছে। এইতো আড়চোখে একটিবার তাকিয়েছেও। আনোয়ার সাহেব কেমন মিটিমিটি হাসছেন। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ‘মাশাআল্লাহ্, মাশাআল্লাহ্’ আওড়াচ্ছেন। মোস্তফা সাহেবের মুখমণ্ডলের অবস্থাও আজ অসন্তোষজনক নয়। যা বেশ সারপ্রাইজিং।
সুমিতা বেগম দোয়াদরুদ পড়ছেন নজর না লাগার। সেদিকে শেষবার চেয়ে কক্ষে ঢুকল। অরুও সঙ্গেসঙ্গে ঢুকল। তিমিরাচ্ছন্ন ভেতরটা। সে অপেক্ষাকৃত বাতি জ্বলে ওঠার। যা কিয়ৎক্ষণের ব্যবধানেও জ্বলল না। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠ তুলে ডাকার সময়টুকুও পেলো না। তন্ময়ের শক্তপোক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হলো। তন্ময়ের রীতিমত ক্রমান্বয়ে এগুনোতে —তার পিঠ গিয়ে ঠেকল বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজায়। শীতল ওষ্ঠদ্বয় ছুঁলো তার গাল দুটো। পরপর আধবোঁচা নাকটা। অরুর ছটফটে হাতজোড়াতে থাকা ব্র্যিফকেস পড়ে গেল ফ্লোরে। ফাঁকা হাতদুটো মুহূর্তেই মুষ্টিবদ্ধ করে ধরেছে তন্ময়ের মেরুন রঙের শার্ট। তন্ময় শুধাল আঁধারে,
‘যাবি সিলেট?’
অরুর জবাবটি যেন ঠোঁটের মাথাতে রাখা। সাথে সাথেই সে ত্বরান্বিত ভঙ্গিতে জানায়, ‘হুঁ। আমি ভীষণভাবে যেতে চাই। অত্যধিক যেতে চাই।’
তন্ময় শব্দহীন হাসল। অরুর মুখের ভীষণ কাছে থেকে পুনরায় শুধাল, ‘কতটা?’
অরু যেন আঁধারে হিসেবনিকেশ করে ভাবল। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই আচমকা শব্দ করে চুমু খেলো তন্ময়ের শীতল ওষ্ঠজোড়ায়। মুহূর্তেই তন্ময়ও সুযোগের সৎ ব্যবহার করে বসল। স্বেচ্ছায় আসা ঠোঁটদুটো আর ছাড়ল না ততক্ষণাৎ। লম্বা এক শক্তপোক্ত চুমুতে মেতে উঠল। অরুটা বড্ড চঞ্চল। দুরন্তপনায় ফার্স্টক্লাস।
ঘনিষ্ঠ হলেই ওর নড়ানড়ির শেষ থাকে না। বাহুতে জাপ্টে রাখতে হয়। একটু ছাড় দিলেই হাঁসফাঁস করে পালাই-পালাই করে বেড়ায়। না চাইতেও ঠোঁটদুটো ছাড়ল সে। বাতি জ্বালাল। অরু অন্যদিকে ফিরে দাঁড়াল ততক্ষণাৎ। তন্ময় একপল দেখেছে ওর লাল টকটকে ঠোঁটজোড়া। গালদুটোও রক্তিম। সে হাসিটুকু গিলে ফেলল। শার্ট খুলতে নিয়েই গম্ভীরকণ্ঠে বলল,
‘তোকে নেয়ার ইচ্ছে নেই।’
অরু নিজের ক্ষণিকের লাজলজ্জা, চুমুর ব্যাপারটা মুহূর্তেই ভুলে বসল। আহত চোখে ফিরে চাইল। ত্বরিত পদচারণে কাছাকাছি গিয়েই শুধাল,
‘কেন? কেন? বললাম না, আমি জ্বালাব না। যেভাবে বলবেন সেভাবেই চলব। সারাক্ষণ আপনার সাথে সাথেই থাকব। যা বলবেন আমি তাই করব। তবুও নিয়ে চলেন, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।’
তন্ময় ভ্রু দুটো নাচাল, ‘যা বলব তাই করবি?’
অরুর চোখদুটি পিটপিট করল, ‘হুঁ।’
তন্ময়ের চোখমুখে এবারে দুষ্টুমি খেলা করল,
‘ইউ শিয়র?’
অরু ভ্যাবাচেকা খেলো যেন, ‘হুঁ। কিন্তুউউ..’
ওয়াশরুম যেতে যেতে তন্ময় সতর্কীকৃত ভঙ্গিতে বলে গেল, ‘মনে থাকে যেন।’
অরু কী খুশি হবে নাকি ভয় পাবে? তন্ময় ভাই তাকে এমন সতর্ক করল কেন? ভাবনায় বিভোর সে দরজার ওখানটায় পড়ে থাকা ব্র্যিফকেস তুলল। সেটি টেবিলের ওপর রেখে বারান্দার স্লাইডিংডোর সরাল। আজকের চাঁদটা দারুণ সুন্দর তো! ঠিক তার তন্ময় ভাইয়ের মতন।
মঙ্গলবার রাতে বন্ধুবান্ধব সব কফিশপে একত্রিত হলো। ভার্সিটির দুই বন্ধুও এই ট্যুরে জয়েন হচ্ছে। এক্সাইটমেন্ট সবগুলোর হাই লেভেলে। আলোচনা হচ্ছে সিলেট ট্যুরের আসল ব্যাপারস্যাপার নিয়ে। বেশ কষাকষির পর ট্যুরের তারিখ ভেবেচিন্তে ফেলা হলো চৌদ্দতে। ঠিক বৃহস্পতিবার। আজ থেকে তিনদিন পর। তবে কীসে করে যাবে? স্লিপিং বাস, গাড়ি নাকি প্লেন? সচরাচর ব্যবসায়ীক কাজে প্লেনেই যাওয়া-আসা হয় সকলের। তাই প্লেনের অপশন ক্যান্সেল। দ্বিতীয়টি স্লিপিং বাস। তবে মাহিনের কাছে সেসব ঝামেলাপূর্ণ মনে হলো। তার মতে মাইক্রো গাড়ি করে গেলে ভালো হবে। সকলে নিজেদের মতন আনন্দ আহ্লাদ করতে পারবে। শেষমেশ মাহিনের কথামত ডিসিশন নেওয়া হলো। তারা চৌদ্দ তারিখ বৃহস্পতিবার দুপুর বেলাতে বেরুবে সিলেটের উদ্দেশ্যে। রুস্তমদের একটি বাগানবাড়ি আছে। ওখানেই উঠবে। অবশ্য সিলেট তন্ময় সহস্র বার গিয়েছে। নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে এবারেরটা ভিন্ন। এবার একান্তগত ভাবে যাচ্ছে অরুকে নিয়ে। বন্ধুবান্ধব তো ছুঁতো মাত্র!
১৪, বৃহস্পতিবার।
আজ দুর্দমনীয়, প্রদীপ্ত; পরিষ্কার গগন। সহস্র নাম না জানা পাখি দলবল বেঁধে নীলসাদাটে গগনের বুক ছিঁড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ঠিক যেন ক্যানভাসে রঙ তুলিতে আঁকা কোনো দৃশ্য। চমৎকৃতভাবে ভূষিত। সূর্যিমামা আজ খ্যাপাষাঁড় যেন। তার প্রলয়ং করী আ গুনমুখ তপ্ততায় মগজ গলে যাবার পথে। ভ্যাপসা গরমে গতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে জ্বালাপড়ার সঙ্কেত। পক্ষান্তরে এই উত্তপ্ত দুপুর মেনে না যায়, তবুও বৃষ্টিবাদল মেনে নেয়ার মতন অন্তঃকরণ আজ নেই। অন্যদিন হলে ভিন্ন ব্যাপার। তন্ময় এইভাবেও বর্ষণের দিনগুলো আহামরি পছন্দ করে না। এই ভাবনাটুকু নিতান্তপক্ষে তার হৃদয়ের কোণেতে যত্নে রাখা সুপ্ত অনুভূতি।
অবশ্যই অরুর সম্মুখে তা প্রকাশ করার মত নয়। ও অনিরাপদ শ্রোতা। দেখা যাবে কেঁদে বসে আছে। কেন বৃষ্টির মতন অসাধারণ জল তার পছন্দ নয়! এই প্রশ্নটুকুই বারংবার করে যাবে। যুক্তি দিয়ে আর যাহোক অরুর সঙ্গে ইহজন্মে পারা সম্ভব নয়। অভিমান করে বসলে একান্ত তন্ময়ের অর্থনাশ। সে চায় না তার হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল— না হওয়া সংসারে আগুন লেগে বসুক। ইতোমধ্যে বাম পকেটের আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থাপুর্ণ যন্ত্রটি সহস্রবার কেঁদেছে। ক্রমান্বয়ে আওয়াজ করেই চলেছে। দুটো মিনিট চুপ করার নাম নিচ্ছে না। ডান হাত বাম পকেটে ঢুকিয়ে ফোন-টা বের করল তন্ময়। স্ক্রিনে ভেসেছে, ইংরেজি অক্ষরে বড়ো করে লিখা মাহিনের নাম। ষোলোটি মিসডকল-এর বারোটি তার একার করা কার্যক্রম। বাকি চারটি শুহানি এবং রিয়ানের। দুজন গুণে-গুণে দুটো-দুটো করে কল করেছে। তন্ময় সর্বাগ্রবর্তী মাহিন মজুমদারকে কল ব্যাক করল। অশান্ত, উদগ্রীব ছেলেটার মাথায় কী সমস্যা জানা প্রয়োজন! মাহিন হয়তোবা ফোন হাতে ধরে বসেছিল। কল রিসিভ হলো তক্ষণ। ম্লান কণ্ঠ খানা ব্যাকুল শোনাল,
‘দোস্ত, দোস্তরে…’
এহেন বিষাদযুক্ত কণ্ঠ কর্ণে পৌঁছে তন্ময়কে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হলো না। হওয়ার কথাও নয়। যুতসই কারণ নেই। সে নির্বিকার হয়ে কাবার্ড হাতাচ্ছে। মোট ছয়টা শার্ট নিয়েছে। ছয় রঙের। টি-শার্ট চারটা। চার ধরনের। ছয়টা প্যান্ট, ভিন্ন স্টাইলের। ল্যাগেজ পরিপূর্ণভাবে গোছানো পরিপাটি ভঙ্গিতে। তারপরও সবকিছু শেষবার দেখে নেয়া তার অভ্যাস।
‘হুঁ, বল।’
অনুরাগশূন্য প্রত্যুত্তর শুনে মাহিন বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে। প্রত্যাশা মোতাবেক বালের ‘ব’ টুকুও হলো না। পাশে ড্রাইভ করতে থাকা অতি ব্যস্ত রিয়ান শিকদার দাঁত কেলিয়ে হাসছে। মাহিন এতে অসন্তুষ্ট হয় দ্বিগুণ। এবারে সত্যিকার অর্থে ম্লান গলায় আওড়ায়,
‘ওন দ্য ওয়ে।’
কক্ষের দুয়ারের সম্মুখে অরু এসে দাঁড়িয়েছে। নুড রঙের ফর্মাল প্যান্টের সাথে ফুলসিলভস এর কালারফুল ফতুয়া পরেছে। ডাবল প্যাঁচে গলায় কালারফুল প্রিন্টেড স্কার্ফ। চরণে ওর উচ্চতার চেয়ে দ্বিগুণ বড়ো হিলস। চুলগুলোতে ঝুটি বেঁধেছে। হালকাপাতলা মেকাপ করেছে। জুতোজোড়া বাদ দিলে সবই তন্ময়ের পছন্দের। ফোনে সে অনাগ্রহী গলায় বলে,
‘ওকে।’
অতঃপর কল কাঁটে। অরুকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। অরু উৎসাহিত বড্ড। সহাস্যমুখে ত্বরিত কাছে এসে দাঁড়ায়। ক’দিন ধরেই তন্ময়ের সবরকম কথাবার্তা শুনছে সে বাধ্যগত মেয়ের মতন। তন্ময় আঙুল তুলে চরণ দেখিয়ে শুধায়,
‘কী পরছিস?’
অবুঝের মত অরু পিটপিট করে আঁখিদুটি। যেন প্রশ্নের অর্থ বোঝেনি। দৃষ্টি নামিয়ে চরণ দুটোর পানে ফেলে। ফের দৃষ্টিপাত করে তন্ময়ের গম্ভীরমুখে। চোখদুটোতে তার প্রশ্নবোধক চিহ্ন!
কী খারাপ পরেছে সে? তন্ময় বিরক্ত মুখে আদেশ ছুঁড়ে,
‘জুতো পালটে আয়। যা।’
মুহূর্তেই অরুর এতক্ষণ যাবত দীপ্তি ছড়ানো মুখশ্রী আঁধারছন্ন হলো। আতঙ্কগ্রস্ত চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে প্রশ্ন করল,
‘কেন? এই জুতোতে কী সমস্যা?’
তন্ময় পরিষ্কার ভাবেই বেশ অবলীলায় জবাবে বলল, ‘নিজের উচ্চতা অনুযায়ী জুতো পরে আয়।’
বাক্যটি অরুর জ খমিত হৃদয়কে ক্ষিপ্রভাবে র ক্তাক্ত করে। ম্লান চোখে চেয়ে রয়। যেন তন্ময় বেশ অন্যায়ত বাক্য বলে ফেলেছে। দণ্ডনীয় অ পরাধ করে বসেছে। অরু বরাবরই একান্ত উচ্চতা নিয়ে কুণ্ঠিত। সবসময় উঁচু জুতো পরতে চাইবে। পা মচকায়, ছিলে যায় তাতেও হিলস পরা বন্ধ হয় না ওর। সেবার তো সবগুলো হিলস কেটে দিয়েছিল তন্ময়। ফের কিনেছে মেয়েটা। ও কী কোনোভাবে তাদের উচ্চতার মানানসই নিয়ে পড়ে আছে? বিষয়টা মস্তিষ্কে আসতেই হাসি পায়। কারণ অরুর উচ্চতা ঠিক তার বুক অবদি। বিষয়টা তাকে সর্বদাই আনন্দ দেয়। উচ্ছ্বাস অনুভব করায়। ইচ্ছে মোতাবেক ওর গোবর ভরতি মাথাটা অনায়াসেই ধরা যায়। বোকা কোথাকার। তন্ময় এবারে উঁচু গলায় ধমকে ওঠে,
‘যাচ্ছিস না কেন? স্লিপার ধরনের জুতো পরবি। এক ইঞ্চি উঁচু হলে খবর আছে।’
অরুর নাকের পাটা দুটো ফুলল। ছলছল করল নয়নযুগল। কেঁদে ফেলার আগামবার্তা। অভিমানে বুক ফুলিয়ে বলল, ‘যাব না।’ এরপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। তন্ময় শব্দহীন হাসল। তবে মাথা ঘামাল না। ওকে তার চেনা আছে, জানা আছে। ঠিকই সময়মত উঁকিঝুঁকি দেবে। এই ট্যুর ও মিস দেবার মত মেয়ে না। ল্যাগেজ লকড করে দেয়ালঘড়ি দেখল তন্ময়। দুটো ত্রিশ। দশ মিনিটের মধ্যেই মাইক্রো আসবে। সে ডাইনিং থেকে হাত ঘড়িটা তুলে পরে নিলো। চুলে ব্যাকব্রাশ ছোঁয়াল। পারফিউম ছিটাল। ওয়ালেট পেছন পকেটে ভরে রাখল। ফোন ডাত তুলে নিয়ে, বাম হাতে ল্যাগেজ টেনে বেরুল কক্ষ ছেড়ে। অরু বাইরেই দাঁড়িয়ে। নত মুখে, ল্যাগেজ হাতে। খেয়াল করলেই দেখা যাচ্ছে, অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। চরণে স্লিপার জুতো। তন্ময় হাসে। ডাকে,
‘আয়।’
অরু এগিয়ে আসতেই, তন্ময় ওর গাল টেনে ধরে আদুরে ভঙ্গিতে। ললাটে এক চটপট শুঁকনো চুমু বসিয়ে মৃদু গলায় জানায়, ‘তোর-আমার এই উচ্চতার ডিফারেন্স দেখতে ভালো লাগে। এইযে তুই আমার বুক বরাবর, এটা আমাকে প্রশান্তি দেয়।’
অরু আশ্চর্যান্বিত। কিয়ৎক্ষণ মস্তিষ্ক যেন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। সংযোগ হতেই একগাল হেসে তন্ময়ের বুকে আছড়ে পড়ে। তন্ময় দাঁত দ্বারা জিহ্বা কেঁটে— সতর্ক চোখের দৃষ্টি নিচে ফেলে। এবং কথায় আছে,
‘যেখানে বাঘের ভয়;সেখানেই সন্ধ্যে হয়।’
একই বিষয় ঘটেছে। মোস্তফা সাহেব অবরুদ্ধ। ইতোমধ্যে মাথা ঘুরিয়ে ফেলেছেন। হতাশ তন্ময় চোখবুজে কপাল চেপে ধরে। কবে যে ওর জ্ঞানবুদ্ধি হবে। দু’হাতে আলতোভাবে সরিয়ে দেয় অরুকে। জবেদা বেগম খেতে ডাকছেন উচ্চকণ্ঠে। তন্ময় ত্বরিত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে। অরুও প্রাণোচ্ছলে রূপান্তরিত হয়েছে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের একবুক অভিমানিনী মেয়েটি যেন এই মেয়ে নয়। হেসেদুলে হুমড়ি খেয়ে পিছু নিয়েছে তন্ময়ের। জবেদা বেগম লাঞ্চবক্স তৈরি করেছেন চারটি। কয়েকরকম খাবার বানিয়েছেন। এরমধ্যে অরুর পছন্দের মমোসও আছে। সুমিতা বেগমও একটি চমৎকার ডিশ প্যাক করে দিয়েছে। আনোয়ার সাহেব মেয়ের জন্য সামান্য বিচলিত বটে। চঞ্চল মেয়েটাকে দূরে ছাড়তে অন্তঃপটে খচখচ হচ্ছে। মোস্তফা সাহেব তেমন কিচ্ছুটি বলেননি। গোমড়ামুখে চেয়ে শুধু বিড়বিড়িয়ে বলেন,
‘অরুকে দেখে রেখ।’
তন্ময় তাদের দুর্ভাবনা বোঝে। অরুকে নিয়ে সবার আশঙ্কাটুকু বোঝা খুবই স্বাভাবিক। ও যা বিচ্ছু ধাঁচের। ওকে কন্ট্রোলে রাখা মুশকিল তো অবশ্যই। অন্যদিক দীপ্ত ভীষণ ইমোশনাল। ছেলেটা চোখজোড়া রক্তিম। খুব করে তাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। তবে সম্ভব নয়। ও টিউটোরিয়াল এক্সাম চলছে। এক্সাম না চললেও ওকে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দ্বার পেরিয়ে বেরুতেই মাইক্রো দেখা গেল। ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে ভ্রমণ গাড়ি। গাড়ির ভেতরের কেউই বেরোল না। তবে অন্দরে বসেই গর্দা ন বের করে সালাম ঠুকল একেকজন। তন্ময় বিদায় জানিয়ে অরুকে নিয়ে গাড়ির কাছাকাছি এলো। গাড়ির পেছনের গদির দরজা খুলে দিলো রিয়ান।
গাড়িটা মূলত তিনটি সারিবেঁধে আসন। ঠিক পেছনের গদি ফাঁকা। বাকি সবগুলো লেপ্টে বসেছে সম্মুখে। তন্ময়ের অনুভূতি ঠিক কী সে জানে না! এমন দেখানো প্রাইভেসি দিয়ে কী বোঝাতে চাচ্ছে? কথা বাড়াল না। সামনেই পরিবারের সদস্য। অরুকে বসিয়ে সেও উঠে বসল। অরু জানালার কাচ নামিয়ে হাত নাড়ছে। তার সজীব মুখশ্রীতে সূর্যের কিরণ পড়ছে। সেই দৃশ্য দেখে আনোয়ার সাহেব অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। হেসে বড়ো ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘মেয়েটা যে এত তন্ময়ের পাগল, আমি বুঝতে পারিনি আগে।’
মোস্তফা সাহেব গম্ভীরমুখে রইলেন। মনে-মনে ব্যাঙ্গ করে বললেন, ‘আর আমার অপদার্থ ছেলেটা যে কত পাগল তোর মেয়ের জন্য, তা জানলে তুই হার্টব্রেক খাবি।’
গাড়িটা ধীরেসুস্থে শাহজাহান দোরগোড়া পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। বাড়িটা এখনই কেমন নীরব, নির্জীব লাগছে।
অরুকে তন্ময়ের বন্ধুবান্ধ সাত জনম আগে থেকেই চেনে। সামনাসামনি পরিচয় পূর্বে একবার মাত্র হয়েছিল। তাও তাদের সহস্র আবেদনের পর, জনাব শাহজাহান্ তন্ময় রাজি হয়েছিলেন। তবে দিয়েছিলেন অজস্র সতর্কবার্তা। সেসব পালন করার প্রতিশ্রুতি বন্ধুদল দিয়েছিল বলেই সে অরুকে এনেছে। এর অবশ্য কারণ আছে। বন্ধুদের মুখ চলে ট্রেনের গতিতে। বন্দু কের বুলেটের মত শুধু নষ্ট, অশ্লীল কথা বেরোয়। এসব অরু শুনে বসলে বিপদ। বিপদ অবশ্যই তন্ময়ের, বন্ধুদের নয়। তারা উলটো তন্ময়কে বিপদে ফেলতে মুখিয়ে আছে। তাই আজ অরুকে পেয়ে মাহিন উৎসুক বড়ো। সটানভাবে চুপচাপ পুতুলের মত বাচ্চা-বাচ্চা মুখের মেয়েটাকে দেখে তার মুখ চলল একাগ্রভাবে,
‘আসসালামু আলাইকুম —মামণি, আর ইউ এক্সাইটেড?’
অরু আশ্চর্য হলো এই সম্বোধনে। তাদের মামণি হলে কী তন্ময়েরও সে মামণি? ততক্ষণাৎ প্রশ্নবোধক চোখে মাথা ঘুরিয়ে তন্ময়ের পানে চাইল। তন্ময় তখন চোয়াল শক্ত করে চোখ রাঙিয়ে চেয়ে মাহিনের দিক। শক্তপোক্ত চাহনি জানান দিচ্ছে, তোকে জাস্ট পিষিয়ে খেয়ে ফেলব। মাহিন বোঝার মত করে –জিহ্ব কেটে ডাকনাম সংশোধন করে ফের বলে,
‘ওহ, সরি। মাই মিস্টেক! আসসালামু আনলাইকুম, ভাবী। আর ইউ এক্সাইটেড।’
অরু বোঝার মত হেসে মাথা দোলাল। সালামের জবাব দিয়ে বাধ্য গলায় প্রত্যুত্তরে বলল, ‘জি, ভাইয়া। অনেক এক্সাইটেড।’
শুহানি সামনেই ছিলো। আপাতত পিছু ঘুরে আছে। অরুকে দেখছে। শব্দ করে হাসছিল। এযাত্রায় অরুর গাল আদুরে হাতে টেনে বলল,
‘একদিক দিয়ে মামণি ডাকা ভুল নয় কিন্তু। তুমি অনেক ছোটো। তন্ময় বাচ্চা বউ বানিয়ে আমাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছে।’
রিয়ান ড্রাইভ করছিল। সড়কপথে চেয়েই জানাল,
‘সহমত। অরু আমাদের স্মল বেইবি।’
তন্ময় হাত বাড়িয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অরুর কানে ইয়ারপিস ঢুকিয়ে দিলো। অরু চোখ তুলে চেয়ে আছে। তন্ময় ওর চোখ হাত দিয়ে ঢেকে গম্ভীরকণ্ঠে বলে,
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৫৩+৫৪
‘শা লা র বাচ্চা, তোর মুখ বন্ধ কর। বেইবি কী? লাথি দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেব।’
রিয়ান সহ বাকিরা..নিষ্ঠুর দানবের মতন হেসে ওঠল। কম্পন সৃষ্টি হলো মাইক্রোর ভেতরটায়। তন্ময়ের এই প্রটেক্টিভ রূপ তারা দারুণ উপভোগ করছে। আহ, সামনের দিনগুলো চমৎকার কাটবে।
