শাহজাহান তন্ময় শেষ পর্ব 

শাহজাহান তন্ময় শেষ পর্ব 
Nabila Ishq

প্লে লিস্টের ভীষণ পছন্দের গানের সুরের মতন পাল্টে গেল সময়ের তাল—কেটে গেল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস…বছরের পর বছর। মনে হয়, এইতো সেদিনই শাহজাহান বাড়ির সবগুলো মানুষ হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষা করছিলেন জনম-জনম ধরে। বুকের ভেতরে ভীত স্রোত, শরীর জুড়ে উত্তেজনা। টালমাটাল পরিস্থিতিতে সবাই কেমন আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে ছিলেন। তারপর.. তারপর একটি জাদু হয়, সেই জাদুর ছোঁয়ায় চমকায়, থমকায়.. আনন্দে দিশেহারা হয় প্রত্যেকটি মানুষ। এলাকা জুড়ে মিষ্টি বিতরণ হয়, বাড়িঘর মেরামত হয়, একেকজনের পরিবর্তন ঘটে সাগরের স্রোতের মতন। সম্পর্কের আলাদাই মোড় নেয় নতুনভাবে।

শাহজাহান বাড়িটাতেই যোগ হয় অন্যরকম আনন্দের। অন্যরকম সুখের। সেই সুখ দু-জন ছোট্টো ছোট্টো প্রাণকে ঘিরেই। প্রাণ দুটো যখন কাঁদতো, কেঁদে উঠতো যেন সবাই। যখন নতুন নতুন হাঁটতে শিখে পড়ে হাপুসনয়নে চেয়ে রইতো, ব্যথা পেতো যেন শাহজাহান বাড়ির সবাই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বছর পাঁচেক পরের এক ভরা বর্ষার সময়। কিন্ডারগার্টেনের দোরগোড়ার পাশেই দারোয়ানের জন্য বসবার ছোটো একটি ঘর করা। চার দেয়ালের ঘরে টিনের ছাঁদ। চালে রিমমঝিম সুর তুলছে বৃষ্টির ভারী, মোটা ফোঁটা গুলো। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সু-বিস্তৃত বুকের খুব নিচ দিয়ে একটি প্লেন যাচ্ছে শব্দ করে। সেই শব্দের সঙ্গে মিশেছে গাছেদের বৃষ্টিতে ভেজার শব্দ। শব্দের তালে কিন্ডারগার্টেনের চতুর্দিক মুখরিত। খোলা মাঠের পশ্চিমের ছাউনির নিচে নাদুসনুদুস ছোটো ছোটো বাচ্চাদের সারি। সারিবদ্ধ বাচ্চাদের মধ্যিখানে দাঁড়ানো ছোটোখাটো দুর্দান্ত চঞ্চল দেহটি ছটফট করছে রীতিমতো। সারিতে নড়চড় বিহীন দাঁড়াতে বড্ড অপারগ সে। স্বাস্থ্যসম্মত, ধবধবে ফরসা বর্ণের বাচ্চাটির গায়ে কালো হাফপ্যান্টের সাথে ছোটো হাতার সাদা শার্ট ইন করে পরা।

গলায় কালো রঙের টাই ঝোলানো। দু’কাঁধে ব্যাগ। হাতে পানির বোতল। কী ভীষণ সুন্দর, মিষ্টি একটা মুখ! বিধাতা যেন বড়ো আদরে নিজ হাতে তৈরি করেছেন। আপাতত ওই আদুরে বাচ্চা মুখটি কাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিতে বারংবার প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই চাইছে অদূরের দুয়ারের দিকে। দারোয়ান কালো রঙের রেইনকোট পরে দাঁড়িয়ে আছেন ওদিকটাতেই। গাড়ি ঢুকতে সাহায্য করছেন। বাচ্চাদের পরিবার একেক করে এসে ছাতা মেলে নিয়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ বাচ্চাদের।
বাম হাতের লেটেস্ট স্পাইডার ম্যানের ঘড়িটিতে নজর বুলোয় অত্যন্ত চঞ্চল, বাউন্ডুলে ফায়াজ৷ সময়তো সে বুঝল না তারপরও নজর বুলিয়ে গেল নিজের মতন। একপর্যায়ে নার্সারির প্রধান শিক্ষিকাকে প্রশ্নও করল বিনয়ী তবে অধৈর্য গলায়,

‘ম্যাম, কয়টা বাজছে?’
নীলা বেগম ফায়াজের সুন্দর মুখটার গাম্ভীর্যতা দেখে হেসে ফেলেন। নিজের হাত ঘড়িতে দৃষ্টি বুলিয়ে মিহি স্বরে জানান,
‘পাঁচটা বাজতে এখনো নয় মিনিট বাকি। ফায়াজ, তোমাদের ফ্যামিলি কার এসেছে তো। যাচ্ছো না কেনো? কারো জন্য অপেক্ষা করছো বুঝি?’
ফায়াজ বড়োদের মতো মাথা দোলায়। পুনরায় দুয়ারের দিকটায় তাকায় অশান্ত ভঙ্গিতে। চেনাপরিচিত গাড়িটির আগমনের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল ও মাথা দুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলে,
‘পাপার জন্য। পাপা আসবে।’

এ-কথায় নীলা বেগম ভারী আশ্চর্য হলেন। তিনি যতটুকু জানেন ফায়াজ-ফাইজার বাবা আপাতত দেশে নেই। ভদ্রমহিলার কপালের চামড়া গুটিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভাঁজ পড়ে কয়েক। অত্যন্ত চিন্তিত গলায় শুধান,
‘মিষ্টার শাহজাহান তো সিঙ্গাপুর গিয়েছেন। আমি ভুল জানতাম কী?’
ফায়াজ বিরক্ত হয়। এতো কথা ওর ভালো লাগছে না। প্রত্যুত্তর না করে চেয়েই থাকে অদূরে— দোরগোড়ায়। ফায়াজের ঠিক পেছনেই দাঁড়ানো ভাবুক চোখমুখের মেয়েটির সাথে, ওর চেহারার অতুলনীয় মিল রয়েছে। দু’জনের উচ্চতাও প্রায় একইরকম। সাদা শর্ট হাতার শার্টের ওপরে কালো রঙের হাতা কাটা হাঁটু সমান গোল ফ্রক পরিহিত মেয়ে বাচ্চাটির গলায় কালো রঙের টাই ঝুলোনো। কাঁধ সমান সিল্কি, কালো চুলগুলোতে দুটি ঝুঁটি বাঁধা। মসৃণ, ফরসা আদুরে মুখটা স্বভাবত গম্ভীর। বাবা বলেছেন, কখনোই বড়োদের অসম্মান করতে না। বড়োদের প্রশ্নের জবাব না দেয়া মানে একপ্রকার তাদের অসম্মান করা। এবং এটাকে অভদ্রতা বলে। তাই ছোটো ভাইয়ের হয়ে ফাইজা নিজেই জবাবে বলে,

‘পাপা আজ আমাদের পিক করবেন বলেছেন।’
নীলা বেগমের চিন্তা আরও বাড়ে। তিনি আকাশের দিকে চান। সেই সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় ফ্লাইট স্থগিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ঠিক সময় মতো পৌঁছানো অসম্ভব প্রায়। তিনি কোমর বেঁকিয়ে —মাথাটা বাচ্চা দুটোর সমান নুইয়ে নরম গলায় বলেন,
‘মিষ্টার শাহজাহান সম্ভবত সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না। ওয়েদার খারাপ। ফ্লাইট ডিলে হবে।’
ফাইজার বাচ্চা বাচ্চা আদুরে কণ্ঠে দৃঢ়তার স্পর্শ,
‘আমার পাপা কখনো ফলস প্রমিজেস করেন না। কখনো মিথ্যে বলেন না। হি ইজ ভেরি স্ট্রিক্ট এবাউট টাইমিং। যখন বলেছেন পাঁচটার মধ্যে আসবেন, তখন নিশ্চয়ই আসবেন।’

বাচ্চা মেয়েটির অটুট বিশ্বাস এবং বিজ্ঞের মতন কথাবার্তার ধরনে নীলা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বাবা ভক্ত এই দু’জনের সঙ্গে অনেকের তর্কবিতর্কের কাণ্ডকারখানার ইতিহাস ইতোপূর্বে ঘটেছে। তাই তিনি আর ওদের ঘাটান না। পুনরায় দৃষ্টি রাখেন চামড়ার হাত ঘড়িটায়। আর দু’মিনিট বাকি পাঁচটা বাজতে। তিনি একটিবার দুয়ারের দিকে চেয়ে হাত ব্যাগ থেকে ফোন বের করেন। এখন শাহজাহান বাড়িতে কল দেয়াটাই উত্তম হবে। অথচ নীলা বেগম কল লিস্টেও যেতে পারেননি এমন সময়তেই বাইকের উচ্চ দধ্বনি কর্ণগোচর হয়। কিন্ডারগার্টেনের ভেতরে উচ্চ শব্দ করার মোটেও অনুমতি নেই। দারোয়ান কীভাবে ঢুকতে দিয়েছে একটি বাইক? আশ্চর্য! ভদ্রমহিলা মাথা তুলে দেখলেন, একটি কালো রঙের বাইক হাই স্পিডে এসে থেমেছে মাঠে— ঠিক ছাউনির থেকে কিছুটা দূরে, খোলা আকাশের একদম নিচে। ঝুম বৃষ্টি তখনো নেমে যাচ্ছে নিজের মতন। আগন্তুক ভিজে নেয়ে একাকার। নেভীব্লু রঙের ফুলস্লিভসের শার্টটি বলিষ্ঠ দেহে আষ্ঠেপৃষ্ঠে মিশে আছে। হাত ঘড়ি থেকে টপটপ করে বৃষ্টির জল ফোঁটা হয়ে ঝরছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ফায়াজ আগন্তুককে চিনে নিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেনি। মুহূর্তেই লাফিয়ে ওঠে খুশিতে। স্পষ্ট কণ্ঠে ডেকে ওঠে,

‘পাপা!’
চকচক করে ওর ভারী সুন্দর আকৃতির চোখ দুটো। ফাইজার গম্ভীর চোখমুখেও আনন্দের ছিঁটেফোঁটা। হাস্যোজ্বল গুটিগুটি পায়ে দ্রুত এগুতে চায়। তখুনি বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠের আদেশ পড়ে,
‘স্টপ রাইট দেয়ার, সোনামণি। এসো না।’

ফাইজার মিষ্টি হাসিটা কেমন গাঢ় হয়। চোখে তারা ভাসে। আদেশ মোতাবেক ও হাসি হাসি মুখে থেমে যায়। অপেক্ষা করে। তবে বেশ ছটফট করতে থাকে। অন্যদিকে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পাত্র ফায়াজ নয়। দূরন্ত কদমে ও ছুটেছে বাবার দিকে। ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই। নীলা বেগমের ঘোর কাটে ওই গভীর পুরুষালি কণ্ঠে। পরপর বিচলিত হয়ে পড়ে ফায়াজের কাণ্ডে। ছুটে গিয়েও ধরতে ব্যর্থ হয় ওকে। ছেলেটা বাঘের মতো বিচ্ছু। কী জোরসে ছুটল! দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে দ্রুত ফাইজার কাছে গিয়ে ওর নরমসরম হাতটি ধরে দাঁড়াল। যেন ছুটে বৃষ্টির মধ্যে যেতে না পারে।
বৃষ্টিতে ভিজে একাকার তন্ময়। হেলমেট খুলে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াতেও পারেনি, এরমধ্যেই ফায়াজ ছুটে এসে জাপ্টে ধরে তার পা-জোড়া। গোঙায় আহ্লাদী স্বরে। বাচ্চাটা ইতোমধ্যে ভিজেনেয়ে একাকার। তন্ময় এক ঝটকায় কোলে তুলে নেয় ছেলেকে। কোলে রাখতে তার সুগঠিত ডান হাতের বাহুতে বসাতেই ফায়াজ বাবার গলাটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে অস্পষ্ট গলায় স্বীকারোক্তি করে,

‘পাপা, আই মিসড ইউ সো.. সোও, সোও মাচ।’
তন্ময়ের গম্ভীরমুখটা নরম হয়। ঠোঁট প্রসারিত হয়। ছেলের ভেজা চুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে এগুতে শুরু করে ছাউনির দিকে। বলে,
‘উম, পাপাও তোমাকে ভীষণ মিস করেছে। পাপার অ্যাবসেন্সে তুমি গুড বয় হয়েছিলে তো?’
ফায়াজ দ্রুত মাথা দোলায় লাগাতার। ডান হাতের দুটো আঙুল দিয়ে গলায় চিমটি কেটে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
‘ইয়েস। তুমি দাদুভাই, নানুভাইকে জিজ্ঞেস করতে পারো।’
তন্ময় হাসিটুকু গিলে নিয়ে ডান ভ্রু তুলে শুধায়, ‘হোয়াট এবাউট ইওর মাম্মাম? তার কথা কেনো বলছো না? তাকে জ্বালাওনি তো?’
ফায়াজ চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে আঙুলের সাহায্যে দেখিয়ে হালকা গলায় বলে, ‘একটুউখানি। এইযে এতটুকুউন।’

তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। ছাউনির নিচে যেতেই ফাইজা ছুট লাগায়। তন্ময় দ্রুত ঝুঁকে মেয়েকে ডান হাতে কোলে তুলে নেয় বেশ আমোদেই।
ফাইজা দু’হাতে গলা জড়িয়ে বাবার ঘাড়ে মুখ গুঁজে রয়েছে। মুখে রা অবদি নেই। তন্ময় মুখ বাড়িয়ে মাথার ওপর ঠোঁট ছুঁইয়ে শুধায়,
‘মন খারাপ?’
ঘাড়েই মেয়েটা মাথা দোলায় দু’বার। বোঝায় তার মন খারাপ। তন্ময় নরম স্বরে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যায়,
‘কেনো? কে আপসেট করেছে আমার সোনামণিকে? কার এতো বড়ো স্পর্ধা? আমাকে বলো আই’ল সর্ট হিম আউট ফর ইউ।’

ফাইজা মাথা তুলে না। সেভাবেই তন্ময়ের ভেজা বুকে লেপ্টে থেকে আওড়ায়,
‘তুমি দেশের বাইরে গেলে আমার খুব আপসেট লাগে, পাপা। তোমার না গেলে হয় না?
ফায়াজও বোনের সুরে সুর মেলায় চটপট। ছেলেমেয়ের আবদারের সামনে তন্ময় অসহায়। এই বিষয়ে সে প্রতিজ্ঞাও করতে পারছে না। কাজের জন্য হঠাৎ করে দেশের বাইরে যাওয়াটা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে। সবকিছু তো আর অনলাইন ভিত্তিক হতে পারে না। সম্ভব না।
বাধ্য হয়েইতো যেতে হয়। এইতো এয়ারপোর্ট থেকে সে সোজা রওনা দিয়েছিল কিন্ডারগার্টেনের উদ্দ্যেশ্যে। এরমধ্যে আবার ঝুম বৃষ্টি! একেবারে বাজে আবহাওয়া। ঢাকাশহরের অঘোষিত জ্যাম নামক যুদ্ধে এমন বৃষ্টিতেও পড়তে হয়েছিল জনম-জনমের জন্য। বাচ্চাদের সঠিক সময়ে নিতে তাকে একপ্রকার বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে অন্য একজনের বাইক চড়ে আসতে হয়েছে। বাইক ওয়ালা ভদ্রলোককে তার গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে এখানেই আসবে ম্যানেজার সুমন।

নীলা বেগম কাছাকাছি এসে মিহি কণ্ঠে সালাম জানান। তন্ময় তাকে লক্ষ্য করে মাথা দুলিয়ে সালামের জবাব দিয়ে বলে,
‘থ্যাংকিউ, ম্যাডাম।’
নীলা বেগম মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বলেন,
‘না না, আমাদের কাজইতো এটা।’
তখুনি একটি গাড়ি ঢোকে কিন্ডারগার্টেনের সদরদরজা দিয়ে। তন্ময় নিজের গাড়ি আসতে দেখে ছেলে-মেয়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘টিচারকে বাই বলো।’

ফায়াজ-ফাইজা সমানতালে বিদায় জানায়। ইতোমধ্যে সুমন সাহেব গাড়ি থেকে বেরিয়েছে ছাতা হাতে। তার পাশে একজন ভদ্রলোক। ভদ্রলোক তন্ময়ের সাথে কুশল বিনিময় করে নিজের বাইকে চড়ে বেরিয়ে গেলেন। সুমন সাহেব এসে ছাতাটা ধরলেন তন্ময়ের মাথার ঠিক ওপর। তন্ময় হাতের ইশারায় সরিয়ে নিতে বলে। সে ইতোমধ্যে ভিজে জবজবে। ফায়াজও ভিজেছে। আর তার সাথে লেপ্টে ফাইজাও সামান্য ভিজে গিয়েছে। এখন আর ছাতার প্রয়োজন নেই। সে দ্বিতীয়বারের মতন নীলা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে এগোয় গাড়ির দিক। সুমন সাহেব গাড়ির ডোর খুলে দিয়েছে। তন্ময় দ্রুত ছেলে-মেয়েকে ভেতরে বসিয়ে দেয়। নিজেও উঠে বসে। সুমন ড্রাইভিং-এ বসে গাড়ি স্টার্ট করেন। ফায়াজ আলগোছে সিট থেকে উঠে তন্ময়ের ঊরুতে উঠে বসে। ফাইজা ছোটো ছোটো চোখে দেখে যায়। তন্ময় হেসে মেয়েকে ফের কোলে তুলে নেয়। অসহায় কণ্ঠে বলে,

‘পাপা, ভিজে আছিতো। কোলেই কেনো চড়তে হবে? সিটে বসো।’
ফায়াজ গম্ভীরমুখে বলে, ‘খুব মিস করেছিতো তাই কোলেই বসতে হবে।’
প্রত্যুত্তর শুনে শব্দ করে হেসে ফেলে সুমন। সেই হাসির শব্দে ফায়াজ অসন্তুষ্ট হয়ে প্রশ্ন করে,
‘কেনো হাসছেন আংকেল? আমি কি কিছু ফানি বললাম?’
সুমন হাসিটুকু গিলে নেয় মুহূর্তে। কাচুমাচু করে বলে, ‘মোটেওনা। আমি হাসলাম কারণ তোমার কথায় যুক্তি আছে, বাবা। তুমিই সঠিক বলেছো।’
ফায়াজ বিজ্ঞের মতো মাথা দোলায়। কাছ থেকে বাবার মুখে চেয়ে থেকে শুধায়,
‘পাপা, হোয়াট ডু ইউ থিংক? সঠিক বলেছিতো?’
তন্ময় চাপা হেসে মাথা বাড়িয়ে চুমু বসায় দু’জনের মাথাতেই। স্বীকারোক্তি দেবার মতন করে বলে,
‘সঠিক বলেছো। পাপাও, তোমাদের কোলেই রাখতে চায়। এখন বলো আমাকে, তোমার মাম্মাম কল ধরছিলো না কেনো? কী হয়েছে?’
ফায়াজ গলা নামিয়ে ছোটো করে বলে, ‘মাম্মার তোমার ওপর অভিমান করেছে। তুমি মাম্মামকে বকেছো যে। এইজন্যে।’

তন্ময় আশ্চর্য হলো। সে কখন বকলো? একটু ভাবতেই মনে পড়লো। সে গত পরশু, ঠিক রাতের দিকে ভিডিওকল দিয়েছিল। অরু কল রিসিভ করেছে লিভিংরুমে বসে। লিভিংরুম জুড়ে তখন বাড়ির সবাই আড্ডা দিচ্ছে। ফায়াজ-ফাইজাও ছিলো অরুর পাশেই। ওমন সময়ে ওর, ‘তন্ময় ভাই’ সম্বোধনটা কেমন শোনায়? একান্ত সময়ে তন্ময় শুধু শুধরে দেয়। তবে বাচ্চাদের সামনে এমন সম্বোধন কী ভালো বিষয়? তাইতো একটু কঠিন গলাতেই ধমকেছিল। তাই বলে এমন কথাবার্তা না বলে থাকবে? সেই পরশু রাত থেকে কল দিলে শুধু ফায়াজ-ফাইজা অথব বাড়ির লোকদের ধরিয়ে দিচ্ছে। এই পর্যন্ত কথা বলেনি একটাও! ও বোঝে তন্ময়ের মন? সে সেই সুদূর থেকে কতটা কাতর হয়েছিল জানে? তা জানবে কীভাবে! শুধু তন্ময়কে পোড়াতেই জানে। তন্ময় দাঁতে দাঁত পিষে হৃদয়ের জ্বালা দমন করে। একটা শক্তপোক্ত শাস্তি না দিলেই না। তন্ময়ও দেখবে ও কতক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে।

‘অরু কোথায়?’
তন্ময় বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই অরুর খোঁজ করল ব্যস্ত কণ্ঠে। জবেদা বেগম রান্নাঘরে তখন গোরুর গোস্তোটা সবে কশাতে শুরু করেছেন। ছেলের কণ্ঠে চুলোর আঁচ কমিয়ে দিয়ে…হাত দুটো আঁচলে মুছে দ্রত কদমে বেরিয়ে এলেন। এতোগুলো দিন পর ছেলেকে দেখে আপ্লূত হতেও পারলেন না। ছেলে এবং নাতিদের ভেজা অবস্থা দেখে দ্বিগুণ ব্যস্ত কণ্ঠে তাড়া দিতে শুরু করলেন,
‘দ্রুতো কাপড়চোপড় বদলে নে। আমি আদা চা বসাচ্ছি।’
তন্ময় অশান্ত দৃষ্টি চতুর্দিকে বুলিয়ে শেষমেশ দোতলায় রেখে যথাসম্ভব কণ্ঠ ঠান্ডা, শান্ত করে বলল, ‘যাচ্ছি। অরু কোথায়, মা?’
জবেদা বেগম তখন ব্যস্ত কদমে রান্নাঘরে প্রবেশের জন্য এগুচ্ছেন। চা-য়ের পানিটা এখুনি বসিয়ে দেবেন। তিনি যেতে নিয়েই বলেন,

‘মারজির বাবা এসে অরুকে নিয়ে গেলেন। আজ মারজির গায়ে হলুদ না? ঘরোয়া ভাবে আয়োজন করেছেন।’
জবাবে তন্ময় নিশ্চুপ। বড়ো করে শ্বাস টেনে নিলো। তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। রাগটা সংবরণ করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। রাগের চোটে মাথার ভেতরটা রীতিমতো ব্যথা করছে। তন্ময়ের মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ফাইজা খুব সন্তর্পণে জড়িয়ে ধরে চিন্তিত চোখে তাকাল। তন্ময় নিজেকে সামলে নিয়ে, গম্ভীরমুখে মৃদু হাসি টেনে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। বোনকে বাবার কোলে উঠতে দেখে ফায়াজও দু’হাতে তুলে রেখেছে কোলে ওঠার জন্য। তন্ময় অন্যহাতে ছেলেকেও কোলে তুলে এগুতে শুরু করল সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিয়ে ভাবল অরুর কথা। মেয়েটা খুব বাড় বেড়েছে! ও জানতো, আজ সে ফিরবে! তাহলে? অপেক্ষা করতে পারতো না? জেনেশুনে এড়িয়ে বেড়াচ্ছে! ভেবেছে তন্ময় ফিরেই ওকে মানাতে যাবে! মানাবে..অবশ্যই মানাবে, তবে শাস্তিটা দেবার পর। কল ধরেনি, মেসেজ-ভয়েজের রিপ্লাই করেনি আজ তিনদিন ধরে। যেই ব্যাপারটা তন্ময় একদম মানতে পারে না, পছন্দ করে না —সেটাই করেছে। এড়ানো কাকে বলে এবারে ভালোভাবে বোঝাবে সে। যদি না বুঝিয়েছে তাহলে সেও শাহজাহান তন্ময় না। অবাধ্য মেয়ে কোথাকার!

ফায়াজ নরম দু’টো হাতে তন্ময়ের গম্ভীরমুখটা আলতোভাবে ধরে শুধায়, ‘পাপা, তুমি কি মাম্মামের ওপর রেগে আছো?’
ইতোমধ্যে বাচ্চাদের নিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করল তন্ময়। ছেলের এমন প্রশ্নে সে ডান ভ্রু তুলে পাল্টা শুধালো, ‘এমন কেনো মনে হলো আমার পাপার?’
ফায়াজ ভারী বিজ্ঞের মতো বলল, ‘তোমার মুখ খুব রাগিরাগি হয়ে আছে। পাপা, প্লিজ তুমি মাম্মামের ওপর রেগো না। মাম্মাম তো খুব ছোট্ট।’

তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ্যাঁ, খুব ছোটো। সেই ছোটো মানুষটা তাকে যেভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ছোটাতে পারে তা এই ভূমণ্ডলে আর কেউ পারে না। ছোটো হয়েই এমন করতে পারছে, এরচেয়ে বড়ো হলে তো আর তার অস্তিত্বটাই বোধহয় রাখবে না। তন্ময় বাচ্চাদের কোল থেকে নামাল। ওদের চটজলদি ফ্রেশ করিয়ে কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে দিলো। এরপর নিজেও ওয়াশরুম ঢুকল গোসলটা সেরে নিতে। তার শরীরে বৃষ্টির পানি সহ্য হয় না। জ্বর অথবা ঠান্ডা লেগে যাবেই। আর আজ অনেকটা সময় ধরে ভেজা হয়েছে। জ্বর সঙ্গে সঙ্গে না এলেও ঠান্ডা লেগে গেছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পরপর দু’বার শব্দ করে হাঁচি দিয়েছে। এসময়ে দীপ্ত দরজায় টোকা দিলো। পিরিচ সহ চা-য়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হাসছে। বেশ লম্বা হয়েছে গত পাঁচ বছরে। কোকড়া চুলে আর্মি কাট দেয়ায় বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা কমেছে। তন্ময় এগিয়ে গিয়ে ওর থেকে পিরিচ সহ চা-য়ের কাপটা নিলো। চা-য়ে চুমুক বসিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ফায়াজ, ফাইজা কোথায়? খাচ্ছে তো?’

‘হুঁ, বড়ো মা খাইয়ে দিচ্ছেন। তোমাকেও খেতে ডাকছে।’
তন্ময় ফোনটা হাতে তুলে নিতে নিয়ে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘পরে আসছি।’
স্ক্রিনে ভাসছে একুশটা মিসডকলের নোটিফিকেশন। একুশটার মধ্যে ষোলোটাই মাহিনের একার। বাদবাকি সব রিয়ান, শুহানি, ইব্রাহিম, সৈয়দের। আজ মাহিনের গায়ে হলুদ। আগামীকাল বিয়ে। মূলত এরজন্য এরা তার পেছনে হাত ধুয়ে পড়েছে। তন্ময় কল ব্যাক করার সময়টুকুও পায় না— মাহিন ফের কল করেছে। তন্ময় বারান্দার দিকে যেতে-যেতে কলটা রিসিভ করে ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে গর্জন ছাড়ে মাহিন,
‘তুই কখন দেশে নামছিস? আর এখন কটা বাজে?’

তন্ময় বাধ্য পুরুষের মতন জানায়, ‘বাচ্চাদের কিন্ডারগার্টেন থেকে রিসিভ করলাম। ওদের নিয়ে বাসায় পৌঁছে মাত্র ফ্রেশ হয়ে দাঁড়ালাম।’
মাহিনের গর্জন আরও বাড়ে, ‘দাঁড়ালাম মানে? দাঁড়াইয়া আছিস কেনো? তোরে কি এখন পালকি করে আনতে যাবো, হুঁ?’
তন্ময় নির্বিকার কণ্ঠে বলে, ‘এখন গিয়ে কী করব? তোকে হলুদ মাখতে হবে?’
মাহিন বিরক্ত হয়, ‘তুই আসবি কি-না?’
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, ‘আসছি, সন্ধ্যার পর আসছি।’

মাহিনের সাথে কথা শেষ করে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু অফিশিয়াল কল ব্যাক করে কথাবার্তা সেরে নিলো। ঘড়ির কাঁটা তখন ছয়টা ত্রিশে। মাগরিবের আজান পড়বে। তন্ময় কাপড়চোপড় বদলে ফেলল। কালো জিন্সের সাথে ওফ হোয়াইট শার্টটা কোনোরকমে গায়ে জড়ানো। বুকের দিকের তিনটা বোতাম খোলা। দু’হাতা কনুইতে অযত্নে গুটিয়ে রাখল। হাত ঘড়িটা পরে — বুকের দিকে কোলন ছিটিয়ে নিলো চটজলদি। ওয়ালেট পেছন পকেটে ঢুকিয়ে ফোন, গাড়ির চাবি বেডের সাইড টেবিল থেকে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। লিভিংরুমে ফায়াজ গাড়ি চালাচ্ছে। দীপ্ত নিপুণ কৌশলে ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। ফাইজা মোস্তফা সাহেবের কোলে বসে কার্টুন দেখছে। মোস্তফা সাহেব বাম ঊরুতে নাতনিকে নিয়ে ডান হাতে চা খাচ্ছেন। একটু পরপর ফায়াজকে দেখে নিচ্ছেন চিন্তিত চোখে। যেই ইলেকট্রনিক গাড়িটায় বসে গাড়ি চালাচ্ছে— ওটা হুট করে ছুটে আবার দেয়ালে লাগলেই ভীষণ বাজেভাবে ব্যথা পাবে ছেলেটা। তন্ময়কে তৈরি হয়ে নামতে দেখেই গাড়ি থেকে দ্রুত নামল ফায়াজ। এক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল তন্ময়ের পা-জোড়া। আবদার ধরল একগুঁয়ে ভাবে,

‘পাপা, কোথায় যাচ্ছো? আমিও যাবো, তোমার সাথে যাবো।’
তন্ময় ছেলের মাথার চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বলে, ‘আজ না, অন্য একদিন নিয়ে যাবো। দাদুর সাথে থেকে হোমওয়ার্ক করে নাও, হুঁ? কী খেতে চাও, বলো। আসার সময় নিয়ে আসবো।’
ফায়াজ কাঁদোকাঁদো মুখে চেয়ে রয়। তন্ময় এক ঝটকায় ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। গালে ঠোঁট ছুঁয়ে নাক টেনে ফিসফিস করে বলে, ‘নেক্সট ফ্রাইডেতে সিলেট ঘুরতে নিয়ে যাবো, কেমন?’
ফায়াজের চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে আসে। আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘সত্যিইই? প্রমিজ করো।’
তন্ময় ইতোমধ্যে সোফায় গিয়ে বসেছে মোস্তফা সাহেবের পাশে। ফায়াজকে কোলে বসিয়ে বলে, ‘প্রমিজ। এখন যাও, খেলো। আজানের পর পড়তে বসবে। নো আর্গুমেন্টস।’

ফায়াজ বাধ্য ছেলের মতন মাথা দুলিয়ে বোঝাল বসবে। কোনোরকমের তর্কবিতর্ক করবে না পড়াশোনা নিয়ে। তন্ময়ের কোল থেকে নেমে ফের গাড়ি চালাতে ছোটে। মোস্তফা সাহেব ছেলের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
‘সন্ধ্যা হলো বলে প্রায়। অরুকে আনতে যাচ্ছো?’
তন্ময় পিঠ এলিয়ে কিছুটা আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসল। পায়ের ওপর পা তুলতেই ফাইজা আলগোছে দাদুর কোল ছেড়ে বাবার কোলে বিড়াল ছানার মতন বসে পড়ল। তন্ময় ডাত হাতে মেয়ের চুলগুলো বুলিয়ে দিতে নিয়ে এবারে প্রত্যুত্তর করল,

‘আমার বেরুতে হবে এখন। গাড়িটা পাঠাও ওকে আনতে।’
মোস্তফা সাহেবের চোয়াল ঝুলে এলো। তিনি নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি কী ভুল শুনলেন? তন্ময় বোঝাল, ও অরুকে আনতে যেতে পারবে না। শুধু গাড়ি পাঠাতে। মোস্তফা সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে মুখ খুললেন,
‘তুমি ঠিক আছো?’
তন্ময় বিরক্ত হয়। বাবার এমন প্রতিক্রিয়া তাকে হতবাকও করে, ‘আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে তোমার?’
মোস্তফা সাহেব মাথাটা ছেলের একটু কাছে নিলেন। আস্তে করে শুধালেন, ‘ঝগড়া হয়েছে? ও বাচ্চা মানুষ। ওর সাথে মনমালিন্যতা করিওনা।’

ফাইজা তখন একমনে তন্ময়ের বড়ো হাতের আঙুল গুলো দিয়ে খেলছে। বাবার হাতের সামনে ওর হাত জোড়া যেন এক ছোটো পুতুলের হাত। বাবার এক হাতের তালুতে ওর দু’হাত নিদারুণ ভাবে ঢেকে যাচ্ছে। এসব নিয়েই মেয়েটা ব্যস্ত। দাদু আর বাবা কী ফুসুরফাসুর করছে, জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
‘এতো বেশি ভেবো না, বাবা। যা চুল আছে মাথায় তোমার… তাও পড়ে যাবে।’
মোস্তফা সাহেব অসন্তুষ্ট হলেন। গোপনে মাথায় হাতও বোলালেন। চুল তো ভালোই আছে। তন্ময় যেন দেখেও দেখল না। প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ওকে আনতে গাড়ি পাঠিয়েছো?’
মোস্তফা সাহেবের মুখ তখন গম্ভীর, ভার… ‘আনোয়ার গিয়েছে আনতে।’
এককথায় —তন্ময় ফাইজার মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে ওকে মোস্তফা সাহেবের কোলে বসিয়ে, নিজে উঠে রওনা হলো দুয়ারের দিকে। বাইরে তখনো বৃষ্টি নামছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। দারোয়ান চাচা গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের করে রেখেছেন। তন্ময় সোজা ড্রাইভিং-য়ে উঠে বসল। দু’হাত স্টিয়ারিং এর ওপর রেখে দৃষ্টি রাখল সদরদরজার দিকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে… আনোয়ার সাহেবের গাড়ির জন্য। গাড়িটা ঢুকতে দেখলেই—সে বেরুবে। ঠিক অরুর সামনে দিয়ে বেরুবে, এবং ওকে উপলব্ধি করাতে হবে তন্ময় ওকে দেখেও এড়িয়ে চলে যাচ্ছে। এসব ভেবে আপনমনে হেসেই ফেলল। এই বয়সে এসে তাকে কীসব বাচ্চামো কাজকর্ম করতে হচ্ছে! মেয়েটা তাকে নষ্ট করেই ছাড়ল।

এসময়ে আনোয়ার সাহেবের গাড়ি ঢুকতে দেখা গেল। তন্ময় তখুনি গাড়ি স্টার্ট করে চলে যেতে চাইলেও, হাত দুটো তার মস্তিষ্কের কথামতো কাজ করল না। অরুকে একটু দেখার জন্য বেহায়ার মতন চেয়ে রইল। তিনটে দিন ধরে ওকে দেখেনি, কণ্ঠটুকুও শোনেনি। এমনটা কী এরপূর্বে হয়েছে? হয়নি। দারোয়ান চাচা ছাতা মেলে ধরতেই গাড়ির ব্যাক সাইড থেকে অরু ধীরেসুস্থে নামছে। হাই হিল পরেছে। গায়ে হলুদ গাউন। ওড়নাটা এক সাইডে রাখা। অন্য সাইডে কার্ল করার চুলের একাংশ। হালকা মেকআপ করেছে।

সাদা বাল্বের আলোয় ওর মুখটা সুস্পষ্ট। কী সুন্দর দেখাচ্ছে! এতো সেজেগুজে বিয়ে বাড়িতে কাকে দেখাতে গিয়েছে? দেখে কে বলবে, এইটুকুন মেয়েটা দুটো বাচ্চার মা? তন্ময় নিজের হিংসা, রাগ সংবরণ করল। দেখল অরু এদিকে চাইছে বারবার। তন্ময় দাঁতে দাঁত পিষে দৃষ্টি সরিয়ে আনলো। গাড়িটা স্টার্ট করে এক টানে সদরদরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। মিরোরে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলো অরুর হতবিহ্বল মুখ, শরীর। থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো বোকার মতন। টলমলে চোখজোড়ায়— অবিশ্বাস। তন্ময় বড়ো করে শ্বাস টেনে নিয়ে ধীরে ছাড়ল। এই কঠিন পরিক্ষা বেশ। কতক্ষণ সে এই নাটক চালাতে পারবে তার আপাতত আর কোনো গ্যারান্টি নেই।

মাহিনদের বাড়ির গ্রাউন্ডফ্লোরে বন্ধুরা সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে চেয়ারে করে। মাহিনের দু-গালে হলুদ। পরনে সাদা লুঙ্গি, গায়ে ভেজা গামছা। সে বেশ লুঙ্গি গুটিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছে। রিয়ানের হাতে গিটার। সে গিটারে টুংটুং করছে। সৈয়দ গলা পরিষ্কার করে কয়েকবার সুর তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে। তন্ময় প্রবেশ করতেই হৈচৈ পড়ে গেল। রিয়ান একটা বিশ্রী ধরনের গান গাইতে শুরু করতেই মাহিন উঠে গিয়ে দ্রুত ওর মুখ চেপে ধরে। নাকমুখ কুঁচকে বলে,

‘ব্যাটা, মানইজ্জত খেতে চাচ্ছিস? এসব কী গান গাচ্ছিস?’
রিয়ান ওর হাত মুখ থেকে সরিয়ে ভারী আশ্চর্য হবার ভাণ ধরে ভ্রু তুলে শুধায়,
‘তোর মানইজ্জত আছে এখনো?’
‘থাকবে না কেনো? সবাইকে কী নিজের মতন ভাবিস? বেলেহাজ।’
রিয়ান থমথমে মুখে আপদমস্তক মাহিনকে দেখে বাঁকা হেসে ফেলল। বলল, ‘মামা, আজই কিন্তু শেষ। আগামীকাল থেকে বউয়ের শাসনে থাকা লাগবে।’
মাহিন নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। চমৎকার হেসে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘আমি এক্ষণ রাজি আছি। কয়বার কবুল বলা লাগবে?’

তন্ময় চেয়ের টেনে বসল। বাম পায়ের ওপর উশৃংখল ভাবে ডান পা-টা রেখে একটা সিগারেট ধরাতে নিতেই, বন্ধুরা সব শান্ত হয়ে গেল। একেকজন নিজেদের ভেতর চাওয়াচাওয়ি করে এবারে তন্ময়ের দিকে পূর্ণদৃষ্টি ফেলল। তন্ময়কে ওরা সব আপদমস্তক চিনে, জানে। অযথার্থ ওকে সিগারেট খেতে দেখা বিরল। স্বেচ্ছায় সিগারেট ধরিয়েছে মানেই—মনমেজাজ ভালো না। চূড়ান্ত বিরক্ত জনাব। অগত্যা সবাই উদগ্রীব কাহিনী জানতে, ঠিক কী কারণে বন্ধু তাদের বিরহে আছে। তন্ময় দেখেও যেন দেখল না ওদের মুখিয়ে থাকা দৃষ্টি। সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে ধরল। মাহিন কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে প্রশ্ন করল,

‘দোস্ত, কী হইছে? আরেকটা বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে? এই বউ কি আর ভালো লাগছে না?’
মাহিন ভেবেই রেখেছে এইমুহূর্তে এমন বেহুদা কথাবার্তার কোনো জবাব পাবে না। কিন্তু না, তাকে অবাক করে দিয়ে তন্ময় অন্যদিকে চেয়েই প্রত্যুত্তরে বলে,
‘মানুষ থেকে শুনে বেড়াই, বিয়ের পর বাচ্চাকাচ্চা হলে নাকি পুরুষ মানুষের আর বউ ভালো লাগে না। ইন্টারেস্ট হারায়। আরও কত হাবিজাবি কথাবার্তা। আমার বেলায় তো উল্টো হচ্ছে! পারি না বউকে পকেটের ভেতর ঢুকিয়ে নিজের সাথে সবসময় রাখি।’
তন্ময় থামে। ফের আওতায়, ‘এসব বোঝে মেয়েটা? সাহস বেড়ে গেছে। অতিরিক্ত মাথায় তুলেছি তো। ওকে আমি মাথায় রেখেই আছাড় মারব।’

মাহিন হাসছে। শব্দ করে হাসতে হাসতে বেফাঁসে বলল, ‘তোর ব্যাপারটা আলাদা কিন্তু। পেলে বড়ো করা গাছের প্রতি মায়া, ভালোবাসা এমনিতেও একটু বেশিই থাকে।’
রিয়ান শব্দ করে হেসে উঠল। তন্ময় সেই হাসিতে সামিল হতে পারল না। একমনে দেখল সেলফোনের স্ক্রিনটা। অরু কল করেছে। কলটা কেটে গেছে অনেকক্ষণ। জেনেশুনে অরুর কল রিসিভ না করাটা বোধহয় এই প্রথম। তন্ময় নিজের ওপর বিরক্ত হচ্ছে মারাত্মক ভাবে। কোনোভাবেই মনকে শান্ত করতে পারছে না। ইচ্ছে করছে, কল ব্যাক করতে–কথা বলতে..বাড়ি ফিরতে। কিন্তু তা সে করবে না। নিজেকে পুড়িয়ে হলেও ওকে সে শায়েস্তা করেই ছাড়বে।
রিয়ান হালকা গলায় দুষ্টু ভঙ্গিতে শুধায়,

‘কী করেছে আমার ডার্লিং?’
তন্ময় নির্বিকার ভাবে শাসায়, ‘খবরদার এসব নামে ওকে ডাকবি না। ভাবি ডাকতে ইচ্ছে না করলে, আপু ডাক।’
রিয়ান দুষ্টু ভঙ্গিতে হেসে যাচ্ছে। নির্ভীক সে দুলে দুলে বলে, ‘এই ব্যাটা..তুই কি ডাকিস? সন্টুমন্টু? নাকি কুটুসপুটুস?’
সৈয়দ অবিশ্বাস নিয়ে মাথা দু’পাশে দুলিয়ে বলে, ‘অরুকে..অরু ব্যতীত আর কোনো নামে ও ডেকেছে কি-না আমার সন্দেহ আছে।’
শুহানি হতবিহ্বল হয়, ‘নিকনেমস আর সিম্বল ওভ লাভ। কেউ কীভাবে ভালোবেসে নানান নামে না ডেকে থাকবে?’ পরপরই তন্ময়কে আপদমস্তক দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘তন্ময়ের ক্ষেত্রে এমনটা হতেও পারে। ও যেই গম্ভীরমুখো।’
তন্ময় সিগারেট ধরা হাতটা চেয়ারের পেছনে অবলীলায় ফেলে এবারে বন্ধুদের দিকে চায়। ওদের আশ্চর্য করে বলে, ‘জান, সোনা ডেকেছি। এরপর কি বেবিগার্ল ডাকব?’
সৈয়দ বোতল থেকে একঢোক পানি খেতে নিয়েছিলো। মুখে পানি নিয়ে বেচারা হুড়মুড়িয়ে কেশে ওঠে। থতমত খাওয়া বাকিরাও হতবাক, কিংকর্তব্যবিমুঢ়! ইব্রাহিম শব্দ করে হাসছে,

‘আসলেই? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।’
হাসাহাসির এক পর্যায়ে কথাবার্তা চলে গিয়েছে গানবাজনায়। ভার্সিটিতে থাকাকালীন তাদের গানের আড্ডায় ক্যাফেটেরিয়া মুখরিত হয়নি এমন খুব কম দিনই হয়েছে। আজও, গিটারে সুর তুলল রিয়ান সেইসব স্মৃতি হাতড়ে। রিয়ান গানটা গাওয়া শেষ করেই গিটারটা তন্ময়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। আজ আর তন্ময় দ্বিমত করেনি। সুন্দরভাবে গিটারটা ধরে কিছুক্ষণ টুংটাং শব্দ তুলল। সুর তোলার চেষ্টা চালাল। একপর্যায়ে গভীর গলায় চারটা লাইন গেয়ে উঠল,

কি আবেসে তারে বারে বারে
দেখি তবু যেন মেটেনা তৃষা,
সে যে পথ চলে বুকে ঝড় তুলে
জেগে ওঠে ঘুমোনো আশা।
মাহিন ভিডিও করেছে সেই গান গাওয়ার দৃশ্যটুকু। তন্ময়ের চোখ বন্ধ। উষ্কখুষ্ক চুল, বুক খোলা শার্ট..অনুভূতির সাগরে ভাসা গম্ভীরমুখের, গভীর কণ্ঠের সুর, বৃষ্টির ধ্বনি মিলিয়ে দারুণ শোনাচ্ছিল, দেখতে লাগছিলো। মাহিন ভিডিওটা সোজা মারজিকে পাঠিয়ে দেয়। মারজি নিশ্চয়ই অরুকে পাঠিয়ে দিয়েছে! ভেবেই মাহিন হাসল। তাদের, বন্ধুদের আড্ডা চলল রাতের দুটো পর্যন্ত। তন্ময় কয়েকপলক নিজের সেলফোনের স্ক্রিনটায় চাইল। দুটো কল এসেছে ফের। এখনো ঘুমোয়নি মেয়েটা! রাতের কটা বাজছে? আজ ঘুমোতে পারছে না, হুঁ? গত তিনদিন কীভাবে থেকেছে, ঘুমিয়েছে? বান্দর! ইতোমধ্যে বন্ধুরা একেক করে বিদায় নিয়ে ফিরে যাচ্ছে বাসার উদ্দেশ্যে। তন্ময় আর মাহিন রইল শেষমেশ। এসময়ে মাহিন মিটমিট করে হেসে তন্ময়ের হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভয়েজ ম্যাসেজ ফোরওয়ার্ড করল। তন্ময় সন্দেহজনক ভাবে ভ্রু তুলে চাইলে মাহিন তাড়া দেয়,

‘শোন।’
তন্ময় ভয়েজটা ছাড়ল। একটা কল রেকর্ডিং। কলে অরু কেঁদে অস্থির। ফ্যাচফ্যাচ কণ্ঠে ফুঁপিয়ে বলে চলল একনাগাড়ে,
‘আমাকে ওভাবে সবার সামনে বকল বলেইতো আমি একটু অভিমান করেছিলাম। সিনেমাতে তো নায়করা নায়িকাদের বকলে.. নায়িকারা নায়ককে এড়িয়ে চলে কিছুদিন। পরে নায়ক পিছু পিছু ঘুরেফিরে বেড়ায় মানানোর জন্য। উনি নায়কদের মতন সুন্দর হলে কী হবে! নায়ক তো আর নয়। মানানো তো দূর, উল্টো আমার সাথে কথাই বলল না। ফিরেও তাকাল না। চলে গেল। কলও রিসিভ করেনি জানিস। আমি তোদের ওখানে এতো সুন্দর করে রেডি হয়ে গেলাম কার জন্য বল? উনার জন্যইতো। ভেবেছিলাম, আমাকে নিতে আসবে। এলো তো নাই, উল্টো বাসায় পৌঁছে দেখি আমাকে রেখে চলে যাচ্ছে। আবার ওখানে বন্ধুদের সামনে গান গাচ্ছে। নিশ্চয়ই অন্য কাউকে ভেবে গাইছে। আমাকে ওভাবে এভয়েড করে নিশ্চয়ই আমাকে ভেবে গায়নি।’

তন্ময় নিঃশব্দে হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে মাহিনও হাসল। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘বাচ্চা মেয়ের সাথে তুইও বাচ্চামি করছিস? কষ্ট পাচ্ছেতো।’
তন্ময় ফোনটা উল্টেপাল্টে ঘোরাচ্ছে। আনমনা বলল, ‘সব সহ্য করে নিতে পারব। কিন্তু ও যে এমন হঠাৎ-হঠাৎ আমাকে এভয়েড করে এটা আমি মানতে পারি না। তুই জানিস, তিনদিন আমি কতটা ছটফট করেছি? একটু ওকে শিক্ষাটা দিই। পরে পুষিয়ে দেব ভালোবেসে।’
মাহিন হেসে ফেলল। বলল, ‘ওরে বাপ্রে, ভালোবেসে? অরুর লাভারবয়।’

তন্ময় হাসল না। বরঞ্চ উঠে দাঁড়াল। বিদায় জানিয়ে ড্রাইভিং-য়ে উঠে বসল। বেরিয়ে পড়ল বাড়ির উদ্দেশ্যে। অরু সহ বাসার সবার ঘুমিয়ে থাকার কথা এতক্ষণে। অথচ বাড়িতে পৌঁছে দেখল, মোস্তফা সাহেব বসে আছেন লিভিংরুমে। মূলত ছেলের জন্যই ভদ্রলোক জেগে আছেন। তন্ময় আহত হলো। ফোড়ন কেটে প্রশ্ন করল দ্রুত গলায়,
‘তুমি জেগে আছো কেনো, বাবা? কয়টা বাজছে? শরীর খারাপ করতে চাচ্ছো আবার?’
মোস্তফা সাহেব চোখমুখ ভার করে রাখলেন, ‘খারাপ হলে তোমার জন্যই হবে। এতো রাত করে তুমিতো কখনো বাসায় ফেরো না। আজ কী হলো?’
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এগিয়ে এসে ধরে বাবার কাঁধ। তাকে রুমের দিকে নিতে নিয়ে বলে, ‘আজই। আর কখনো এতো রাত হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো।’

মোস্তফা সাহেব ছেলের কথা শুনলেন। অসন্তুষ্ট চোখে একবার চেয়ে রুমের ভেতর ঢুকলেন। তন্ময় ধরল সিঁড়ি পথ। সিঁড়ি চড়ে দোতলা উঠে এসে তাদের রুমের আধখোলা দরজাটা আলগোছে খুলে ভেতরে ঢুকল। আঁধার রুমে শুধুমাত্র টেবিলল্যাম্প মিটিমিটি জ্বলছে। অরু ঘুমিয়ে পড়েছে। তার পাশে ফায়াজ, ফাইজা নিজেদের জড়িয়ে ধরে মিষ্টি ঘুমে মগ্ন। তন্ময় বিছানার কাছে এগোয়। কোমর বেঁকিয়ে মাথা নুইয়ে নিগূঢ় দৃষ্টিতে দেখে অরুর কেঁদেকেটে ফুলিয়ে ফেলা মুখটা। রক্তিম গাল দুটোতে চোখের জলের দাগ বসেছে। ঠোঁট দুটো হয়ে আছে টকটকে লাল। তন্ময় সন্তর্পণে লোভনীয় ঠোঁটজোড়ায় নিজের ঠোঁট জোড়া ছোঁয়ায়। ছুঁইয়ে অল্প একটু সরে আসে। শক্ত করে, গভীর-দৃঢ়ভাবে ওই ঠোঁটে ডুবতে ইচ্ছে করলেও, ইচ্ছেকে সংযত করে রাখে। ভারী সন্তুষ্ট গলায় ফিসফিস করে আওড়ায়,
‘এখনই এতো কাঁদলে হবে, সোনা? তোমাকে আমার এখনো শায়েস্তা করা বাকি। সিনেমা দেখে ট্রিক্সস শেখা, হুঁ? ভালোভাবে শেখাচ্ছি।’

আজ পরিষ্কার নীলসাগরের আকাশ। খণ্ডখণ্ড মেঘ ভাসছে। পাখিরা উড়ছে। তন্ময় রাতে ভালোভাবে ঘুমোতে পারেনি। ভোরসকালে গোসল সেরে অফিস এসে পৌঁছেছে। কিছু জরুরী কাজ, আর একটা মিটিং শেষ করে বাসার জন্য রওনা হয়েছে সবেমাত্র। ঘড়ির কাটা বারোটায়। একটার মধ্যে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছাতে হবে। মাহিন ইতোমধ্যে কলের ওপর কল করে যাচ্ছে। বাসার সকলে তৈরি হয়েছে কি-না কে জানে! পৌঁছে তাকে কাপড়চোপড়ও বদলাতেও হবে। তন্ময় বাড়ির সদরদরজা দিয়ে গাড়ি ঢোকাতে নিয়েই আচমকা ওপরে চায়। অরু দাঁড়িয়ে আছে। পরনে শাড়ি। টকটকে লাল জর্জেটের শাড়ি পরেছে। ইশ, কী সুন্দর লাগছে দেখতে! অপ্সরা। তন্ময়ের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। দৃষ্টি এলোমেলো হয়। ছন্নছাড়া অনুভূতিরা। কোনোরকমে সরিয়ে এনে গাড়িটা পার্ক করে বেরোয়। আজ তার নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হবে, কঠিন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মনে হয় না সে বেশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারবে।

ফায়াজ শুভ্র রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে। মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার, ওহী সাহেবও শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি স্যাট পরেছেন। ফাইজা লাল রঙের গাউন পরেছে। চুলে দুটো ঝুটি বাঁধা। সে শাবিহার কোল বসে আছে লক্ষ্মী মেয়ের মতন। অয়ন মোস্তফা সাহেবের পাশে বসে আলাপে মশগুল। লিভিংরুমে তখন সকলেই চা-য়ের কাপে ব্যস্ত। তন্ময় প্রবেশ মাত্রই ফায়াজ ছুটে এসে পাজোড়া জড়িয়ে ধরল তার। অরু দৌড়ে এসে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েছে। বারবার চেয়ে চেয়ে ছটফট করছে। হাতে আঁচল প্যাঁচিয়ে চলেছে বারংবার। তন্ময় চোরা চোখে সবটাই দেখল। আপাতত কোথাও আর তার ধ্যান নেই। সিঁড়িতে দাঁড়ানো রমণী ব্যতীত চোখে আর কিছুই লাগছে না। মোস্তফা সাহেব বললেন,
‘যাও, তৈরি হয়ে নামো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

তন্ময় মাথা দুলিয়ে এগোয় সিঁড়ির দিকে। চোয়াল শক্ত করে, চোখমুখ খিঁচে অরুর পাশ কেটে উঠে চলে আসে। কী সুন্দর একটা স্মেল আসছে ওর গা থেকে। তন্ময় ঢোক গিলে। লাল রঙের লিপস্টিপও পরেছে। এই মেয়ে ইচ্ছে করে এভাবে সেজেগুজে এসেছে। তন্ময়ের মাথা খেতে একেবারে প্রস্তুত।
বিছানায় পাজামা-পাঞ্জাবি নামিয়ে রাখা। শুভ্র রঙের। কলার দিকে অল্প কাজ। তন্ময় সোজা পাজামা নিয়ে ওয়াশরুম ঢোকে।
শুধু পাজামা পরে, উদোম গায়ে যখন বেরিয়ে এলো…দেখল অরু দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। জড়োসড়ো হয়ে ভাব। চোখমুখ বিষণ্ণ। মেকাআপ উঠে যাবার ভয়ে বোধহয় কান্না আঁটকে রেখেছে। তন্ময় দেখেও দেখে না। সেন্ডো গেঞ্জিটা গায়ে চাপিয়ে, পাঞ্জাবিটা একটানে পরে ফেলল। অরু হাঁসফাঁস করছে। টলমলে চোখে চেয়ে অবশেষে মুখ খোলে,

‘আ-আপনি কি আমার ওপর রেগে আছেন?’
তন্ময় তখন হাত ঘড়িটা পরছিলো। আড়চোখে চাইলেও ভাণ ধরে আছে যেন শোনেওনি, দেখেওনি। অরুর চোখ বেয়ে জল গড়াল এযাত্রায়। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে কান্না গিলে এগিয়ে এসে টেনে ধরল তন্ময়ের পাঞ্জাবির একাংশ।
‘কেনো কথা বলেন না! আমি- আমি আর ওমন করবোনা তো।’
তন্ময়ের ভেতরটা গলে জল হয়ে গেল। অবাধ্য মন ধড়ফড়িয়ে বলল, এক্ষণ অরুকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তা সে করল নামস্তিষ্কের কথা শুনে নিজেকে সামলে রাখল। আরেকটু…এখনই ধরা দিলে হবে না। অগত্যা অরুকে এড়িয়ে…নিজের মতো গায়ে কোলন ছড়িয়ে নিচ্ছে। অরু এবারে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। দু’হাতে চোখ মুছে ছুটে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকাল ওর যাওয়ার পথে। পড়ে না যায় মেয়েটা! এভাবে শাড়ি পরে দৌড়ানোর মানে হয়? জুতোজোড়া পরে, ওয়ালেট, গাড়ি চাবি হাতে নিজেও বেরোল রুম ছেড়ে। ওপর থেকেই শুনতে পেলো অরুর গলা,

‘আমি যাবো না, বাবা। পেট ব্যথা করছে। ফায়াজ, ফাইজাকে দেখে রেখো।’
ফায়াজ-ফাইজা তখন মায়ের আঁচল টেনে ধরে রেখেছে। অরুকে সাথে যেতেই হবে, এমন! মোস্তফা সাহেব চিন্তিত চোখে চেয়ে বললেন,
‘কী হয়েছে, মামণি? চোখমুখ ফোলা কেনো? বেশি ব্যথা হচ্ছে? ডাক্তার ডাকাব?’
তন্ময় তখুনি নামল ধীরেসুস্থে। সে একনজর মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা অরুকে দেখল। তবে কিছুই বলল না—অরু না যেতে চাওয়া নিয়ে। উল্টো ফায়াজ, ফাইজাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘দেরি হচ্ছে, চলো।’

মোস্তফা সাহেব চোখমুখ কুঁচকে ছেলের দিকে চাইলেই, তন্ময় বেশ গোপনে ডান চোখ টিপল। পরিষ্কার বোঝাল, সবাইকে বেরিয়ে যেতে। মোস্তফা সাহেব মুহূর্তেই শুকনো কাশলেন। অসন্তুষ্ট হলেও সবাইকে তাড়া দিয়ে আনোয়ার সাহেবকে ইঙ্গিত করে বেরিয়ে গেলেন। অরু মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে এক ছুটে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল। তন্ময় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। ওদের দুজনকে গাড়ির ব্যাক সাইডে মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেবের কোলে বসিয়ে দিলো। আকাশ বসেছে ড্রাইভিং-য়ের সিটে। তন্ময় বাচ্চাদের মাথা ছুঁইয়ে মোস্তফা সাহেবকে বলল,
‘যাও, তোমরা। আমি অরুকে নিয়ে একটুপর আসছি।’
মাথা দোলালেন মোস্তফা সাহেব। ফায়াজ হাসিখুশি মুখে বলল,
‘তাড়াতাড়ি এসো, পাপা। মাম্মামকে নিয়ে এসো।’
‘ওকে। উইল ইউ বি আ গুড বয়?’

ফায়াজ মাথা দোলাল ক্রমান্বয়ে। হাত নাড়িয়ে টা-টা জানাল। তন্ময়ও হাত নাড়াল। গাড়িটা ধীরেসুস্থে সদরদরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। দারোয়ান তন্ময়ের কথায় সদরদরজা আটকে দিয়েছে। তন্ময় পুনরায় ঢুকল বাড়ির ভেতর। ফাঁকা বাড়িতে শুধু অরুর কান্নার ধ্বনির প্রতিধ্বনি তুলছে। এমন ম রা কান্না জুড়েছে যেন স্বামী মা রা গিয়েছে! তন্ময় তো দিব্যি বেঁচে আছে। বাড়ির দরজাটা আঁটকে লিভিংরুম পেরিয়ে সিঁড়ি চড়ল। নিঃশব্দে এসে হাজির হলো তাদের রুমের দরজার সামনে। দরজাটা খোলা। অরু ফ্লোরে হাঁটু জড়িয়ে বসে কাঁদছিলো। কারো ছায়া অনুভব করে চোখজোড়া তুলে চায়। তন্ময়কে দেখতে পেতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। তন্ময় রুমের ভেতরে না ঢোকার ভাণ ধরে গম্ভীরমুখে বলে,

‘আয়, দেরি হচ্ছে।’
অরুর চোখমুখ লাল। কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে রেখেছে। পরনের শাড়িটা খুব সুন্দরভাবে গায়ে মিশে আছে। ধবধবে সাদা পেটের অনেকাংশ দেখা যাচ্ছে। তন্ময় দৃষ্টি সংযত করে। অরু অস্পষ্ট কণ্ঠে আওড়ায়,
‘আমি যাবো না।’
তন্ময় নির্বিকার গলায় শুধায়, ‘কেনো যাবি না?’
অরু ডুকরে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমার সাথে কথা বলছেন না! আমি কোথাও যাবো না। কোথাও না।’
তন্ময় ডান ভ্রু নাচিয়ে বলে, ‘গত তিনদিন ধরেইতো কথা হচ্ছে না। তাতে কী?’
অরু চমকায়। আহত হয়। ঝর্ণার মতন ঝরে চোখের জল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাপড়ে অভিমানী চোখে চেয়ে রয়। পরমুহূর্তেই ছুটে এসে হামলে পড়ে তন্ময়ের প্রশস্ত বুকে। কোমর শক্ত করে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘আর কক্ষনো ওমন করবো না। কক্ষনো না। প্লিজ, এমন করবেন না আমার সাথে।’
‘আমি কী করলাম?’

অরুর চোখের জলে তন্ময়ের পাঞ্জাবির অনেকাংশ ভিজে গেছে। অরু ভাঙা কণ্ঠে আওড়ায়, ‘আপনি আমাকে বকুন, যা ইচ্ছে করুন। চুপ করে থাকবেন না, প্লিজ। আমি একদম সইতে পারি না। ম রেই যাবো। আমি আর কখনো ওমনটা করবো না।’

ব্যস, তন্ময় আর একমুহূর্ত দেরি করল না। অরুর ঘাড়টা ডান হাতে ধরে মুখটা উঁচু করেই —ওর গাঢ় লাল লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটেজোড়ায় ডুবল। সেই ডোবার গভীরতা, দৃঢ়তার ভার অরু সামলে উঠতে পারেনি। বেচারি পিছু সরে যায়। তন্ময় পাল্টা ধেয়ে এগিয়ে গিয়ে শাড়ি ভেদ করে আঁকড়ে ধরে মেয়েটার শীর্ণ, কোমল কোমর। মিশিয়ে নেয় নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে। পেছনেই শেল্ফটা। পেছাতে পেছাতে অরুর পিঠ গিয়ে ছোঁয় শেল্ফ। দু-একটা বই শব্দ করে পড়ে ফ্লোরে। সেই শব্দে অরু চমকে ওঠে চোখ খুলে চায়। তার চোখের কোণ বেয়ে তখনো জল গড়িয়ে চলেছে। দরজাটা কেমন খোলা! কম্পিত হাত দুটো এবারে তন্ময়ের বুকের পাঞ্জাবির অনেকাংশ মুঠোয় ভরে নেয়।

অস্পষ্ট আর্তনাদ করে। চুমুর এহেন গভীরতা হঠাৎ করে সইতে না পেরে মাথাটা ঘুরিয়ে ফেলতে চাইলে—তন্ময়ের ডান হাতটা অবলীলায় তার ঘাড় ফের চেপে ধরে। বাধ্য করে তার শক্তপোক্ত ঠোঁটের আক্রমণ মেনে নিতে। যখন তন্ময় শান্ত হয়, ততক্ষণে অরু দুর্বল হয়ে তার বুকে মিশে আছে। পরনের শাড়িটা অগোছালো। লিপস্টিক লেপ্টে আছে মুখের চারপাশ জুড়ে। দু’হাতে অরুর এলোমেলো চুলগুলো তন্ময় গুছিয়ে নেয়। মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে চোখের সামনে। মাথা ঝুঁকিয়ে চুমু খায় দু’চোখের পাতায়, দু-গালে, নাকের ডগায়। মৃদু তবে দৃঢ় স্বরে তন্ময় বলে,
‘আমার পৃথিবীর অর্ধেকাংশে সবাই, বাকি অর্ধেকটা জুড়ে শুধু তুই।’ তন্ময় থামে। শুধায়, ‘বুঝিস এই কথার মানে?’
অরুর ভেতরের সত্তা সহ শরীর কেঁপে ওঠে। ক্রমান্বয়ে মাথা দোলায়। তন্ময় নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে, ‘মুখে বল। কী বুঝলি?’

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৮১+৮২

অরুচোখজোড়া বুজে কম্পমান ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে ইতস্ততভাবে আওড়ায়, ‘আমাকে অনেক ভালোবাসেন।’
তন্ময় গভীর ভাবে ঘ্রাণ নেয় অরুর চুলের। বলে,
‘পৃথিবীর যেমন কোনো অবসান নেই, আমার ভালোবাসারও নেই। আমি শাহজাহান তন্ময় —তোকে তোর ভাবনার চেয়েও অতিমাত্রায় ভালোবেসেছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেসে যাবো।’

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here