শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৭
সুমাইয়া সুলতানা
আগুন একটা ক্লাস নিয়ে এসে লাইব্রেরীতে বসে আছে। আপাতত তার ক্লাস নেই। দুই ঘন্টা গ্যাপের পর আরেকটা ক্লাস আছে। কলেজের কর্মরত এক দপ্তরী এসে তাকে পানি আর বিস্কুট দিয়ে গিয়েছে। আগুন পানি ছাড়া কিছুই খায়নি। বসে বসে একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। এমন সময় অপ্রত্যাশিত একটা মুখ ভেসে উঠল। নাঈমা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। আগুন ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। ও এখানে কি করছে? কোনো কিছুই বোধগম্য হলো না। নাঈমা, আগুনের পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। সাইড ব্যাগটা টেবিলের উপরে রেখে আগুনের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” কি খবর শিকদার সাহেব? কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? ”
” তুই এখনে কি করছিস? হসপিটালে যাসনি? ”
” তুই আমাকে ইগনোর কেন করছিস বলতো? ফোন দিলে একটু কথা না বলেই তড়িঘড়ি করে কে’টে দিস। ”
” তুই আমাকে যেই যেই টাইমে ফোন করিস, সেটা কি আজও সঠিক সময় বলে তোর মনে হয়? ”
নাঈমা ন্যাকা স্বরে বলল,
” তো কি হয়েছে? তুইকি ডিস্টার্ব ফিল করিস? আমি তোকে ফোন করবো না তো কে করবে? ”
আগুন চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
” যদি বলি হ্যাঁ, ডিস্ট্রাব ফিল করছি। তবুও তো বেহায়ার মতো ফোন করা বন্ধ করবি না। আর তোর আমাকে ফোন করে খবর নেওয়ার কোনো কারণও দেখছি না। ”
” আমি এতকিছু জানি না। তোর সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। একদিন কথা না বললে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” সেটা তোর সমস্যা, আমার নয়। তোর সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। আমি একা থাকতে পছন্দ করি। তারউপর তুই যেসব টাইমে ফোন করিস জাস্ট বিরক্তিকর। ”
আগুনের কথায় নাঈমার কোনো ভাবান্তর হলো না। বেশ মহোনীয় কন্ঠে বলে উঠলো,
” তোর একাকিত্ব ঘুচিয়ে দিতে চাই। আমি সারাজীবনের জন্য তোর একাকিত্ব দূর করে দিতে চাই। দিবি কি সেই সুযোগ? ”
আগুন হাতে থাকা খোলা বইটা বন্ধ করে ফেলে। নাঈমার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” হুটহাট আমার কলেজে চলে আসবি না। কলিগরা দেখলে বিষয়টা খারাপ ভাবে দেখবে। খোশগল্প করার জন্য তোর কাছে অনেক সময় থাকলেও আমার কাছে নেই। ফ্রি থাকলে অন্য সময় গল্প করবো। আমার একটা ক্লাস আছে। আমাকে যেতে হবে। তুই এখন আসতে পারিস। ”
” তোর ঠিক আমাকে কি মনে হয়? বাজারের কোনো সস্তা পণ্য? কেন এভাবে বারবার তোর কাছে ছুটে আসি তুই বুঝতে পারছিস না? ”
আগুন বুঝেও না বুঝার ভান করে বলল,
” ঠিক কি মনে হাওয়ার কথা বলছিস? তাছাড়া তুই আমার ফ্রেন্ড। একজন ফ্রেন্ড আরেকজন ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে আসতেই পারে। তোর মতো আরো অনেকজন মেয়ে ফ্রেন্ড আছে আমার। ”
নাঈমার কিছু কড়া কথা শোনাতে ইচ্ছে করল। নিজেকে সামলে ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলল,
” বাদ দে। তা শোনলাম তোদের কলেজ থেকে নাকি কিছু দিনের মধ্যে একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করা হবে। বলতে গেলে, বড়সর একটা পার্টির আয়োজন করা হবে। কলেজের সকল টিচার্সরা থাকবেন মেবি। তুইও কি তাদের সাথে এটেন্ড করবি? আই মিন, তারা যেখানে যাবে তুইও কি যাবি? ”
” আমি যাবো বা না যাবো সেটা জেনে তোর কি কাজ? তুই তো সেখানে যেতে পারবি না। কোনো ফ্রেন্ড এলাউড না। জাস্ট বউ থাকলে তাকে নেওয়া যাবে। ”
” জেনে কি কাজ সেটা আমারটা আমি বুঝে নিবো। তুই শুধু বল তুই যাবি কি না? ”
আগুন গা ছাড়া ভাবে বলল,
” বলতে বাধ্য নই। যখন কারটা তখন ভেবে দেখা যাবে। আমার ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছে। আসছি। ”
আগুন চলে গেল। নাঈমার রাগ হলো খুব। আগুনের ইগনোর করাতেও বেশ গায়ে লাগলো। এভাবে কেউ কাউকে বলে? ওর মতো এত সুন্দর একজন মেয়েকে রীতিমতো ইগনোর করছে সে। বিষয়টা সত্যি হতাশা-জনক। আগুন কেন এমন করছে? সে কি বুঝতে পারছে নাঈমা তাকে ভালোবাসে। নাঈমা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আগুন এসে দেখলে আবার যদি উল্টা পাল্টা কিছু বলে বসে? সেটা কেউ দেখতে পেলে মানস্মানের হালুয়া হেয়ে যাবে। তাকে হসপিটালে ফিরতে হবে। রুগী দেখা বাদ দিয়ে নির্দয় আগুনের সাথে দেখা করার জন্য এসেছিল। বিনিময়ে কি পেল? তিরস্কার!
” মোম, তোমার মা ফোন করেছে কথা বলো। ”
মিনা কল রিসিভ করে মোমের নিকট ফোনটা এগিয়ে দিলেন। মোমের হাতে ফোন দিয়ে তিনি চলে যান। মোম ফোন কানে নিল কিছুু বলছে না। ওর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে অনেক। ওপাশ থেকে আতিফা বানু মোলায়েম কন্ঠে ডেকে উঠলেন,
” মোম! ভালো আছিস মা? কি করছিস? সকালে খেয়ে ছিলি? ”
মোম কান্না মিশ্রীত কন্ঠে বলল,
” তোমাদের খুব মনে পড়ে মা। আমার এখানে মন টিকছে না। তারউপর উনি এখন ওনার ফ্ল্যাটে চলে যেতে চান। সেখানে গেলে তো আমি আরও একা হয়ে যাবে। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। ”
” হ্যাঁ, শুনেছিলাম। রাশেদ ভাই ফোন করে জানিয়ে ছিলেন। শোন মা, জামাই যেখানে থাকবে তোকেও তার সাথেই থাকতে হবে। মন খারাপ করিস না। ”
” বাবা কোথায়? তার শরীর ঠিক আছে? মুনিয়া কি করছে? স্কুলে নাকি বাড়িতে? ”
” না, মুনিয়া স্কুলে যায়নি। মেয়েটা যা অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। কোনো কথা শোনে না আমার। ঘরে নেই এখন। পাড়ার মেয়েদের সাথে খেলতে চলে গিয়েছে কোথাও। তোর বাবা একদম ঠিক আছে। ঘুমাচ্ছেন তিনি। দুপুরে খাওয়ার পর কড়া ডোজের ঔষধ খেয়েছে তো সাথে ঘুমের ঔষধ। তাই অল্প সময়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। ”
মোম আরও কিছুক্ষণ তার মায়ের সাথে কথা বলে ফোন কে’টে দিয়েছে। মায়ের সাথে কথা বলতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু এখন মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। মোম শ্বাশুরীর কাছে গিয়ে ফোনটা দিয়ে আসে। ফিরে আসার সময় মিনা তাকে ডেকে উঠেন,
” মোম শোন? ”
মোম তাকায় শ্বাশুরীর দিকে। মিনা, মোমের কাছাকাছি এসে মাথায় একটা হাত রেখে নরম কন্ঠে শুধায়,
” আজকে চলে যাবে বলে মন খারাপ? নাকি বাড়ির কথা মনে পড়ছে? ”
মোম কিছু বলছে না। মিনা পুনরায় বললেন,
” বোকা মেয়ে। একদম মন খারাপ করবে না। বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করলে আগুনকে বললে সে ছুটি পেলেই নিয়ে যাবে। আর আগুনের সাথে ওর ফ্ল্যাটে একা যাওয়া নিয়ে টেনশন করারও দরকার নেই। আমি যাবো অথবা সেলিনাকে তোমাদের সাথে পাঠাবো। গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসবো। তোমার কাছে তো সবকিছু নতুন মনে হবে। চিন্তা করোনা। আমি যতদিন থাকবো তোমাকে যতটুকু সম্ভব শিখিয়ে দিয়ে আসবো। ”
এতক্ষণ মনটা খারাপ লাগলেও মিনা তাদের সাথে যাবেন বলে খুশি হলো সে।
” সেলিনা আপা না, আপনি চলুন আমাদের সাথে। ”
” দেখি। ”
” আমি কিছু শোনবো না। আপনাকে যেতেই হবে। ”
” আচ্ছা। ”
” ময়ূরী আপুকেও আমাদের সাথে নিয়ে যাবো, মা। ”
” ও কিভাবে যাবে? ওর তো ক্লাস আছে। এমনিতেই কালকে একদিনের জন্য ছুটি নিয়ে ছিল। ময়ূরী অন্য সময় যাবে। আপাতত তোমাদের সাথে আমি যাবো। ”
মোম মায়া মায়া চোখে মিনার দিকে চেয়ে বলল,
” আপনি আমাদের সাথে গেলে বাবা আছেন, আয়মান ভাইয়া, ময়ূরী আপু ওদের দেখবে কে? ”
মিনা হাসেন। ছোট হলে কি হবে? সবদিকে নজর আছে পিচ্চি বউ মা’র।
” ওদের নিয়ে ভাবতে হবে না। সেলিনা আছে। ওদের কোনো অসুবিধা হবে না। ময়ূরীও হাতে হাতে সেলিনাকে সাহায্য করে দিবে। তাছাড়া আমি দুই দিনের বেশি থাকবো না। ”
” একি? তুমি এখনো তৈরী হওনি? একটা কথা কতবার বলা লাগে তোমাকে? জলদি করো। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ”
গম্ভীর কন্ঠে কথা গুলো বলল, আগুন। কলেজ থেকে ফিরে পইপই করে বলে দিয়েছে বিকালে তারা ফ্ল্যাটে ফিরে যাবে। মোম যেন রেডি হয়ে থাকে। অথচ, এই মেয়ে এখনো রেডি হয়নি। আগুন মায়ের কাছে গেল। এক্ষুনিতো চলে যাবে। মাকে বলে আসা দরকার। মায়ের রুমের দরজায় টোকা দিতেই মিনা দরজা খোলে দিলেন। আগুন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মিনা নতুন শাড়ি পড়েছে। আগুন চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি কোথাও যাচ্ছ নাকি? ”
মিনা শাড়ির কুঁচি গুলো আরেক বার হাত দিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে নিতে জবাব দিলেন,
” যাচ্ছি তো। ”
” কোথায়? ”
” তোদের সাথে। ”
অবাক হয়নি আগুন। সে মনে মনে ভেবেই নিয়ে ছিল তাদের সাথে হয়তো মা যাবেন বা ময়ূরীকে তাদের সঙ্গে পাঠাবে।
” আমাকে তো বলোনি। ”
” মনে ছিল না। চল যাওয়া যাক। মোম কোথায়? ”
” রেডি হচ্ছে। দেখো কতদিন লাগে তোমার আদরের বউমার তৈরী হতে। ”
আগুনের মুখে বিরক্তির ছাপ। আগুন ফোন বের করে একটা পরিচিত নাম্বারে ডায়াল করল। মিনা আগুনের রুমে চলে গেলেন। গিয়ে দেখেন ময়ূরী মোমকে রেডি করিয়ে দিচ্ছে। মোম শাড়ি পড়তে চেয়েছিল। মিনা না করে দিয়েছেন। মেয়েটা শাড়ি পড়ায় অভ্যস্ত নয়। শুধু শুধু মেয়েটাকে হয়রানি করে কি লাভ? তাই ভালো দেখে ডিজাইনার একটা থ্রি পিছ পড়েছে। জামাটাতে ছোট ছোট পাথরের কাজ করা। ময়ূরী সুন্দর করে মোমকে হিজাব পড়িয়ে দিয়েছে। আজকে মোমকে দেখতে অন্য রকম সুন্দর লাগছে। এরই মধ্যে আগুনের চিৎকার ভেসে আসছে। নিচে যাওয়ার জন্য তারা দিচ্ছে। আয়মান তাদের লাগেজ গুলো গাড়ির ডিকিতে তুলে দিয়ে আসলো। মিনা, মোমকে নিয়ে গাড়ির কাছে চলে আসলেন। যেতে যেতে মোমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” আমার বড় ছেলেটা যতটা পছন্দের ততটা ভয়েরও। এত ব’দ মেজাজি ছেলে দুটো দেখিনি। সকল কাজ তার টাইম টু টাইম হওয়া চাই। চাই মানে চাই। কোনো কাজে দেরি সহ্য হয় না। মুহূর্তেই রেগে বো’ম হয়ে যায়। ”
মিনা, মোমকে নিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়েছেন। আগুন গিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসেছে। সে মোমকে এখনো খেয়াল করেনি। ঠোঁট দুটো চোঁখা করে নিজের মতো ফোন টিপছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মোম ডাগড় ডাগড় নয়ন জোড়া ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে চারপাশ দেখছে। মোমের ভীষন আনন্দ হচ্ছে। অপাশের গাড়ি গুলো জ্যামে আটকে যাওয়ার কারণে সব গুলো প্রাইভেট কার সাড়িবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে আছে। বিষয়টা মোমের কাছে ভালো লাগছে দেখতে। গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গিয়েছে। আগুন ভ্রু কুঁচকে ড্রাইভারের দিকে তাকায়। প্রচন্ড গরম পড়েছে। আর এ এখন গাড়ি থামিয়ে নাইট শো দেখছে নাকি? ধমকে বলল,
” গাড়ি থামিয়েছেন কেন? ”
” দেখছেন না, জ্যাম পড়েছে। আমার কি দোষ? ”
আগুন দেখলো তাদের লাইনেও জ্যাম পড়েছে। বিরক্তিতে নাক, মুখ কুঁচকে ফেললো। জ্যাম লাগার সময় পেলো না! মাথা উঠিয়ে লুকিং গ্লাসে নজর পরতেই চোড়া চোখে একবার পেছনে ফিরে তাকাল। মিনা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে আছেন। মোম বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা যাই পড়ে তাতেই মানায়। এইযে থ্রি পিছের সাথে হিজাব পড়েছে। মাথায় হিজাবের উপর গোল সাদা পাথরের কি যেন লাগিয়েছে।
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৬
হয়তো সিফটিফিন। রৌদ্রের আলোতে ঝলমল করছে। মুখে তেমন সাজ নেই। চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপিস্টিক। এতেই কত সু্ন্দর লাগছে। নাকি তার চোখেই মোমকে এতটা ভালো লাগছে? উত্তর জানা নেই আগুনের। মুখটা ঘুরিয়ে সামনে তাকাল। নজর তার লুকিং গ্লাসে। সেটাতে মোমের মুখশ্রী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ বিরক্ত লাগলেও এখন তেমনটা লাগছে না। হাতের ফোনটা নাড়াচাড়া করছে আর চুপিচুপি গাড়ির সম্মুখের আয়না দিয়ে মোমকে দেখছে।