শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১২

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১২
সুমাইয়া সুলতানা

রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। আগুন দু’ হাতে মাথা চেপে শোয়া থেকে ওঠে বসে। কালকে অনেক রাত করে ঘুমিয়ে ছিল। বাড়িতে থাকতে রাত জাগলে মিনা কফি বানিয়ে দিয়ে যেতেন। ফ্ল্যাটে আসার পর মাঝে মাঝে নিজে বানিয়ে খায়। গতকাল রাতেও তার কফির প্রয়োজন ছিল। মোমকে একবার বলতে চেয়েছিল কফি বানিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে বলেনি। কারণ, মোম তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল।

অলসতার জন্য আগুনেরও বানাতে ইচ্ছে করেনি। চোখ দুটো কচলে বিছানা থেকে নেমে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। মোম কোমড়ে ওড়না বেঁধে সকালের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরী করছে। ডাল দিয়ে আলু ভাজি রান্না করছে। কড়াই থেকে ঢাকনা সরিয়ে ভাজি নামিয়ে বাটিতে ঢেলে নিলো। ডাল দিয়ে আলু ভাজি মোমের খুব পছন্দ। কয়েকদিন ধরে রুটি দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছিল। সেজন্য আজকে রান্না করেছে। চুলায় তাওয়া টা বসিয়ে দিলো গরম হওয়ার জন্য। এখন রুটি গুলো ছেঁকে নিবে। আগুন রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বুকে দুই হাত গুজে মোমের কাজকর্ম দেখছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মোম তাওয়া থেকে শেষ রুটি টা নামানোর সময় গরম তাওয়ার এক পাশে হাত লেগে কিঞ্চিৎ পুড়ে গেল। এটাকে ঠিক পোড়া বলে না। অনেকটা ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো। মোম হাত ধরে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। ইতোমধ্যে চোখে পানি চলে এসেছে। আর্তনাদ শুনে আগুন দ্রুত মোমের কাছে আসলো। ডান হাতের তালু’সহ কবজি পর্যন্ত লাল হয়ে আছে। এখনো ফোসকা পড়েনি। তবে ফোসকা পড়তে কতক্ষণ? আগুন হাতটা ভেসিনে নিয়ে পানি ছেড়ে সেখানে ধরল। মোমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। হাতে ভীষণ জ্বালা করছে। আগুন চট জলদি ফ্রিজ থেকে বরফ এনে পোড়া স্থানে আলতো করে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” সবকিছুতে পাকনামি না করলে হয় না? কে বলেছিল তোমাকে ব্রেকফাস্ট তৈরী করতে আসতে? আমি বলেছিলাম? বারবার নিষেধ করেছি তোমাকে রান্নার কোনো কাজ করতে হবে না। প্রয়োজনে বাইরের খাবার খাবো। শুনলে না আমার কথা। রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়লো কার? তোমারিই তো! হাত পুড়ে এখন কষ্ট কে পাচ্ছে? আমি না তুমি, হুম?
মোম ঠোঁট উল্টে কেঁদে বলল,

” আমার কি দোষ? আমি কি ইচ্ছে করে হাত পুড়েছি নাকি? এগুলো তো নতুন না। বাড়িতে থাকতে তো আমি রান্না করেছি, রুটিও বানিয়ে ছিলাম। আমার অভ্যাস আছে। কিন্তু আজকে যে হাতে ছ্যাঁকা লেগে যাবে বুঝতে পারিনি। ”
আগুন ধমকে বলে উঠলো,
” শাট আপ! বেশি পকড় পকড় আমার পছন্দ না। আমার কথা শুনলে আজকে এরকম হতো না। বাচ্চা একটা মেয়ে। যে সামান্য শাড়ি ঠিক করে সামলাতে পারে না, সে নাকি পুরো সংসারের দয়িত্ব সামলাবে! ”
মোম শুকনো ঢোক গিললো। মিনমিন করে বলল,

” বোকছেন কেন? আচ্ছা, আর হবে না। এখন থেকে সাবধানে কাজ করবো। ”
আগুন কিছু বললো না। চুলা অফ করে মোম’কে নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে দিলো। রুমে গিয়ে ফার্স্ট-এইড বক্স নিয়ে আসলো। ক্ষত স্থানে আলতো করে মলম লাগিয়ে দিলো। মোমের হাতে এখন কিছুটা জ্বালা কমেছে। বরফ দেওয়াতে বেশ আরাম পেয়েছে। আগুন শাসিয়ে বলল,
” একদম চুপ করে বসে থাকবে। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কোথাও যাবে না। ”
” কোথায় যাবেন আপনি? আপনি ফিরে আসলে যেতে পারবো? ”

আগুন চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মোম দমে গেল। বুঝতে পেরেছে, আগুন রেগে যাচ্ছে। সেজন্য চুপ করে রইল। আগুন রান্নাঘরে এসে একটা প্লেটের মধ্যে রুটি আর ভাজি নিয়ে পুনরায় ড্রয়িংরুমে ফিরে আসলো। রুটি ছিড়ে তাঁতে ভাজি নিয়ে মোমের মুখের সামনে ধরলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” হা করো? নিজের হাতে তো খেতে পারবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ”

মোম কোনো কথা বাড়ালো না। চুপটি করে খেয়ে নিলো। কিছু বললেই এখন ফ্রিতে ধমক খেতে হবে। ধমক খাওয়ার থেকে আগুনের হাতে রুটি খাওয়া ঢেরবেশি ভালো। আগুন খাবার খাইয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিজের হাতেই মোম’কে পানি পান করিয়ে, সাথে একটা ব্যথার মেডিসিন খাইয়ে দিলো। হাত বাড়িয়ে মোমের ভেজা ঠোঁট মুছে দিলো। আগুনের ছোঁয়ায় মোম মৃদু কেঁপে উঠল। মোম বলে উঠলো,
” আপনি তো কলেজে চলে যাবেন। যান, নাস্তা করে নিন। ”
” আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। ”

মোম বার কয়েক পলক ঝাপটে, গোল গোল চোখে চেয়ে বলল,
” আপনার কথা আমি ভাববো না তো কে ভাববে?আমি তো আপনার বউ। আপনার জন্য এখন থেকে বেশি চিন্তা তো আমিই করবো। তাই না? ”
আগুন জবাব দিলো না। অন্য দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসলো। মোমের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রাশভারী কন্ঠে বলল,

” রুটি গুলো তো খুব সুন্দর করে বানিয়েছ। ভালোই গোল হয়েছে। ”
আগুনের থেকে প্রসংশা শুনে মোমের মন’টা খুশিতে নেচে উঠল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
” অনেক দিন পর বানিয়েছি বলে তেমন গোল হয়নি। নয়তো আমি আরো গোল করে রুটি বেলতে পারি। আপনি খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে। ”
পরমুহূর্তেই মুখটা গোমড়া করে বলল,
” শুধু রুটি খাবেন কি করে? আমি তো আপনার জন্য কিছু করতেই পারলাম না। তার আগেই হাত পুড়িয়ে ফেললাম। ”
” ব্যাপার না। ভাজি আছে তো। আমি ম্যানেজ করে নিবো। ”
মোম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি ডাল দিয়ে আলু ভাজি খান? ”
আগুন ফিচেল হেসে বলল,
” হুম। ”

” তাহলে জলদি খেয়ে নিন। কলেজের দেরি হয়ে যাবে তো। আর দয়া করে বাইরের থেকে খাবার অর্ডার করবেন না। বাইরের খাবার খেতে ভালো লাগে না। আমি কষ্ট করে দুপুরে রান্না করে নিবো। অসুবিধা হবে না। ”
আগুন ধমকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” মুখটা একটু কম চালাতে পারো না? এমনিতে যখন কথা বলতে বলি তখন কিছু বলো না। চুপ করে থাকো। আর অন্য সময় তো কথা বলতে নিষেধ করলে বেশি করে বলো। ”
মোম গাল ফুলিয়ে বসে রইল। এই লোকটা এমন কেন? ওনার মেজাজ কি সবসময় নাকের ডগায় থাকে নাকি? সারাক্ষণ শুধু ধমক দেয়। মোম মনেমনে ভেঙচি কা’টে।

আয়মানের ভার্সিটির পেছনের গেইটের বাম দিকে একটা পুকুর আছে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। বসার জন্য সিমেন্টের তৈরী চার-পাঁচটা বেঞ্চের মতো রয়েছে। অনেক গুলো গাছপালা আছে। গাছের ছায়ায় পরিবেশটা হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব । ব্রেক টাইমে স্টুডেন্ট’রা এখানে এসে আড্ডা দেয়। স্টুডেন্ট ছাড়াও আরো অনেক মানুষ আসে, এখানে সময় কাটানোর জন্য। আয়মানের গার্লফ্রেন্ড মাইশা, পুকুর পাড় দাঁড়িয়ে আছে। বারবার ঘড়ির দিকে নজর বুলাচ্ছে। হয়তো কারো আসার জন্য অপেক্ষা করছে। আয়মান আজকে ভার্সিটিতে না গিয়ে সরাসরি এই পুকুর পাড়ে চলে এসেছে। আজকে ওর প্রথম ক্লাস ইংরেজী। ইংরেজী স্যারের ক্লাস করতে ওর একদম ভালো লাগে না। ব্যাটা ক্লাসের ল্যাকচারের থেকে আ’জাইরা ল্যাকচার বলে বেশি। সেজন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল, আজকে ইংরেজী ক্লাস করবে না। পুকুর পাড়ে এসে মাইশা কে দেখে খুশি হয়ে গেল। কোনো আওয়াজ না করে চুপি চুপি মাইশার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাইশার চোখ দুটো চেপে ধরলো। মাইশা নিজের চোখের উপরে কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই মৃদু চেঁচিয়ে বলল,

” রিমন প্লিজ, আজকে তুমি চলে যাও। আমার হবু বর আমার সাথে দেখা করতে আসবে। সে এসে আমাদের এক সাথে দেখলে ভুল বুঝবে। ”
আয়মান, মাইশার চোখ থেকে নিজের হাত সরায়নি। আর না নিজে মাইশার থেকে সরেছে। ও চুপ করে আছে। মাইশা বিরক্ত হয়ে চোখ থেকে হাত সরিয়ে পেছন ফিরতে ফিরতে ত্যাজি কন্ঠে বলে উঠলো,
” এ্যাই! আমি কতবার বললাম, চলে যাও। কথা কেন শুনছো না? ছ্যাঁচরা মানুষের মতো আমার পিছে পড়ে আছো। তোমার জন্য যদি আমার হবু বর আমাকে ভুল বুঝে না, দেখো তোমার কি হাল করি। আম…..। ”
বাকিটা বলতে পারলো না। আয়মান’কে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায় তার দিকে। শুষ্ক ঢোক গিলে বলল,
” আ…আয়মান, তুমি? ”

আয়মান একটা হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের আঙুল ফুটাতে ফুটাতে বলল,
” অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি? তা রিমন কে? নতুন মুরগী নাকি? আবার হবু বর? ওয়ান্ডারফুল! এক সাথে এতজন’কে কিভাবে সামলাও, জান? ”
” আয়মান, আমার কথাটা শোন। একটু সময় দাও। আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি। ”
আয়মান রক্ত’চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বলল,
” চুপ শা’লি। আর একটা কথা বললে থাপড়িয়ে তোর মুখের নকশা বদলে দিবো। তোর বিয়ে হচ্ছে, আমাকে একবার বলতে পারতি। আমি কি নিষেধ করতাম নাকি? তোর জন্য সেদিন গুল্টে কাকুর সাথে ঝগড়া হয়েছে। তারপর থেকেই ওনার মেয়ে আমার ফোন ধরছে না। শা’লি নিজে তো গেলি, সাথে আমার ওইটাকেও হাত ছাড়া করালি। তোকে আমি ক্ষমা করবো না। ”

মাইশা হাত জোড় করে বলল,
” আয়মান প্লিজ, তুমি রাগ করো না। আর তুমি আমাকে তুই তুকারি কেন করছো? আমি এই বিয়ে করবো না। বিয়ে করলে তোমাকেই করবো। বিয়ের পর তুমি আমাকে একই রকম ভাবো ভালোবাসবে তো? ”
আয়মান গাছের পাতা ছিড়ে সুর টেনে বলল,
” কেন নয়? বিবাহিত মেয়েদের আমার খুব ভালো লাগে। তোকে তুই বলছি সেজন্য তোর উচিত আমাকে সালাম করা। আমার তো তোকে আরো অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করছে, সোনা। ”
” বুঝলাম না? ”

” মানে, তোর বিয়ে আমার সাথে হোক বা অন্য কারোর সাথে আমি তোকে সবসমই ভালোবাসবো। তবে একটা বিষয়ে আমি কনফিউজড। ”
” কোন বিষয়ে? ”
” এটাই যে, আমি তোকে আজো কখনো ভালোবেসেছি কি না! ”
” তু….। ”

” আর একটা কথা বললে, তোর হবু বরের সামনে তোর ইজ্জতের হালুয়া বানিয়ে ছাড়বো। লাস্ট কথা, তুই আর কোনো দিন আমার সামনে আসবি না। যদি কখনো ভুলেও আমার সামনে আসিস তাহলে তোকে গুল্টে কাকুর একজন ভাতিজা আছে না, ম’দখোর? তার সাথে তোকে বিয়ে দিয়ে দিবো। তুই খুব ভালো করেই জানিস আয়মান কি করতে পারে। আউট। চোখের সামনে থেকে দূর হ। ”

মাইশা ভয়ে ঢোক গিললো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আয়মান পুনরায় ডেকে আদেশের স্বরে বলল,
” ওই শোন। তোর একটা ছোট বোন আছে না? ক্লাস সেভেন এ পড়ে। ওর সাথে আমাকে লাইন করিয়ে দিস তো। সেদিন দেখে ছিলাম স্কুল ফাঁকি দিয়ে একজন ছেলের সাথে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিল। ওই ছেলের থেকে আমি কম হ্যান্ডসাম নাকি? ছেলেটার কোলের উপর বসে আইসক্রীম খাচ্ছিলো। আহা! দেখতে কি রোমান্টিক লাগছিল রে। মনেমনে হবু বউ’কে খুব মিস করেছিলাম। যা বললাম মনে থাকবে তো? ”
মাইশা মেকি হেসে দু দিকে মাথা নাড়ালো। আয়মান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” তাহলে এখনো, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা শা’লি, ভাগ এখান থেকে। ”

মাইশা কাচুমাচু হয়ে দৌড়ে আয়মানের সামনে থেকে চলে গেল। ভেবেছিল আয়মান’কে পটিয়ে ওর বাবার বিশাল সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে। কিন্তু ফাটা কপাল! সেটা সম্ভব হলো না। আর হবেও না। আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠে ছিল, কে জানে? মাইশা সেখান থেকে চলে গেলে, আয়মান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিমেন্টের তৈরী বেঞ্চের উপর বসে পড়ল। পুকুরের হালকা ঢেউ খেলানো পানির দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল,

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১১

” ডিয়ার হবু বউ, কোথায় তুমি? তোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না তো! তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। মাইরি, সত্যি বলছি। তুমি আসলে আমি পিউর সিঙ্গেল হয়ে যাবো। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৩