শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৭
সুমাইয়া সুলতানা
আঁকাবাকা কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে ছন্নছাড়া মানুষের মতো হেঁটে চলেছে এক নারী। বুকে তার অসহ্য যন্ত্রণা। দিকশূন্য হয়ে কোন দিকে যাচ্ছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। নেই কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য। হাঁটতে হাঁটতে বড়সড় এক ঝিলের কাছে এসে থামলো। জায়গাটা অতন্ত্য নিরিবিলি। আশেপাশে কোনো মানুষ নজরে আসছে না। ঝিলের আইল গুলোতে বিভিন্ন ধরনের ফল গাছ লাগানো। গাছ গুলো খুবই ছোট ছোট। দেখে মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে লাগানো হয়েছে। ঝিলটিও দেখতে নতুন মনে হচ্ছে। ঝিলটির এক পাশে অল্প বিস্তার জায়গা নিয়ে সবজির বাগান রয়েছে।
সবজি গাছ গুলো নিজস্ব শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়ে চারপাশে বেড়া দেওয়া নেটের জাল আঁকড়ে ধরেছে। ঝিলের মধ্যে থাকা স্বচ্ছ পানিতে কিছু সংখ্যক মাছ ভেসে ওঠে লাফিয়ে লাফিয়ে পুনরায় স্বচ্ছ পানির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। ঝিলের এক পাশে দাঁড়িয়ে এ’সকল বিষয় গুলো অবলোকন করে চলেছে, নাঈমা। কয়েক কদম এগিয়ে মাঝারি সাইজের কিঞ্চিৎ বাঁকানো একটা নারিকেল গাছের সামনে এসে দাঁড়ায়। গাছটির সাথে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। লম্বা শ্বাস টেনে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। মুহূর্তেই অক্ষিকোটর ভরে উঠে জলে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আগুনের মুখ। কানে বাজতে থাকে আগুনের বলা সেই তিক্ত, যন্ত্রণাদায়ক বাক্য। নাঈমা সহ্য করতে পারছে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছুতেই পারছে না। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। বুকটা পুড়ছে। বুকের মধ্যে আগুন নামক বেঈমানের জন্য আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। নাঈমা চোখ খুলে উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। দু’ হাতে মাথার চুল গুলো মুঠো করে খামচে ধরে। ঠাস করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল নিচে। একটা গাছের শিকর হাঁটুর নিচে পড়ায় বেশ ব্যথা পেলো। নাঈমা পাত্তা দিলো না। বুকের ভেতর যেই ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে তার কাছে এই ব্যথা নিতান্তই তুচ্ছ। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। জোরে জোরে শ্বাস টেনে কান্না মিশ্রিত গলায় ক্রোধ নিয়ে বলে উঠলো,
” তুই কেন আমাকে বুঝতে পারলি না, আগুন? আমি কি দেখতে খুব খারাপ? আমি কি দেখতে অসুন্দরী? কেন আমাকে ভালোবাসলি না? কেন আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করলি? কেন আমার বুকের গহ্বরে খোদাইকৃত তোর নামটা দেখতে পারলি না? কেন এই ভাবে আমাকে কষ্ট দিলি? ”
নাঈমা চিৎকার করে কান্না করছে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে আগুনের বিরুদ্ধে কত-শত অভিযোগ জানাচ্ছে। তক্ষুনি ধীর গতিতে এগিয়ে এসে কেউ নাঈমার পেছনে দাঁড়াল। আগুন্তকঃ একটা হাত নাঈমার কাঁধে রেখে মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
” একি ডক্টর নাঈমা! আপনি হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে আছেন কেন? এভাবে বসে থাকলে পা ব্যথা করবে। উঠুন। ”
নাঈমা চমকে উঠে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে আগুন্তকঃ কে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” মিস্টার রাফি, আগুনের কলিগ রাইট? আপনি এখানে কি করছেন? ”
রাফি কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
” মাঝে মাঝেই আসি এই দিকে। নতুন ঝিল কাটা হয়েছে ভাবলাম এসে দেখে যাই। এসে ভালোই হলো। আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল। ”
নাঈমা কিছু না বলে চলে যাওয়ার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়। রাফি পেছন থেকে হাত টেনে ধরে। নাঈমা চোয়াল শক্ত করে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়। রাফি হাত ছেড়ে দেয়। মেকি হেসে বলল,
” সরি। এক্ষুনি চলে যাচ্ছেন কেন? চলুন, ওইদিকে কিছুক্ষণ বসে গল্প করি। ”
নাঈমা ঝাঁঝাল গলায় বলল,
” আমার গল্প করার মুড নেই। ”
” আপনারা চোখ, মুখ কেমন শুকনো লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে কান্না করেছেন। আপনি কি সত্যি কান্না করছিলেন? ”
নাঈমা এদিক ওদিক নজর ফেরায়। নিজের দুর্বলতা কখনো কাউকে দেখাতে ইচ্ছুক নয় সে। লম্বা শ্বাস টেনে ভারিক্কি গলায় বলল,
” তেমন কিছু না। মন, মেজাজ ভালো নেই। তাই মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য এখানে এসেছি। ”
রাফি গভীর দৃষ্টিতে নাঈমার দিকে চেয়ে বলল,
” ভালো। তবে আমি চাই আপনি আরো কাঁদুন। কাঁদতে কাঁদতে চোখ, মুখ লাল করে ফেলুন। ”
নাঈমা কপাল কুঁচকে ফেলল। রাশভারী কন্ঠে বলে উঠলো,
” সিরিয়াসলি! আপনি চান আমি যেন কান্না করি? কেন চান শুনি? ”
রাফি মুচকি হেসে জবাব দিল,
” কান্না করলে যে আপনাকে কতটা সুন্দর লাগে সেটা আপনি হয়তো নিজেও জানেন না। ফোলা ফোলা চোখ, হালকা লাল হয়ে যাওয়া উঁচু নাক, যখন চোখের পানি কণা গুলো থুতনিতে এসে জমা হয়? তখন দেখতে কি মিষ্টি লাগে আপনাকে। ”
নাঈমা ভ্রু কুঁচকে চওড়া গলায় বলল,
” এভাবে কাঁদতে আপনি আমায় কখনো দেখেছেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” কোথায় দেখেছেন? কবে দেখেছেন? ”
রাফি মৃদু হাসলো। মোহনীয় কন্ঠে বলল,
” রোজ দেখি। তবে সেটা আমার কল্পনায়। ”
” আপনি আমাকে কল্পনা কেন করেন? ”
” ভালো লাগে তাই। ”
নাঈমার মেজাজ খারাপ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” আপনার কেন আমাকে ভালো লাগে? ভালো লাগার তো কোনো কারণ দেখছি না। ”
” কোনো কারণ ছাড়াই আমার আপনাকে ভালো লাগে। কেন লাগে সেটার কারণ আমি নিজেও জানি না। ”
” অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!
বিনিময়ে রাফি মুচকি হাসলো। নাঈমা ফের হতাশ কন্ঠে বলল,
” আপনার আমাকে ভালো লাগে তাও কোনো কারণ ছাড়াই। অথচ, যার চোখে ভালো হতে চাইলাম, যাকে নিজের সবটা ভাবতাম সেই পাষাণ মানুষ টাই আমাকে বুঝলো না। ”
রাফি বুঝতে পারলো না। কন্ঠ খাদে এনে প্রশ্ন করলো,
” কার কথা বলছেন? কে সেই মানুষটা যে আপনার মতো সুন্দরী রমণীকে প্রত্যাখ্যান করে? ”
নাঈমা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
” আছে এমন একজন। যার কাছে আমার অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। বেঈমান একটা। ”
রাফির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে পুনরায় বলল,
” আমি সুন্দর? আমি সুন্দর হলে সেই পাষাণ মানুষটা কেন আমাকে গ্রহণ করল না? ”
” সেটা আমি কিভাবে জানবো? সবার তো ভালো লাগা এক না। সবার সবকিছু ভালোও লাগে না। ”
নাঈমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রাফি ফিচেল গলায় বলল,
” ঝিল কি সম্পূর্ণভাবে ঘুরে দেখেছেন? দেখে থাকলে চলুন বাড়ি ফেরা যাক। ”
” না, সম্পূর্ণটা ঘুরে দেখিনি। এখন আর দেখতে চাইও না। ”
” তাহলে চলুন। ”
” হুম। ”
নাঈমার সাথে পাশাপাশি হাঁটতে দারুণ লাগছে রাফির কাছে। যতদিন ধরে নাঈমা’কে চিনে আজ প্রথম এতটা কাছাকাছি দুজন। রাফির কাছে আজ দিনটা অন্যরকম লাগছে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সময় টুকু উপভোগ করতে লাগলো সে।
আগুন সচারাচর অসুস্থ হয় না। ফিটনেস বডিওলা শরীরটা সবসময় চাঙ্গা থাকে। হবে নাই বা কেন? আগুন তার শরীরের দিকে অনেক যত্নশীল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। যথেষ্ট গুছানো মানুষ সে। অথচ, দুপুরে বাসায় ফেরার পর সন্ধ্যার দিকে গা কাঁপিয়ে জ্বর চলে আসলো। ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে দুপুরে খেতেও পারেনি। মোম নিজেও খায়নি। আগুনের মাথাটা কোলে নিয়েই বিকেল পর্যন্ত বসে ছিল। যখন আগুনের ঘুম ভেঙেছে ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে মোমকে পরক্ষ করছিলো। ঘুমানোর আগে মোমকে যেভাবে বসে থাকতে দেখেছিল? সেভাবেই বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। শোয়া থেকে ওঠে বসে একটা হাত মোমের গালে রেখে শান্ত কন্ঠে শুধাল,
” তুমি এতক্ষণ এভাবেই বসে ছিলে? ”
” জ্বি। ”
আগুন হতভম্ব হয়ে গেল। মৃদু ধমকে বলল,
” কে বলেছিল এভাবে বসে থাকতে? এতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে পা ব্যথা করেনি?
” জ্বি, আমি ঠিক আছি। ”
” খেয়েছিলে? ”
মোম মাথা নিচু করে নিলো। মিনমিন করে বলল,
” জ্বি, না। ”
আগুন চোয়াল শক্ত করে কঠিন গলায় বলল,
” খাওনি কেন? প্রায় মাগরিবের কাছাকাছি সময়। ”
” আপনিও তো খাননি। ”
” আমার সাথে তোমার তুলনা করো? একে তো চুনোপুঁটি’র মতো শরীর। তারউপর তুমি না খেয়ে বসে আছো। এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে না? এমনিতেই তেমাকে নিয়ে টেনশনে আছি। কি চাও? আমি মরে যাই? ”
এতক্ষণ আগুনের কথা গুলো গাল ফুলিয়ে শুনছিল মোম। কিন্তু শেষের কথায় মোমের বুকে ধক করে উঠল। চমকে তাকায় আগুনের দিকে। মোমের গালে রাখা আগুনের হাতটা সরিয়ে নিজের পেলব এক হাত আগুনের দাঁড়ি যুক্ত গালে রেখে আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,
” এসব কি বলছেন আপনি? মা’রা যাওয়ার কথা কেন বলছেন? আপনি আসার আগে নুডলস রান্না করে খেয়েছিলাম। সেজন্য তেমন একটা খিদে পায়নি। আবার একা একা খেতেও ইচ্ছে করছিল না। খাইনি বলে আপনি মরার কথা বলবেন? ”
আগুনের চোখ দুটো জ্বলছে। মাথাব্যথা করছে না। ঘুমানোর জন্য মাথাব্যথা কমে গিয়েছে। তবে মাথা’টা প্রচন্ড ভার ভার লাগছে। শরীরও কেমম অসাড় হয়ে আসছে। মোমের দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” মরার কথা বলায় এত ভয় পাওয়ার কি আছে? এমনিতেই আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়ো। প্রায় তেমার বয়সের দ্বিগুণ বয়স আমার। হিসাব অনুযায়ী তোমার আগে আমি মরে যাবো। তখন কি করবে তুমি? ”
মোমের বুক কেঁপে উঠে। তখন থেকে কি অদ্ভুত কথাবার্তা বলে চলেছে মানুষটা? এসব বলার মানে কি? আগুন কি বুঝতে পারছে না মোমের কষ্ট হচ্ছে? মোম ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। ব্যগ্র গলায় বলল,
” দয়া করে বারবার মরার কথা বলবেন না। কি হয়েছে আপনার? আজকে বাসায় ফেরার পর থেকেই কেমন মনমরা হয়ে আছেন। কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলছেন, সব ঠিক আছে। তাহলে এরকম কথা বলার মানে কি? ”
আগুন শীতল গলায় বলল,
” আরে কান্না করার কি হলো? আমি এতকিছু ভেবে বলিনি। তুমি দেখছি সিরিয়াস হয়ে গিয়েছ। আমি বললেই কি আমি মরে যাবো? আর না বললে কি সারাজীবন বেঁচে থাকতে পারবো? ”
মোম নাক টেনে টলমল চোখে চেয়ে মায়াভরা কন্ঠে বলল,
” আল্লাহ্ যখন নিয়ে যাবেন, নিবেন। তাই বলে আপনি কেন বারবার মৃত্যুর কথা বলবেন? আপনি জানেন না, আপনার মরার কথা বললে মোম কষ্ট পায়। আপনি কি চান মোম কষ্ট পাক? ”
শরীর খারাপ নিয়েও মোমের কথায় একপেশে হাসলো, আগুন। মোমের স্নিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল,
” জ্বি না। আমি চাই না আমার মোম কষ্ট পাক। আচ্ছা, আর বলবো না। আমার শরীরটা অবশ অবশ লাগছে। উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খাবার গুলো রুমে নিয়ে আসো। এখানেই খাবো। ”
আগুনের কথায় মোম খুশি হলো। তবে আগুনের শরীর খারাপের কথা শুনে খুশিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
” কপাল তো হালকা গরম গরম লাগছে। জ্বর আসবে নাকি? ”
আগুন মোমের নাক টেনে ফিচেল হেসে বলল,
” গরমের কারণে হয়তো গরম হয়ে রয়েছে। তুমি চিন্তা করো না। ক্ষুধা পেয়েছে তো। খাবার দিবে না? ”
মোম সহসা জিভ কাটলো। চঞ্চল পায়ে দ্রুত ছুটলো রান্নাঘরের দিকে। হাত চালিয়ে ঝটপট খাবার গুলো গরম করতে লাগলো। এই ফাঁকে আগুন গিয়ে অল্প সময় নিয়ে গোসল করে আসলো। যদিও সকালে গোসল করে কলেজে যায়। তবে আজকে বাসায় এসে ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। ঘামযুক্ত ভেজা শার্ট এতক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। শরীরে বাইরের কিঞ্চিৎ ধুলাবালি লেগে আছে। তারউপর নাঈমা তখন ওই ভাবে জড়িয়ে ধরে ছিল। তাই এখন গোসল করা আবশ্যক।
মোম খাবার নিয়ে এসে দেখে আগুন ভেজা চুল মুছছে। খাবার গুলো বিছানায় রেখে আগুনের পাশে এসে গোমড়া মুখে বলল,
” এই সন্ধ্যার সময় গোসল করেছেন কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে না? এমনিতেই তখন গা গরম দেখেছি। ”
” আমি সহজে অসুস্থ হই না। কথা না বাড়িয়ে খাবার দাও। ”
মোম একটা প্লেটে খাবার বেড়ে আগুনকে দিলো। আগুন ভ্রু কুঁচকে বলল,
” তোমার জন্য প্লেট কোথায়? তুমি খাবে না? ”
” পরে খাবো। ”
” চুপ! কোনো কথা না। এতক্ষণ না খেয়ে আছো। এখন আবার বলছো পরে খাবে? ”
মোম উঠে গেল। আগুন পেছন থেকে ডেকে উঠে,
” কোথায় যাচ্ছ? ”
মোম গাল ফুলিয়ে বলল,
” প্লেট আনতে। ”
আগুন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আনতে হবে না। এদিকে আসো। ”
মোম গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়। আগুনের ভরাট স্বর,
” বসো। ”
মোম বসলো। আগুন ভাত মেখে এক লোকমা মোমের মুখের সামনে ধরল। মোম অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। আগুন ধমকে বলল,
” হা করে তাকিয়ে আছো কেন? খাও। আমিও তো খাবো নাকি? ”
মোম খেয়ে নিলো। মোম রান্না মোটামুটি ভালোই পারে। মুরগির ঝাল ঝাল কসা মাংস’টা দারুণ হয়েছে। আগুন তৃপ্তি করে খেলো। খাওয়া শেষে আগুন আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। কি ব্যাপার? আজকে শরীর’টা এমন লাগছে কেন? এত ঘুম পাচ্ছে কেন? বিষয়টি আগুনের বোধগম্য হলো না। আগুন চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। আধা ঘন্টা পরই মাগরিবের আযান শোনা গেল। মোম নামাজ পড়ে এসে আগুনকে ডাক দিলো। আগুন কেমন গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। সাড়া না পেয়ে হাত ঝাঁকিয়ে ডাকল। প্রচন্ড গরম হয়ে আছে হাত। মোম তুরন্ত হাত বাড়িয়ে কপালে রাখলো। অমনি চমকে উঠল। গা এতো গরম হয়ে আছে কেন? দ্রুত ফাস্ট-এইড বক্স নিয়ে এসে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে নিলো। থার্মোমিটারে গায়ে দৃশ্যমান নম্বরের লিখাটা চোখে পড়তেই ঘন পাপড়ি যুক্ত নয়ন জোড়া বড়ো বড়ো হয়ে গেল। একশো চার ডিগ্রি জ্বর!
ব্যস! তারপর থেকেই মোম শান্তি পাচ্ছে না। আগুনের বলা তখন কার কথা আর এখনকার অবস্থা দেখে কন্ঠ ফুঁড়ে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। চেয়েও আটকাতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগেও তো ঠিক ছিল। তাহলে হুট করে জ্বর কোথা থেকে চলে আসলো? মোমের চিন্তা বাড়লো। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। বাড়িতে কি ফোন করবে? মোম আগুনকে ডাকতে লাগলো,
” শুনছেন? ”
আগুন চোখ খুলতে পারছে না। অনেক কষ্টে চোখ খুলে মিহি কন্ঠে বলল,
” কিছু বলবে? ”
মোম কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
” আপনার তো জ্বর এসেছে। তখন কি দরকার ছিল গোসল করার? বাসায় জ্বরের ঔষধ আছে? ”
আগুন বিছানায় ভর দিয়ে উঠে বসলো। ক্লান্ত গলায় বলল,
” বক্সটা আমার কাছে দাও। আর এক গ্লাস পানি দাও। ”
মোম দিলো। আগুন বক্স থেকে দুটো নাপা ট্যাবলেট বের করে খেয়ে নিল। পুনরায় বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
” বাড়িতে কাউকে জানিও না। শুধু শুধু টেনশন করবে। মেডিসিন খেয়েছি। আশা করি ঘন্টা দুয়েক পড়ে জ্বর ছেড়ে দিবে। ”
আগুন নিষেধ করে ছিল বলে মোম বাড়িতে ফোন করে কাউকে জানায় নি। তবে রাতে জ্বরও ছাড়ে নি। বরং মধ্যেরাতে জ্বরের তীব্রতা আরো বেড়ে গিয়েছে। আগুনের গায়ের উপর পাতলা কম্বল জড়ানো ছিল। আগুন শীতে কাঁপছিল বলে মোম আরেকটা ভারী কম্বল এনে আগুনের গায়ের উপর মেলে দিলো। মোম অ্যাসি বন্ধ করে দিয়েছে। জাস্ট তিন পাখাওয়ালা ফ্যান চালানো। মোমের ভীষণ হাঁসফাঁস লাগছে। কারণ, আগুন তাকে কম্বলের ভেতর টেনে নিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। আগুন জ্বরে মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছিল বলে মোম পেলব হাতে আলতো করে আগুনকে জড়িয়ে ধরে ছিল।
মিনিট কয়েক পরেই আগুন তাকে কম্বলের ভেতর টেনে নেয়। মোম ভেবে ছিল আগুন সজাগ। কিন্তু না! সে তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার চোখ দুটো বন্ধ। একে তো গরম। তারউপর আগুনের শরীরের উত্তাপে মোমের শরীর ঘেমে উঠেছে। মোমের অস্বস্তি হচ্ছে। আগুনকে সরিয়ে উঠতেও পারছে না। আগুনের মতো বলিষ্ঠবাণ পুরুষের শরীরের নিচে তার ছোট্ট শরীর চাপা পড়ে আছে।
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৬
আর মোমের মতো চুনোপুঁটি মার্কা মেয়ের পক্ষে বলিষ্ঠ আগুন’কে সরিয়ে উঠা চারটি খানিক কথা না। অগত্যা মোম হাল ছেড়ে ওই ভাবেই আগুনের সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে। আগুনের ভারিক্কি নিঃশ্বাস মোমের ঘাড়ে আচঁড়ে পড়ছে। উষ্ণ নিঃশ্বাসে মোমের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। মোম কিছুক্ষণ পরপর কপালে হাত দিয়ে চেক করছে। কিন্তু জ্বর তো কমছেই না। মোম এবার কেঁদে উঠল। মোমের কান্না আগুনের কর্ণগোচর হলো না। উঠে যে মাথায় জলপট্টি দিবে সেটাও সম্ভব না। এই কুমড়ো মার্কা লোকটা মোম’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।