শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২
সুমাইয়া সুলতানা

সন্ধ্যার শোরগোল কাটিয়ে ধরণীর বুকে রাত্রি নেমেছে। গোধুলির কিঞ্চিৎ রক্তাভা আলো সরে গিয়ে চারপাশে অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছে। ছোট বড়ো পক্ষীকূল ডানা ঝাপটিয়ে নিজ আবাসস্থলে ফিরে যাচ্ছে। কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ নিমিষেই নিস্তব্ধতায় ভরে গিয়েছে।
এই শুনশান নীরবতা পরিবেশে মোমের গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। মাটিতে কারো পায়ের দাপাদাপির শব্দ, সেই সাথে মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতার খচখচে আওয়াজ। শব্দ অনুসরণ করে রাফি এদিকটায় ছুটে এলো।
সন্ধ্যার সময় শেষে রাত্রি নামছে অথচ আগুন, মোমের দেখা নেই। ভিন্ন শহরে চোর ডাকাতের অভাব নেই, তাই প্রিন্সিপাল স্যার রাফি’কে সাথে আরো একজন সিনিয়র প্রফেসর’কে ওদের খোঁজার জন্য পাঠিয়েছিলেন। রাফি সিনিয়র প্রফেসর’কে বলল, দুজন দু দিকে গেলে তাদের খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। সেজন্য দুজন দু দিকের রাস্তা ধরে আগুন, মোম’কে খুঁজে চলেছে। রাফিরা যেখানে ছিল, তার থেকে ত্রিশ মিনিটের দূরত্বে শুনশান নিরিবিলি প্রাকৃতিক লতাপাতায় ঘেরা একটা জায়গা আছে। খুঁজতে খুঁজতে রাফি এদিকেই এসেছে। আর তক্ষুনি অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পায়।

রাফি সামনে যতটা এগুচ্ছে শব্দের প্রখরতা ততটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জায়গাটাতে তেমন আলোর ঝলকানির দেখা নেই, তবে আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটাতে চারপাশের ক্ষুদ্র আলোকরশ্মি হানা দিয়েছে। রাফি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হাতাহাতির দু’টি ছায়ামূর্তি দেখতে পেলো। পা চালিয়ে দ্রুত ছুটলো সেদিকে। যদিও সবকিছু আবছা আবছা দেখাচ্ছে, তবুও মৃদু আলোতে মোমের মুখ আর ড্রেস চিনতে একটুও ভুল হলো না। এদিকে এসেই রাফির চোখ ছানবোড়া হয়ে গেল। কেউ একজন মোমের গলা চেপে আছে, আর মোম গলা হতে হাত ছাড়ানোর জন্য রীতিমতো তড়পাচ্ছে! থেমে থেমে সমান তালে গোঙ্গিয়ে যাচ্ছে। কন্ঠনালীর মোলায়েম হার গুলো যেন মড়মড় করে ভেঙে গিয়েছে৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাফি সময় ব্যয় না করে, কাছে গিয়ে আগুন্তক’কে পুরুষালী শক্তি খাঁটিয়ে মোম থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মোমের শরীর টলছে। গলা ধরে খুকখুক শব্দ তুলে কাশছে আর জোরে জোরে শ্বাস টানছে। এক্ষুনি মাটিতে পড়ে যাবে পড়ে যাবে ভাব! রাফি হাত বাড়িয়ে আবার গুটিয়ে নেয়। অন্যের স্ত্রী’কে এভাবে ছোঁয়া কি ঠিক হবে? মোম শরীর ছেড়ে পড়ে যেতে নেয়, সকল দ্বিধাবোধ দূরে ঠেলে মোমের কাঁধ জড়িয়ে এক হাতে আগলে নিলো। মোম বহু কষ্টে নিভুনিভু চোখ তুলে আগলে ধরা মানুষটির দিকে চায়। পরিচিত মুখাবয়ব দেখে অধরে কিঞ্চিৎ হাসির ঝলক মেলে। ভরসা স্বরূপ বুকে সাহসের সঞ্চার হয়। চাউনীতে একটুকরো আশা জেগে উঠে। মোমের দিকে এক পলক চেয়ে রাফি মেকি হেসে আমতা আমতা করে সাফাই দিল,

” আপনাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে ছুঁয়েছি, নয়তো এক্ষুনি পড়ে যেতেন। আমার ছোঁয়া খারাপ ভাবে নিবেন না, প্লিজ। বয়সে আমি আপনার থেকে অনেক বড়ো। অস্বস্তি অনুভব করলে বড়ো ভাইয়ের ছোঁয়া মনে করে একটু মানিয়ে নিন। শুধু কলিগের বউ বলে আপনি আগ্গা করছি। নয়তো হাঁটুর বয়সি মেয়েকে আপনি সম্বোধন করতে ঈগৌ তে লাগছে! ”
মোম পলক ঝাপটিয়ে মাথা নেড়ে বুঝালো, সে কিছু মনে করেনি। রাফি সন্তুষ্টি হাসল। হাসি বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলো,

” ভাবি আপনি এখানে কি করছেন? আগুন স্যার কোথায়? ”
মোম উত্তর দেওয়ার আগেই, আগুন্তকঃ পুনরায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে মোমের নিকট তেড়ে এলো। দূর হতে সুক্ষ্ম আলোক রশ্মি আগুন্তকের মুখে এসে পড়ল। রাফি আগুন্তকের মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলো। অমনি হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময়ে নয়ন জোড়া বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল। অবিশ্বাস ঢেলে বলে উঠলো,
” ডাক্তার ম্যাডাম আপনি? ”

আগুন্তকঃ উত্তর দিল না। তাকে দেখতে পাগল পাগল লাগছে। চুল গুলো খোলা। মুখশ্রী ঘামে ভিজে ব্যাহাল দশা। কিছু চুল মুখের সামনে এসে ঘামের সাথে লেপ্টে রয়েছে। চোখের মণি যুগল বাজে ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। বড়সড় মোটা একটা লাঠি দেখতে পেয়ে সেটা হাতে তুলে নিলো। মোম’কে আঘাত করতে চাইল কিন্তু পারলো না। তার আগেই রাফি লাঠি ধরে এক টানে আগুন্তকের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। রাগ দেখিয়ে ধমকে বলল,
” সমস্যা কি ম্যাডাম? ভাবি কে মারতে চাচ্ছেন কেন? আর আপনি এখানে কি করছেন? ”
আগুন্তকঃ এবারেও নিশ্চুপ। উন্মাদের মতো শুধু ঠোঁট নেড়ে কাঁপা গলায় আওড়াল,
” এই মেয়েটা’কে ছেড়ে দিন। আমার ওকে দরকার। ওকে মেরে আমাকে এখান থেকে যতদ্রুত সম্ভব বিদায় হতে হবে। ”
রাফি অবাক হয়ে জানতে চাইল,

” আপনি ওনাকে মারতে চান কেন? কি ক্ষতি করেছে উনি আপনার? ”
আগুন্তকঃ ফুঁসে উঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” আমার হাতে এত কথা বলার সময় নেই। আপনি সামনে থেকে সরুন। মেয়েটাকে ছেড়ে দিন। ”
রাফি, মোমের কাঁধ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দাম্ভিক সহিত বলে,
” সরবো না। আপনার যা করার ইচ্ছা করতে পারেন। ”
” এত দরদ কেন এই মেয়েটার জন্য? ও তো আপনার আপন কেউ হয় না, তাহলে? আমি বুঝি না, এই অপয়া মেয়েটার জন্য সকলের এত দরদ কিসের? ”
” কে বলেছে উনি আমার কেউ হয় না? উনি আমার ছোট বোন। আর বড়ো ভাই হিসেবে আমার কর্তব্য বোন’কে রক্ষা করা। রক্তের সম্পর্ক হলেই যে শুধু ভাই হওয়া যায়, এমনটা কোথায় লেখা আছে? ”
আগুন্তকঃ তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে,
” ওর থেকে দূরে সরে দাঁড়ান। ”

” অসম্ভব! আমি থাকতে আপনাকে খামোখা আর একটা আঘাতও ভাবি কে করতে দিবো না। ”
আগুন্তকঃ আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল, তক্ষুনি লম্বা চওড়া, বলিষ্ঠ পেটানো শরীরি কাউকে ধুপধাপ পা ফেলে এদিকে আসতে দেখে, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। মানুষটা দেখতে অনেকটা আগুনের মতো লাগছে। আগুন্তকঃ বুঝতে পারলো এটা আগুনই। শব্দ শুনে রাফিও সেদিকে তাকায়। আগুন্তকঃ ঢালু দিয়ে নিচে নেমে, সরু রাস্তার পথ ধরল। চোখের পলকে সকলের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
বলিষ্ঠ ছায়ামূর্তি মোম, রাফির সম্মুখে এসে দাঁড়াল। আগুনের প্রতিচ্ছবি দেখে রাফি গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” স্যার, আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন? রাত্রি নামছে সেদিকে কোনো খেয়াল আছে? চিন্তা হয় না, বলুন? ”
আগুন থেকে আশান্বিত উত্তর না পেয়ে রাফি হতাশ হলো। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

” চলুন, হোটেলে ফিরে যাওয়া যাক। ”
রাফির কথা আগুন কতটুকু শ্রবণ করেছে বোঝা যাচ্ছে না। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আবছা ঘোলাটে আলোতে মোমের মুখের দিকে। মোমের মুখশ্রী স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। এক ঘন্টা ধরে পাগলের মতো খুঁজে চলেছে এই মেয়েটা’কে, আর সেই মেয়ে এখানে রাফির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে? কত বড়ো স্পর্ধা! মোমের কাঁধে রাফির হাত দেখে মেজাজ আরো বিগড়ে গেল। রাফির বুকে ধাক্কা দিয়ে মোম থেকে দূরে সরিয়ে দিল। কাঁধ হতে হাত সরে যাওয়ার দরুন মোমের শরীর আবার টলছে। শরীরে শক্তি যেন ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। যার জন্য নিজ পায়ে ভর ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

আগুন’কে দেখে মোমের অর্ধমৃত প্রায় শরীর টা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। মুচকি হেসে ক্ষীণ স্বরে ঠোঁট নেড়ে কিছু বলতে উদ্যত হলো, কিন্তু সেটা আগুন হতে দিল না। মোমের হাত শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটা শুরু করল। হেঁটে আলোর দিশারে পৌঁছাতে রাফি খেয়াল করল মোমের গায়ে রক্ত। আগুন সামনে, তার পেছনে মোম। আর ওদের দুজনের পেছনে রাফি। রাফি মৃদু আওয়াজে চেঁচিয়ে বলল,
” স্যার, ভাবির গায়ে রক্ত লেগে আছে। দেখুন তো কোথায় ব্যথা পেলো। ”
রাফির এই কথাটাও আগুন শুনতে পেয়েছে কি না? বোঝা গেল না। গটগট করে পা চালিয়ে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হচ্ছে সে। আগুনের সাথে পা মেলাতে পারছে না, মোম। তারউপর শরীর ভীষণ দুর্বল! গলা ব্যথায় কথা বলতে পারছে না সঠিকভাবে। আগুন, মোমের দিকে না তাকিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, সাথে নেতানো ভঙ্গুর মোম’কে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।

হোটেলের রুমে এসে ঝারা মেরে মোমের হাত ছেড়ে দিল আগুন। পুরো রুম অন্ধকারে ঢেকে আছে। সুইচ টিপে সাদা রঙের বাতি জ্বালিয়ে দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে রাগান্বিত চোখে মোমের দিকে কঠিন দৃষ্টি ফেলল। লাইট জ্বালিয়ে মোমের দিকে ঘুরে দৃষ্টি তাক করতেই সহসা মুখবিবর বদলে গেল। জ্বলন্ত রাগ টুকুন নিমেষে মিইয়ে গেল। গায়েব হয়ে গেল আগুনের কিছুক্ষণ আগের অভিব্যক্তি! থমকে গেল তার হৃৎপিণ্ডের শিরা উপশিরা! স্নায়ুর কোষ গুলো যেন অচল হয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে গেল জ্বলজ্বল করা চাউনী! অবাক লোচনে চেয়ে রইল কিয়ৎকাল। প্রাণহীন শান্ত, স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল। ললাটের গোটানো প্রখর ভাঁজ শিথিল হলো। অনিমেষ চেয়ে রইল বিধস্ত হয়ে হেলেদুলে দাঁড়িয়ে থাকা মোমের দিকে।

মোমের কপাল, ঠোঁট, থুতনিতে গড়িয়ে পড়া রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে গিয়েছে। হাতের তালু, গলা, বুক থেকে কোমর পর্যন্ত জামা তরতাজা রক্তে মাখামাখি অবস্থা। একটা পায়ের পাতার চামড়া ছিঁলে গিয়েছে, সেখানেও রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ফর্সা নরম গালে কারো হাতের আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। গলার চামড়ায় আঙুলের ছাপ, সেই সাথে কিঞ্চিৎ কালচে হয়ে রয়েছে। ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে গিয়েছে, যেন কত সময় ধরে সে আদ্রতাশূন্যে ভুগছে! অনেকক্ষণ যাবত শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিরোধ হয়েছিল, ফলাফলস্বরূপ ডাগর ডাগর আঁখি যুগল ধারণ করেছে টকটকে রক্তিম আভা। মাথার লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। চুলের আগা প্যাঁচিয়ে জটলা বেঁধে গিয়েছে। চোখেমুখে রয়েছে একরাশ আতঙ্ক!

মোম’কে দেখে আগুনের মনে হচ্ছে, বহুদিন যাবত অনাদর, অবহেলায় অত্যাচারীত হওয়া রুগ্ন কোনো মানুষ! যার দেহের একাংশ সুস্থ সবল নেই! শুধু প্রাণসঞ্চার আত্মাটা দেহের মধ্যে আটকে রয়েছে বলে শরীরের মাংস তরতাজা! নয়তো এই শরীরি মানুষটা’কে মৃত ঘোষণা করা হতো!
আগুন বিধস্ত মোমের নিকট দু’কদম এগিয়ে যায়। মোম’কে স্পর্শ করল না! কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে শান্ত কন্ঠে শুধাল,
” কে ছিল? ”

মোম দেয়ালে এক হাত ঠেকিয়ে কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছে। ঘনঘন শ্বাস টানছে। কথা বলার চেষ্টা করছে, পারছে না। এখনো মনে হচ্ছে কেউ তার কন্ঠনালী চেপে ধরে আছে! আগুনের ধৈর্য্য শক্তি কুলচ্ছে না! অধৈর্য্য সহিত আগের থেকেও শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” তোমার এ অবস্থা কে করেছে? সে কে, যে তোমাকে আঘাত করেছে? বলো আমায়? ”
মোম ভাবলো, কে ছিল সেটা বলে দিলে আগুন তার সামনে গেলে সেই খারাপ মানুষটা যদি আগুনের কোনো ক্ষতি করে? আগুনের কোনো ক্ষতি হোক, মোম সেটা মানতে পারবে না। তাই অনেক কষ্টে থেমে থেমে ক্ষুদ্র বুলি আওড়াল,
” কেউ ছিল না। হাঁটতে গিয়ে কিছুর সাথে পা লেগে পড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গাছের শিকড়ের উপর পড়ায় ব্যথা পেয়েছি। ”

এতক্ষণের ক্ষয় হওয়া রাগ টুকুন পুনরায় দপ করে জ্বলে উঠল। হাত বাড়িয়ে তিন আঙুলে শক্ত করে মোমের চোয়াল চেপে ধরল। ব্যথায় মোমের প্রাণটা বুঝি এবার বেরিয়েই আসলো! নেত্রদ্বয়ে ঝর্ণার পানির মতো বারিধারা নামল। এতে আগুনের মায়া হলো না! বরং ক্রোধ নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

” মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই, তাহলে বলার চেষ্টা কেন করছো? পড়ে গিয়ে না হয় আঘাত পেয়েছো মেনে নিলাম। কিন্তু গালে, গলায় আঙুলের ছাপ আসলো কোথা থেকে? বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছো? আমাকে হয়রানি করে কি মজা পাও তুমি? গত এক ঘন্টা ধরে তোমার দেখা না পেয়ে আমার কেমন লেগেছিল জানো? আমার কি অবস্থা হয়েছিল? পাগলের মতো এদিক সেদিক খুঁজে বেড়িয়েছি। অপরিচিত জায়গা, মানুষজন ভালো নাকি খারাপ তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যদি কেউ নিয়ে যেতো? হারিয়ে গেলে কিভাবে ফিরে পেতাম? বুঝতে পারো আমার যন্ত্রণা? অনুভব করতে পারো আমার কষ্ট? জানবে কিভাবে? তুমি তো আমাকে কখনো বোঝার চেষ্টাই করোনি! সবসময় পাকনামি না করলে হয় না? কে বলেছিল আমাকে রেখে চোখের আড়াল হওয়ার? আজ যদি তোমাকে খুঁজে না পেতাম, ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যেতো! তখন বাড়িতে ফিরে তোমার বাবা-মা কে কি জবাব দিতাম আমি? আর আমার কি হতো? কিভাবে থাকতাম তোমাকে ছাড়া? ”

শেষের বাক্য দুটি কেমন কাতর গলায় বলল, আগুন। মোম ঠোঁট কামড়ে কান্না করছে। কোনো প্রতিত্তোরে করল না। মোমের নিশ্চুপতায় আগুনের রাগ আরো বেড়ে গেল। হাতের চাপ আগের তুলনায় দৃঢ় করল। নরম চামড়া ভেদ করে আঙুল গুলো যেন মুখের ভেতর ঢুকে যাওয়ার উপক্রম! মোম ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। মনে হচ্ছে, এবার সে মরেই যাবে। যতটুকু শ্বাস চলছে, এবার সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। এই আগুনের কি মায়া দয়া নেই? এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারছে লোকটা? সে কি বুঝতে পারছে না মোমের কষ্ট হচ্ছে? আগুন চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে ধমকে বলল,

” লাস্ট বার জিজ্ঞেস করছি, কে ছিল সে? না বললে, এর থেকেও শতগুণ যন্ত্রণা আমি তোমায় দিবো। আমার রাগ তুমি এখনো দেখোনি মোম। আর না আমি তোমাকে আমার রাগের সাথে পরিচয় করাতে চাচ্ছি! ভালো এটাই হবে তার পরিচয় আমাকে বলো। ”
মোম ব্যথায় টিকতে না পেরে, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বলতে বাধ্য হলো। মৃদুস্বরে ব্যথাতুর আওয়াজে বলে,
” বলছি। ”
আগুন চোয়াল হতে হাত সরিয়ে নিলো। গমগমে গলায় বলে,
” বলো। ”
মোম জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে ভাঙা গলায় জানালো,

” নাঈমা নামের ওই মেয়েটা। ওই যে আমি আসার পর আমাদের বাসায় একদিন এসেছিল? তারপর আপনাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে ফিরে আসার সময় রাস্তায় দেখা হয়েছিল, সেই মেয়েটা। ”
মোম, নাঈমা তাকে কিভাবে নিয়ে গিয়েছে, কি কি বলেছে, কিভাবে আঘাত করেছে, রাফি সঠিক সময় না আসলে আজকে মোম মরেই যেতো। সকল কথা একে একে ক্ষীণ স্বরে আগুন’কে বলল। আগুন ভাবুক চিত্তে আনমনে প্রশ্ন করলো,

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩১

” নাঈমা এখানে কি করছে? ”
মোম প্রশ্নটা শুনলো। পাতলা রক্তাক্ত অধর জোড়া নেড়ে নেড়ে জবাব দিল,
” আমি কিভাবে জানবো? ”
আগুনের টনক নড়ল। মোম’কে পাল্টা কিছু বলল না। আর না মোমের দিকে ফিরে তাকাল৷ অল্প ধাক্কা দিয়ে মোম’কে সামনে থেকে সরিয়ে দিল। মোম ফ্লোরে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো। অপেক্ষা করল না। আগুন চোয়ালদ্বয় শক্ত করে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করল। মোম’কে রেখে ধারাম করে দরজা বন্ধ করে কোথাও চলে গেল। যাওয়ার আগে বাইরে থেকে দরজা লক করে রেখে গিয়েছে।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২(২)