শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৪
সুমাইয়া সুলতানা
ট্যুরের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। সময়ের প্রহর গুনতে গুনতে দোতলা বিশিষ্ট বাস গাড়িটি ঢাকায় পৌঁছে গিয়েছে। ভোর ভোর সকলে রওয়ানা দিয়েছিল, তারপরও ঘড়ির কাঁটা প্রায় বিকেলের কাছাকাছি এসে ঠেকেছে। বাসটি কালো রঙের ঘুর্নায়মান চার চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কলেজের গেইট পেরিয়ে কলেজের মাঠের মাঝখানে এসে থামল। একে একে সবাই বাস থেকে নেমে, যে যার মতো নিজেদের আপন নীড়ে ফেরার উদ্দেশ্যে চলে গেল।
আগুন, মোম’কে নিয়ে নিজস্ব ফ্ল্যাটে এসেছে। মিনা বলেছিলেন, ট্যুর থেকে ফিরে আসার পর তাদের সাথে দেখা করে আসতে। তবে এখন ও বাড়িতে গেলে মোমের অসুস্থতা দেখে নানান রকমের কথা জিজ্ঞেস করবে। রাশেদের ধারালো কথার সম্মুখীন হতে হবে! যদিও মোম আগের তুলনায় অনেক সুস্থ, ব্যথা নেই বললেই চলে। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন গুলো এখনো সুস্পষ্ট। মোম’কে দেখে তারা দিশেহারা হয়ে পড়বেন। তারথেকে বরং কিছুদিন যাক, তখন ও বাড়িতে যাওয়া যাবে। আর কিছু একটা বুঝিয়ে মোমের আঘাতের চিহ্ন গুলোর কথা জানানো যাবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এসব চিন্তা করে আগুন ও বাড়িতে যায়নি। এমনকি প্রিন্সিপাল স্যার কে আসার সময় আগুন বলে এসেছে, সে কয়েকদিন সঠিক সময়ে কলেজে যেতে পারবে না। ক্লাস সে নিবে তবে বেটাইমে নিতে হতে পারে! কারণ মোম অসুস্থ। প্রিন্সিপাল মোমের কপালের ক্ষতটা দেখেছিলেন। আগুন জানিয়েছে রাস্তায় পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। আগুন অযথা ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার মতো মানুষ না, সেজন্য প্রিন্সিপাল সম্মতি প্রকাশ করছেন।
বাসায় এসে মোম ফ্রেশ না হয়েই ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে পড়ল। আগুন ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছে। একবারে গোসল করে বেরিয়েছে। টি-শার্ট, ট্রাউজার পরিধান করে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে ড্রয়িংরুমে আসে। মোম’কে শুয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কাছে গিয়ে ঝুঁকে মোমের কপালে হাত রাখল। তাপমাত্রা ঠিকঠাক। গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে ডেকে ওঠে,
” মোম? শরীর খারাপ লাগছে? ”
মোম পিটপিট করে চক্ষুদ্বয় পুরোপুরি খুলে তাকায়। মুখশ্রীতে ক্লান্তি লেপ্টে রয়েছে।
” না। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ”
” আগে ফ্রেশ হয়ে নাও, পরে শুয়ে থেকো। ”
” এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না। ”
আগুন ভরাট কন্ঠে বলল,
” উঠতে হবে। ফ্রেশ হলে ভালো লাগবে। ”
মোম অলস ভঙ্গিতে উঠে বসলো। চোখে তার ঘুম পাখিরা হানা দিয়েছে। মুখটা চুপসে আছে। ডাগর ডাগর আঁখি জোড়া বুঁজে আসতে চাচ্ছে, মেয়েটা জবরদস্তি খুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আগুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে তার কোমলমতির গোলগাল মুখবিবর পর্যবেক্ষণ করল। হাত বাড়িয়ে মোম’কে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। মোম, আগুনের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। মেয়েটার আঁখিতে ঘুম লুটোপুটি খাচ্ছে। মোম’কে নিয়ে আগুন সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কোল থেকে নামিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে দেয়। পানির সংস্পর্শ পেতেই মোম তড়াক করে চোখ খুলে চায়, ঘুম ছুটে যায় পুরোপুরি। আকস্মিক পানি গায়ে লাগায় ভয় পেয়ে যায়। সহসা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আগুন’কে জড়িয়ে ধরে। ঠান্ডা পানি বলে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঝর্ণার পানি দিয়ে মোমের সাথে সাথে আগুনও ভিজে যাচ্ছে।
আগুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মোমের গায়ের পানিতে তার টি-শার্ট ভিজে গিয়েছে। ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো,
” আগেই বলতে পারতে এক সাথে গোসল করতে চাও, তাহলে অন্তত আমাকে দু’বার গোসল করতে হতো না। ”
মোম মিনমিন করে বলে,
” আপনি যে আমাকে সরাসরি ওয়াশরুমে নিয়ে আসবেন, আমি জানতাম নাকি? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ”
” তুমি সবকিছুতে এত ভয় কেন পাও? পানির সংস্পর্শে এসেও তোমার ভয় লাগছে? ”
মোমের থেকে আশাবাদী উত্তর পাওয়া গেল না। চুপ করে রইল সে। আগুন আর কিছু বলল না। মোম’কে গোসল করিয়ে, পোশাক এনে দিল৷ আগুন গিয়ে রুমে চেঞ্জ করে নিলো।
আয়মানের ভার্সিটির পেছনে সেই পুকুর পাড়ের বেঞ্চে বসে আছে আনিকা। বসে থাকতে থাকতে মেয়েটার কোমর অসার হয়ে আসছে। বিরক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অপেক্ষা করতে আর ধৈর্য্যে কুলচ্ছে না! বসা হতে দাঁড়িয়ে পায়চারী করতে লাগলো। এদিক ওদিক ঘাড় নাড়াচ্ছে, অথচ আয়মানের কোনো হদিশ নেই। রাগের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে, গাছের পাতা ছিঁড়তে শুরু করল। আবার কখনো নখ দিয়ে গাছের ছাল খুঁটতে লাগলো।
ঢাকা শহরে রাস্তার মাঝে মাঝে কিছু গাছের সারি দেখা যায়, যদিও শহরে গাছপালার সংখ্যা নগণ্য। তবে এই অল্প গাছগুলোই শহরের যান্ত্রিক জীবনকে খানিকটা প্রশান্তি দেয়। গাছের পাতাগুলোতে হালকা বাতাসে খেলে যায়, আর সেই সাথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো যেন শহরের কোলাহলের মধ্যে শান্তির মূর্ত প্রতীক।
আয়মান আরও কিছুক্ষণ পর আসলো। আয়মান’কে দেখে আনিকা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
” কখন আসতে বলেছিলেন? আর আপনি এখন এসেছেন? দেরি করেই যখন আসবেন, তাহলে এত তাড়াতাড়ি আসতে বলার কি দরকার ছিল? ”
আয়মান হাঁপাচ্ছে। দৌড়ে এসেছে বলে নিঃশ্বাস দ্রুত গতিতে হচ্ছে। ঘনঘন শ্বাস টানছে। ভার্সিটির ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বেঞ্চে বসে পড়ল। বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেয়ে শান্ত হলো। আনিকা’কে ইশারায় পাশে বসতে বলল। আনিকা বসলো। আয়মান ব্যগ্র গলায় বলে ওঠে,
” টাইম মতোই আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু স্পেশাল ক্লাস ছিল সেজন্য আসতে লেট হয়ে গিয়েছে। ক্লাস না করেই চলে আসতে চেয়েছিলাম, তবে স্যারের জন্য সম্ভব হয়নি। খুব খুব সরি। ”
” ওকে। এবার বলুন কেন ডেকেছেন? ”
” কেন ডেকেছি মানে? তোমাকে দেওয়া টাইম শেষ। ভুলে গিয়েছো? ”
” না ভুলিনি। ”
” তো বলো, কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো? ”
” কিসের সিদ্ধান্ত? ”
আয়মান ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চওড়া গলায় শুধাল,
” বুঝেও না বুঝার ঢং করছো? তোমাকে ভাবার জন্য সময় দিয়েছিলাম, আমাকে ভালোবাসবে কি-না সেটার জন্য। ভালো না বাসলেও প্রবলেম নেই। আমার একার ভালেবাসাই যথেষ্ট। শুধু বিয়ের জন্য হ্যাঁ বললেই চলবে। ”
আনিকা ভেঙচি কাটে। ব্যঙ্গাত্মক করে জবাব দিল,
” রাজি না হলে কি করবেন? এমন ভাবে বলছেন যেন আমি আপনাকে গ্রহণ করতে বাধ্য! ”
” অবশ্যই তুমি বাধ্য। আমি ছাড়া তোমার সেকেন্ড কোনো ওয়ে নেই। সো ফাউতা বাজী বাদ দিয়ে আসল কথা বলো। ”
আনিকা ভাবলেশহীন ভাবে জানালো,
” আপনাকে আমার পছন্দ না। ”
আয়মানও ফাটাফট মুখ ঝামটি মেরে উত্তর দিল,
” আমাকে পছন্দ নাকি জানতে চাইনি। তোমার ফাইনাল এক্সাম এর আগে আমাদের এনগেজমেন্ট হবে, তার জন্য তুমি প্রস্তুত কি-না সেটা বলো? ”
আনিকা হতভম্ব হয়ে গেল। ঝাঁঝ নিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে বলে,
” যেখানে আমি আপনাকে পছন্দই করি না, সেখানে আপনার সাথে এনগেজমেন্টর জন্য হ্যাঁ বলবো কিভাবে? ভারী আশ্চর্যজনক মানুষ তো আপনি! ”
” বেশি কথা ভালো লাগছে না। আজকে লাঞ্চ করিনি, ক্ষুধায় পেটে ইদুর দৌড়েচ্ছে। তুমি মেয়ে ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না! আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করে ফেলেছো, আর এখন অ্যাটিটিউড দেখিয়ে মুখে তেজ ফুটিয়ে অস্বীকার করছো? ”
আনিকা গা ছাড়া ভাবে অন্য দিকে চেয়ে বলে,
” আমার বয়ে গেছে আপনাকে পছন্দ করতে। ”
আনিকার কোমর প্যাঁচিয়ে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিলো আয়মান। একদম কাছে, যতটা কাছে গেলে দুজন ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের গাত্রে গাত্রে স্বল্পবাসনা, স্থুলকায়ার জন্ম দেয়! দু’জনের শ্বাসপ্রশ্বাস একে অপরের মুখে আছড়ে পড়ে। আনিকার নাকের সাথে আয়মানের নাক লেগে আছে, আর কপালে কপাল। চার জোড়া পীবর ঠোঁট মাত্র অল্প একটু দূরে। আয়মানের সুগভীর স্পষ্ট প্রকাশযোগ্য অক্ষিপট আনিকার কাজল কালো অক্ষিপটে নিবদ্ধ। আনিকার তনুমন কেঁপে ওঠে আয়মানের ছোঁয়ায়। শরীর বরফ খন্ডের মতো জমে গিয়েছে, নয়তো আনিকা শরীর নাড়াতে পারছে না কেন? বুকের মধ্যে ধকধকানো তবলা বাজছে! হাত,পা থরথর করে কাঁপছে। মাথা ঝিমঝিম করছে।
আনিকার কাঁপাকাঁপি কে প্রাধান্য দিল না আয়মান। এভাবে থেকেই হিসহিসিয়ে বলল,
” পছন্দ করো কি না, সেটা তো আমার একটা ছোট্ট কলে তোমার এখানে ছুটে আসাতে প্রমাণিত হয়েছে। তুমি চাইলে আমার কল ইগনোর করতে পারতে। ভার্সিটির পুকুর পাড়ে একা এসে বসে থাকারও প্রয়োজন ছিল না। তুমি ভীষণ স্মার্ট মেয়ে। আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যতোই হোক পুরুষ মানুষ। তোমার মনে আমাকে নিয়ে এসব চিন্তা বিরাজমান হতে পারতো, তবে হয়নি। কারণ তোমার মন জানে আমি ওরকম টাইপের ছেলে নই। তুমি বাইরে প্রকাশ করো তুমি আমার কথা, কাজে বিরক্ত। কিন্তু সত্যবাণী হলো, তুমি সবসময় আমার সকল কথা মনোযোগ সহিত শ্রবণ করো। আমার দৃষ্টির অগোচরে মিটিমিটি হাসো। তবে তুমি হয়তো জানো না, তোমার ওই শ্যামলাটে মুখের হাসি আয়মানের নজর এড়ায়নি। আমি সত্যি বুঝতে পারি না, কিভাবে তোমার মায়ায় আটকে গিয়েছি? মায়া শব্দটা বড্ড খারাপ। একবার কারো মায়ায় আটকালে তাকে ছাড়া কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না। ”
আনিকা এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল। আয়মানের কথার সমাপ্তি হতেই আস্তে আস্তে চোখ মেলে চায়। আয়মান এখনো ওর দিকে একরাশ মুগ্ধতা সমেত চেয়ে আছে। আয়মানের গভীর চাউনীতে দৃষ্টি রেখেই আলগোছা কোমর থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে, আয়মানের থেকে দূরত্ব বজায় রাখল। মুখে কোনো কথা ফুটলো না। বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস টানল। আয়মানও দাঁড়িয়ে পড়ল। স্লেজ স্বরে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” উত্তর দিচ্ছো না কেন আনিকা? কিছু তো বলো? ”
নিজেকে সামলে আনিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত কন্ঠে বলল,
” আপনি ভীষণ চালাক! ”
” কার সাথে চালাকি করেছি? ”
” আপনি সবার আগে আমার বাবাকে হাত করলেন। তাকে ইমোশনাল কতশত কথাবার্তা বলে বশ করলেন। এরপর আমাকে পটানোর মিশন শুরু করেছেন। চমৎকার! ”
” আমি জানতাম তুমি তোমার বাবার কথা অনেক মানো। তার কথা তুমি ফেলতে পারো না। তাই ভাবলাম হবু শ্বশুরকে আগে পটানো যাক! তবে তোমার বাবাকে আমার মনের যেসব কথা বলেছি, সেগুলো সত্যি ছিল। ”
” ওইদিন আপনার সাথে বাবার কথোপকথন সব শুনে ছিলাম। আপনি আমার উপর রাগ দেখিয়ে না খেয়ে চলে গিয়েছিলেন। ”
আয়মানের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। আনিকা ভেবেছিল আয়মান অবাক হবে। এরকম কিছুই হলো না। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে আয়মান বলে,
” তুমি দরজার বাইরে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিলে সেটা আমি জানি। ”
আনিকা চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে তাকায়। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
” কিভাবে? ”
আয়মান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। কন্ঠ খাদে এনে উৎফুল্লতা নিয়ে জানায়,
” দরজার বাইরে তোমার ওড়নার একাংশ দেখা যাচ্ছিল। ”
আনিকা আর কিছু বলল না। দুজনের মধ্যে পিনপিনে নীরবতা বিরাজ করছে৷ পুকুরের টলমলে পানিতে নজর বুলিয়ে আনিকা বলে,
” সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়িতে ফিরতে হবে। বাবা চিন্তা করবেন। ”
” আনিকা হেয়ালি ভালো লাগছে না। তোমার বাবা আমাকে মেনে নিয়েছে। এখন তুমি বললে, আমার ফ্যামিলি নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যাবো। ”
” পরে বলবো। ”
” পরে না এখন বলো? ভাবার জন্য তো এতদিন সময় দিয়েছিলাম। ”
” আমার পরীক্ষা শেষ হোক। তাছাড়া আপনার অনার্স এখনো কমপ্লিট হয়নি। ”
” এক্ষুনি বিয়ে করে বাসর করে ফেলতে চাচ্ছি নাকি? জাস্ট এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখব। ”
একটু থেমে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে আয়মান হাসি মুখে বলল,
” ওই? তারমানে তুমি রাজি? আমাদের পরীক্ষার জন্য দ্বিধায় ভুগছো? ”
আনিকা থমথমে খায়। শুষ্ক ঢোক গিলল। ভেতরের উত্তেজনা আয়মানের সামনে প্রকাশ করল না। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” মোটেই না। আপনাকে তো আমার সহ্যই হয় না। আমার বাবা যেহেতু আপনাকে পছন্দ করে আর আপনি ছ্যাঁচড়ার মতো আমার পিছু পিছু ঘুরেন তাই দয়া দেখিয়ে ভাবছি, আপনার কথায় রাজি হয়ে যাবো। ”
আয়মান চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” ও হ্যালো? এখনকার মেয়েরা বাবার কথায় নাচে না! নিজেদের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করে। এসব ফাউ এক্সকিউজ অন্যদের বলো, আমাকে না। তুমি আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছো। ওভার অ্যাটিটিউড এর ঠেলায় স্বীকার করছো না। ”
কথা ঘোরাতে প্রসঙ্গ পাল্টে আনিকা বলল,
” চলুন, বাড়ি ফেরা যাক। ”
আয়মান দু কদম এগিয়ে আনিকার কাছে আসে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিরেট স্বরে বলে,
” বাড়িতে তো যাবোই। তবে মনে রেখো, এ সপ্তাহের মধ্যে ফ্যামিলি নিয়ে তোমাদের বাড়িতে আসছি। ”
” এত তাড়াতাড়ি? ”
আয়মান সিরিয়াস কন্ঠে বলল,
” হুম। আমার অপেক্ষা সহ্য হয় না। ধৈর্য্য শক্তি কম! কতদিন আর সিঙ্গেল থাকবো? আজ বাইশটা বছর ধরে বউ বাচ্চার মুখ দেখি না! কষ্ট হবে না, বলো? ”
” আপনার কি মাথা টাতা খারাপ হয়ে গিয়েছে? ”
” আমার মাথা ঠিকই আছে, মেবি তোমার মাথা ঠিক নেই। এখনো সিঙ্গেল জীবন পার করছো, লজ্জা করছে না তোমার? ”
আনিকার চক্ষু কপালে উঠে গেল। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে। বলে কি এই ছেলে? শেষে কিনা এক মেন্টাল ছেলে তার কপালে জুটেছে? ঝাঁঝাল গলায় বলল,
” কিসব আজেবাজে বকছেন আপনি? সিঙ্গেল থাকতে লজ্জা কেন করবে? সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট আমি, এত ছোট থাকতে বিয়ে করার কি আছে? ”
আয়মান ঠেস মেরে ঠোঁট উল্টে বলে,
” ওলে, আমার কচি খুকি সোনারে! তুমি নিজেকে ছোট ভাবছো? হুহ্! জানো? আমার বড়ো ভাইয়ের বউ বয়সে তোমার থেকে অনেক ছোট। দশম শ্রেণীতে পড়ে। সে আমার ভাইকে বিয়ে করে বাসর করে ফেলেছে। ”
” আমাকে বলছেন কেন? ”
” তোমাকেই তো বলবো। কারণ তুমি ভাবীর থেকে বড়ো, বুঝদার মেয়ে মানুষ! ”
পরমুহূর্তেই নাক টানার মতো অভিনয় করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
” যেদিন আমার ভাইয়ের বাসরের ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজের রুমে এসেছিলাম? সেদিন তোমাকে কত্ত মিস করেছি। মেয়েদের প্রতি আকর্ষিত না হওয়া আমার ভাই, কচি বউ পেয়ে রুম থেকে বেরুতেই চায় না! মনে হয় প্রতিদিনই বাসর করে। পরপর দুইদিন ভাই’কে সকালে গোসল করতে দেখেছি। যদিও কলেজে গেলে সকালে গোসল করে, বাট ভাবীকে ভেজা চুল মুছে বারান্দায় দড়ির মধ্যে তোয়ালে মেলতে দেখেছি। তারমানে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? নিশ্চয়ই, প্রতি রাতে ফুটবল খেলে। ”
” ইয়া আল্লাহ, মাবুদ! ছিঃ! চুপ করুন, বজ্জাত ছেলে! নিজের বড়ো ভাই-ভাবীর দিকে এভাবে নজর বুলাতে লজ্জা করে না? ও হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি একটা নির্লজ্জ! লজ্জাও আপনাকে দেখে লজ্জা পাবে। ”
আয়মান চনমনে চিত্তে দাম্ভিক সহিত বলে,
” আমি তাদের দিকে নজর রাখতে যাবো কোন দুঃখে? বেডরুমের দরজা খোলা ছিল, ভাইকে ডাকতে গিয়ে দেখেছিলাম। তবে তুমি এত চাপ নিও না। মেয়েদের প্রতি আমার কোনো ইন্ট্রাস্ট নেই। আমাদের এনগেজমেন্ট হলে তোমার হাতটা পর্যন্ত স্পর্শ করবো না, দুরত্ব মেইনটেইন করে চলবো। শুধু মাঝে মাঝে দু’একটা চুমু টুমু খাবো, এই আর কি। এছাড়া বেশি কিছু করবো না, যা করার বিয়ের পর করবো। আঃফ্টার ওল্ আই এম অ্যা ইনোসেন্ট বয়। ”
বলেই ঝুঁকে আনিকার গালে টুপ করে একটা চুমু খেল। সময় ব্যয় করল না। তুরন্ত পেছন ফিরে হাঁটা ধরল। যেতে যেতে হাঁক ছেড়ে আনিকা ‘কে তার পিছু পিছু পা চলাতে বলল।
এদিকে আনিকা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। আয়মানের ভেজা চুমু আনিকার মসৃণ গালে লেপ্টে রয়েছে। আনমনে এক হাত গালে রাখল আনিকা। যেখান টায় আয়মান চুমু খেয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে আয়মানের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। নিজে হাঁটতে বেমালুম ভুলে গেল। মস্তিষ্কের ভেতর আয়মানের আগোছালো বাক্য গুলো দাপাদাপি করছে। এনগেজমেন্ট হলে দুরত্ব মেইনটেইন করবে? অথচ চুমু খেতে কোনো সমস্যা নেই!
গরমের রাতের আকাশ এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা, যা মনকে প্রশান্তি ও শান্তি দেয়। দিনের গরম তাপের পর, যখন রাতের অন্ধকার সবকিছু গ্রাস করে, তখন প্রকৃতি এক নতুন রূপে ধরা দেয়।
আগুন বুকে হাত গুঁজে মোমের পাশে সটান হয়ে দাঁড়িয়। সে খাতায় কিছু লিখছে। আগুন গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল,
” পড়া কতদূর মোম? ”
মোম হকচকিয়ে যায়। তুরন্ত খাতাটা বন্ধ করে ফেলল। জোরপূর্বক হেসে বলল,
” এই তো আর একটু। ”
আগুন ধারাম করে টেবিলে হাতে থাকা স্টিলের স্কেল দিয়ে শব্দ তুলল। কাঠের ডিজাইনার কাঠামো টেবিল টা ভুমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠল, সাথে মোমের পাতলা শরীর। গমগমে গলায় প্রশ্ন করলো,
” গত আড়াই ঘন্টা ধরে একই কথা বলছো, আরেকটু আরেকটু! এখনো তোমার পড়া শেষ হয়নি? পড়া টুকুন সোনারগাঁওয়ে যাওয়ার আগে দিয়েছিলাম, এতদিন কি করেছো? পরীক্ষার সময় যে ঘনিয়ে আসছে, মাথায় আছে কি? কিছু বলি না বলে মাথায় চড়ে বসেছ! কথা গায়ে মাখো না!
মোম চুপসানো মুখে ভীতিকর নজরে বলে,
” কোথায় আপনার মাথায় চড়েছি? আমি তো চেয়ারে বসে আছি। ”
আগুন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে সিরিয়াস কথা বলছে আর এই মেয়ে….? ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস টানল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টেবিলে রাখা খাতার উপর মোমের হাতটা পরক্ষ করল। শক্ত করে খাতাটা ধরে রেখেছে।
” দেখি খাতাটা দেও তো। ”
মোমের ছোট্ট কায়া ধড়ফড়িয়ে উঠে। শুষ্ক ঢোক গিলে মেকি হেসে বলল,
” খাতা নিয়ে আপনি কি করবেন? ”
” সেটা আমি বুঝে নিবো। ”
মোম দিল না। আগুনও অপেক্ষা করল না। টান দিয়ে খাতাটা নিয়ে গেল। অল্পসংখ্যক পৃষ্ঠা উল্টাতে চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো, এবড়োখেবড়ো আঁকা একটা মানুষের ছবি। ছবিটার নিচে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা গুলো আগুন স্বীয় কন্ঠস্বরে উচ্চারণ করলো,
” কুমড়ো মার্কা, গোমড়া মুখো মাস্টার মশাই। আপনি এত রাগী কেন? কথায় কথায় ধমক দেন কেন? আপনি যখন ধমক দেন, তখন আমি পঁচা পান্তা ভাতের স্বাদ পাই। যখন রাগী গলায় কথা বলেন, তখন আমি অটো-রিকশার ঠ্যাডের ঠ্যাডের আওয়াজ শুনতে পাই। যখন শাসন করেন, তখন আমি তিতা করলার গন্ধ পাই। যা তিতা হলেও স্বাস্থ্যকর। যখন আমার যত্ন করেন, তখন আমি বাবা-মায়ের ছায়া দেখতে পাই। যখন আপনি আদর করেন, তখন……”
লাস্টের লাইনের বাক্য অসম্পূর্ণ। মনোযোগ সহকারে পুরো লেখাটা পড়ল আগুন। ভ্রু কুঁচকে সুগভীর চাউনীতে তাকাল মোমের দিকে। মোম সহসা জিভ কাটল। চোখ খিঁচে বন্ধ করে রাখল। লজ্জায় হাঁসফাঁস লাগছে। মোমের কর্ণগোচরে ভেসে আসলো আগুনের ভরাট কন্ঠস্বর,
” তুমি পড়া রেখে খাতার মধ্যে এসব হাবিজাবি লিখছিলে? তোমার সাহস দেখে আমি রীতিমতো হতবিহ্বল হয়ে যাচ্ছি! ”
মোম চোখ খুলে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে আচমকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতে আগুনের ভাবান্তরের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা গেল না। বরং মুখবিবরে ফুটে উঠল বিরক্তিকর ভাব।
” আর কিছু পারো আর না পারো, ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নাকাটি করতে ভালোই পারো! একদম কান্না করবে না। কান্না করার মতো কিছু হয়েছে? প্রশ্ন করেছি উত্তর দিবে। ”
মোম কোনো টু শব্দ করল না। একমনে কেঁদেই চলেছে। ঘন পাপড়ি যুক্ত নয়ন জোড়া চোখের জলে ভিজে জুবুথুবু হয়ে রয়েছে। নাক টা লাল হয়ে গিয়েছে। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে তো কাঁদছেই। কান্নার তোপে রক্তজবা ঠোঁট দুটো তীর তীর করে কাঁপছে। সেদিকে নজর পড়তেই আগুনের ঘোর লেগে যাচ্ছে। আজকে নিজের কামুকতা অগ্রাহ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” কি পেয়েছটা কি তুমি? এভাবে কেঁদে কেঁদে নিষ্পাপ মুখশ্রী বানিয়ে ফেললেই আমি বারবার গলে যাবো? এরকম কিছু ভেবে থাকলে সেটা তোমার ভুল ধারণা। ”
মোম নাক টেনে ভাঙা গলায় বলে,
” খাবো। ক্ষুধা পেয়েছে। ”
আগুন অবিশ্বাস্য নিস্প্রভ চোখে চেয়ে থাকল। এতক্ষণ ধরে কাকে কি বলল ও? তেজি গলায় বলে ওঠে,
” খেতে হবে না। এক রাত না খেলে কিছু হবে না। আজকে পড়া না দিয়ে খাওয়া, ঘুম কোনটাই করতে পারবে না। ”
মোম গাল ফুলিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ও পড়াটা সম্পূর্ণ পারে, তবে আগুন জিজ্ঞেস করলে সঠিক উত্তর দিতে পারে না। আগুন প্রশ্ন করে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে, যার দরুন সব উত্তর কেমন গুলিয়ে যায়।
আগুন লম্বা শ্বাস টানে। মোমের চোখের পানি মুছে দেয়। কপালে গাঢ় করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শান্ত কন্ঠে বলল,
” এখনো তোমার অর্ধেক সিলেবাস কমপ্লিট হয়নি। কত পড়া বাকি রয়েছে জানো? একদিন পড়বে দশদিন পড়বে না, এমন করলে হবে? নিয়মিত পড়াশুনা করতে হবে। তবেই না ভালো রেজাল্ট আশাকরা যাবে। ”
” আমি পড়েছি তো, কিন্তু আপনি পড়া ধরলে কেন যেন বলতে পারি না। ”
” কেন পারো না? ”
” সেটা তো আমিও বুঝতে পারি না। ”
” খাতার মধ্যে ওইসব লিখে সময় নষ্ট করেছো কেন? ”
” আর লিখবো না। ”
” মনে থাকবে? ”
” থাকবে। ”
আগুন বুক থেকে মোম’কে সরিয়ে অঞ্জলিপুট মোমের মুখশ্রী তুলে নিলো। চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত শীতল গলায় বলে,
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৩
” আমি কি তোমাকে বকেছি, নাকি মেরেছি? বলেছিলাম না, অযাচিত কান্না আমার পছন্দ না? তাও তুমি কাঁদছো! এরকম কেন করো? ”
মোম জবাব দিল না। এখনো মুখ গোমড়া করে রেখেছে। আগুন, মোমের নাকের ডগায় চুমু খেল। হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বলল,
” কেঁদে কেটে আমার রাগ পানি করতে ওস্তাদ ইনি! ট্রিকস টা খারাপ না। ”