শুভ্ররাঙা ভালোবাসা শেষ পর্ব
সুমাইয়া সুলতানা
খোলা আকাশে উজ্জ্বল মিটিমিটি তারকারা জ্বলজ্বল করছে। রাতের আকাশে তারার সৌন্দর্য যেন এক অপার্থিব স্বপ্নের মতো। চারপাশ যখন ঘুমিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন আকাশে অগণিত তারা ঝিকিমিকি করে জ্বলে ওঠে, যেন অন্ধকারের চাদরে ছড়িয়ে থাকা মুক্তোরাশি। ঝলমলে তারাগুলো কখনও ছোট, কখনও বড় দেখায় কিছু উজ্জ্বল, কিছু ম্রিয়মাণ। ছাদের উপর দাঁড়িয়ে এই তারাভরা আকাশের নিচে সময় কাটানো মানেই এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করা।
ছাদে আসা মাত্র আনিকা ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো। রেগে কটমট করে আয়মানের পানে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেয়ে আছে। রাগে শরীর কনকনে শীতের মতো ঠকঠক করে কাঁপছে। আগুনের সামনে থেকে টেনে আনায় রাগ করেনি! আজকে রাগের কারণ, আনিকা যখন আয়মান’কে কেক খাইয়ে দিতে চেয়েছিল তখন আয়মান খায়নি। ভাব নিয়ে আনিকা’কে ইগনোর করেছে। অমনি রেগে বোম হয়ে রয়েছে।
আনিকা গটগট কদমে চলে যেতে চাইল। আয়মান বাঁধা প্রদান করল। ছাদের দরজা বন্ধ করে ফটাফট আনিকার সামনে এসে দাঁড়ায়। আয়মান হাত ধরতেই।
আনিকা তেজি গলায় বলল,
” ছাড়ুন! ”
আয়মানের অটল জবাব,
” ছাড়ার জন্য ধরেছি নাকি? ”
আনিকা মুখ ঝামটি মেরে চোখমুখ অন্ধকার করে রেখেছে। ছাদের এক সাইডে দোলনা রাখা আছে। আয়মান সরু চোখে চেয়ে আনিকার কোমর প্যাঁচিয়ে দোলনায় বসে পড়ল। আনিকা বর্তমানে আয়মানের কোলে অবস্থান করছে। আনিকা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। অভিমানের পাহাড় জমেছে মনগহীনে। নেত্রদ্বয়ে লেপ্টে রয়েছে বিষাদের ছাপ।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
হঠাৎ গলায়, গালে ঠান্ডা কিছুর পরশ পেতেই আনিকা লোমহর্ষক ভাবে চকিতে আয়মানের দিকে দৃষ্টি তাক করল। আয়মান কেকের ক্রীম তার গায়ে লাগিয়ে দিয়েছে। আচমকা আনিকার গলদেশে মুখ ডুবিয়ে আয়মান লিক করতে লাগল। আকস্মিক আক্রমণে আনিকা হকচকিয়ে যায়। চোখ খিঁচে বন্ধ করে পেলব হাতে আয়মানের চুল খামচে ধরল। তার নিঃশ্বাসের গতি জোরালো। গলা হতে মুখ উঠিয়ে আয়মান এবার আনিকার গাল স্পর্শ করল। ঠোঁটের সাহায্যে আনিকার গালের ক্রীম গলাধঃকরণ করে ফেলল। সবটুকু ক্রীম সাবাড় করে ক্ষান্ত হলো।
তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাঁকা হেসে দুষ্টু কন্ঠে আয়মান বলল,
” এখন মনে হয়েছে কেক খেয়েছি। এতক্ষণ স্বাদটা কেমন পাংশুটে মনে হয়ছিল। ”
আনিকা আইঢাই করে ওঠে। ভেঙচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
আয়মান হাসল। অধর এগিয়ে আনিকার গালে চুমু খেল। কোমরে আরও শক্ত করে চাপ প্রয়োগ করে কাছে নিয়ে আসলো। আনিকার মুখ এদিকে ঘুরিয়ে স্লেজ স্বরে বলল,
” কেক খেয়েছি তো। তোমার থেকেই খেয়েছি। আশাকরি এবার সব অভিমান বিলীন হয়ে গিয়েছে। ”
আনিকা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো। কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে কটাক্ষ করে বলল,
” অসভ্য! বেহায়া! নির্লজ্জ! কথা নেই আপনার সাথে। ”
উন্মুক্ত গগনের নিচে দম্পতির নৈঃশব্দের দীর্ঘ সময় শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যতীত কোনো কিছুর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হয়তো দূর হতে শব্দ ভেসে আসছে কিন্তু দম্পতির কর্ণধার হয়নি! আয়মান’কে মৌন দেখে আনিকা মনটা খারাপ হয়ে গেল। আয়মান কি কষ্ট পলো? কোনও শব্দ কেন পাচ্ছে না আনিকা?
আয়মানের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যুক্ত গালে আনিকা গাল ঘষে মিহি স্বরে বলল,
” আমার কথায় আপনার খারাপ লেগেছে? দুঃখিত! ”
আয়মান চোখ তুলে চায়। আনিকার কপালে প্রগাঢ় চুমু বসিয়ে থমথমে গলায় বলে,
” তোমার কোনো কিছুই আমার খারাপ লাগে না। তাহলে কথায় কেন খারাপ লাগবে? ”
আনিকা আটঘাট বেঁধে আরও জড়োসড়ো হয়ে আয়মানের কোলে বসে থাকে। গালে এক হাত ছুঁয়ে চুপচাপ আয়মান’কে দেখতে থাকল।
আনিকার বুকে মাথা রেখে আয়মান আবেগ সমেত ভরাট কন্ঠে বলে,
” অ্যাই শ্যামকন্যা! কি আছে তোমার মাঝে? যার দরুন তোমার প্রতি আমার নেশা দিনদিন বেড়েই চলেছে! আহামরি সুন্দরী রমণী তো তুমি নও। তাহলে আমি কেন দেশের সাদা চামড়ার মেয়েদের রেখে বারংবার তোমার ওই কাজল কালো চোখের মায়ায় আটকে যাই! তোমার শরীরের গন্ধ না পেলো ইদানীং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। বুক ধড়ফড় করে। এমন কেন হয় বলতে পারো? ”
আনিকা টলমল নয়ন জোড়া মেলে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। মুখটা আরও কাছাকাছি নিয়ে ছোট করে উত্তর দিল,
” আপনি শুধু আমাতেই আটকাবেন। আমার জন্য পাগলামো করবেন। আপনার এসব সুখকর পাগলামো সহ্য করার ক্ষমতা রাখি আমি। বুঝেছেন? ”
আয়মান ঠোঁট এলিয়ে একপেশে হাসল। প্রতিত্তোরে আলতো করে আনিকার চোখের পাতায় চুমু খেল। বেহায়া ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিল গাল। হাতের বিচরণ অঢেল রইল। আঙুলের উষ্ণতা যেন বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে আনিকার শরীরে। আনিকা চোখ বন্ধ করে অনুভব করে সেই মুহূর্তের যাদু। আয়মানের ঠোঁট আলতো ভাবে ছুঁয়ে যায় আনিকার ঠোঁটে। প্রথমে হালকা স্পর্শ, তারপর ধীরে ধীরে গভীর হয়ে ওঠে। চুমুর সেই স্পর্শে সময় যেন থমকে যায়। আনিকা হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, তার হাত মুঠো করে আয়মানের শাটি-র্ট আঁকড়ে ধরে। আয়মানের হাত আনিকার ঘাড়ে চলে আসে, তাকে আরও কাছে টেনে নেয়। হাওয়ার মৃদু শিস, রাতের তারাদের ঝিকিমিকি সব যেন তাদের এই মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঠোঁট ছেড়ে আনিকার থুতনিতে চুমু দিয়ে আয়মান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দুজনের চোখে একরাশ ভালবাসা, ঠোঁটে এক অদ্ভুত স্মিত হাসি।
আয়মান আনিকার হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বলল,
” তুমি জানো, এই রাত, এই আকাশ সবকিছু তোমার মতোই সুন্দর। ”
আনিকা একটু লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, আর এই লাজুক হাসিটাই আয়মানের মন ভরে দেয় আনন্দে।
” বেশি বেশি বলে ফেলছেন! ”
” একদম না! আমার ডার্লিং অলওয়েজ চমৎকার একজন রমণী। আমার ব্যক্তিগত শ্যামকন্যা। ”
” সময় যদি এখানে স্থির হয়ে যেতো! এই রাত যদি কখনও শেষ না হতো। ”
আয়মান, আনিকার মাথায় চুমু খেয়ে, চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
” তুমি পাশে থাকলে রাত আমার দিনের মতো আলোয় ভরে ওঠে। আমার জোনাকিপোকা তুমি!”
আনিকা, আয়মানের বাহু আঁকড়ে ধরে মিহি কন্ঠে বলল,
” ছাদের মধ্যে এই তারাভরা আকাশের নিচে সময় কাটানো মানেই এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করা। মনে হয়, আকাশের এই তারারা আমাদের হাজারো গল্প জানে। কখনও আনন্দের, কখনও বিষাদের। আর তারা চুপচাপ থেকে আমাদের মনে স্বপ্ন বুনে যায়। ”
আয়মান ঝুঁকে আসে। আনিকার কানের লতিতে চুমু খায়। কন্ঠে আবেগ আকুলতা ঢেলে হিসহিসিয়ে বলে,
” তোমার ভাসুর বাবা হয়ে যাচ্ছে। আমি কবে বাবা ডাক শুনতে পাবো? ”
আনিকার লজ্জায় হাঁসফাঁস লাগছে। দন্তপাটি দিয়ে আয়মানের বুকে কামড় বসিয়ে দিল। কনুই দিয়ে পেটে গুতা মারল। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চোখ বন্ধ করে আয়মানের বুকের সঙ্গে মিশে রইল।
আয়মান ঠোঁট কামড়ে হাসে। আনিকার অগোছালো চুলের ভাঁজে পরপর কয়েকটা চুমু খেল। মুগ্ধতা সমেত পুনরায় একই ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল,
” আমাদের প্রেমময় উন্মাদনা, ভালোবাসার সফর শেষ হবার নয়। প্রতিটি স্মৃতি আমাদের হৃদয়ের উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে চিরকাল। শুভ্রতার আভায় মোড়ানো আমাদের এই পথচলা সময়ের পরিসীমা অতিক্রম করে চিরস্থায়ী হবে। শুরুতে যেমন মায়াবী ছিল আমাদের ভালোবাসার গল্প, শেষেও তেমনই অনন্ত থাকবে তার সৌন্দর্য। আমাদের পথ চলার ধ্রুবতারা হয়ে থাকবে বিশ্বাস, একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি। যেখানে সমাপ্তি বলে কিছু নেই, আছে শুধু ভালোবাসার অবিরাম স্পর্শ। যার শুরু তো আছে, তবে শেষ নেই। ”
সাদা লাইটের আলোতে বদ্ধ কক্ষে মোমের দু’হাত বিছানার সঙ্গে চেপে ধরে তারউপর ঝুঁকে রয়েছে আগুন। মোম চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে চেয়ে আছে। আগুন পলকহীনভাবে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। মোম বুঝতে পারছে না, আগুন এমন করছে কেন? দীর্ঘক্ষণ একই অবস্থায় থাকায় মোমের ঘাড় ব্যথা করছে। মাথার নিচে বালিশ নেই। আগুন ওকে নড়তে দিচ্ছে না। মোম বৃথা চেষ্টা করে আগুন’কে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল, কিন্তু সক্ষম হলো না।
মোম বিরক্ত চাউনী নিক্ষেপ করে বলে,
” কি দেখছেন? ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” দেখছি, আমার কোমলমতি কত বড়ো হয়ে গেল। ”
” মানে? ”
আগুন, মোমের বুকে ঠোঁট ছুঁয়ে ধীর গলায় বলল,
” মানে বেশি বেশি আদর করার জন্য পারফেক্ট বয়স হয়ে গিয়েছে। ”
মোমের শরীর শিউরে উঠল। একটু নড়ার চেষ্টা করলেও বিশেষ লাভ হয়নি। মানুষটার বলবাণ শরীর বালিশের মত ঠেসে রেখেছে তাকে।
ছটফটিয়ে বলে উঠলো,
” এরকম করছেন কেন? সড়ুন ”
আগুন সড়ল না। নড়লও না। একইরকম গায়ের সাথে মিশে থেকে শুধাল,
” আজকের রান্ন করেছে কে? তুমি?
মোম ছোট করে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” আমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান কি তুমি করেছো? ”
” জ্বি। ”
আগুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এই সুন্দর সাজ কি আমার জন্য সেজেছো? ”
মোম ঠোঁট উল্টে ত্যাড়া কন্ঠে খোঁচা মেরে বলল,
” নাহ্! আমার আরও দশ-বারো টা জামাই রয়েছে তাদের জন্য! ”
আগুন তুরন্ত মোমের গলায় মুখ ডুবিয়ে ছোট ছোট কামড় দেওয়ার পাশাপাশি চুমু দিতে শুরু করল। মোমের নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম। কিছুটা শক্তি খাঁটিয়ে আগুন’কে সরিয়ে কোনো রকম উঠে বসলো। জোরে জোরে শ্বাস টানছে। আগুন পুনরায় কাছে টেনে নিলো। গালে ঠোঁট বুলিয়ে দুপাশ হতে দুইবাহু চেপে ধরল। চোয়াল শক্ত করে ধমকে বলল,
” সাহস বেরে গিয়েছে? ”
মোম পলক ঝাপটিয়ে সরল গলায় বলল,
” তাহলে প্রশ্ন কেন করছেন, কার জন্য সেজেছি! আপনি ছাড়া আর কার জন্য সাজবো? ”
আগুন চক্ষু হাসল। মোমের রক্তজবা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে নেশাক্ত কন্ঠে বলল,
” আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি কোমলমতি। এখন এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? ”
মোম ঠেলে আবার সরিয়ে দিল। তাকায় আগুনের আদলে। তার ঠোঁটে দূর্বোধ্য হাসি। নিগূঢ় চাউনীতেও তাই। ঝট করে এক টান মারল, উত্তাল ঢেউয়ের ন্যায় বুকের মধ্যে এসে আছড়ে পড়ল মোম। হকচকানো দৃষ্টি তুলতেই আগুন ভ্রু নাঁচাল,
” খবরদার! আমার থেকে বিন্দু পরিমাণ দূরে যাওয়ার চেষ্টাও করবে না। ”
একটু থেমে লম্বা শ্বাস টেনে ব্যগ্র গলায় ফের বলে,
” তোমার সারপ্রাইজে আমি অ্যাপ্রিশিয়েট হয়েছি। আমারও তো উচিত তোমাকে কিছু দেওয়া। ”
মোম চওড়া হাসি উপহার দিয়ে বলে,
” আমার আর কিছু চাই না। এ পর্যন্ত আপনি অনেক দিয়েছেন। সেগুলো নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। ”
আগুনের কন্ঠে নিপাত জেদ,
” আমি দিবোই। ”
” কি দিবেন? ”
” আমার ভালোবাসা। ”
মোম লজ্জায় নুইয়ে গেল। আড়ষ্টতায় ক্ষুদ্র সত্তা বুঁদ হলো। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে বলল,
” আমার আপনাকে কিছু বলার আছে। ”
মোমের ঘাড়ের চুল গুলো অন্য পাশে নিয়ে, উন্মুক্ত ঘাড়ে আগুন উষ্ণ ওষ্ঠপুট চেপে ধরল। লম্বা শ্বাস টেনে মেয়েলি শরীরি ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে লুফে নিলো। সেথায় ঘনঘন চুমু খাচ্ছে। অধর দ্বারা স্লাইড করছে অবলীলায়। মোমের শরীর দুলে উঠল। হাঁসফাঁসে বিমূঢ় অবস্থা।
মোমের কানের পিঠে চুমু খেয়ে আগুন শীতল গলায় শুধায়,
” বলো? ”
মোম শুষ্ক ঢোক গিলল। কথাটা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। হা করে বলার পূর্বেই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করল। মোম হকচকিয়ে যায়। উৎকন্ঠিত নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল। আগুন তাকে কোলে তুলে বেলকনির দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে বলল,
” আজ চন্দ্র বিলাস করবো। ”
বেলকনিতে এসে মোম’কে নিয়ে আগুন কাউচে বসে পড়ল। আগুনের হাত মোমের পেটে বিচরণ করছে। মোমেন কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে নিরেট স্বরে বলল,
” তখন কি বলতে চাইছিলে, এবার বলো? ”
মোম সময় নিলো। নিজেকে ধাতস্থ করল। চোখমুখ খিঁচে সুমধুর বাক্য আওড়াল,
” আপনি বাবা হতে চলেছেন, মাস্টার মশাই। ”
মোমের কথা আগুনের কর্ণগোচর হলো বটে। কিন্তু মস্তিষ্ক ক্যাচ করতে সক্ষম হলো না। ভাবুকতা গলায় প্রশ্ন করলো,
” বুঝলাম না? ”
আগুনের হাত টেনে মোম নিজের পেটে রাখল। ছলছল চোখে চেয়ে ভঙ্গুর গলায় জানালো,
” আপনার আর আমার ভালোবাসার অস্তিত্ব রয়েছে এখানে। ”
আগুন থমকে গেল। বক্ষস্থল প্রচন্ড গতিতে ধরাস ধরাস করছে। হতবিহ্বল অক্ষিপটে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তীব্র উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে। মূর্তির মতো চুপচাপ ঠায় বসে। কথা বলতে চাইছে কিন্তু পারছে। কন্ঠনালী ভেদ করে কথা বের হচ্ছে না। ব্রীড়ানতায় অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। অনুভূতির অচেনা এই তাণ্ডবলীলায় গোটা শরীর থেমে গিয়েছে। আচ্ছা, পৃথিবী কি আগুনের অন্তঃস্থিতর ন্যায় থমকে আছে? ঘড়ির কাঁটা চলছে না? না কি ওর শ্বাস আটকে পড়েছে বুকে! এই জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মত অস্থির ভাবটা কীসের তবে?
আগুনের বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় মুখমন্ডলে মোম নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। আগুনের ভাব ভঙ্গি বোধগম্য হচ্ছে না। আগুনের মন মস্তিষ্কে কি চলছে বোঝা বড়ো দায়! মোমের উৎকন্ঠায় ভয় জেঁকে বসেছে। কতবার আগুনের থেকে বাচ্চা চেয়েছে। কিন্তু আগুন বারংবার ফিরিয়ে দিয়েছে। কান্নাকাটি, রেশারেশি, চ্যাঁচামেচি করেও লাভ হয়নি। আগুনের নিজের জেদে অটল থেকে বলেছে, একুশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত যেন বাচ্চার কথা মাথাতেও না আনে। এখন মোমের আঠারো বছর চলমান। সেজন্য কি মানুষটা মেনে নিতে পারছে না? রেগে গিয়েছে কি লোকটা? কোনও প্রশ্নেরই কোনও সুরাহা সে পাচ্ছে না। ড্যাবড্যাবে নজর দুটো শুধু একভাবে আগুন’কে দেখছে। মোমের পৃথীবি দুলে উঠল। এসব চিন্তা করে পৃষ্ঠদেশে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বুকের মাঝে অস্থিরতার শেষ নেই। ভয়ে হাত, পায়ে নামল কম্পন। থেমে থেমে ক্ষুদ্র শরীর টা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মোমের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ঘনঘন শ্বাস টানছে।
সেই মুহূর্তে মোম অনুভব করল কেউ তাকে নিজের বাহুডোরে বেষ্টনী করে রেখেছে। আগুন তাকে প্রচন্ড শক্তি খাঁটিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আগুনের শরীর মৃদু কাঁপছে। মোম টের পেলো ঘাড়ে ফোঁটা ফোঁটা পানিরকণা টপটপ করে পড়ছে। আগুন কি কাঁদছে?
মোম নিজের থেকে আগুন’কে ছাড়িয়ে নিলো। আগুনের চোখে অশ্রু দেখে নিজেও কেঁদে দিল। আগুনের দুচোখ ছাপানো অদ্ভুত কোনও মুগ্ধতায়। আগুন, মোমের ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে কাঁদতে নিষেধ করল।
মোম হেঁচকি তুলে কাঁপা গলায় অভিযোগ জানায়,
” আপনার মৌনতা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল, জানেন কি? ”
আগুন প্রতিত্তোর করল না। খসখসে অঞ্জলিপুটে মোমের কোমল স্নিগ্ধতায় ভরপুর মুখশ্রী তুলে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলল। আগুন পাগলের মতো একবার মোম’কে বুকে জড়িয়ে ধরছে তো একবার পুরো মুখমন্ডল জুড়ে অসংখ্য চুমু খাচ্ছে। আগুনের আদর খেয়ে মোম ধীরে ধীরে শান্ত হলো। কিয়ৎকাল পর সময় নিয়ে দুজন স্বাভাবিক হলো।
আগুন ঝুঁকে মোমের পেটে দৃঢ় চুম্বন করে সেথায় মাথা রাখল। প্রফুল্ল সতেজ হেসে চনমনে কন্ঠে বলল,
” ভালোবাসি কোমলমতি। ভালোবাসি আমাদের অস্তিত্ব’কে। অনেক বেশি ভালোবাসি আমার বাবুর আম্মু’কে। ”
মোম চমকে উঠল। কিয়ৎপরিমাণ থম মেরে বসে রইল। পরমুহূর্তে আগুনের মুখে এই প্রথম ভালোবাসি শব্দ শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এই ছোট্ট জীবনে মোমের অপূর্ণ কিছুই নেই। সবকিছু কানায় কানায় ভরে গিয়েছে। এতদিন যা শুনতে চেয়েছিল, আগুন আজ সেটাও শুনিয়ে দিল। মোমের আর কিছু চাওয়ার নেই। মোমের কান্নায় আগুন হকচকিয়ে যায়। মোম’কে আদুরে সহিত প্রসস্থ বুকে জড়িয়ে নিলো।
মোম চোখে জল সমেত ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি খুশি হয়েছেন? ”
আগুনের চোখে পানি চিকচিক করছে। মোমের নাকে চুমু খেল, নাকে নাক ঘষে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
” কেন খুশি হবো না? তোমার পাতলা গড়নের চুনোপুঁটি মার্কা শরীরের কথা চিন্তা করে আমি এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিতে চাইনি! তার মানে এই নয় যে আমার বাচ্চা আসছে শুনে অখুশি হবো কিংবা অসন্তোষ হবো। আজকের জন্মদিন উপলক্ষে বেস্ট গিফট এটা ছিল, আমার কোমলমতি। ”
মোম অশ্রু সিক্ত নয়ন জোড়া আগুনের আদলে নিবদ্ধ করে, অনুরোধ সমেত আর্জি জানালো,
” আরেকবার বলবেন? ”
আগুন ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
” কি? ”
” ভালোবাসি কথাটা! ”
আগুন মুচকি হাসল। মোমের গলায় চুমু খেয়ে শীতল গলায় বলে উঠলো,
” ভালোবাসি। ”
মোম চোখ বুঝে ফেলল। প্রশান্তি হেসে ফের চোখ মেলল। খেই হারিয়ে আগুনের মুখটা নরম তুলতুলে হাতে তুলে নিলো। পদ্মকুড়ির ন্যায় লাল অধর জোড়া এগিয়ে আগুনের গালে, কপালে নাকে টুপটাপ বৃষ্টির মতো চুমু খেল।
আগুন হতভম্ব হয়ে নেত্রদ্বয় বড়ো বড়ো করে ফেলল। আগুনের বেসামাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মোমের সম্ভূতি ফিরল। নিজের কাজে নিজেই লজ্জায় আড়ষ্টতায় আটকে পড়ল। সরে আসতে নিতেই আগুন বলিষ্ঠ হাতে উদরে চাপ প্রয়োগ করে কাছে টেনে নিলো। আগুনের কোটরে বিষ মেশানো মাদকতা। যা দেখে মোমের দেহের সমস্ত শিরায় অবধি রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মেয়েটা বেশিক্ষণ ওই নেশালো চোখে চোখ রাখতে পারলো না। চট করে নামিয়ে নেয় নিচে। খুব কষ্টে মুখ খোলে,
” এভাবে তাকাবেন না, ধ্বংস হয়ে যাবো। ”
মোমের ঠোঁটে শব্দ করে চুমু খেয়ে নেশাক্ত, আবেগীয় গলায় আগুন বলল,
” ভালোবাসার ধ্বংসে কেউ ধ্বংস হয় ন। জানোই তো তোমার থেকে দূরত্ব সহ্য হয় না। তবুও সরে যেতে চাচ্ছো? ”
মোম পেলব দু’হাতে আগুনের গলা জড়িয়ে ধরে। ব্যগ্র গলায় বলে,
” আপনার থেকে দূরে যাওয়ার সাধ্যি আমার আছে? আপনাকে ছাড়া তো নিজেকে কল্পনাই করতে পারি না। ”
আজ আকাশে গোলাকার সুন্দর চাঁদ উঠেছে। প্রকৃতিতে মৃদুমন্দ বাতাসে বইছে। চাঁদের কিরণ উঁকি দিচ্ছে প্রেমে বুঁদ হওয়া দুই কপোত-কপোতীর বেলকনিতে। আগুনের নিকট আকাশের বুকে থাকা চাঁদের থেকে, আগুনের বুকের চাঁদটা বেশি সুন্দর আর দামী মনে হচ্ছে।
আগুন, ওষ্টপুট এগিয়ে মোমের ললাটে এক মৃদু চুমু খায়। মোম চোখ বন্ধ করে অনুভব করে সেই স্পর্শের উষ্ণতা। আগুনের ছোঁয়ায় মোম শিহরিত হয়। দু’জনের মধ্যে যেন কোনো শব্দ নেই, শুধু অনুভূতির এক গভীর স্পন্দন। নীরব রাত, চারপাশে নিস্তব্ধতা। দু’জনেই একে অপরের খুব কাছে। আগুন, মোমের চোখের দিকে গভীরভাবে তাকায়। তার দৃষ্টি এতটাই তীব্র যে মোম লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
আগুনের বুকে মাথা রেখে মোম মিহি স্বরে বলল,
” আপনার আমার ভালোবাসার প্রণয় হাজার বছরেও শেষ না হোক। ”
মোমের কপালে কপাল ঠেকিয়ে, ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল আগুন। কন্ঠে মাদকতা মিশিয়ে হাস্কিস্বরে বিড়বিড়িয়ে আওড়াল,
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৩
❝ আকাশ জুড়ে চাঁদের আলো,
সোনালি রঙ ছড়ায়।
তোমাকে যতবার দেখি,
ততবার আমার মন হারায়।
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা ছুঁয়ে যায় প্রাণের গান,
তুমি ছাড়া এই জীবন যে শূন্যতার সমান।
চাঁদের আলোয় তোমার ছায়া,
স্বপ্নে এনে দেয় সুর,
তোমায় পেয়ে মনে হয়,
এ জীবন সুন্দর ভীষণ মধুর।
রংতুলি দিয়ে ফুটে ওঠে,
কতশত প্রেম গাঁথা।
আবারও বাতাবরণে পরিস্ফুটিত হবে
আমাদের শুভ্ররাঙা ভালোবাসা। ❞