শেষ থেকে শুরু পর্ব ৩২

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৩২
Sabihatul sabha

হাতের চিরকুটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভ্র। গোটাগোটা অক্ষরে লেখা ” আপনার এতো চমৎকার সারপ্রাইজ আমি গ্রহণ করে নিলাম ! প্রিয় দেবর ”
আজ থেকে দুইদিন আগে অনিকের মাধ্যমে এটা পাঠিয়েছে নিরুপমা। অভ্র কম চেষ্টা করেনি একটু যোগাযোগ করার ফলাফল শূন্য।
আজ নিরুপমা আর আসিফের হলুদ অনুষ্ঠান। কুলসুম বেগম এক আবদার করে বসলেন নিরুপমার ছোট মামার কাছে বিয়ের সকল আয়োজন একসাথে হবে তাও চৌধুরী বাড়িতে। ছোট মামা আপত্তি করে বসে ছিলেন একমাত্র ভাগ্নীর বিয়ে নিজের বাড়িতে করবেন! পর মুহূর্তে নিরুপমার জন্য মেনে নিলেন। নিরুপমা চাইলো কুলসুম বেগমের কথাই থাক।

সেই জন্য সকালে আসিফ আর বেলী এসে নিয়ে গেলো নিরুপমা কে।
গায়ে হলুদের প্রবেশপথে বড় আকারের ফুলের মালা, সোনালী ফিতায় মোড়া এবং দামী পাথর ও রত্ন দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। গেটের পাশে ঝলমলে আলো, হালকা সোনালী রঙের আলো জ্বলছে, যা পুরো পরিবেশকে উজ্জ্বল করে তোলে। সাধারণত, এই পথের দুই পাশে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে থাকে সুন্দর ফুলের বাগান।
গায়ে হলুদের মূল আকর্ষণ কেরেছে মঞ্চ, খুবই দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানো হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিশাল ঝলমলে আলোকসজ্জা এবং অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম করা হয়েছে । স্ট্রিং লাইট, ঝালর এবং আর্কের মাধ্যমে পুরো জায়গা আলোয় ভরে যায়। মিউজিকের জন্য সুরেলা বাদ্যযন্ত্র এবং DJ এর আয়োজন করেছে, যাতে পুরো অনুষ্ঠানে একটা দোলা দেওয়া পরিবেশ তৈরি হয়। পুরো আয়োজন নিজ হাতে করেছে অভ্র।
বাড়ির এবং মঞ্চের চারপাশ ফুলে সাজানো হয়েছে। এখানে সাধারণত গোলাপ, মণিরাগী, সূর্যমুখী, লিলি, অর্কিড, এবং অন্যান্য বিলাসবহুল ফুল ব্যবহৃত করেছে। ফুলের ডেকোরেশনে কোনো কমতি রাখেনি অভ্র। ,
অতিথিদের জন্য বিলাসবহুল খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। খাবারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাওয়া, যেমন ফিঙ্গার ফুড, দামী মিষ্টি, ফ্রেঞ্চ কুকিং, ইন্ডিয়ান মিষ্টান্ন, ও আন্তর্জাতিক খাবারের আয়োজন। খাবারের পসরা সাজানো হয় একটানা পাত্রে। অতিথিরা বেশ অবাক হয়েছে এতো সুন্দর আয়োজন দেখে।
বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা কোনো কিছুর কমতি রাখেনি কুলসুম বেগম আর সবকিছুর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অভ্রর উপর।

সবাই বউ দেখতে ব্যাস্ত। একজন বলে উঠলো, ‘ বিয়ের ফুল ফটলে বুঝি মেয়েদের সৌন্দর্য এভাবে বেড়ে যায়.? ‘
একদম দুধের মতো ফর্সা, ত্বক যেন এক টুকরো সাদা মখমল। মুখাবয়বে আছে একটি নির্ভেজাল উজ্জ্বলতা, যেন সে নিজে একটি আলোর আধার। আর মাথার চুলগুলো সিল্কের মতো লম্বা ও কোমল লাগছে, একে একে ভাঁজ হয়ে নেমে আসছে কোমরের কাছে, আর যেন প্রতিটি চুলে একটা নিজস্ব সৌন্দর্য রয়েছে। চুলগুলো মাঝে মাঝে একখণ্ড মুক্তা যেমন ঝলমল করে, তেমনই তার সোজা করা চুলে কোমলতা আর রুচির ছাপ স্পষ্ট।
তার চোখ দুটি যেন গভীর সাগরের মতো টানা, গা dark গভীর এবং অত্যন্ত মনোলোভা। চোখের কল্পনা থেকে যেন বেরিয়ে আসে হাজারো অনুভূতি—নীরব হাসি, মিষ্টি ভালোবাসা আর এক অজানা মায়া। এই চোখে যে কত কিছু গোপন থাকছে, তা তার অঙ্গভঙ্গি থেকেই বোঝা যাচ্ছে তাই না.?।
মহিলাটা অবাক হয়ে পাশে তাকালো। মহিলাটার পাশের চেয়ারে বসে ছিল অভ্র। মুগ্ধ ছলছল নয়নে তাকিয়ে নিরুপমার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিল অভ্র।

মহিলাটা হাল্কা হেঁসে বললো,’ একদম ঠিক বলেছো, চৌধুরী বাড়িতে চাঁদের এক টুকরো আলো নেমে এসেছে। ‘
মলিন হাসি দিয়ে নিরুপমার দিকে তাকিয়ে রইলো অভ্র। পাশেই সাদা পাঞ্জাবি পড়ে বসে আছে আসিফ।
” তুমি ভীষণ ভাগ্যবান ভাই! হাজার চেয়েও যাকে পেলাম না তুমি তাকে কতো অল্পতে পেয়ে গেলে। ”
হলুদের সাজে, গা জুড়ে সোনালী হলুদের পেস্ট যেমন সুন্দরভাবে মাখানো, তেমনি সেই হলুদ যেন তার ত্বকের ফর্সাকে আরও চকচক করে তুলেছে আসিফের চোখে। গায়ে হলুদের এমন স্নিগ্ধ রঙের বাহারে যেন নিরুপমা আরও বেশি শোভিত হয়ে উঠেছে। নিরুপমার শরীরে সোনালী গহনা এবং হাতে হালকা সাদা রঙের ফুলের তোড়া নিরুপমা কে আরও একধাপ দেবী-মূর্তির মতো মাধুর্য দিচ্ছে। নিরুপমার হালকা হাসি, নরম চোখের মায়া, সাদা রঙের গায়ের হলুদের সাথে মিলিয়ে নিরুপমা যেন এক অপরূপ রূপের নারীতে পরিণত হয়েছে।
একে একে সবাই এসে নিরুপমার গায়ে হলুদ লাগিয়ে গেলো।
অভ্রর পাশে এসে দাঁড়ালো বেলী।

” আপনি বাকি আছেন”
অভ্র হাল্কা হেঁসে হেলেদুলে গিয়ে দাঁড়ালো নিরুপমার সামনে।
বেলী পেছন ফিরতেই ধাক্কা খেতে খেতে অল্পই জন্য বেঁচে গেলো। চোখ মুখ খিঁচে রেখেছে যখন মনে হলো সে পড়ে যায়নি তখনি আস্তে করে চোখ খুলে তাকালো।
চোখের সামনে আয়ান কে দেখে থ বনে গেলো। আজ ওকে এতো কাছে কেন লাগছে.? এতো হ্যান্ডসাম কবে হলো.??
আয়ান বেলীর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,’ দেখে শুনে চলতে পারিস না.? নাকি ছেলেদের সাথে ধাক্কা খেতে ভালোই লাগে!.? ”
বেলী কিছু না বুঝে বললো,’ মানে.?’

আয়ান রেগে বেলীকে ছেড়ে বললো,’ অভিনয় ভালোই পারিস!”
” আপনি হয়তো ভুল ভাবছেন ও ইচ্ছে করে… ‘
অনিক কথা শেষ করার আগেই আয়ান রেগে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘ আপনি চুপ থাকুন! আমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে কথা বলতে আসবেন না!”
আয়ানের হঠাৎ এমন রাগ দেখে বেলী থমকে গেলো। ভয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে রইলো।
” আর তুই.. বেলীর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,’ আমার পিছুপিছু আয়, এক পা অন্য দিকে যেতে দেখলে পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিব!”

এমন হুমকি শুনে ভয়ে বেলী ঠোঁট উল্টে কান্না করে দিবে এমন সময় অনিক বললো,’ এভাবে বলছেন কেন.? বেলীফুল ভয় পাচ্ছে! স্বামী হয়েছেন বলে এই নয় যা ইচ্ছে করতে পারবেন!”
বেলীফুল! আগুনে ঘি ঢালার মতো কথা ছিল। আয়ান অনিকের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,’ আমাকে থামাবেন আপনি.? আজ আপনি নিরুপমার কাজিন না হলে বুঝিয়ে দিতাম স্বামী হলেই কি করা যায়! স্বামীর অধিকার কতোটুকু। ‘
বেলীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেলো বাড়ির ভেতর ভয়ে বেলীর জান যায় যায় অবস্থা।
আজ কি হবে কে জানে.? আয়ান কি জেলাস অনিকের জন্য!.?
গায়ে হলুদের মঞ্চে নিরুপমার হাস্যোজ্জ্বল মুখের মধ্যে এখন এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা রয়েছে, যেন সে তার নতুন জীবনের সূচনা করতে প্রস্তুত। নিরুপমার গায়ে হলুদ মাখানোর পর, তার মুখে এক প্রশান্তি, কিন্তু তার ভেতরে এক অজানা দুঃখের ছায়া বিদ্যমান। নিরুপমা কখনোই জানত না, আজ এই মুহূর্তে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
অভ্রর মনে হলো নিরুপমা যখন হাসে, মুখের কোণে সূক্ষ্ম এক টুকরো আলো ঝলমলে হয়ে ওঠে, আর নিরুপমার নরম হাসির ভেতর যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ ও শান্তি লুকিয়ে থাকে। নিরুপমা নয় তার জবারাণী, তার জবারাণীর স্নিগ্ধ রূপে একদিকে যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতা, অন্যদিকে পুরনো রীতির বিলাসিতাও মিশে আছে।

অভ্র দাঁড়িয়ে থাকে একটু দূরে, তার চোখে বিরাট এক যন্ত্রণার ঝিলিক। অভ্রর ভেতর যেন তীব্র এক শূন্যতা, হৃদয়ের গভীরে দুঃখের ছুরির মতো তীক্ষ্ণ অনুভূতি। সে দেখছে, তার জবারাণী আজ তার ভাইয়ের গায়ে হলুদ লাগাচ্ছে—অথচ সে দুইদিন আগেও ভেবেছে তার জবারাণী তার নামে গায়ে হলুদ লাগাবে। কিন্তু আজ, সেই সম্পর্কের শেষ দৃশ্য।
হুট করে অভ্রর বুকে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে সে কোনোভাবে এই পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারছে না। তার মনে ভেসে ওঠে একে একে সব স্মৃতি— ছয় বছর আগে তাদের একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলো, হাত ধরে হাঁটা, মিষ্টি কথোপকথন, সেই হাসি। কিন্তু এখন, সে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে এক অপ্রতিরোধ্য যন্ত্রণায়, যেখানে সে জানে, তার ভালোবাসা দুইদিন পর অন্য কারো হাতে চলে যাবে।

নিরুপমার চোখে এক অদ্ভুত দৃশ্য—একদিকে সে হাসছে, আর অন্যদিকে হৃদয়ে যে বেদনা, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠছে তার চোখের জলে। নিরুপমা চোখে অব্যক্ত দুঃখ নিয়ে অভ্রর দিকে তাকায়, যেন সে কিছু বলতে চায়, কিছু ঘটানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই বলা হয় না। নিরুপমার চোখের গভীরে এক চিরন্তন হাহাকার
অভ্র তাকায় নিরুপমার দিকে দুজনের চোখে তখন এক যন্ত্রণার চাহনি, যেন তারা একে অপরকে বলতে চায় “কীভাবে এতটা দূরে চলে গেলাম আমরা? তুমি আমাকে কিভাবে এতো সুন্দর সারপ্রাইজ দিলে.?”
কুলসুম বেগম ছেলের বউকে নিয়ে গেলেন নিজের রুমে পিছুপিছু গেলো শার্লিন বেগম।
আজ জেনো সবাই অভ্র কে ভুলেই গেছে। অভ্রর পাশে এসে দাঁড়ালো অনিক। অনিকের মন ভালো না এসেই এতো এতো অভিযোগ দিতে শুরু করলো আয়ানের নামে।
অভ্র বিরক্ত হয়ে বললো,’ ওদের স্বামী স্ত্রীর বিষয় আমরা কিছু বলে কি হবে.? আয়ান খুব ভালো বেলীর সাথে এমন টুকটাক ঝগড়া সবসময় হয় এটা নতুন নয় অনিক। তুমি বরং ওই পাশে দেখো সুন্দর সুন্দর মেয়েরা বসে আছে একটা পটিয়ে নাও”
অনিক আহত চোখে তাকিয়ে রইলো অভ্রর দিকে। এমনিতেই অভ্র এক জ্বালায় বাঁচে না এখন আবার আরেক ঝামেলা

মধ্য রাত বাড়ির হয়তো অনেকে জেগে আছে। আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভরতি কেউ কেউ জেগে থাকতেই পারে।
উদাস কন্ঠে বেলী বললো,’ তোমার নামটা জবা কে রেখেছে হবু ভাবি.?’
নিরুপমা হাল্কা হেঁসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমার না হওয়া প্রেমিক!’
বেলী অবাক হয়ে বললো,’ মজা করছো তাই না..?’
নিরুপমা বেলীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ তোমার কি মনে হয়!.?’
বেলী তাকালো নিরুপমার চোখের দিকে। থমকে গেলো সে চোখের গভীরতা ধরতে গিয়ে অবাক হয়ে বললো,’ সে কোথায়!.?’
নিরুপমা হাল্কা হেঁসে বললো,’ অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও যাও।’
বেলী নিরুপমার হাত ধরে বললো,’ বলো না প্লিজ, আমি কাউকে বলবো না! সে কোথায় এখন.? তুমি তাকে ছেড়ে ভাইকে কেন বিয়ে করছো.? তোমাকে ত কেউ জোর ও করেনি।’
নিরুপমার কি হলো কে জানে! খুব করে আজ বেলীকে নিজের সে ছয় বছর আগের অতীত বলতে ইচ্ছে হলো।

” শুনবে ছয় বছর আগের গল্প!.? ‘
” গল্প! ”
” গল্পই ধরে নাও মেয়ে! ”
বেলী অবাক হয়ে নিরুপমার হাসি দেখে। হাসছে ঠোঁট অথচ চোখে পানি টলমল কি ভয়ংকর লাগছে এই মেয়েকে সে কি জানে.?
” একটা গ্রাম ছিল যার নাম সুন্দরপুর। সেই গ্রামে একটা সরল সোজা বোকা টাইপের সুন্দরী মেয়ে ছিল। যার কাজ ছিল সারাদিন ঘুরে বেড়ানো এই গাছ থেকে ওই গাছে… বুঝেছো.?।
বেলী তাকাতেই নিরুপমা বললো ” মজা পাচ্ছ না.?’
বেলী কিছু বললো না। সে সবটা জানতে চায়।

সে গ্রামে এক সুদর্শন যুবক আসলো তার নানাবাড়ি বেড়াতে। আর হ্যা মেয়েটা কিন্তু সেই গ্রামের মেয়ে ছিল না সেও সেই গ্রামে গিয়ে ছিল বড় মামির বাবার বাড়ি বেড়াতে।
তাদের প্রথম দেখা হয় গ্রামের রাস্তার মোড়ে। মেয়েটা তার বড় মামার দুই মেয়ে কে নিয়ে আম চুরি করতে এসে ছিল ছেলেটার নানার আম বাগানে। চুরিও করে ছিল কিন্তু গাছ থেকে নামার আগেই ধরা পরে যায় এক অপরিচিত পুরুষের কাছে।
ছেলেটা চোর গাছে পেয়েও একটা শব্দ করতে পারেনি। থমকে গিয়ে ছিল। অবাক হয়ে বলে উঠে ছিল ” নানার আম বাগানে দিন দুপুরে পরীর সাক্ষাৎ! ”

ছেলেটার যখন মেয়েটার দিকে নজর পড়ল, মনে হল যেন পৃথিবীটা কিছু মুহূর্তের জন্য থেমে গেছে। সেই মেয়ে, যার চোখে ছিল একটি অদ্ভুত শান্তি এবং ভীতি, যেন এক এক ধরনের রহস্য লুকানো। তার ডাগর ডাগর আঁখিগুলোর মধ্যে ছিল এমন এক আকর্ষণ, যা মনের গভীরে একদম অবচেতনে চলে গিয়েছিল। প্রতিটি চোখের পলকে যেন হাজারো অনুভূতি আর গল্পের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

তার গাঢ় কালো চুলগুলো সযত্নে বিনুনি করা, যেন তার পরিশ্রম আর পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। চুলের মধ্যে আকাশের মতো গা dark একটা ছায়া ছিল, যা তার সৌন্দর্যকে আরও অপূর্ব করে তুলছিল। তার পায়ে ঝঙ্কৃত নুপুরের আওয়াজটা যেন সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, প্রতিটি পদক্ষেপে সে যেন এক নতুন গল্প লিখছে, আর সেই আওয়াজ মনের ভিতরে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করে, যা থামানো অসম্ভব। মেয়েটি গাছ থেকে নেমে পালিয়ে যাচ্ছে তাতে ছেলেটার কোনো হুঁশ নেই সে ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অপরিচিতার দিকে। ছেলেটা বিরবির করে বলে উঠলো, ‘ আস্ত একটা রক্তজবা! হাতে মেহেদীর লাল টকটকে রং, পায়ে আলতা দেওয়া, কানে জবা গুঁজে রাখা ফর্সা শরীরে মনে হলো সে নিজেই একটা আস্ত জবা!

মেয়েটার মুখে কোনো গর্ব বা অহংকার ছিল না, বরং ছিল এক কোমলতা, এক নির্ভীকতা, যে মেয়ে জীবনকে তার স্বাভাবিক রূপে গ্রহণ করে, নির্জীব সুন্দর পৃথিবীর মতো। যদিও তার চোখে ছিল এক ধরনের ভীতি, তবে সেই ভীতি ছিল এক ধরনের মায়া, যা তাকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল। যেন তার মধ্যে এক অনবদ্য সংমিশ্রণ—যেখানে সৌন্দর্য আর সরলতা একে অপরকে আঁকড়ে ধরে, আর সেই আঁকড়ানো হৃদয়ের গভীরে এক অপরিচিত সুখের অনুভূতি জন্ম নেয়।
মেয়েটার উপস্থিতি যেন ছেলেটার হৃদয়ের মাঝে এক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যেন পৃথিবীর সমস্ত কিছু একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, শুধু সে এক মুহূর্তের জন্য চিরকাল থেকে যাচ্ছে। হৃদয় জেনো থমকে দাঁড়ায়।
ছেলেটা খুব সহজেই মেয়েটাকে খুঁজে বের করে ছিল। কারণ মেয়েটার বড় মামার ছেলে ছিল সেই ছেলেটার বাচ্চা কালের বন্ধু। সেই সুবাদে বাড়িতে এসে ছিল তখনি দ্বিতীয় বার চোখাচোখি হয় তাদের। ভয়ে জমে যায় মেয়েটা। এই বুঝি আম চুরির জন্য নালিশ জানাতে এলো।

মেয়েটা ভয়ে এইদিন আর রুম থেকে বের হয়নি। সময় যায় মেয়েটা খেয়াল করে ছেলেটা কারণে অকারণে বাড়ির রাস্তার মুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে দেখলেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
হৃদয়ে এক অজানা উত্তেজনা ও আনন্দের হাওয়া বইতে থাকে। ছেলেটা যখন রাস্তায় চলে আসে, মেয়েটার মন যেন এক লুকানো সুরে বাজতে থাকে। ছেলেটার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, ছেলেটার প্রতিটি পদক্ষেপ, ছেলেটার কোমল হাসি, তার কাঁধে ঝুলানো আনা-ফানা, সব কিছুই যেন মেয়েটার কাছে এক নিখুঁত কবিতা হয়ে ওঠে। তার প্রতি ছেলেটার অনুভূতিগুলো এমনভাবে শক্ত হয়ে পড়ে, যেন তীব্র এক আকর্ষণে তারা আটকে পড়ছে।
মেয়েটা যখন ছেলেটার দিকে চোখ ফেরায়, তার চোখে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা, যেন কিছু বলার আগেই তার চোখে একটি প্রশ্ন ভেসে ওঠে। আর সে যখন ছেলেটার দৃষ্টি থেকে সরে গিয়ে এক লজ্জাবতী গাছের মতো মাথা নিচু করে চলে যায়, তখন মনে হয় যেন পুরো পৃথিবীটা থেমে গেছে। তার শরীরের নরম আন্দোলন, চুলের আলতো ঝাপটা, এবং সেই লজ্জাবতী গাছের মতো গুটিয়ে যাওয় তে ছেলেটা যেন মুহূর্তে হারিয়ে যাও।

মেয়েটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, ছেলেটা তাকে ঠিক দেখেছে, । মেয়েটা জানে না, ছেলেটা তাকে নিয়ে ঠিক কী ভাবে, কিন্তু তার চোখের দিকে একবার তাকালে, এক অদ্ভুত জাদু যেন ওকে সমস্ত অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়। সে জেনো নিজের অজান্তেই মেয়েটার হৃদয়ের ভিতরে জায়গা করে নিয়েছে।
সদ্য কিশোরী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা নিজ মনে বার বার বলে যায় “এটা আমার প্রথম প্রেম, তার দিকে যতবার তাকাই, ততবার আমার মনকে যেন নতুন করে খুঁজে পাই।”
একদিন ছেলেটা সাহস করে মেয়েটার সাথে কথা বলে। তাদের মধ্যে ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়ে যায়। অন্তরে প্রেম থাকলেও বাহিরে তারা একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠে।

একদম সদ্য জন্ম নেওয়া মানুষটির প্রতি ভালোবাসা, এক অনুভূতি তৈরি হয়। মেয়েটার ছোট্ট আঙুলের ঝাপটা, তার নিঃশব্দ হাসি, তার কোমল মুখাবয়ব—সবকিছুই যেন এক পৃথিবী জয়ের মতো। সে যেন এক নতুন জীবন, একটি নতুন সূর্য, যার কাছে পৃথিবী এখনো অচেনা। এ ভালোবাসা খুবই গভীর, এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা, যেখানে কোনো কিছুই তার নিরাপত্তাকে আঘাত করতে পারে না।
কিন্তু যদি হঠাৎ সেই মানুষটিকে, যার প্রতি তুমি এত গভীর ভালোবাসা অনুভব কর, হোটেলের কোনো এক কক্ষে অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে একই বিছানায় দেখতে পাও, তা এক ভয়ানক যন্ত্রণা হয়ে ওঠে। মনে হয়, পৃথিবীটা যেন ঘুরে গেছে বেলী। শরীরের ভেতর তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভব হয়—একধরনের শূন্যতার অনুভূতি, যেখানে কিছুই সঠিক লাগে না। হৃদয়ের মধ্যে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়, যেন কোনো অপ্রত্যাশিত কিছু হয়ে গেল, মেয়েটা নিজেকে অসহায় অনুভব করলো।

সেটা কোনো ধাক্কার মতো ছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি মেয়েটা , চোখের সামনে যা ঘটছে, তা সঠিক নয়। তবুও, একবার চোখে পড়লে, মনে হয় যেন সব কিছু কাঁপছে, পৃথিবীটা ডুবে যাচ্ছে। তার চোখে আর সে যে ভালোবাসা ছিল, তা এখন অন্য কোথাও চলে গেছে, যেন তোমার আশেপাশে সব কিছু এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে গেছে। শরীরের ভেতরে যন্ত্রণার ঢেউ চলে আসে, তীব্র এক বিষাদ, যা মানতে খুব কষ্ট হয়। প্রেম, ভালোবাসা—সব কিছু এখন অন্য এক দিশা নিতে চলেছে।
এই অনুভূতি মনের ভেতর গুমরে ওঠে। কেন এমন হলো? কেন তাকে তুমি এত ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করেও, তোমার আশপাশে সেই সুখের মুহূর্ত এখন ম্লান হয়ে যাচ্ছে? কেন সেই নতুন পৃথিবী, যা তুমি তৈরি করেছিলে, আজ ভেঙে যাচ্ছে? এক ধরনের শূন্যতা, ক্ষোভ এবং চিৎকার তৈরি হয় ভেতর থেকে—এই অনুভূতিটা এতটাই তীব্র যে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
নিরুপমা থামে বেলী বলে উঠে, ‘ তারপর.? ‘

নিরুপমা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ এখানেই গল্প শেষ! ‘
‘ মিথ্যা কেন বলছো আপু.? আরও গভীর কাহিনী আছে। গ্রামে হোটেল কোথায় আসলো.?’
নিরুপমা কিছু সময় চুপ থেকে বলে, ‘ গল্প শেষ বেলী ঘুমাতে যাও বাকিটা মেয়েটা ভুলে গেছে ‘
‘ ছেলেটা এখন কোথায়.?’
‘ এতো প্রশ্ন কেন করো বেলী.?’
‘ এটাই শেষ প্রশ্ন আর করবো না সত্যি! ‘
নিরুপমা হাল্কা হেঁসে বলে, ‘ আমাদের আশেপাশে ‘
অন্ধকার ব্যালকনিতে পাশাপাশি বসে আছে জবা আর বেলী।
বেলী নিরবতা ভেঙে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ নামের মতো আমাদের ভাগ্যটাও কেন মিলে গেল জবা!..?’
জবা ঠোঁটের কোনে বিষাদের হাসি ঝুলিয়ে গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে গেয়ে উঠলো!…
“এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম
প্রেম মেলে না।
শুধু সুখ চলে যায়
এমনই মায়ার ছলনা।”

বাগানের মধ্যে এক জোরা ক্লান্ত চোখ ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে অন্ধকার ব্যালকনির গিটার হাতে ছায়া মানবির দিকে। বিরবির করে বলে উঠে ” আমি ত সুখ চাইনি দুঃখই চেয়ে ছিলাম, প্রেম নয় তোমাকে চেয়ে ছিলাম তাও কেন আমার হলে না রক্তজবা!.? প্রেমের বদলে না হয় যন্ত্রণাই দিতে তাও আমারই থাকতে। এই এক জীবনে তোমাকে না পাওয়ার আপসোস আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিবে রক্তজবা”
ব্যালকনি থেকে বিষাদ ভরা কন্ঠে ভেসে আসলো মেয়েলী কন্ঠে গান…

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৩১

” তাই কেঁদে কাটে নিশি,
তাই দহে প্রাণ..
ও তাই মান অভিমান,
তাই এত হায় হায়..”
যুবকটি চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো, ‘ তুমি কখনো জানতেই পারবে না জবারাণী , কোনো এক যুবক তোমার বিরহে কাফন ছাড়াই সেই কবে দাফন হয়ে গেছে! ‘

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৩৩