শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৪
ইনায়া রোজ
– তুমি আমাকে বারবার কষ্ট দাও শ্রাবণ ভাই, বারবার জোর করে নিজের অধিপত্যের বিস্তার করতে চাও। তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি তোমাকে ভয় পাই? তোমাকে মেনে নিতে পারছি না!
মেঘের এমন কথা শুনে মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় শ্রাবণের। সে মেঘের দুবাহু চেপে ধরে মেঘের একেবারে নিকটে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
– তুই চাইলেও তুই আমার, না চাইলেও তুই আমার। আমি যখন বলেছি তুই আমার তার মানে তোর পুরো অস্তিত্বটাই আমার। আর এটা যত তাড়াতাড়ি মেনে নিবি ততই তোর জন্য ভালো জান!
– কিন্তু আমি তোমাকে কখনোই মেনে নিব না শ্রাবণ ভাই। আমার বাবা যেটা বলবে সেটাই হবে।
শ্রাবণের রাগ যেন এবার তিরতির করে বেড়েই চলেছে। এই মেয়ে কি কখনোই তাকে একটু বুঝবে না? এত অবুঝ কেন এই মেয়ে?
– খেয়ে নে জান কথা বাড়াস না!
শ্রাবণের কথায় রাগ দেখিয়ে মেঘ বলে ওঠে,
– খাব না আমি।
– তো কি খাবি? অন্য কিছু খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
শ্রাবণের হঠাৎ এমন কথা ভড়কে গেল মেঘ।
– মা- মা-নে,
মেঘকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তার আগেই মেঘের তুলতুলে ঠোঁট নিজের ঠোঁটের দ্বারা আগলে ধরলো শ্রাবণ।
– উমম্ ,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেঘ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কিন্তু কিছুতেই যেন পেরে উঠছে না শ্রাবণের সাথে। শ্রাবণ তো তার নিজ কাজে মগ্ন। মেঘ নিজেকে ছাড়াতে গেলে শ্রাবণ আরো অধিক জোড়ালো ভাবে চেপে ধরে মেঘকে। একসময় ছটফট বন্ধ করে শান্ত হয়ে যায় মেঘ। মেঘের তুলতুলে ঠোটের স্বাদ আস্বাদন করা শেষ হলে একটা সময় মেঘকে ছেড়ে দেয় শ্রাবণ।
হাঁফিয়ে গিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে মেঘ।সেই সাথে মেঘের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে বিষাদের অশ্রুকণা। এই লোকটা কি তাকে এক দন্ড শান্তিতে থাকতে দিবে না? কেন বারবার জোর করে নিজের অধিকার ফলাতে আসে এই লোক?
মেঘকে ছেড়ে দিয়ে মেঘের কপালে নিজের কপাল ঠেকায় শ্রাবণ। এরপর ফিসফিস করে বলে ওঠে,
– জেদ ধরিস না জান তুই নিজেও জানিস আমার সাথে জেদ ধরে কখনোই পারবি না তুই। চুপচাপ খেয়ে নে নয়তো ওষুধের ডোজ আমি ভালোই দিতে পারি।
বলেই মুখ তুলে মেঘে চোখের পানি দুহাতের আঙ্গুলের দ্বারা মুছে দেয় শ্রাবণ। এরপর মেঘের হাত ধরে টেনে নিয়ে খাটে বসে নিজের কোলের উপর মেঘ কে বসায় সে। খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে আলতো হাতে খাইয়ে দিতে থাকে মেঘকে। মেঘ ও চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মত খাবার খেয়ে নেয়। সে জানে এই উন্মাদ লোকের সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না।
– ফুল! ঐ নিলয়ের থেকে দূরে থাকবি। আমি চাইনা কালকের ঘটনাটা আর কখনো তোর সাথে রিপিট হোক।
কিছুটা থমকালো মেঘ। এরপর মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,
– কেন বারবার আপনি আমার জীবনে হস্তক্ষেপ করেন শ্রাবণ ভাই?
– এর কারণটা নিশ্চয়ই অজানা না তোর জান। নতুন করে আর বলতে চাই না।
– আমাকে একটু একা থাকতে দিন শ্রাবণ ভাই, একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
– একাই তো তোকে থাকতে দিচ্ছি, সময় যখন আসবে তখন না হয় আমার সাথেই থাকবি।
ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে মেঘ। তার জীবনটা এমন কেন? কেন এত দুর্বিষহ? কেন আর দশটা সাধারণ মেয়ের মত স্বাভাবিক না তার জীবন? একদিকে তার বাবা অন্যদিকে শ্রাবণ, দুইজনের টানাপোড়নে মাঝখানে পিষে ম’রে যাচ্ছে সে। তার কথা কি কেউ একবারও ভাববে না? কখনো কি তার দুঃখ কষ্ট নিয়ে ভাববে না? মেঘকে এমন চুপচাপ বসে থাকতে দেখে শ্রাবণ মনে মনে আওড়ায়,
– এভাবে কষ্ট পাস না জান সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব ঠিক করে দিব খুব তাড়াতাড়ি তোর সব কষ্ট লাঘব করে দিব।
দুপুরবেলা,
শান্তিনিকেতনে আজকে বিশাল তোরজোড় চলছে। আজ ফয়েজ আহমেদের বড় ছেলে শাহরিয়ার আহমেদ মাহিদ বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরছে। সেই সুবাদেই শান্তিনিকেতনে আজ এত আয়োজন। রাহেলা বেগম আর আফসানা বেগম সেই কখন থেকে একের পর এক রান্না করে যাচ্ছেন। করবেন নাইবা কেন? এত বছর পর বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরছে ছেলে ভালো মন্দ রান্না না করলে চলে কিভাবে?
মাহিদ কে আনতে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে শ্রাবণ, মেঘ আর শ্রাবণের ছোট বোন শ্রেয়া। আজকে একেবারের জন্য হোস্টেল থেকে বাড়িতে ফিরেছে শ্রেয়া। আর এসেই শুনতে পেল মাহিদ আসছে। তাই আর দেরি না করে শ্রাবণদের সাথে বেরিয়ে পড়েছে শ্রেয়া। আজকে মেঘ অনেক খুশি কারণ তার ভাই আসছে অনেকদিন পর। কত মিস করেছিল সে তার ভাইকে।
আর শ্রেয়া ও এবার একেবারের জন্য বাড়িতে এসে গেছে আজ । আর শ্রাবণের অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হবে না। ভেবেই আনন্দে নেচে উঠছে মেঘের ছোট্ট হৃদয়।
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তারা তিনজন। তখনই দূর থেকে মাহিদকে দেখতে পায় তারা। মাহিদকে দেখেই মেঘ কিছুটা চেচিয়ে ওঠে,
– ভাইয়া!
মেঘ চেচিয়ে উঠায় তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় শ্রাবণ। শ্রাবণকে এভাবে তাকাতে দেখে এক ভেংচি কাটে মেঘ। যেন সে শ্রাবণকে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না। তার ভাই চলে এসেছে, হুহ্! কিসের ভয়! মনে মনে ভেজায় খুশি মেঘ। মেঘের এমন ভাবভঙ্গি দেখে ভ্রু কুঁচকে মেঘের দিকে তাকায় শ্রাবণ। মনে মনে আওড়ায়,
– বেশি উড়িস না জান তোর ডানা কেটে দিতে আমার বেশি সময় লাগবে না।
মাহিদ এসে দাঁড়াতেই দৌড়ে তার কাছে গিয়ে তাকে ঝাপটে ধরে মেঘ। হাউমাউ করে কেদে দিয়ে অভিযোগের স্বরে বলে ওঠে,
– এত দেরি করলে কেন ভাইয়া জানো তোমাকে কত মিস করেছি আমি।
মেঘকে সান্ত্বনা দিতে দিতে মাহিদ বলে ওঠে,
– আরে পাগলি এতো কাঁদছিস কেন এইতো চলে এসেছি আমি।
বেশ কিছুক্ষণ মাহিদকে জড়িয়ে রেখে নিজের অভিমান অভিযোগ সব উগড়ে দেয় মেঘ। মেঘের এমন বাচ্চামোতে চোখ ছোট ছোট করে দুহাত পকেটে গুজে তার দিকে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। শ্রেয়া একবার শ্রাবণের দিকে তাকাচ্ছে আবার মেঘ আর মাহিদের দিকে তাকাচ্ছে। এরপর শ্রেয়া মনে মনে বলে উঠে,
– মেঘের বাচ্চা বেশি ঢং করিস না তোর কপালে দুঃখ আছে।
কিছুক্ষণ পর মাহিদের চোখ পড়ে মেরুদন্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রাবণের দিকে। এবার মেঘ কে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে এসে শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে মাহিদ।
– কেমন আছো ভাই? কতদিন পর তোমার সাথে দেখা।
হঠাৎ আক্রমণে কিছুটা ভড়কে যায় শ্রাবণ। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে সেও জড়িয়ে ধরে মাহিদ কে।
– ভালো আছে ছোট তুই কেমন আছিস?
শ্রাবন কে ছেড়ে দিয়ে মাহিদ বলে উঠে,
– এই তো একেবারে ঝাকানাকা!
মাহিদের কথায় সবাই হেসে দেয়। শ্রেয়া এগিয়ে গিয়ে মাহিদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
– কেমন আছো মাহিদ ভাই? তুমি তো বিদেশে গিয়ে আমাদের একেবারে ভুলে গিয়েছো।
মাহিদ হেসে শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ওঠে,
– কত বড় হয়ে গেছিস রে শ্রেয়া তুই! আর তোদের কি করে ভুলে যাই বল সবাইকে অনেক মিস করেছি।
– এবার তাহলে যাওয়া যাক।
সকলের কথার মাঝখানে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে শ্রাবণ। সকলেই সম্মতি জানিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তখনই স্পাইডারম্যানের মতো সেখানে উপস্থিত হয় রাব্বি আহমেদ। শ্রাবণ দের ছোট চাচা রাব্বি। তাকে দেখে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে শ্রাবণ।
শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৩
– এই যা সেরেছে,
বলেই আহত দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকায় শ্রেয়া। মেঘ কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে মাহিদের দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাদের একেবারে কাছে এসে রাব্বি আহমেদ বলে উঠে,
– হ্যালো গাইজ তোমাদের রাব্বি ফ্যান্টাস্টিক হাজির।
এটা শুনেই উচ্চস্বরে হেসে উঠে মাহিদ। সে হাসতে হাসতে বলে উঠ,
– ছোট চাচ্চু তুমি আবার কবে থেকে রাব্বি আহমেদের বদলে রাব্বি ফ্যান্টাস্টিক হয়ে গেলে?
– সে অনেক কাহিনী মাই ডিয়ার সান, শুধু তুমি এটুকু জেনে নাও আমি রাব্বি ফ্যান্টাস্টিক। আমিই একমাত্র মানুষ যে নিজেকে নিজের হাতে আবিষ্কার করেছে। এখন চলো যাওয়া যাক।