সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৪

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৪
Jannatul Firdaus Mithila

“ যেখানে আমার দেহ,প্রান,মন সবটাই একজনের দখলে।সেখানে তুই কিভাবে বলিস তোকে আমি ভালোবাসি? ”
থমকে গেলো শিশির। গলা হয়ে আসলো বাকরূদ্ধ। মেয়েটার চোখ বেয়ে অঝোরে ঝরে পড়ছে অশ্রুধারা। সে থেমে থেমে বললো,
“ তুই আমায় ভালোবাসিস না রোদ?”
“ নাহ।” —— শক্ত গলায় জবাব দিলো রৌদ্র।
একথা শুনে শিশির যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে চকিত দৃষ্টিতে তাকায় রৌদ্রের পানে।ধরে আসা গলায় বললো,
“ তাহলে সেদিন যে বললি তুই তোর খুব কাছের একজন আত্নীয়কে ভালবাসিস। যাকে কি-না তুই ছোট থেকে চিনিস।এমনকি তার সঙ্গে না-কি জীবনের অধিকাংশ সময়ও কাটিয়েছিস। তাহলে সেগুলো কার উদ্দেশ্য বলেছিলি রোদ? আমি নাহলে কে সে?”
রৌদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় শিশিরের দিকে। তাচ্ছিল্যের সহিত বলে ওঠে,

“ সেটা তোর না জানলেও চলবে। আপাতত আমার দুচোখের সামনে থেকে দূর হ তুই।”
শিশির নড়লো না।এমনকি পলকও সরালো না রৌদ্রের থেকে।মেয়েটা বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেলো।চোখের পাতা নড়ছে না,পলক পড়ছে না কেবল মাত্র আখিদ্বয় হতে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। এ কি আর যেই-সেই অশ্রুধারা? এ অশ্রুধারা যে মেয়েটার হৃদয় ভাঙার উপখ্যান। হয়তো হৃদয় ভাঙার ব্যাথা সইতে না পেরে চোখ হতে ঝড়ে পড়ছে অশ্রুধারা হিসেবে।খানিক সময় বাদে মুখ খুললো শিশির।ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ রোদ! এই রোদ! তুই আমার সাথে কোনরূপ প্র্যাংক করছিস নাতো? যদি এমনটা করে থাকিস তাহলে প্লিজ বলে দে।আমি যে কথাগুলো সহ্য করতে পারছিনা রে।প্লিজ বল তুই মজা করছিস।”
কথাগুলো বলতে বলতেই এগিয়ে আসে শিশির। হাত বাড়িয়ে রৌদ্রের একহাত যে-ই না ছুঁতে যাবে তার আগেই হাতটা ছিটকে দূরে সরিয়ে নেয় রৌদ্র। নিজেও দু-কদম পিছিয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। পরক্ষণেই মুখের আদল আরও কিছুটা শক্ত করে খেঁকিয়ে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ এই তোর সাহস তো কম না! আমি না করার স্বত্বেও আমায় স্পর্শ করতে আসছিস তুই।কিছুক্ষণ আগের ঘটনা নিশ্চয়ই এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাসনি। কান খুলে শুনে রাখ,তোর ভাগ্য ভালো তুই আমার এক সময়ের বন্ধু ছিলি কিন্তু আজকের করা তোর এমন কাজের জন্য তুই সেটাও হারালি।আর কোনদিন আমার সামনে যাতে তোকে না দেখি। কোনদিন না।চলে যা এখান থেকে। নাহলে এখন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলবো।”

পরপর এমন শক্ত কথায় বাকহারা হয়ে দাড়িয়ে রইলো শিশির। মেয়েটার বুঝি নিশ্বাসটাও আঁটকে আসছে এ মুহুর্তে। কানে শোনা কথাগুলোর সত্যতা মস্তিষ্ক মানতে চাইলেও মন যেন তা মানতে নারাজ। মেয়েটা অনুভুতিশূন্য দৃষ্টিতে এখনও তাকিয়ে রৌদ্রের পানে।এদিকে রৌদ্র যেন সেকেন্ডে সেকেন্ডে মেজাজ হারাচ্ছে। বারবার ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজের রাগটাকে কোনরকম বশে আনতে চাইছে ছেলেটা কিন্তু নাহ! কাজ হচ্ছে না। বরাবরের মতোই ছেলেটার রাগ বেশ খারাপ প্রকৃতির। এই যে এখন কেমন ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে যাচ্ছে। কিয়তক্ষন পেরিয়ে যাবার পরও শিশিরকে আগের ন্যায় একই জায়গায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে আরেকধাপ মেজাজ চটে ছেলেটার।সে কোনরূপ কথা না বলে শিশিরের বামহাতের কনুই চেপে তাকে সজোরে টেনে নিয়ে একপ্রকার ছুড়ে ফেলে ঘরের বাইরে। মেয়েটা প্রায় পড়তে পড়তে বাচঁলো। তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে রৌদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“ রোদ, আমার কথাটা তো একটু….”
তার কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই মুখের ওপর সশব্দে দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয় রৌদ্র। এহেন কান্ডে মেয়েটা থমকায়।ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলো বন্ধ দরজার দিকে।কাঁপা কাঁপা হাতটা দরজার ওপরে রেখে নিজের কপালটা সেখানটায় ঠেকিয়ে দূর্বল কন্ঠে বলতে থাকে,
“ আমার কথাটা একটু শোন না রোদ। আমি তোকে ভালোবাসি রে। ভিষণ রকমের ভালোবাসি। তুই আমায় এভাবে ফিরিয়ে দিলে যে আমি মরে যাবো। একদম মরে যাবো রোদ। ”

ওপাশ থেকে শব্দ এলোনা কোনো। মেয়েটা ধীরে ধীরে নিজের মাথা উঠায়। হাতের তালু দিয়ে কোনরকমে নিজের অশ্রুসিক্ত লোচনদ্বয় মুছে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরের দিকে ছুটে চলে আসে শিশির। একছুটে ঘরে গিয়েই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে মেয়েটা। পাশ থেকে একটা বালিশ এনে সেখানে নিজের মুখটা গুঁজে দিয়ে কাঁদতে থাকে আপনমনে। উদ্দেশ্য কান্নার শব্দ যেন অন্যকারো কর্নগোচর না হওয়া। মেয়েটা হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে। বলতে থাকে,
“ আমায় কেন ভালোবাসলি না রোদ? আমি কি তোকে ভালোবাসিনি? আমার চাইতেও কে বেশি ভালোবাসবে তোকে? কেন এমন করলি তুই?”
আপনমনে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে মেয়েটা।ইশশ! মন ভাঙার কষ্ট এতো প্রখর কেন?

টানা একঘন্টার গোসল সেড়ে মাত্র বেরুলো রৌদ্র। ছেলেটার শ্যামবরণ দেহের প্রায় অনেকটা জায়গায় কেমন লাল হয়ে আছে। মুখটাও কেমন শক্ত করে ফুটিয়ে রেখেছে। চৌকস চোয়ালটা স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা দৃঢ় তার। রৌদ্র ভেজা চুলগুলোকে হাত দিয়ে এলোমেলো করে পানি ঝাড়তে থাকে।আশ্চর্য! কতক্ষণ যাবত পানির নিচে দাড়িয়ে ছিল ছেলেটা তবুও যেন মাথাটা ঠান্ডা হচ্ছে না তার।মাথাটায় কেমন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে এ মুহুর্তে। ছেলেটা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। চিৎ হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ঠিক তখনি ঘরের দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ হয়।রৌদ্র শুয়ে থেকেই ভ্রু গোটায়। গলার স্বর উঁচু করে বলে ওঠে,

“ কে? ”
তৎক্ষনাৎ আওয়াজ আসেনা ওপাশ থেকে। রৌদ্র আর সেদিকে পাত্তা দিলো না। সে ধরেই নিলো,এবারো বুঝি শিশির এসেছে। তাইতো ছেলেটা চোয়াল শক্ত করে শুয়ে রইলো বিছানায়। মিনিট খানেক পর আবারও দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ হয়। রৌদ্র এবার মেজাজ হারায়।খালি গায়েই ছুটে যায় দরজার কাছে।দরজাটা খুলতে খুলতেই শক্ত গলায় খেঁকিয়ে বলে ওঠে,
“ এই তোর লজ্জা নাই? কতবার বলেছি এখানে আসতে…. ”
কথাটা শেষ হবার আগেই থমকায় রোদ। চোখদুটো বড়সড় করে তাকিয়ে রইলো দরজার সামনে দাড়ানো অরিনের দিকে। মেয়েটা তার এহেন ধমকে কেমন গুটিসুটি মেরে দাড়িয়ে আছে মাথানিচু করে। রৌদ্র মনে মনে আহত হলো।অপরাধীর ন্যায় বললো,

“ এই সরি সরি! আ’ম এক্সট্রিমলি সরি জানবাচ্চা। আমি বুঝিনি তুই এসেছিস।আমি ভেবেছিলাম.. ”
কথাটা বলতে গিয়েই থামলো রৌদ্র। প্রসঙ্গ এড়াতে বলে ওঠলো,
“ থাক ওসব বাদ দে। তুই কি বলতে এসেছিস সেটা বল!”
অরিন এবার মুখ খুলে।মিনমিনে স্বরে বললো,
“ বড়মা আপনাকে খেতে ডাকছে।”
রৌদ্র মাথা নাড়ায়।বলে,
“ আচ্ছা, তুই যা আমি আসছি।”
অরিন মাথা কাত করে। চলে যেতে এক-কদম বাড়াতেই কি মনে করে আবারও পেছনে ফিরে মেয়েটা। মাথানিচু রেখে নমনীয় কন্ঠে বলে,

“ একটা কথা বলি রোদ ভাই? ”
রৌদ্র দায়সারাভাবে হেলান দিয়ে দাড়ালো দরজায়। সরু চোখে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে।তারপর রাশভারী গলায় বললো,
“ জ্বি বলুন। ”
অরিন তৎক্ষনাৎ চোখ তুলে তাকায়। রৌদ্রের মুখে এ কথাটা তার বরাবরই বেশ পছন্দের। মেয়েটা কিঞ্চিৎ হাসলো।রৌদ্রও নিরেট দৃষ্টিতে অবলোকন করলো সেই হাসিটা। অরিন চোখ সরাতে নিবে তখনি তার চক্ষুগোচর হয় রৌদ্রের পেটানো উম্মুক্ত দেহখানায়।যেখানে এখনো পানির বিন্দু বিন্দু কনাগুলো স্পষ্ট ফুটে আছে। অরিন সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সেখান থেকে। বুকটায় আবার কেমন যেন হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। অরিন ফাঁকা ঢোক গিললো। দাঁড়িয়ে থেকে হাসফাস করতে লাগলো সে।অরিনের এহেন কান্ড সবটাই পর্যবেক্ষন করছে রৌদ্র। সে মুচকি হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিজের। তারপর মেয়েটাকে আরেকটু বাজিয়ে দেখতে বলে ওঠে,

“ কি যেন বলবি বলছিলি?”
অরিন পরপর উপর-নিচ মাথা ঝাকায়। আমতা আমতা করে কিছু বলবে তার আগেই পেছন থেকে ভেসে আসে অনিকের গম্ভীর এবং শক্ত কন্ঠ!
“ অরিন!”
তড়িৎ সেদিকে তাকায় মেয়েটা।ভাইয়ের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়তক্ষন। অনিক জোরালো কদমে এগিয়ে আসে তাদের কাছে। রৌদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত না করে অরিনকে বলে,
“ এখানে কি?”

ভ্রু কুচকায় রৌদ্র। অনিকের হাবভাবে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে সে।বোঝার চেষ্টা করছে ছেলেটার এমন কথার কারণ। অন্যদিকে অরিন চুপ করে দাড়িয়ে আছে মাথানিচু করে। হয়তো উপযুক্ত কথা খুঁজছে ভাইকে বলার মতো। অনিক বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে, আলতো করে হাত বাড়িয়ে বোনের মুখের সামনে চলে আসা চুলগুলোকে গুছিয়ে কানের পিঠে গুজে দেয়। অতঃপর বোনের গালে আলতো করে হাত রেখে গম্ভীর গলায় শুধায়,
“ কোন কিছু অপাত্রে দান করার চাইতে নিজের কাছেই পড়ে থাকা ঢের ভালো সোনা।”
অরিন অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের দিকে। চোখে তার একরাশ জিজ্ঞাসা। হয়তো জানতে চাচ্ছে, এতোটা কঠিন কথার ভাবার্থ! অনিক বুঝলো বোনের চোখের দৃষ্টি। গম্ভীর মুখের আদলে মুচকি হাসি টেনে বললো,
“খেতে যা বনু।আমি আসছি।খাইয়ে দিবো তোকে।”

অরিনও আর কিছু বললো না।অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আলতো করে ঘাড় কাত করলো। তারপর কোন প্রকার কথা না বলে চলে গেলো সেখান থেকে। অরিন চলে যেতেই রৌদ্র সটান হয়ে দাড়ায়। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাজ ফেলে অনিককে জিজ্ঞেস করে,
“ এই কথার মানে কি অনিক? আর তুই হঠাৎ এমন বিহেভিয়ার করছিস কেন?”
অনিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রৌদ্রের দিকে।গলায় কাঠিন্যের ছাপ ফুটিয়ে বললো,
“ সেটা আমার আর আমার বনুর ব্যাপার মি: ইফতেখার এহসান রৌদ্র। এ বিষয়ে আপনার নাক না গলানোটাই বেটার। ”
কথাটা বলেই সামনে হাটা ধরে অনিক।দু-কদম সামনে যেতেই পেছন থেকে ভেসে আসে রৌদ্রের গম্ভীর গলা,

“ হোল্ড ইউর টাঙ্গ অনিক! কাকে কি বলছিস ভেবে বলিস।”
অনিক তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।ঘাড় বাকিয়ে রৌদ্রের দিকে তীর্যক দৃষ্টি ফেলে কঠিন গলায় বললো,
“বিফোর টেলিং মি হোয়াট টু ডু, ইউ শুড কারেক্ট ইউরসেলফ ফার্স্ট। বাই দা ওয়ে, স্টে এওয়ে ফ্রম অরিন।”
থমকে গেলো রৌদ্র। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো অনিকের দিকে।সেদিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে গটগট পায়ে প্রস্থান ঘটায় অনিক। ছেলেটার মনটায়ও ভিষণ রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে। হয়তো সে নিজেও কখনো ভাবতে পারেনি তার এতো প্রিয় বন্ধুর মতো ভাইয়ের সাথে এরূপ ব্যবহার করবে কোনদিন। কিন্তু কি আর করার! তার বনুর সামনে পৃথিবীর সকল সম্পর্কই যেন নিছক ক্ষুদ্র মাত্র।

“ বড় বু! কই হলো তোমার? এসো না গো,আমি একটু চুলগুলো বেঁধে দেই তোমার। সবারটা তো বেঁধেই দিলাম,এবার শুধু তুমিই বাকি।”
রাইসা বেগমের একের পর এক অনুনয়ে অবশেষে হার মানলেন জুবাইদা বেগম। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে ড্রেসিং টেবিলের টুলের ওপর বসে পড়েন তিনি।তারপর তাড়া দেখিয়ে বললেন,
“ নে এবার বেধেঁ দে তো বাপু। আর খবরদার বেশি জাঁকজমকভাবে বাঁধিস না কেমন! কনের মা আমি,আমার কি আর ওতো সাজগোজ চলে বল?”
জুবাইদা বেগমের কথায় মুচকি হাসলেন রাইসা বেগম। মাথা নাড়িয়ে বললেন,

“ ঠিক আছে, ঠিক আছে। একেবারে সিম্পলভাবেই বেধে দিচ্ছি। ”
বলেই তিনি ধীরে ধীরে জুবাইদা বেগমের মৃদু পাঁক ধরা চুলগুলো আঁচড়ে দিতে লাগলেন। তখনি নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলে ঘরে প্রবেশ করে রুহি।রাইসা বেগম থামলেন। পেছন ফিরে রুহির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ আরে রুহি! তুমি এখানে চলে এলে যে? তোমার তো এখন স্টেজে থাকার কথা!”
রুহি চুপ করে দাড়িয়ে রইলো।চোখদুটো কেমন চিকচিক করছে মেয়েটার। জুবাইদা বেগম ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় স্পষ্ট খেয়াল করলেন তা। মনটা তার মুহুর্তেই ভারি হয়ে ওঠলো।তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ায় বসা ছেড়ে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে মেয়ের কাছে। মেয়ে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে আওরালেন,

“ কি হয়েছে মা? কিছু বলবি?”
রুহির এখন কি হলো কে জানে! মেয়েটা কোনরূপ টু শব্দ না করে ফট করে জড়িয়ে ধরে মা’কে। অতপর বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটা। জুবাইদা বেগম হিমশিম খাচ্ছেন মেয়েটাকে সামলাতে। তাঁরও এখন কান্না চলে আসছে।কিন্তু এ মুহুর্তে মেয়েটার সামনে কাঁদলে যে মেয়েটা আরও কিছুটা মূর্ছা যাবে।তখন কিভাবে সামলাবেন তিনি? জুবাইদা বেগম পরপর ঢোক গিললেন।হয়তো গলা থেকে উগরে আসা কান্নাগুলো কোনরকমে গিলছেন তিনি। চোখদুটোকে শাড়ির আচলে মুছে নিয়ে বললেন,
“ ধূর পাগলি মেয়ে! গায়ে হলুদের দিনে কেও এভাবে কাঁদে? আর একটু পরেই রেহানদের পক্ষ থেকে হলুদ ছোঁয়াতে আসবে। তখন যদি তারা বউয়ের এমন কান্নায় লেপ্টে যাওয়া মুখ দেখে তাহলে কি বলবে বলতো?”
মেয়েটা থামলো না। হয়তো তাকে থামাতে চাওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা বেশ বুঝেছে সে। জুবাইদা বেগম ধীরে ধীরে পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন মেয়ের।তিনি আর থামাচ্ছেন না মেয়েটাকে। কাঁদতে দিচ্ছেন মেয়েকে।কথায় আছে, কান্না করলে নাকি কষ্ট কমে! তাহলে এবারও নাহয় তাই হোক।মেয়েটার সকল কষ্ট গুলোও যাতে এই চোখের পানিতেই একেবারে ধুয়ে মুছে যাক।

চারিদিকে হৈ-হুল্লোড়। রঙিন বাতির আলোয় পুরো উঠোন জুড়ে এক রাজকীয় আবহ। স্টেজের আশেপাশে বিভিন্ন ফুলের সমারোহ। বেশকিছুক্ষন পর রুহিকে নিয়ে আসা হয়। মেয়েটাকে বসানো হয় স্টেজের মুখোমুখি সারির চেয়ারে।রুহি এসে থেকেই কেমন এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে কাওকে। মাইমুনা বেগম বুঝলেন হয়তো। এগিয়ে এসে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি হয়েছে মা? কাওকে খুঁজছিস? ”
রুহি মাথা ঝাকায়। দৃষ্টি চারিদিকে বুলিয়ে আওরায়,
“ সেজো-মা, অরিকে তো কোথাও দেখছি না। কই গেলো মেয়েটা? ”
মাইমুনা বেগমের বুঝি টনক নড়লো কথাটায়।তিনিও ভাবুক হয়ে বললেন,
“ হ্যা,অনেক্ক্ষণ যাবতই মেয়েটাকে আশে-পাশে কোথাও দেখছি না। আচ্ছা তুই বস, আমি দেখছি কোথায় আছে মেয়েটা।”

বলেই চলে গেলেন তিনি।এদিকে ইতোমধ্যেই উঠোনে সবাই চলে এসেছে। ছেলেদের ড্রেস কোড আজকে একেবারেই সিম্পল। হলুদ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট। রৌদ্রও কিছুক্ষণ পর পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে উপস্থিত হয় সেখানে। উঠোনে পা রাখতেই ছেলেটার কানে পৌঁছায় অদূরেই রাফিয়া বেগমের কিছু কথাবার্তা,
“ কই গেলো মেয়েটা? সেই কখন থেকে দেখলাম না ওকে।হ্যা,রে অনি! তুই দেখেছিস বাবা?”
অনিক ছেলেটা চিন্তিত হয়ে ফোন দিয়ে যাচ্ছে বোনের মোবাইলে। কিন্তু ফোনটা রিং হলেও ওপাশ থেকে তুলছে না কেও।অনিক মায়ের এহেন কথায় মাথা নাড়ায়।বলে,
“ আম্মু! আমি ওকে লাস্ট বিকেলেই দেখেছিলাম। এরইমধ্যে মেয়েটা কই গেলো?”
সবগুলো কথাবার্তা কানে এসে পৌছুতেই বুকটা ধ্বক করে ওঠে রৌদ্রের। সে দ্রুত কদমে রাফিয়া বেগমের কাছে এগিয়ে এসে বললো,

“ মেজো মা! অরিন? ”
রৌদ্রকে দেখেও না দেখার ভান ধরলো অনিক।এদিকে রাফিয়া বেগম বিচলিত হয়ে বললেন,
“ বাবা মেয়েটা!….
কথাটা শেষ হবার পূর্বেই মাইকে কেও একজন উচ্চস্বরে বলতে শুরু করে,
❝ হেলো! এভরিওয়ান, এই যে! সবাই এদিকে তাকাবেন প্লিজ! আপনাদের জন্য ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ আছে তাই আপনারা প্লিজ একটু বসুন।কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনারা বেশ বড়সড় একটা চমক পেতে চলেছেন।❞
স্টেজে দাড়িয়ে কথাগুলো বলে থামলো পুতুল। ছেলেটার এহেন কান্ডে বিরক্ত হলো রৌদ্র।এদিকে তার প্রানকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না, আর ওদিকে ছেলেটা পড়ে আছে তার সারপ্রাইজ নিয়ে।রৌদ্র চিন্তিত হয়ে উঠোন পেরিয়ে যাবার জন্য দু-কদম বাড়াতেই থমকে গেলো। অবাক চোখ তার স্টেজের ওপরে দাড়ানো মেয়েগুলোর দিকে।মেয়েগুলোকে স্টেজে আসতে দেখে হাঁফছেড়ে বাঁচলো সবাই। চিন্তামুক্ত হলেন নিমিষেই। স্টেজে দাড়িয়ে আছে আহি-মাহি। আর তার ঠিক সামনে পেছন ঘুরে আছে অরিন।সকলেই তাদের দেখে একপ্রকার হুল্লোড়ে মেতে ওঠেছে তৎক্ষনাৎ। পরক্ষণেই কানে আসে সাউন্ডবক্সে বাজানো গানের শব্দ।

♩ ♪ নাচো হেলিয়া নাচো গো দুলিয়া
রাখো নয়নে নয়ন
মন্ত্র পড়িয়া আগুন জ্বালাইয়া
নীশিতে আসিব যখন
দিধা যত মনে রাখিও যতনে
হাসি মুখে করিও বরণ
যদি অভিমানে মেঘ জমে প্রাণে
ভালোবেসে জেলো আলোড়ন…(নিজ দায়িত্বে পড়ে নিয়েন)

সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ফিরে অরিন। মেয়েটা কেমন মনোমুগ্ধকর নাচের ভঙ্গি নিয়ে নেচে যাচ্ছে। আর সেদিকে তাকিয়ে থমকে গেছে রৌদ্র। বেচারা অবাকের চাইতে হয়তো শক হয়েছে বেশিই! এই যে কেমন হা করে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।মেয়েটার ফর্সা শরীরে কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িটা বেশ সুন্দর করে ফুটে উঠেছে। তার ওপর কোমর অবধি চুলগুলো বিনুনি গাঁথা। মেয়েটার মুখের হাসিগুলো যেন প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে ছেলেটার।

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৩

ভিষন বাজেভাবে টানছে তাকে। রৌদ্র শুষ্ক অধর জোড়া জিভ দিয়ে খানিকটা ভিজিয়ে নেয়। নাহ! এবার যেন তৃষ্ণাটা আরেকধাপ বেড়ে গেলো তার।বুকের ভেতরটায় আবারও কিছু একটা হাতুড়ি পেটা করছে। ছেলেটা এতোটাই প্রভাবিত হয়েছে ,কেননা কখন যে তার অজান্তেই তার বুকের বাঁ-পাশে তার হাতটা চলে গিয়েছে সেদিকে কোনরকম হুঁশ নেই! সে-তো মত্ত নিজের প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে থাকতে। আচ্ছা মেয়েটা যে তাকে দিনকে দিন এতোটা পাগল করে ছাড়ছে,সে খবর কি মেয়েটা আদৌও রাখছে?

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here