সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৭
Jannatul Firdaus Mithila
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে! সেই সাথে চলছে শীতল দমকা হাওয়া।অন্ধকার ছাঁদে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রেমিকযুগল।দু’জনের মুখে টু শব্দ অবধি নেই।অথচ এহেন নিরবতাতেও যেন বহুকথা চলছে তাদের মাঝে। রৌদ্র মুগ্ধতা মিশ্রিত নয়নে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে দাড়ানো ভিজে জবুথবু হয়ে যাওয়া মেয়েটির দিকে।মনটা তার এখন ভিষণ রকমের অস্থির! এতদিন নাহয় মেয়েটাকে নিজ থেকে কাছে টানেনি, ভালোবাসি বলেনি কিন্তু আজ! আজকে তো মেয়েটার সামনে সবটাই স্বীকার করতে হলো তার। ভালোবাসার এহেন উপখ্যানের পরও মেয়েটার থেকে দুরত্ব কিভাবে বজায় রাখবে সে? রৌদ্র ফাঁকা ঢোক গিলে। পলকহীন চোখে তাকিয়ে,দুই-আঙুলের সাহায্যে অরিনের চিবুকটা ধীরে ধীরে উঁচু করে তোলে। মেয়েটার আখিঁদ্বয় বন্ধ করে রাখা।তিরতির করে কাপছে তার, গোলাপের পাপড়ির ন্যায় অধর জোড়া। চোখের বন্ধ পাতা দুটোও কেমন ক্ষনে ক্ষনে কাপছে মেয়েটার।এমন দৃশ্যে রৌদ্রের হৃদয়স্পন্দন বুঝি তড়াক করে বেড়ে গেলো কিছুটা! ছেলেটার নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে আসে মুহুর্তেই। রৌদ্র কেমন অস্থির গলায় শুধায়,
“ এতোটা পাগল করিস না সানশাইন! ”
চট করে চোখ খোলে অরিন।রৌদ্রের ঘোরলাগা নয়নে চোখ পড়তেই মুহুর্তে জমে যায় মেয়েটা।পরক্ষণেই তার কানে আসে রৌদ্রের কন্ঠ!
“ ঘরে চল সানশাইন! এখানে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে তোর শরীর খারাপ হবে নির্ঘাৎ! ”
অরিন হালকা মাথা কাত করে। রৌদ্রের হাতে হাত রেখে ছাঁদ থেকে নিচে নেমে আসে। খানিকক্ষণ পর রৌদ্র অরিনের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়।আশেপাশে একবার সর্তক নজর বুলিয়ে অরিনকে রুমে ঢোকায়।তারপর বলে,
“ তুই ফ্রেশ হ! আমি আসছি কিছুক্ষণ পর। ”
“ কেন?” ––রৌদ্রের কথার পিঠে ফট করে কথাটা বলে ওঠে অরিন। পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে নিতে মিনমিনে স্বরে বললো,
“ না, মানে এতো রাতে? ”
রৌদ্র এহেন কথায় মুচকি হাসলো। মেয়েটার গালে আলতো হাত রেখে বললো,
“ তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে সানশাইন! যা আপাতত তোর জানা ভিষণ প্রয়োজন! ”
অরিন কি বুঝলো কে জানে! মেয়েটা বাধ্যদের মতো মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। তা দেখে রৌদ্র আলতো হাসলো।তারপর গটগট পায়ে হাটাঁ ধরলো নিজের রুমের দিকে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
প্রায় মিনিট দশেক পর অরিন ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার হাঁচি দিয়ে ফেলেছে মেয়েটা! নিশ্চিত অতিরিক্ত বৃষ্টি ভেজার ফলে খুব শীঘ্রই জ্বর আসবে তার।শরীরটাও কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। তারওপর ঠান্ডাও লাগছে ভিষণ। অরিন দ্রুত কদমে এগিয়ে এসে, বিছানা হতে ওড়নাটা হাতে তুলে নেয়। মুহুর্ত ব্যায়ে ওড়নাটাকে বেশ ভালোভাবে পেচিয়ে নেয় শরীরে।উদ্দেশ্য, এতে যদি খানিকটা শীত কমে তার।তখনি দরজায় মৃদু শব্দে কড়া নাড়ানোর আওয়াজ আসে।অরিন তৎক্ষনাৎ গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ভাব এমন, এতক্ষণ বুঝি এই মানুষটার জন্যই অপেক্ষা করে বসে ছিলো সে। রৌদ্র ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করে। হাতে তার খাবার ট্রে। রৌদ্র ট্রে টা বেড সাইডের টেবিলের ওপর রাখে।তারপর ফিরে এসে দরজাটা নিঃশব্দে আটকে দেয়। পেছনে দাঁড়ানো অরিন এতক্ষণ সবটাই নির্বিকার ভঙ্গিতে পরোখ করলো। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,
“ আপনি কিভাবে জানলেন আমি খাবার খাইনি?”
রৌদ্র দরজার দিকে মুখ করে নিঃশব্দে হাসলো। তারপর পেছনে ফিরে ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো অরিনের কাছে। মেয়েটার একহাত টেনে তাকে খাটে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়লো তার মুখোমুখি। কিয়তক্ষন বাদে খাবার প্লেটটা হাতে নিয়ে যত্ন সহকারে খাবার মাখাতে লাগলো রৌদ্র। অরিন এখনও নিশ্চুপ হয়ে দেখছে সবটা। রৌদ্র খাবার মেখে আলতো করে লোকমা তুলে ধরে অরিনের সামনে। চোখ দিয়ে ইশারায় বোঝায়, — খেয়ে নিতে। অরিনও বুঝি আজকে একদম বাধ্য মেয়ে বনে গেলো।কি সুন্দর করে ছেলেটার বলা প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে বিনা
অজুহাতে! অরিন খাবারটা মুখে তুলে নিলো।আবেশে এই বুঝি চোখটা বন্ধ হয়ে আসলো তার! মেয়েটা খাবার চিবোতে চিবোতে হঠাৎ থামলো।তাড়াক করে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে, কোনমতে মুখের খাবারটা গিলে নিয়ে বললো,
“ ডাক্তার সাহেব! আপনি খেয়েছেন তো?”
রৌদ্র নিচু করে রাখা চোখদুটো এবার উপরে তোলে। মৃদু হেসে বলে,
“নাহ, খাইনি!”
অরিনের এবার বেশ খারাপ লাগলো।সে আহত গলায় বললো,
“ কেন খাননি?”
রৌদ্র মেয়েটার কথার প্রতিত্তোরে কিছু না বলে আরেকটা লোকমা এগিয়ে ধরে অরিনের মুখের সামনে। অরিন এবার মুখে তুললো না খাবারটা।রৌদ্রের দিকে উৎসুক দৃষ্টি ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
“ আগে বলুন কেন খাননি!”
রৌদ্র ভ্রুকুটি করে। কন্ঠে কপট গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটিয়ে বলে,
“ এতো জেদ কোত্থেকে আসে তোর সানশাইন? চুপচাপ খাবারটা খেয়ে নে সোনা! এরপর ঔষধও খেতে হবে।নাহলে কাল থেকে তো আবার বিছানার সঙ্গে তোর সখ্যতা হয়ে যাবে নিসন্দেহে! ”
অরিন বুঝি এতেও দমলো না।মেয়েটা একপ্রকার গো ধরে বসে রইলো। আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“ কেন খাননি না বললে আমিও খাবো না ডাক্তার সাহেব! ”
রৌদ্র অবশেষে হার মানলো। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো ছেলেটা।বললো,
“ তুই না খেয়ে থাকলে আমি কিভাবে খাই বলতো সানশাইন? ”
“ আপনি আমার জন্য না খেয়ে ছিলেন? ” — অরিনের কন্ঠে স্পষ্ট অবাকের রেশ। তা শুনে রৌদ্র মিহি হেসে মাথা ঝাকায়। আরেকটা লোকমা তুলে বললো,
“ এবার তো অন্তত খেয়ে নে সোনা! ”
অরিন খেলো না।বরং বললো,
“ আমি খাবো এক শর্তে, আপনাকেও আমার সাথে খেতে হবে। বলুন খাবেন? ”
রৌদ্র কিয়তক্ষন সরু চোখে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। পরক্ষণেই মুচকি হেসে সায় জানিয়ে বললো,
“ এখনি বেশ বউ বউ ভাব নিচ্ছিস তো সানশাইন! অবশ্য মন্দ লাগছে না শুনতে। ”
অরিন বুঝি কথাটায় খানিকটা লজ্জা পেলো। মুখটা নামিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ। রৌদ্র মেয়েটার পরিস্থিতি অবলোকন করে কথা ঘোরায়।নাহলে যে মেয়েটার আর খাওয়া হবে না!
প্রায় বেশ কিছুক্ষন পর রৌদ্র অরিন খাওয়া শেষ হলো।রৌদ্র খাবারের খালি প্লেটটা ট্রেতে রেখে,
হাত ধুয়ে আসে। ট্রেতে রাখা ঔষধের প্যাকেট থেকে দুটো প্রয়োজনীয় ঔষধ আর একগ্লাস পানি হাতে দেয় মেয়েটার।অরিনও খেয়ে নেয় ঔষধগুলো। মেয়েটা যে সেই কখন থেকে একনাগাড়ে হাঁচি দিয়েই যাচ্ছে, থামবার আর নাম নেই! রৌদ্র এবার হাতে একটা শুকনো টাওয়েল তুলে নেয়। অরিনকে পেছনে ঘুরিয়ে তার ভেজা চুলগুলোকে আলতো হাতে মুছে দিতে থাকে সযত্নে। মেয়েটা যে কি পরিমানে অযত্ন নিজের প্রতি,তা বলে বোঝানো মুশকিল! এই যে এখন, তার ভেজা চুলগুলো থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে তার পিঠের অংশ যে একেবারেই ভিজে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে আছে সে খবর কি আছে মেয়েটার? থাকবেই বা কিভাবে? যার প্রতি যত্নশীল মানুষের অভাব নেই, তার কি আর নিজের প্রতি ওতোটা যত্নশীল হওয়া লাগে? অরিন মুচকি হেসে উপভোগ করছে রৌদ্রের কর্মকাণ্ডগুলো। হঠাৎ করে কি যেন একটা মনে পড়লো তার। সে চট করে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ ডাক্তার সাহেব! আপনি যদি আমায় আগে থেকেই ভালোবেসে থাকেন,তাহলে ঐদিন আমায় ফিরিয়ে দিলেন কেন?”
তৎক্ষনাৎ হাতদুটো থেমে যায় রৌদ্রের। পরিবর্তন নেমে আসে মুখের আদলে।হয়তো কোন অপ্রকাশিত সত্য বেরিয়ে আসার উৎকন্ঠা তার মধ্যে! অরিনও খেয়াল করলো রৌদ্রের থেমে যাওয়া হাতদুটো। সে পেছনে ঘুরে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ কি লুকাচ্ছেন আমার থেকে ডাক্তার সাহেব? ”
রৌদ্র একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। অরিনকে আবারও সামনের দিকে ঘুরিয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে বলে,
“ বলবো সানশাইন! আজকে সবই বলবো।”
অরিনও চুপ করে গেলো।কিন্তু মনে তার রয়ে গেলো একরাশ জিজ্ঞাসাবোধ! রৌদ্র অরিনের চুলগুলোকে সুন্দর করে মুছে দিলো।তারপর মেয়েটাকে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়। টেবিলের ওপর থেকে একটা ভেপো-রাব ক্রিম নিয়ে চলে আসে মেয়েটার পায়ের কাছে। অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের পাদু’টো গুটিয়ে নেয়। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ কি করছেন ডাক্তার সাহেব! আপনি আমার পায়ের কাছে বসলেন কেন? উঠুন ওখান থেকে। ”
কে শোনে কার কথা! রৌদ্র অরিনের কথাটাকে রীতিমতো উপেক্ষা করে ঠায় বসে রইলো আগের জায়গায়। বললো,
“ পাদু’টো ছাড় সানশাইন! তোর ইতোমধ্যেই ঠান্ডা লেগে গেছে। ক্রিম টা পায়ের তালুতে রাব করলে কিছুটা আরাম মিলবে তোর। তাই কথা না বাড়িয়ে পাদু’টো সামনে দে!”
অরিন একেবারেই রৌদ্রের সামনে পা দিতে নারাজ।মেয়েটা আরও খানিকটা গুটিয়ে ফেলে নিজেকে।তা দেখে রৌদ্র সরু চোখে বাঁকা হাসে। অরিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
“ আমি জোর করলে খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে না সানশাইন! ”
থমকায় অরিন।চোখদুটো যেন এখুনি বেরিয়ে আসবে কোটর ছাড়িয়ে। মেয়েটা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। তা দেখে রৌদ্র কেমন গা-ছাড়া ভাব নিলো।আরেকবার বললো,
“ পা সামনে আনবি না-কি আমি জোর করবো?”
“ এই না, আমি দিচ্ছি! ” — চট করে ব্যস্ত কন্ঠে কথাটা বলে ওঠে অরিন।পরক্ষণেই ধীরে ধীরে পাদু’টো সামনে নিয়ে আসে।তা দেখে রৌদ্র আলতো হাসলো।অরিনের ফর্সা মসৃণ পাদু’টো আলতো করে নিজের কোলে নিয়ে বললো,
“ দেটস লাইক আ গুড গার্ল!”
তারপর শুরু হলো ছেলেটার যত্ন। আলতো হাতে মলম নিয়ে পাদু’টোর তালুতে রাব করতে থাকলো রৌদ্র। পরক্ষণেই সে বললো,
“ আচ্ছা সানশাইন! বলতো আমাদের বাবা-চাচারা কয় ভাইবোন। ”
অরিন চমকায়।অবাক হওয়া কন্ঠে জবাব দেয়,
“ কয়জন আবার! তারা চার ভাই একবোন।”
অরিনের কথা শোনামাত্রই স্মিত হাসলো রৌদ্র। হাতের কাজ বহাল রেখে ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে বললো,
“ যদি আমি বলি তারা চার ভাই দু-বোন!”
“ মানে?” — তৎক্ষনাৎ অবাক কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে কথাটা। অরিন এবার নড়েচড়ে বসলো। আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“ কি বলছেন এটা ডাক্তার সাহেব? আমরা তো ছোট থেকেই জানি আমাদের মেহু ফুপ্পি ছাড়া আর কোন ফুপ্পি নেই।তাহলে আপনি যে বলছেন আরেকজন আছে! থাকলে আমরা কেন জানিনা ডাক্তার সাহেব? ”
রৌদ্র এবার অরিনের দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখেমুখে একরাশ উদ্বেগের ছাপ। সে ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ফেলে বললো,
“ সানশাইন! এখন আমি যা বলবো তা পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শুনবি।ওকে?”
অরিন মাথা ঝাকায়। রৌদ্রের দিকে উৎসুক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে। অতপর রৌদ্র বলতে থাকে পুরনো কিছু ঘটনা!
“ অরি! মেহু ফুপ্পি ছাড়া আমাদের আরেকজন ফুপ্পি আছে।তার নাম আমরিন এহসান। তিনি প্রায় ২৪ বছর আগে থেকেই এহসান বাড়ির সঙ্গে নিজের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছেন। ছিন্ন করেছেন বললে ভুল হবে, তাকে বিছিন্ন করা হয়েছে এই পরিবার থেকে।তার পেছনে আছে কিছু না জানা কারণ!
রৌদ্র থামলো।গলার স্বর এপর্যায়ে ভারি হয়ে আসছে ছেলেটার! তবুও সে ফাঁকা একটা শুষ্ক ঢোক গিলে বলতে লাগলো,
“ আমি তখন বেশ ছোট জানিস! এইতো সবে ক্লাস ওয়ানে উঠেছি।তখন আমাদের দিদা বেঁচে ছিলো।এমন-ই এক অনুষ্ঠানের জেরে আমরা এসেছিলাম গ্রামের বাড়িতে। ওহ! ভুলে গেছি, অনুষ্ঠানটা ছিলো আমাদের বড় ফুপ্পির বিয়ে।
ফ্ল্যাশব্যাক……..
“ কবির! তুই গিয়া তোর চাচিরে একটু আইবার ক-তো বাপ! নাইলে তো আবার দোষ ধরবো,কইবো — তোমরা আইছো নিজেগো মাইয়া বিয়া দিতে অথচ আমগোরে তো একবার কইলানা।”
মায়ের কথায় মুচকি হাসলেন কবির সাহেব।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়েন কেদারা হতে। গটগট পা ফেলে যে-ই না বাড়ির উঠোনে পা ফেলবে ওমনি পেছন থেকে দুটো কোমল ছোট ছোট হাত তার কোমর জড়িয়ে ধরে। কবির সাহেব থামলেন। পেছনে না ঘুরেই চিনে ফেললেন হাতদুটোর মালিককে। তিনি আলতো করে হাতদুটোকে কোমর হতে ছাড়িয়ে পেছনে ঘুরলেন। রৌদ্রের কোমল মুখখানা দেখে সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে নিলেন।বললেন,
“ কি হইছে আব্বু? ”
ছোট্ট রৌদ্র তখন বাবার কথা শুনে আধো আধো স্বরে বললো,
“ আব্বু! আমি তোমার সাথে যাবো!”
কবির সাহেব ছেলের কথায় সায় জানিয়ে বললেন,
“ ঠিক আছে তাহলে চলো!”
বলেই তিনি আবারও হাটা ধরবেন তার আগেই পিছু ডাকেন জুবাইদা বেগম।
“ এই রোদের আব্বু! দাড়াও!”
কবির সাহেব আবারও থামলেন।পেছনে ফিরে স্ত্রীর ছুটে আসা দেখে বললেন,
“ আস্তে! এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন? শাড়িতে পা আটকালে তো নির্ঘাৎ পড়ে যাবে! একটু ধীরেসুস্থে হাটো!”
জুবাইদা বেগম কথা ঘোরালেন। হাত নাড়িয়ে বললেন,
“ আরে তেমন কিছু হবে না! তুমি ছেলেকে নামাও কোল থেকে।”
কোল থেকে নামার কথা শুনতেই রৌদ্র যেন আরেকটু চেপে ধরলো কবির সাহেবকে।গো-ধরে বলতে লাগলো,
“ নাহ! আমি আব্বুর সাথে যাবো! ও আব্বু আমায় নিয়ে চলো তোমার সাথে। ”
“ এই ছেলে! নিচে নামো বলছি।সেই সকাল থেকে ছোটাছুটি করেছো পুরো বাড়ি। বেলা বাজে সাড়ে ১১টা অথচ ছেলের এখনো খাওয়ার খবর নাই।এসো আমার কাছে। খাবার খেয়ে তারপর যেয়ো বাবার সাথে। ”
জুবাইদা বেগমের কথায় চোখমুখ কুচকে ফেলে ছোট্ট রৌদ্র। মুখ কুচকে বলে ওঠে,
“ আম্মু! আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।আমি আগে আব্বুর সাথে যাই,তারপর এসে খাবার খাবো!”
ছেলের কথায় সম্মতি জানায় কবির সাহেব। স্ত্রীকে মানানোর জন্য বললেন,
“ থাক জবা, ও নাহয় এখন আমার সাথে আসুক।আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবো।এরপর নাহয় তুমি ওকে খাবার খাইয়ে দিও।কেমন?”
“ হ্যা হ্যা এমনভাবেই তো আশকারা দিয়ে মাথায় তুলছো ছেলেটাকে! আমি কিছু বলতে গেলেই চুপ করিয়ে দাও।ধূর! যা ইচ্ছে করো যাও।”
মুখ ঝামটি মেরে কথাগুলো বলে আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালেন না জুবাইদা বেগম। হনহনিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসেন তিনি।এদিকে স্ত্রীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন কবির সাহেব। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ তোমার জন্য আবারও তোমার আম্মুর মুখ ভেংচি খেলাম আব্বু! ”
ছোট্ট রৌদ্র কি বুঝলো কে জানে! ছেলেটা কেমন খিলখিল করে হেসে ওঠে। কবির সাহেব একপলক ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে হাঁটা ধরলেন।
“ আসসালামু আলাইকুম চাচাজান! ভেতরে আসবো?”
বাড়ির সদর দরজা থেকে আসা হঠাৎ ডাকে সেদিকে চোখ তুলে তাকায় আব্দুল মান্নান এহসান। চশমাবিহীন ছানি পড়া চোখদুটো দিয়ে কোনরকমে ঝাপসা চাহনি ফেললো আগন্তুকের ওপর। পরক্ষণেই বললো,
“ কেডা?”
কবির সাহেব ছেলেকে কোলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন।বৃদ্ধ চাচার সামনে এসে কেদারার পাশের টেবিলের ওপর পড়ে থাকা চশমাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“ চাচাজান আমি! কবির।”
বৃদ্ধ আব্দুল মান্নান এগিয়ে দেয়া চশমাটা চোখে এঁটে সামনে দৃষ্টি ফেলতেই তার চক্ষুগোচর হয় কবির সাহেবকে। তিনি আপ্লূত কন্ঠে বলে ওঠেন,
“ আরে বাপজান! কবে আইলা তুমরা?আর এহনো দাড়ায় আছো কেন? বও বও!”
বলেই তিনি হাত বাড়িয়ে পাশে থাকা চেয়ারটি এগিয়ে দেন কবির সাহেবের নিকট। কবির সাহেব চাচার এহেন ব্যাবহারে সম্মানসূচক হাসলেন। বললেন,
“ এইতো আজকে সকালেই এসে পৌঁছিয়েছি চাচাজান।”
“ ওহ! ভালো হইছে।তা বিয়ার কাম-কাইজ কতদূর আগ্গাইলো?”
“ চাচাজান এ বিষয়ে আলাপ করার জন্যই তো আমার এখানে আসা। আমিতো আর ওতো কিছু ঠিকঠাক মতো বুঝিনা।তাই বলছিলাম কি, আপনি এসে যদি একটু বলে কয়ে বুঝিয়ে দিতেন সবটা! ”
বৃদ্ধ মান্নান সাহেব পান খাওয়া লালচে দাঁতগুলো দিয়ে ফোকলা হাসলেন। মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে বললেন,
“ আরে! ঐডা কি কওন লাগবো না-কি? আমার ভাইয়ের মাইয়া মানে আমারও মাইয়া।আর আমার মাইয়ার বিয়ার কাম আমি করমু নাতো কে করবো? তুমি বাপজান চিন্তা কইরো না! আমি আগেত্তেই বাবুর্চি, হেরপর ঐ-যে কি জানি করে না! ওহ হ হ,সাজানি-টাজানি এইসবেরে কইয়া রাখছি।এহন তুমি গিয়া হুদা ফাইনাল করবা।তাইলেই হইবো।”
কবির সাহেব কৃতজ্ঞ হাসলেন।চাচার বয়সের ভারে কুচঁকে যাওয়া হাতদুটো ধরে কৃতজ্ঞতার সহিত বললেন,
“ আপনি আমার কাজ অনেকটাই কমিয়ে দিলেন চাচাজান।আপনার প্রতি কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো তা জানা নেই আমার।”
“ হ,হ পোলারা আইয়া কৃতজ্ঞতা জানাইবো আর বাপে যে ঐদিক দিয়া আমগোর দুনিয়াডা খতম কইরা দিয়া গেছেগা ঐডার কি হইবো?”
রসুইঘর থেকে পানের বাটাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে কথাটা বললেন খুশবু বেগম।বয়স হলেও চেহারায় বুঝি একবিন্দু জৌলুস কমেনি তার।পোশাক -আশাকেও কেমন রাজকীয় ভাবসাব। খুশবু বেগম এগিয়ে এসে বসলেন স্বামীর পাশে।হাত বাড়িয়ে চাবির গোছা বাঁধা আঁচলটা টেনে কাঁধে তুলে নিলেন তিনি।পরক্ষণেই পানের বাটা থেকে পান,চুন,খয়ের মিশিয়ে দক্ষ হাতে পান বানালেন দুটো। তারপর সেখান থেকে একটি এগিয়ে দিলেন স্বামীকে আর একটি মুখে পুরে নিলেন নিজের। পানটা মুখে দিয়ে হাতে থাকা এক চিমটি চুনও মুখে দিতে ভুললেন না তিনি।তারপর বেশ আরাম করে বসে কবির সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ তা কবে আইলা বাপু?”
কবির সাহেব আহত হাসলেন। মাথানিচু রেখে জবাব দিলেন,
“ জ্বি কাকীমা, আজকে সকালেই আসছি!”
“ তা হুনলাম তোমার বইনের না-কি বিয়া ঠিক হইছে।তা পোলা কি কাম করে?”
“ ছেলে ডাক্তার কাকীমা। ঢাকা শ্যামলি হসপিটালের…. ”
কথাটা শেষ করবার আগেই কবির সাহেবকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলেন খুশবু বেগম। নাক সিটকে বললেন,
“ থাক আর কইতে হইবো না বাপু! বুঝবার পারছি মেলা বড়লোক বাড়ির লগে আত্মীয়তা করতাছো।”
পরপর এমন আক্রমনাত্মক কথাবার্তায় ভ্রু কুচকান মান্নান সাহেব। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন,
“ আহ! একটু থামো তো আরিফের মা! কি শুরু করলা? পোলাডা আইছে কতগুলা দিন পরে।কই হের লাইগা একটু নাস্তা পানির ব্যাবস্থা করবা তা-না কইরা কিসব কথা জুইড়া বইছো! যাও ভিতরে যাইয়া হের লাইগা নাস্তা পানির ব্যাবস্থা করো।”
স্বামীর এহেন কথায় মুখ ভেংচি কাটেন খুশবু বেগম। মুখ ঝামটি মেরে বলে ওঠেন,
“ হুুু, একটু কথাও কি কইবার পারিনা আমি? কইলে কি জাত যাইবোনি তোমার? ”
মান্নান সাহেব জবাবে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই কবির সাহেব বলে ওঠেন,
“ চাচাজান!এখন তাহলে উঠি আমি। বাড়িতেতো প্রচুর কাজ পড়ে আছে। আমি নাহয় সেদিকটা গিয়ে সামলাই।হাতে তো আর বেশি দিন নেই। এই আজকের দিনটাই।”
কবির সাহেবের কথায় মান্নান সাহেব চেয়েও কিছু বলতে পারলেন না। ছেলেটাকে যে একটু আটকাবেন তারও বা উপায় কই? বউটা তার যেই পরিমাণে দজ্জাল! না জানি কখন কি বলে বসে।মান্নান সাহেব একটা ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলেন।কবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৬
“ আইচ্ছা বাপজান।তুমি তাইলে যাও।আমিও আইতাছি।”
কবির সাহেব মাথা নাড়লেন। চুপচাপ হেঁটে চলে গেলেন বাড়ির বাইরে।মনে মনে ভাবলেন,
“ আব্বা! আপনি থাকলে হয়তো আমাদের এতো কথা শুনতে হতো না!”