সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২১

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২১
Jannatul Firdaus Mithila

“ আমার সামনে এতোটা লজ্জা পাস না সানশাইন! কেননা,তোর ওমন লজ্জা মাখা মুখ দেখলে নিজেকে আটকে রাখা দায় হয়ে পড়ে আমার জন্য। বারেবারে ইচ্ছে হয়,তোর সব লজ্জা ভেঙে দিতে। তাই প্লিজ আমায় এতোটা পাগল করিস না!”
থমকায় অরিন! চোখদুটো এখনো পলকহীন তার।বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দটা যেন বেড়ে যাচ্ছে আবারও। রৌদ্রের বলা প্রতিটা কথাই কেমন বুকে এসে লাগে তার।আচ্ছা এমন কেন হচ্ছে এখন? কই আগে তো ছেলেটার কথা শুনলে এমন লাগতো না! তাহলে এখন কেন এমন লাগে? অরিন ধীরে ধীরে বললো,

“ আপনি এতোটা বদলে গেলেন কিভাবে ডাক্তার সাহেব? ”
রৌদ্র সরু চোখে তাকিয়ে অরিনের দিকে। কথাটা শোনামাত্র হাসলো ঠোঁট পিষে।বললো,
“ আমি বদলাইনি সানশাইন! এটা বল আমি নিজের আসল রুপের কিছু অংশ দেখাচ্ছি তোকে।”
অরিন অবাক হয়। চোখদুটো বড়সড় করে জিজ্ঞেস করে,
“কিছু অংশ বলতে? আরও কি বাকি আছে বলার? ”
রৌদ্র এহেন কথার প্রতিত্তোরে মুচকি হাসলো। অরিনের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“ নিচে আসেন ম্যাম! বর তো এই বলে!”
অরিনও আলতো হাসলো।তারপর ধীর কদমে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। দু-পা এগোতেই আবারও থামলো মেয়েটা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখতে পায়, রৌদ্র তার লেহেঙ্গার একটা অংশ ধরে উঁচু করে হাঁটছে, উদ্দেশ্য মেয়েটা যেন কিছুটা হলেও স্বস্তিতে হাটতে পারে। অরিন ছেলেটার এহেন কান্ডে আরেকবার মুগ্ধ হয়।অবশেষে রৌদ্রের সাথেই হেঁটে চলে আসে নিচে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ কই গো? এদিকে আসো! বর তো চলে এসেছে! ”
সাব্বির সাহেবের হাঁক ছোঁড়ায় ঘর ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসেন জুবাইদা বেগম আর রাফিয়া বেগম। বাকিরা তো সেই কখন চলে গেলো গেটের সামনে।ছেলেমেয়ে গুলো হয়তো এতোক্ষণে আটকিয়েও ফেলেছে বরকে। জুবাইদা বেগম এগিয়ে এলেন।সাব্বির সাহেবকে বললেন,
“ ভাই! তোমার বড় ভাইজান কোথায়? মানুষটা সেই যে ছুটোছুটি করছে,আর তো থামার নাম নিচ্ছে না।”
বড় ভাবির কন্ঠে স্পষ্ট ব্যাকুলতা টের পেলেন সাব্বির সাহেব। তিনি মৃদু হেসে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
“ ও তুমি ভেবোনা বউমনি! আমি আছি না! আমি খেয়াল রাখবো ভাইজানের।”
দেবরের কথায় কৃতজ্ঞ হাসলেন জুবাইদা বেগম। মাথা নাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন উঠোনে। ঘাড়টা সামান্য উঁচু করে বারবার তাকাচ্ছেন সামনে, হয়তো দেখতে চাচ্ছেন মেয়ের জামাইকে।

কবির সাহেব, তায়েফ সাহেব, সাব্বির এবং তাশরিক সাহেবও এগিয়ে আসেন বাড়ির গেটের সামনে।এসেই দেখতে পান,ছেলেমেয়ে গুলো কেমন ফিতা ধরে আটকিয়ে রেখেছে বরপক্ষকে।হয়তো টাকা উসুলে ব্যস্ত তারা। কবির সাহেব একবার সেদিকে তাকালেন, পরক্ষণেই মৃদু হেসে রেহানের বাবা-মা এবং বয়স্ক আত্মীয় স্বজনদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ ভাই সাহেব! ছেলেমেয়েরা নাহয় পরে আসুক।আপনারা এদিক দিয়ে ভেতরে চলে আসেন।”
বলেই তিনি সামনে ধরে রাখা ফিতাটা খানিকটা সরিয়ে বর আর তার বন্ধুদের বাদে বাকিদের ভেতরে প্রবেশ করান। এতে অবশ্য সবাই খুশি হলেও আহত হলো রেহান! বেচারা বেশ আফসোসের সুরে বললো,
“ সবাই যখন ভেতরে যাচ্ছে, তাহলে আমি কি দোষ করলাম? আমাকেও নিয়ে চলুন ভেতরে। ”
ছেলেটার কথা শেষ হতে দেরি পাশ থেকে মেয়ে পক্ষের ছেলেমেয়েগুলো হৈ-হৈ করতে দেরি নেই।তারা সকলে একযোগে বলে ওঠে,

“ একদম না!”
অগত্যা একরাশ আশায় এক বালতি জল পড়লো রেহানের। ছেলেটা কেমন চুপসে গেলো মুহুর্তেই।থমথমে মুখে বসে রইলো চেয়ারে।উফফ! মনটা তার বড্ড আনচান করছে। ভাবছে, –– কখন যে মেয়েটাকে একপলক দেখে চোখ জুড়োবে কে জানে!
রেহান ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। পকেট থেকে রুমালটা বের করে কপালের ওপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো মুছে নিয়ে বলতে লাগলো,
“ এই শ্যালক-শ্যালিকারা! কার কি দাবি তারাতাড়ি বলো।আমি তোমাদের সকল দাবির পাঠ চুকিয়ে দিচ্ছি! ”
রেহানের এরূপ কথায় যেন মুহুর্তেই ফুঁসে ওঠলো তার বন্ধু মহল। তাদের মধ্য থেকেই একজন খেঁকিয়ে ওঠে বলতে লাগলো,

“ আরে! এতো সহজেই মেয়ে পক্ষের কাছে হেরে যাবো নাকি? আমরাই বা-কম কিসে? তুই আরেকটা কথাও বলবি না।শুধু চুপচাপ বসে থাক এখানে।”
অগত্যা এহেন কথায় না চাইতেও চুপ হয়ে গেলো রেহান। নিজের বিয়ের দিনে, উল্টো পাল্টা কিছু বলে থোড়াই বন্ধুদের কাছে গালমন্দ খাবে! রেহান চুপটি করে বসে পড়ে নিজের আসনে।তখনি পাশ থেকে তার বন্ধু সিয়াম বলে ওঠে,
“ ওহে সুন্দরীরা! আপনাদের দাবি বলেন।”
সিয়ামের এমন কথার ভঙ্গীমায় আরেকদফা হাসির রোল পড়ে যায় উপস্থিত সকলের মাঝে। কিয়তক্ষন বাদে আহিরা বলে ওঠে,

“ তেমন কিছু না বেয়াই সাহেব! যেহেতু আমাদের হবু দুলাভাই বেশ ভালো, তাই আমরাও ভালো একটা দাবি জানাচ্ছি! বেশিকিছু না,এই ধরুন নগদ ৫০ হাজার টাকা এই টেবিলের ওপর রাখবেন তারপর সামনে থাকা মিষ্টিগুলো একটু-আধটু মুখে নিবেন।ব্যস, এটুকুই! ”
আহিরার কথায় যেন বিষম খাওয়ার মতো অবস্থা বরপক্ষের। ছেলেগুলো একে-অপরের দিকে তাকিয়ে যেই না কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভোলাভালা রেহান সাধু মনে বলে ওঠে,
“ আরে! শুধু এই ব্যাপার! এ আর এমন কি? দাঁড়াও এক্ষুনি… ”
বেচারা কথাটা শেষ করবার আগেই পেছন থেকে তার বন্ধুমহল একেবারে জেঁকে বসলো তাকে।সিয়াম তো একটা কড়া কথাই শুনিয়ে দিলো,

“ এ-ই! তুই করছিসটা কি -রে ভাই? এখানে তো কথা টাকার না,এখানে কথা হচ্ছে হেরে যাওয়া। আর আমরা ছেলেপক্ষ হয়ে এতো সহজে হার মেনে যাবো তা কি করে হয়?”
রেহান কি বুঝলো কথাটা? কে জানে! ছেলেটা ধমক খেয়ে থমথমে মুখে বসে রইলো চেয়ারে। উফফ্ না এদের নিয়ে আর পারা যায় না।রেহান একবার আড়চোখে আশেপাশে পরোখ করে খুঁজতে থাকে রৌদ্র আর অনিককে।ঠিক তখনি অনিক আসে সেখানে। ছেলেটা এসেই একগাল হেসে বলে ওঠে,
“ কিরে! আমাদের হবু দুলাভাইকে এভাবে বসিয়ে রেখেছিস কেন? ভেতরে আসতে দে!”
রেহান বুঝি এবার একটা আশার প্রদীপ দেখলো! তৎক্ষনাৎ মুখ ভার করে বললো,
“ দেখনা রে অনিক! সেই কখন থেকে বসিয়ে রেখেছে, একটু ভেতরও আসতে দিচ্ছে না। ”
রেহানের কথায় মুখ ঝামটি মেরে সিয়াম বলে বসলো,

“ ছ্যাহ! শালা* বিয়া পাগল একটা! বলি এখনি এমন করছিস, তাহলে বাকিদিন কি করবি শুনি?”
সিয়ামের ঝামটি মারা কথায় বাকিদের বুঝি হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। অথচ রেহানের মুখাবয়বে যেন রাজ্যের আঁধার!
রৌদ্র ব্যস্ত পায়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে। ছেলেটার এহেন ব্যস্ততার মধ্যে একবারও গেটের সামনে যাওয়া হলোনা। সে হাতের কাজগুলো থেকে খানিকটা বিরতি নিয়ে গেটের দিকে এগোতে যাবে তখনি তার সামনে পড়ে অরিন। মেয়েটা মুখ ভার করে দাড়িয়ে আছে অদূরে। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ এগিয়ে গেলো মেয়েটার কাছে। অস্থির গলায় বললো,

“ কি হয়েছে অরি? এভাবে মন খারাপ করে দাড়িয়ে আছিস কেন? কেও কিছু বলেছে?”
অরিন মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানায়। চোখ তুলে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বললো,
“ আসলে আমার না একটু গেটের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু ঐখানে প্রচুর ভিড়।আপনিতো জানেন আমি বেশি ভিড়ে একা যেতে পারিনা”

এমন কথায় রৌদ্রের মেজাজটা খানিকটা বিগড়ে যায়। সে ভ্রুকুটি করে তাকায় মেয়েটার দিকে।তার এ মুহুর্তে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে দুটো কড়া কথা শোনাতে।ভাবা যায়,কতবড় সাহস হলে এতোগুলাে ছেলের সামনে যাবার কথা ভাবে সে! মনে মনে এমন যুক্তি দাড় করাবার পরও বাইরে থেকে কন্ঠে একরাশ কোমলতা মিশিয়ে রৌদ্র বললো,
“জানবাচ্চা! ঐদিকটায় তো অনেক ছেলে।সেখানে গেলে নিশ্চিত তুইও অকোয়ার্ড ফিল করবি।তারচেয়ে তুই বরং এখানেই থাক।আমি যাচ্ছিতো সেখানে, দরকার হয় তোর জন্য সবটা ভিডিও করে আনবো কেমন?”
নাহ! কথাটা বোধহয় মনে ধরলো না অরিনের। মেয়েটার মুখাবয়বে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তা। সেদিকে তাকিয়ে রৌদ্র ফোঁস করে একটা ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেললো। মেয়েটার ফোকাস অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য একটা দুষ্ট বুদ্ধি আটলো। আশপাশে মানুষের ঢল দেখে বললো,

“ সানশাইন! একটু বাড়ির পেছনের দিকে আয় তো!”
চকিতে দৃষ্টি ফেললো অরিন।বললো,
“ কেন? হঠাৎ ঐখানে কেন?”
রৌদ্র দুষ্ট হাসলো।ঠোঁট কামড়ে ধরে ইশারায় চুমুর ভঙ্গি দেখালো।যা দেখে মেয়েটার যেন লজ্জায় লুটিয়ে পড়ার মতো অবস্থা! গালদুটোয় ঈষৎ লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে নিমিষেই। চিবুক নেমে এসেছে গলার কাছে। রৌদ্র দেখলো সবটা। মেয়েটাকে আরেকটু জ্বালাতে হাস্কিস্বরে বললো,
“ আয় না সানশাইন! এ মুহুর্তে একটা চুমু নামক ভিটামিন যে আমার ভিষণ দরকার! দেখনা এই ভিটামিনের অভাবে শরীরটা কেমন দূর্বল দেখাচ্ছে! ”

অরিন জিভে দাত কাটে। মুখে কপট রাগী ভাব এনে বলে,
“ ছিহ! ডাক্তার সাহেব! এমন নামের কোন ভিটামিন কি আদৌও আবিষ্কার হয়েছে কখনো?”
রৌদ্র সরু চোখে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। বাঁকা হেসে বললো,
“ হুম হয়েছে তো! বহুযুগ আগে থেকেই এটা আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে এটা যেকেউ যখন-তখন দেয়া-নেয়া করতে পারেনা। খুব ব্যাক্তিগতভাবে এটা আদায় করতে হয়। তুই চাইলে আমি তোকে দেখাতে পারি কিভাবে নিতে হয়।কি বলিস দেখাবো?”
ভড়কায় অরিন। তৎক্ষনাৎ ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না বলে ওঠে মেয়েটা। তা দেখে রৌদ্র দুষ্ট হাসলো। মেয়েটার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসতেই অরিন যারপরনাই একপ্রকার ছুটে পালালো সেখান থেকে। অরিনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রৌদ্র। বিরবির করে বললো,
“ ফাইনালি!”

এককথা -দুকথায় প্রায় অনেক্ক্ষণ হলো তর্কাতর্কি চলছে দুপক্ষের মধ্যে, কিন্তু কোন পক্ষই বুঝি থামার নাম অবধি নিচ্ছে না। তখনি সেখানে আগমন ঘটে রৌদ্রের। এসেই দেখতে পায় দুপক্ষের হুলস্থুল কান্ডের।রৌদ্রকে দেখা মাত্র উভয়পক্ষ বুঝি একেবারেই শান্ত হয়ে গেলো।অথচ কিছুক্ষণ আগে কি তর্কটাই না চলছিলো।রৌদ্র এসেই ভ্রু-গোটায়, গম্ভীর গলায় শুধায়,
“ কি হচ্ছে এখানে? ওরা এসেছে সেই কখন, তাহলে এখনো ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো না কেন?”
রৌদ্রের এহেন কথায় মাথানিচু করে দাড়িয়ে রইলো সকলে।পাশ থেকে অনিক গম্ভীর গলায় বললো,
“ ওরা ওদের প্রাপ্যটুকুই চাইছে।না দিলে কিভাবে ঢুকতে দিবে?”
রৌদ্র এবার রেহানের দিকে তাকায়। গম্ভীর গলায় বলে,
“ কিরে! তোর এতোটা অভাব আসলো কবে থেকে যে ওদের প্রাপ্যটুকু দিতে এতোটা হিমশিম খাচ্ছিস?”
রেহান এবার মুখ খুললে।আহত কন্ঠে বললো,

“ দোস্ত বিশ্বাস কর! আমি আরও আধঘন্টা আগে থেকেই টাকা নিয়ে বসে আছি, কিন্তু এই হারামিগুলো দিতে দিচ্ছে না! ”
রেহানের কথায় মেয়েপক্ষ মুচকি হাসতে লাগলো।আর রেহানের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেগুলো বুঝি ফুঁসতে লাগলো।সিয়াম তো ঠাট্টার স্বরে বলেই বসলো,
“ এখনি কনেপক্ষের সামনে এভাবে মাথানিচু করে ফেললে,তাহলে তো বাকিদিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে তোমায়!”
সিয়ামের এমন ঠেস দিয়ে বলা কথায় সকলেই ভ্রুকুচকায়। রৌদ্র সিয়ামের দিকে খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অতপর বললো,

“ মাথা নিচু করাটা দূর্বলতা নয় সিয়াম, এটা একটা আদব।আর রইলো বাকি মেয়েপক্ষের সামনে মাথানিচু করার কথা, তাহলে ভুলে যেও না মেয়েপক্ষের ঘরেই কিন্তু রেহানের ঘরের সম্মান আছে। আর যে ঘরে সম্মান আছে, সেখানে মাথা একটু নিচু করলেও চলার পথে তেমন একটা ক্ষতি হয় না।”
রৌদ্রের এমন প্রতিত্তোরে গর্বিত হাসলো সকলে।রেহানও হাসলো তেমন। তারপর কালবিলম্ব না করে পকেট থেকে নগদ টাকা বের করে টেবিলের ওপর রাখলো।অতপর তাকে টুকটাক সমাদৃত করে ভেতরে নিয়ে আসা হলো।

চারিদিকে হৈ-হুল্লোড় থামিয়ে এখন কিছুটা নিস্তব্ধতা। বিয়ে পড়ানো হচ্ছে রেহান-রুহির। রেহানের কবুল বলার পালা শেষ হতেই সবাই একযোগে বলে ওঠে “ আলহামদুলিল্লাহ ” এবার সবাই বসে রুহির কাছে।মেয়েটার পেছনে তার মা-চাচীরা এবং ফুপু, আর এক পাশে বসে আছেন কবির সাহেব, সাব্বির সাহেব অন্যপাশে তায়েফ ও তাশরিক। রৌদ্র দাঁড়িয়ে আছে রেহানের পাশে, অনিকও তাই! কাজী সাহেব বেশ সুন্দর করে রুহিকে কবুল বলতে বললেন কিন্তু মেয়েটা যেন একেবারেই নির্বাক। আর হবে না-ই বা কেন? এতো সহজে কি বলে দেওয়া সম্ভব? এই একটা শব্দই তো তাকে আজীবনের জন্য অন্যের করে দিবে।পর হয়ে যাবে নিজ বাড়িতে। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা বাড়িটাই হয়ে যাবে পর। রুহির কেমন গলা ধরে আসলো।হয়তো চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার! হাতে থাকা কলমটাও কেমন কাপছে মেয়েটার! পাশে বসা কবির সাহেব বেশ লক্ষ্য করলেন বিষয়টা। লোকটা তৎক্ষনাৎ অন্যদিকে মুখ ঘোরালেন। হয়তো ভরে আসা চোখগুলো লুকানোর ক্ষুদ্র চেষ্টা তার। রৌদ্র সবটা খেয়াল করে এগিয়ে আসে।বোনের মাথায় আলতো হাত রেখে বলে,

“ বল বুড়ি!”
ব্যস এটুকু আশকারাই যথেষ্ট ছিলো রুহিকে কাঁদাবার।মেয়েটা ঝট করে ভাইয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে। তারপর হু হু করে কাঁদতে থাকে বুক ভাসিয়ে। রৌদ্রও বোনকে জড়িয়ে ধরলো।পিঠে আলতো করে হাত বুলাতে লাগলো বোনের।ছেলেটার চোখদুটোও কেমন রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে ইতোমধ্যে! হয়তো কাঁদতে চাইছে চোখগুলো কিন্তু অনুমতি নেই বিধায় আর ঝড়লো না!
এদিকে রুহির এমন কান্না দেখে অরিনও কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। মেয়েটার আবার এই এক জ্বালা! তার সামনে কেও কাঁদলেই সেও কেঁদে ওঠে। অরিন যখন কাঁদতে ব্যস্ত তখনি তার কাছে ছুটে আসে অনিক।বোনের মাথাটা আলতো করে বুকে চেপে ধরে বোঝাতে লাগলো সে,

“ কাঁদে না বনু! থেমে যা। নাহলে মাথা ব্যাথা করবে তো!”
ভাইয়ের এমন কথায় আরেকটু আহ্লাদী হলো অরিন।ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“ আমি কোনদিন বিয়ে করবো না ভাইয়া! আমি তোমাদের ছেড়ে কোনদিন যাবো না!”
বোনের এমন বোকা কথায় না চাইতেও হেসে ওঠে অনিক। বলে,
“ আচ্ছা ঠিক আছে! সেটা পরে দেখা যাবে।”
ওদিকে বেশ কিছুটা সময় পার হবার পর রুহি থামলো।ক্ষনে ক্ষনে নাক টানার শব্দ আসছে তার থেকে। ভাইয়ের কোমর ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো।তারপর আবারও কাজী সাহেবের কথামতো ধীরে ধীরে সেও বললো।অতপর সবাই এবার একযোগে “ আলহামদুলিল্লাহ ” বলে ওঠে।

দেখতে দেখতে বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো।রুহিতো সেই কখন থেকে একবার মা’কে জড়িয়ে কাঁদছে, তো একবার চাচীদের জড়িয়ে কাঁদছে। জুবাইদা বেগম মেয়ের জন্য কেঁদে কেটে অস্থির! তাকে এখন সামলাচ্ছেন রাফিয়া বেগম আর মাইমুনা বেগম। রুহি এবার ধীরে ধীরে বাবার কাছে আসে।তারপর ফট করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মেয়েটা। কবির সাহেবও মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলেন বুকে।ভাব এম, ছাড়লেই বুঝি হারিয়ে গেলো! লোকটার চোখদুটো কেমন চিকচিক করছে। হয়তো পুরুষ মানুষ বলে চিকচিক করা অশ্রুকণা গুলো বাইরে আসতে পারছেনা। কবির সাহেব মুখ খুললেন। এপর্যায়ে কন্ঠ তার বেশ মোটা!

“ সাবধানে থেকো আম্মু! ভালোমতো চলাফেরা কইরো! ”
রুহি কি শুনলো কথাটা? হয়তো শুনেছে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে,
“ আমি যাবোনা আব্বু! আমি তোমাদের ছেড়ে যাবোনা! প্লিজ আব্বু ”
কবির সাহেব ভেজা চোখে হাসলেন মেয়ের কথায়। মেয়ের কপাল বরাবর চুমু একে বললেন,
“ তা হয়না আম্মু! এখন থেকে যে ঐটাই তোমার আসল বাড়ি! যেতে তো হবেই আম্মু! ”
রুহি শুনলো না।বাচ্চাদের মতো গো ধরে ভাইয়ের দিকে ছুটলো।রৌদ্রের কাছে এসেই ভাইয়ের বুকে আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো সে। রৌদ্রও বোনকে বাহুডোরে আঁকড়ে ধরলো।ছেলেটার মুখটা কেমন লাল হয়ে আসছে।চোখদুটোতেও কেমন রক্তাভ আভা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রুহি বললো,

“ ভাইয়া! ও ভাইয়া! আমি যাবো না কোথাও। প্লিজ ওদের চলে যেতে বলো।প্লিজ!”
রৌদ্র ঢোক গিললো। হয়তো গলা অবধি আসা কান্নাগুলো কোনরকমে গিললো ছেলেটা। সে বললো,
“ রেহানটা যে কষ্ট পাবে বুড়ি! ও কষ্ট পেলে কি তোর ভাল্লাগবে?”
অগত্যা এহেন কথায় থেমে গেলো রুহি। নাক টানলো জোরালো ভাবে। রৌদ্রও বোনকে বুক থেকে উঠিয়ে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। তারপর বোনকে এগিয়ে নিয়ে যায় রেহানের গাড়ির দিকে। রুহিকে সযত্নে গাড়িতে বসিয়ে রেহানের দিকে তাকায় রৌদ্র। রেহানের পান্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে গম্ভীর এবং নিরেট কন্ঠে বললো,
“ তুই শুধু আমার বোনকে না, আমার কলিজার একাংশ নিয়ে যাচ্ছিস। তাই বি কেয়ারফুল! বিনা কারণে ওর চোখ থেকে যদি একফোঁটা অশ্রুও বের হয়, তাহলে আমি কিন্তু ভুলে যাবো রেহান নামে আমার কোন বন্ধু আছে কিংবা ছিলো! মাইন্ড ইট! ”

রেহান খানিকটা শুকনো ফাঁকা ঢোক গিলে। তারপর বলে ওঠে,
“ কেন শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছেন সম্বন্ধিবাবু? কথা দিচ্ছি, আপনার বোনকে রানীর মতো করে রাখবো ইনশাআল্লাহ! ”
এহেন কথায় রৌদ্র মৃদু হাসলো। মাথা ঝাকিয়ে বললো,
“ জানি!”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২০

ধীর স্বরে বলা কথাটাও বেশ শুনলো রেহান।ছেলেটা আলতো হেসে রৌদ্রের সাথে হ্যান্ডশেক করে নেয়। রৌদ্রও কথা শেষে গাড়ি থেকে মাথা উঠিয়ে নেয়। তারপর রেহানদের গাড়িও কিছুক্ষণ পর রওনা দেয় নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে! আর পেছন থেকে কয়েক জোড়া ছলছল চোখ তাকিয়ে রইলো সেই চলে যাওয়ার দিকে…

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here