সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৪০

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৪০
Jannatul Firdaus Mithila

“সেটা সামনা-সামনি এলে বোঝাবো হানি! তাও আবার রাতের আধারে প্র্যাক্টিক্যালি বোঝাবো!”
অরিনের লজ্জা রাঙা মুখখানা তৎক্ষনাৎ হা হয়ে যায়।মনে মনে ভাবে, — মানুষটা কি সাংঘাতিক কথাবার্তা শুরু করেছে তার সঙ্গে।অথচ দেখো, তার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ লজ্জা-সরমের বালাই নেই। অরিন দাঁতে জিভ কাটে।মিনমিনে সুরে বলে ওঠে,
“ আপনি এমন লাগামহীন কথা বলেন কেনো সবসময়?”
রৌদ্র আবারও ঠোঁট কামড়ে হাসে। টেবিলের ওপর হাতের কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে।অরিনের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলতে থাকে,
“ এমন একটা পিচ্চি বউ থাকলে আমার মতো সুপুরুষ লাগামহীন হবে,বেশরম হবে এমনকি নির্লজ্জ হতেও বাধ্য! তাছাড়া পরিবারটা যদি মেনে নিতো বউ…… বিশ্বাস কর, রোজ তোর আর আমার বাসর হতো!”
অরিনের কাশি উঠে যায় এমন কথায়। মেয়েটা কাশতে কাশতে ঠিক মতো তাকাতেও পারছেনা রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র মুখের সামনে হাত এনে আড়ালে মুখ টিপে হাসছে।মেয়েটাকে বারবার নাস্তানাবুদ করতে কেন যে এতো ভালো লাগে তার! রৌদ্র মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। নরম কন্ঠে বলে,
“ ঘুমিয়ে পড় সানশাইন! আর শোন, নিজের খেয়াল রাখবি কিন্তু!”
অরিনের কাশি থামিয়ে কোনমতে মাথা কাত করে রৌদ্রের কথায়। রৌদ্র মুচকি হেসে ইশারায় চুমু দেখায় অরিনকে।অরিনও খানিকটা লজ্জালু হাসে।রৌদ্র কিয়তক্ষন অনিমেষ চোখে তাকিয়ে থেকে কলটা কেটে দেয়। অরিন নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ছেলেটার পাগলামিগুলো কল্পনা করতেই খানিকটা মুচকি হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কোণে।

সময় আর নদীর স্রোত নিজ গতিতে এগিয়ে চলে। তারা মানে না কোনো বাঁধ কিংবা বাধা। এই যেমন দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরও ৯ টি দিন। রৌদ্র ক্যাম্পেইনে গিয়েছে ঠিক ১২ দিন আগে।বলেছিলো তার না-কি সপ্তাহখানেক লাগবে অথচ এখন দেখো, আজ সপ্তাহ পেরিয়ে ১২ দিন তবুও ছেলেটার কোনো খোঁজ নেই আসার।
ইদানীং অরিনের মনটাও বেশ খারাপ থাকে।আগের মতো হাসির দেখা নেই আদুরে মুখটায়।থাকবেই বা কি করে? সেদিন রাতে কথা বলার পর থেকে আর একটিবারের জন্যও ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ মেলেনি অরিনের। কিভাবে মিলবে সুযোগ? রৌদ্র যে এখন ভিষণ ব্যস্ত তার রোগীদের নিয়ে! যদিও মাঝেমধ্যে সময় বাঁচিয়ে অরিনের কাছে দুয়েকটা মেসেজ দিয়ে নিজের খোঁজ-খবর দিয়েছে ছেলেটা। এই যা!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সকাল পৌনে ৯ টা!
রাফিয়া বেগম সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে একের পর এক হাঁক ছুড়ছেন মেয়ের উদ্দেশ্যে।অথচ অরিনটার নিচে নামার কোনো নাম-গন্ধও নেই।রাফিয়া বেগমের মেজাজ চটলো খানিকটা। তিনি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবেন তখনি রুম থেকে সাব্বির সাহেবের ডাক আসে। স্বামীর কন্ঠ কানে যেতেই আর উপরে গেলেন না তিনি।রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলেন। রুমে ঢুকতেই রাফিয়া বেগমের আগুন জ্বলা রাগে বুঝি আরেকদফা ঘি পড়লো। সারা ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অফিসের কাগজপত্র। অথচ কিছুক্ষণ আগেও তিনি পুরো ঘরটা গুছিয়ে গিয়েছিলেন। সাব্বির সাহেব স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেয়ে সেদিকে না তাকিয়েই বলেন,
“ রাফু! আমার লাল ফাইলটা কই গো? এখানে তো পাচ্ছি না! তুমি কি কোথাও…. ”
কথাটা বলতে বলতে একপলক পেছনে তাকালেন সাব্বির সাহেব। আর ওমনি তার নজর আঁটকে গেলো দরজার সামনে রণমুর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিজ স্ত্রীর দিকে।যার অগ্নি দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। নাকের পাটা রাগে ফেঁপে উঠেছে খানিকটা। সাব্বির সাহেব খানিকটা ঢোক গিললেন। আড়চোখে একবার আশপাশে তাকালেন। পরক্ষণেই দাঁতে জিভ কেটে স্ত্রীর দিকে তাকালেন সহাস্য মুখে।থেমে থেমে বললেন,

“ ইয়ে মানে..রাফু… ”
বালাইসাট! তার কথা শেষ হবার আগেই খেঁকিয়ে ওঠেন রাফিয়া বেগম।
“ কি করেছোটা কি ঘরের অবস্থা? এটা কি ঘর না-কি গোয়ালঘর? এতো বয়স হয়ে এলো, অথচ এখনো বাচ্চাদের মতো হাবভাব করা ছাড়লে না তুমি! বলি, আমাকে কি একদন্ডও শান্তি দিবেনা তোমরা?”
স্ত্রীর মুখে একের পর এক ঝাড়ি খেয়েও চুপ করে রইলেন সাব্বির সাহেব। এই মুহূর্তে স্ত্রীর কথার পিঠে কিছু বলে থোড়াই না আগুনে ঘি ঢালবেন তিনি! তাই মাথানিচু রেখে সবটা শোনাই শ্রেয় মনে করলেন তিনি।এদিকে স্বামীকে নির্বাক থাকতে দেখে আরেকটু খেপে গেলেন রাফিয়া বেগম। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ঘরটা গোছাচ্ছেন আর বলছেন,

“ হ্যা..হ্যা..এখন তো আমার কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান ধরবে! বাপ টা যেমন, ছেলেমেয়ে গুলোও তেমন হচ্ছে। একজনও আমার কথা শোনে না। সব চলে নিজেদের মতো।”
রাফিয়া বেগম থামলেন। হয়তো কথা শোনাতে শোনাতে হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। রাফিয়া বেগম হাতের কাজগুলো গুছিয়ে খাটের পাশের ছোট টেবিলের কাছে গেলেন।সেখানের দ্বিতীয় ড্রয়ার থেকে লাল ফাইলটা বের করে এনে এগিয়ে দিলেন স্বামীর পানে।সাব্বির সাহেব একবার চোখ তুলে চাইলেন। পরক্ষণেই প্রয়োজনীয় ফাইলটা সামনে পেয়ে বেজায় খুশি হলেন মানুষটা।হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলেন ফাইলটা। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খুশিমনে বললেন,
“ কোথায় পেলে এটা? আমিতো সেই কখন থেকে খুঁজছি!”
রাফিয়া বেগম মুখ ঝামটি দিয়ে বলে ওঠেন,
“ চোখকান খোলা রেখে খুঁজলে তবেই না পাবেন! আপনি তো শুধু হাওয়ার ওপর চোখ বুলিয়েই ক্ষ্যান্ত হোন।”
সাব্বির সাহেব স্ত্রীর ঝাঁঝালো কথাতেও হাসলেন। স্ত্রীর একহাত চেপে তাকে নিজের পাশে বসালেন। আলতো হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

“ সকাল সকাল এতো ক্ষেপে গেলে কেনো বলোতো? ”
রাফিয়া বেগম ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন। শাড়ির আঁচলে ঘর্মাক্ত ললাটটা খানিকটা মুছে নিয়ে বলতে লাগলেন,
“ ক্ষেপি কি আর সাধে? তোমার আদরের দুলারিকে সেই কখন থেকে ডাকছি,কিন্তু তার বুঝি মায়ের ডাক শোনবারও সময় নেই! তারওপর তোমার ছেলেটা। তার কথা আর কি বলবো।সারাক্ষণ বোনের পিছুপিছু ঘুরবে, বোনকে মাথায় তুলে রাখবে।তোমার আর ওর আশকারা পেয়ে পেয়ে দিনকে দিন মেয়েটা বাদঁর হচ্ছে।উফ! আর পারিনা!”
সাব্বির সাহেব বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন স্ত্রীর কথা।তিনি মিটমিটিয়ে হাসছেন।রাফিয়া বেগম কথার একফাঁকে স্বামীর দিকে তাকান।পরক্ষণেই তাকে হাসতে দেখে খেঁকিয়ে বললেন,
“ কি ব্যাপার? ওভাবে হাসছো কেন?”
সাব্বির সাহেব থতমত খেলেন খানিকটা। আমতা আমতা করে বললেন,
“ ইয়ে না…এমনি!”

বর্ষার আবহাওয়া এই ভালো তো এই খারাপ! কখনো টানা বৃষ্টি তো কখনো আবার মেঘলা মৃদুমন্দ বাতাস!
মাহিরা ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে লাইব্রেরীর সামনে। সেই কখন থেকে মেয়েটা অপেক্ষা করে যাচ্ছে নিজের এক বান্ধবীর। তার কাছে মাহিরার একটা বই পড়ে আছে অনেকদিন যাবত।মাহিরা এটা নিয়েছিলো এই লাইব্রেরি থেকে।এখন জমা দেওয়ার ডেট এসেছে কিন্তু বইটা তার হাতে নেই। মাহিরা বৃষ্টির মধ্যে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে একটা চায়ের টংয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। ইশশ্… ছাতা থাকা সত্বেও মেয়েটা ভিজে নেয়ে একাকার! মাহিরা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায়।একহাতে ছাতা ধরে অন্যহাতে নিজের গায়ের ওপর থেকে পানির ঝাপটা গুলো সরাচ্ছে।তখনি পাশ থেকে ভেসে আসা পরিচিত পুরুষালী কন্ঠে খানিকটা হকচকিয়ে ওঠে সে!

“ কেমন আছেন মিস?”
মাহিরা চমকে পাশে তাকায়।দেখতে পায় — ইফতি ছাতা হাতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মাহিরা হালকা হাসলো তাকে দেখে।ধীর স্বরে জবাব দিলো,
“ জ্বি ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন? ”
ইফতি মৃদু হেসে মাহিরার থেকে কিছুটা দুরত্বে এসে দাঁড়ালো। হাতের ছাতাটা গুটিয়ে নিয়ে বললো,
“ এইতো আলহামদুলিল্লাহ! বেশ ভালো আছি।”
তারপর… তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা চললো তাদের মাঝে। এরইমধ্যে ইফতি নিজ থেকে বলে ওঠে,
“ চা খাবেন মিস?”
মাহিরার ইচ্ছে করলো একবার না বলে দিবে।কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, — এভাবে মুখের ওপর না করে দিলে ব্যাপরটা একটু অড হয়ে যায় না? তাই সে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ খাওয়া যায়!”
ইফতি মুচকি হেসে দুটো চায়ের অর্ডার দিলো। তারপর এসে দাঁড়ালো আগের জায়গায়। ইফতি একবার আড়চোখে তাকালো মাহিরার দিকে।মেয়েটার মধ্যে আহিরার মতো একদমই কোনো চঞ্চলতা নেই।একদম ধীর-শান্ত মেয়েটা। তবুও ইফতির কেনো যেন আহিরাকেই ভিষণ মনে পড়লো এ মুহুর্তে। ইফতি নিজ মনেই অবাক হলো বেশ! ইদানীং হুটহাট মেয়েটার কথা বেশ মনে পড়ছে তার। এই যে এখনও পড়ছে।ইফতি নিজের এহেন ভাবনায় খুব বিরক্ত হলো।সে বিরবির করে বললো,

“ ড্যাম!”
“ হু? কিছু বললেন?”
পাশ থেকে মাহিরার কথায় মাথা নাড়িয়ে না জানায় ইফতি।প্রসঙ্গ ঘোরাতে সে বলে ওঠে,
“ আব…ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আ’ম আস্কিং, এখানে কি করছিলেন মিস?”
মাহিরা আলতো হেসে পুরো কাহিনি বললো।ইফতিও বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো সবটা। তখনি পেছন থেকে একটা ছোট ছেলে এসে তাদের হাতে দুকাপ ধোঁয়া ওঠা উষ্ণ চা দিয়ে যায়। মাহিরা আর ইফতিও চাদুটো নিয়ে নিজেদের মতো হেসে হেসে কথা বলছে আর একটু পরপর কাপে চুমুক দিচ্ছে। তাদের এই ঘটনা অদূরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরোখ করছে আহিরা।মাহিরার কল পেয়েই এদিকটায় আসছিলো সে কিন্তু পথেই তাদের দু’জনকে এভাবে একসঙ্গে টাইম স্পেন্ড করতে দেখে সেখানেই থমকে দাঁড়ায় মেয়েটা। আহিরা গভীর চোখে তাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে শ্লেষাত্মক হাসলো।ইফতির দিকে তাকিয়ে বিরবিরিয়ে বললো,
“ অল মেন আর ডগস! তারা মুখে বলবে একজনের নাম,মনে রাখবে আরেকজনের, আর স্বপ্নে আনবে আরেকজনকে! শালার… পারভার্ট কতগুলা!”

[বিঃদ্রঃ উক্ত কথাটি কাওকে ছোট করার লক্ষ্যে বলা হয়নি। এটা বহুল প্রচলিত একটা বাক্য বিধায় চরিত্রের খাতিরে লিখেছি। যদি আমার লেখা কাওকে কষ্ট দিয়ে থাকে তাহলে আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ হতে না হতেই আকাশ কালো হয়ে এলো। একটু পরেই টুপটাপ বেগে বৃষ্টি নামলো ধরণীতে।ক্যাম্পাসের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা স্টুডেন্টগুলো দৌড়াদৌড়ি করে এদিক ওদিক ছুটলো, কেউবা আশ্রয় নিল ডিপার্টমেন্টের বারান্দায়। ইকরা তখনও ক্লাসরুমেই।
অনিক ডিপার্টমেন্টের কর্নারে দাঁড়িয়ে ইকরার অপেক্ষায়। সেই কখন থেকে মেয়েটার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে।আজ নিজেকে বেশ প্রস্তুত করে এসেছে —যেন মেয়েটাকে নিজের মনের কথাগুলো জানাতে পারে। অনিক একবার নিজের হাতঘড়ির দিকে চাইলো। নাহ,সময় তো হয়ে গেছে মেয়েটার ক্লাস শেষ হবার,তবুও আসছে না কেন? অনিক নিজের ভাবনায় নিমগ্ন। তার হাতে থাকা কালো ছাতাটা ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির তোপে, অথচ মন যেন তার বড্ড অস্থির।ক্ষনে ক্ষনে একটা কথাই মনে এসে দোল খাচ্ছে তার — যদি আজও কিছু বলা না হয়?
অনিকের ভাবনার মাঝেই ইকরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো ধীরে ধীরে। মেয়েটার চোখে কেমন হালকা ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু মুখে সেই চিরচেনা কোমলতা। ইকরা হাটার গতি কমিয়ে বাইরে তাকিয়ে হালকা হাসলো, বৃষ্টির দিকে চাইলো মুগ্ধ হয়ে। অনিক অদূরে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখলো ইকরাকে।মেয়েটার এই মনকাড়া হাসির ওপর যে সে বরাবরই বিমুগ্ধ।

হাঁটার একপর্যায়ে বারান্দার কিনারায় এসে দাঁড়াতেই ইকরা খানিকটা ভিজে গেলো।তবুও সেদিকে মেয়েটার কোনো হেলদোল নেই।সে চুপচাপ মাথা উচুঁ করে চোখ বন্ধ রেখে দাঁড়িয়ে রইলো বৃষ্টির নিচে।কিছুক্ষণ পর ইকরার মনে হলো তার ওপর বুঝি বৃষ্টির পানি আর পড়ছে না।মেয়েটা তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে।দেখতে পায়— অনিক তার ওপরেই ছাতা ধরে নিজে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে অনিককে দেখে ইকরা কিছুটা ঘাবড়ে যায়।সে নিজের কাঁধে থাকা ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে অনিককে পাশ কাটাতে নিলেই বাঁধ সাধে অনিক।গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“ তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে!”
ইকরা ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকায়।জিজ্ঞেস করে,
“ আমার সাথে কি কথা আপনার?”

অনিক ইকরার চোখের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকায়। সেই সরু দৃষ্টি বুঝি কাঁপন ধরিয়ে দিতে সক্ষম ইকরার মতো ছোট্ট কোমলপ্রান মানুষের মনে।ইকরা তৎক্ষনাৎ নিজের চোখজোড়া সরিয়ে নেয়। অনিক মুচকি হাসে মেয়েটার কান্ডে।সে ফিসফিস করে বলে,
“ তোমার সাথে প্রেম করবো, সেই নিয়েই কথাবার্তা বলবো আরকি!”
এহেন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খায় ইকরা।কি শুনলো সে? লোকটা কি সত্যিই এই কথাটা বললো? ইকরা সন্দিহান গলায় ফের জিজ্ঞেস করলো,
“ কিহ?”
অনিক এবার দু-কদম এগিয়ে আসে ইকরার পানে। ঘাড়টা খানিক নিচু করে দাঁড়ায় মেয়েটার সামনে। ইকরা আবার হাইটে তার থেকে ছোটো কি-না! ইকরা অনিককে এতোটা কাছে দাঁড়াতে দেখে পিছু হটতে নিলে অনিক খানিকটা জোর গলায় বলে ওঠে,

“ উহুম! একপা ও নড়বে না এখান থেকে!”
কি ছিলো এই কথাটায়? কেন ইকরা থেমে যেতে বাধ্য হলো এমন অনুরক্তিতে? অনিক মৃদু হেসে বলে,
“ তোমার সাথে প্রেম করার ভিষণ শখ জেগেছে মেয়ে! চলো এই বৃষ্টিতে ভিজে কিছুক্ষণ বৃষ্টিবিলাস করি একসাথে। পাশাপাশি পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটি কিছুক্ষণ। ঐ যে অদূরে দাঁড়ানো চায়ের দোকানটা দেখছো না? ঐখান থেকে নাহয় চা খেলাম দু’জনে।তারপর দু’জনার প্রেম হলে হলো,নাহলে নাই! কি? যাবে না-কি মেয়ে আমার সঙ্গে? ”
ইকরার কি হলো কে জানে! মেয়েটা কেমন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মাথা দোলালো অনিকের কথায়। অনিক চমৎকার হাসলো তা দেখে।সে নিজ উদ্যোগে সামনের দিকে একহাত বাড়িয়ে ইকরার উদ্দেশ্যে বলে,
“ তো চলুন মেডাম!”

ইকরা নতমুখে হাসলো কিছুটা। সে পা বাড়ায় সামনের দিকে। অনিকও মেয়েটার পাশাপাশি বৃষ্টির মধ্যেই প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে হাঁটছে।খানিকক্ষণ বৃষ্টিবিলাস করতেই ইকরার চোখেমুখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত দীপ্তী! যেখানে স্পষ্ট তৃপ্তির আভাস! অনিক চুপচাপ মেয়েটার ভেজা স্নিগ্ধ মুখটা পরোখ করছে। কি সুন্দর সেই মুখ! কতটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে সেথায়! অনিক হুট করেই ইকরার একহাত চেপে ধরে। ইকরা হকচকিয়ে ওঠে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অনিকের দিকে।অথচ অনিক একেবারেই ভাবলেশহীন! সে মেয়েটার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় চায়ের টংয়ে।সেখানে এসেই আগে অর্ডার দিলো দুকাপ উষ্ণ লাল চায়ের!

তারপর অনিক কিছু না বলে ইকরাকে দোকানের সামনে রেখে একটু দূরেই নিজের গাড়ির কাছে গেলো।পেছনে ইকরা এখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মেয়েটা বরাবরই বুঝতে চেষ্টা করছে অনিকের কর্মকাণ্ড। অনিক মিনিট খানেক বাদেই একপ্রকার দৌড়ে আসে। হাতে তার কালো ব্লেজার কোটটা। অনিক কোনরূপ কথাবার্তা ছাড়াই কোটটা ইকরার গায়ের ওপর ছড়িয়ে দেয়।এমন কান্ডে ইকরা নিজের সকল হতবাকতা কাটিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনিকের পানে।আচ্ছা মানুষটা কিভাবে বুঝলো তার ঠান্ডা লাগছিলো? না-কি এটা শুধুই সেন্স অফ হিউমার থেকেই করলো?
অনিক ইকরার গায়ে কোটটা পড়িয়ে দিয়ে মেয়েটার চোখের দিকে তাকায়। ইকরার গভীর চোখ তার পানেই নিবদ্ধ। অনিক বাঁকা হাসলো। ইকরার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো,

“ এভাবে দেখোনা মেয়ে! এভাবে দেখতে থাকলে যে তুমি আমার প্রেমে রীতিমতো পা পিছলে পড়বে!”
তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে ইকরা।যাহ! কেমন নির্লজ্জের মতো হা করে তাকিয়ে ছিলো সে? ধ্যাত, লোকটা না জানি কি ভাবলো! ইকরা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে চারপাশে। তা দেখে অনিক কেমন নিরেট কন্ঠে বলে ওঠে,
“ মনের কথা লুকিয়ে রাখতে পারলেও চোখের কথা কি আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব মেয়ে? শুধু শুধু কেনো এতো ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছো?”

ইকরার বুকটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে কিছুটা।এই ছেলেটাকে প্রথম দেখার পর থেকেই তার অবুঝ মনটা বড্ড বেপরোয়া আচরণ করছে তার সাথে। চোখ বন্ধ করলেই শুধু তার ছবিটাই কল্পনার মানসপটে ভেসে ওঠে আলো হয়ে।এ কেমন অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার! আচ্ছা সে কি প্রেমেটেমে পড়ে গেলো না-কি? না…না… কি ভাবছে সে।তাদের পরিবারের যে বিশাল দ্বন্দ্ব একে-অপরের সাথে। এমন পরিস্থিতিতে তার ওমন উটকো অনুভুতি বরাবরই কাল বয়ে আনবে। ইকরা নিজের ভাবনায় এতোটাই নিমগ্ন — যে কখন তার সামনে অনিক চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই খবরই নেই মেয়েটার। অনিক মেয়েটার ভাবুক মুখটা দেখে ভ্রু কুঁচকায়।খানিকটা জোর গলায় ইকরাকে ডাক দেয়,

“ ইকরা?”
হঠাৎ ডাকে কিছুটা হকচকিয়ে ওঠে ইকরা।অনিকের দিকে তাকাতেই অনিক চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয় তার দিকে।ইকরা স্মিত হেসে চা-টা নিয়ে নেয়। অনিক এবার কেমন সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“ কি হয়েছে তোমার? এতো মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছিলে?”
ইকরা মাত্রই একটা চুমুক দিতে যাচ্ছিলো চায়ের কাপটায়।কিন্তু অনিকের এমন কথায় আর চুমুক দেওয়া হলো না তার।সে চা-টা ঠোঁট হতে সরিয়ে হালকা হেসে বলে,
“ তেমন কিছুই না!”
“ সত্যি?”
“ আপনার মিথ্যা মনে হচ্ছে কেন?”
এপর্যায়ে অনিকের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো।সে মেয়েটার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো,
“ তোমার চোখ বলছে তুমি মিথ্যা বলছো!”

ইকরা থমকালো। চোরের মতো নিজের দৃষ্টি লুকাতে তৎপর হলো মেয়েটা।অনিক এবার হাত চেপে ধরে মেয়েটার।তারপর তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইকরাকে টেনে নিয়ে নিজের গাড়িতে বসালো। এরইমধ্যে ইকরা বেশ কয়েকবার বলেছেও— কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? গাড়িতে কেনো বসালেন? কি হয়েছে?
অথচ এতো এতো কথার কোনোটাই কানে তুললোনা অনিক।সে মেয়েটাকে একপাশে বসিয়ে দিয়ে নিজে বসে পড়লো ড্রাইভিং সিটে।তারপর কোনরূপ কালবিলম্ব না করে ইকরার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“ তুমি কি আমার বউ হবে মেয়ে? আমার হবু বাচ্চাদের মা হবে? কথা দিচ্ছি পৃথিবীর সকল সুখ এনে ভরিয়ে দেবো তোমাতে।সারাজীবন আগলে রাখবো তোমায়।কোনোদিনও তোমার প্রতি নিজের ভালোবাসার কমতি আসতে দিবোনা! দেখো মেয়ে, তোমার সঙ্গে শুধু প্রেম নয়।আজীবন কাটানোর ইচ্ছে আমার!তোমার মুখ দেখে প্রতিটা রাত যেমন পার করার ইচ্ছে, তেমনি প্রতিটা সকাল শুরু করার ইচ্ছে,বলো,হবে কি আমার বউ?”

অনিকের এক নিশ্বাসে বলা কথাগুলো শুনে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো ইকরা।হয়তো ভাবছে — এ মুহুর্তে তার ঠিক কেমন রিয়েক্ট করা উচিত? একটা মানুষ ঘন্টা খানেক আগে বললো প্রেম করবে আর এখন দেখো — কেমন ডিরেক্ট বিয়ে করার প্রস্তাব দিচ্ছে তাকে!
এদিকে ইকরাকে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে বুকটা কাপছে অনিকের। ভাবছে, — মেয়েটা এমন চুপ করে আছে কেনো? সে কি তাকে পছন্দ করেনা? ওর জীবনে কি অন্য কেও আছে? ও কি অন্যকাউকে ভালোবাসে?
অনিক নিজের মনে উত্থাপিত কথাটা মুখে নিয়ে আসলো।ইকরার দিকে সন্দিষ্ট চোখে তাকিয়ে বললো,
“ তুমি কি অন্য কাওকে ভালোভাসো মেয়ে?”

ইকরা তক্ষুনি ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না জানায়। পরপর ব্যস্ত গলায় বলে ওঠে,
“ এই না, না.. এমনটা কিছুই না।”
মনমতো উত্তর পেয়ে রাজ্য জয়ের হাসি দিলো অনিক। ছেলেটা গালভর্তি হাসি টেনে গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে বসলো।চোখ বন্ধ করে বললো,
“ দ্যান কংগ্রাচুলেশনস মেডাম! খুব শীঘ্রই আপনি ইশতিয়াক এহসান অনিকের বউ হচ্ছেন!”
ভড়কায় ইকরা।মেয়েটার চোখদুটো কেমন বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। সে হতবাক হয়ে বলতে লাগলো,
“ মানে? আমি কখন এক্সেপ্ট করলাম আপনার প্রপোজাল? যেখানে এখনও এক্সেপ্টই করলাম না সেখানে বউ হওয়া….”

ইকরার কথার মাঝেই অনিক চোখদুটো মেলে তার দিকে তাকায়। ইকরার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
“ আপনার এক্সেপ্ট করার আশায় তো আমি বসে থাকবো না বউপাখি! আমি যেহেতু বলে দিয়েছি আপনি আমার বউ হচ্ছেন,তার মানে এটাই ফাইনাল! আর তাছাড়া, আমি কিন্তু মোটেও আপনার অনুমতি চাইনি, আমিতো আপনাকে জানিয়েছি মাত্র!”
“ কিন্তু আপনি যেটা চাচ্ছেন সেটা দু-পরিবারের জন্য বরাবরই কাল বয়ে আনবে!”
অনিক মৃদু হাসলো মেয়েটার কথায়।ইকরার প্রায় অনেকটা কাছে এসে নরম কন্ঠে বললো,
“ ওসব নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না বউপাখি।তুমি বরং আমায় নিয়ে ভাবো কেমন?”
খানিকটা লজ্জা পেলো ইকরা।মেয়েটা তৎক্ষনাৎ মুখটা নামিয়ে নিলো নিজের। অনিকের তখন কি হলো কে জানে! সে গভীর আবেশে মেয়েটার কপাল বরাবর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো নিজের। এহেন স্পর্শে কেঁপে ওঠে ইকরা।সে সঙ্গে সঙ্গে চেপে ধরে অনিকের শার্টের কলার।অনিক বেশ সময় নিয়ে ইকরার কপাল থেকে ঠোঁট সরায়। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,

“ ভালোবাসি!”
ইকরা মুগ্ধ হাসলো। লাজুক চোখগুলো তুলে আর চাইতে পারলোনা অনিকের দিকে। অনিক মৃদু হেসে আরেকটু এগোবে তখনি তার ফোনটা কর্কশ শব্দে বেজে ওঠে। অনিক তক্ষুনি বিরক্তি নিয়ে মুখটা কুঁচকে ফেলে।ইকরার কাছ থেকে সরে এসে কপালে দু-তিনেক ভাজ ফেলে ফোনটা চেক না করেই কানে তুলে।ঝাঁঝালো গলায় বলে,
— “ হ্যালো কে?”
— “ তোর দুলাভাই!”
হকচকিয়ে ওঠে অনিক।তৎক্ষনাৎ ফোনটা সামনে ধরতেই দাঁতে জিভ কাটে ছেলেটা।ফোনটা ফের কানে ঠেকিয়ে বোকার মতো হাসি দিয়ে বলে,
“ রোদ ভাই তুমি! আসলে…”

অরিন ঢাবির কলা ভবনের সামনে এসে বসে আছে প্রায় আধঘন্টা হতে চললো।বৃষ্টিটা এবার বুঝি খানিকটা থামলো।ইদানিং ক্লাস করতেও মেয়েটার কেমন যেন অনিহা ধরে এসেছে। অথচ তার ডাক্তার সাহেব তাকে বারবার করে বলে গিয়েছিলো — সে যেন তার অবর্তমানে মোটেও ভেঙে না পরে।অথচ মেয়েটাকে দেখো! সে কেমন মূর্ছা গেছে রৌদ্রের অবর্তমানে। মুখের সেই জৌলুশটা কেমন যেন মলিন হয়ে এসেছে তার। চোখের নিচে পড়েছে রাতভর জেগে থাকার প্রমাণ — ডার্ক সার্কেল। অরিন ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে রৌদ্রের একটা ছবি ওপেন করে। ছবিটাকে জুম করে ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। এটা যে এখন নিত্যদিনকার কার্যকলাপ তার। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর অরিনের ফোনে কল আসে অনিকের।অরিন ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে তখন অনিক বলে ওঠে,

“ বনু! তারাতাড়ি বাইরে আয়।আমি দাঁড়িয়ে আছি!”
“ ঠিক আছে!” — অরিন ছোটো করে উত্তর দিলো। তারপর ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে, ব্যাগটা কাঁধে তুলে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে লাগলো বাইরের দিকে।
অরিন ভার্সিটির গেট ছেড়ে বেরোতেই অনিকের দেখা মিললো। অনিক আলতো হেসে বোনের কাছে আসে।অরিনের কাঁধ হতে ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“ ক্লাস কেমন গেলো?”
অরিন মাথা দুলিয়ে কোনমতে বললো,
“ ভালো!”

অনিক বোনের মলিন হওয়া মুখটার দিকে চাইলো।পরক্ষণেই বুক চিড়ে এক দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। অনিক বোনের হাত ধরে তাকে গাড়িতে নিয়ে বসায়। তারপর নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে বলে ওঠে,
“ বনু! আমার একটু হসপিটালে যেতে হবে। রোদ ভাইয়ের কি যেন ইম্পর্ট্যান্ট একটা ডকুমেন্টস লাগবে বললো সে জন্যই আরকি! এখন তুই কি আমার সঙ্গে যাবি?”
অরিন বাইরে দৃষ্টি রেখে জবাব দেয়,
“ হুম যাবো!”
অনিকও আর তেমন কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দেয়।যাওয়ার পথে অবশ্য সে অরিনের সঙ্গে নিজ থেকেই এটাসেটা বলেছে, অরিনও ভাইয়ের কথায় শুধু হু,হা -তেই নিজের উত্তর সীমাবদ্ধ রেখেছে।

প্রায় আধঘন্টা পর অনিকের গাড়ি এসে থামলো হসপিটালের সামনে।অনিক গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অরিনের দিকের দরজাটা খুলে দেয়। অরিনকে নামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“ বনু! তুই ভাইয়ার কেবিনে গিয়ে বস আমি গাড়িটা পার্ক করেই আসছি।”
“ কিন্তু তার কেবিন কি খোলা থাকবে?”
“ হুম, ভাইয়া ওয়ার্ড বয়কে বলে লক খুলে রেখেছে।”
অগত্যা এমন কথায় অরিন আর কিছু না বলে চলে যায় হসপিটালের ভেতরে।অনিকও বোনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে মুচকি হেসে গাড়ি নিয়ে যায় পার্কিং এরিয়ায়।
অরিন ধীর পায়ে রৌদ্রের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজার গায়ের ওপর বসে থাকা নেম প্লেটটার গায়ে আলতো করে হাত ছোঁয়ায় মেয়েটা। তারপর ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে অরিন। ভেতরে ঢুকতেই মেয়েটার চোখ ছানাবড়া হয়ে আসার উপক্রম। তার অবাক কন্ঠ ফুঁড়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে আসে,

“ আপনি?”
রৌদ্র অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। চোখদুটোতে একপাশে ক্লান্তি অন্যপাশে মেয়েটাকে এতোদিন পর দেখতে পাবার প্রশান্তি! রৌদ্র আর কিছু না বলে চট করে এসে জড়িয়ে ধরে অরিনকে।মেয়েটার ছোট্ট কোমল দেহখানা একেবারে টেনে আনে নিজের বাহুডোরে। এদিকে অরিন এখনও হতবিহ্বল! মেয়েটা বুঝি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা — তার ডাক্তার সাহেব সত্যি তার সামনে, তাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। অরিন তার কাঁপা কাঁপা হাতদুটো ধীরে ধীরে রৌদ্রের পিঠের ওপর রাখে।থেমে থেমে বলে,
“ ডাক্তার সাহেব! এটা সত্যি আপনি?”
রৌদ্র মেয়েটাকে আরেকটু চেপে ধরে নিজের বুকের সঙ্গে। অরিনের পিঠে শক্ত করে চেপে ধরে ধরে আসা গলায় বলতে থাকে,

“ হুম আমি সানশাইন! আমি…তোর ডাক্তার সাহেব!”
অরিনের তখন কি হলো কে জানে! মেয়েটা তক্ষুনি ছেলেটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। রৌদ্র ভড়কে যায় অরিনের কান্নায়।সে তৎক্ষনাৎ মেয়েটাকে বুক থেকে ছাড়িয়ে মেয়েটার মুখখানা নিজের খসখসে দু’হাতের আজলায় নিয়ে নেয়।বিচলিত কন্ঠে বলতে থাকে,
“ হেই…আমার জানবাচ্চা! হুঁশ.. কাঁদেনা বউজান! এইতো আমি চলে এসেছি তো… এই বউজান… তাকা আমার দিকে..”

অরিনের কান্না বাড়লো বৈ কমলো না। সে বুক ভাসিয়ে কাঁদছে। এতোদিন পর মানুষটার বিরহের অনলে জ্বলে পুড়ে মরেছে মেয়েটা,এখন তো মিলনে খানিকটা অশ্রু ঝরবেই! এদিকে তার এহেন কান্নায় দিশেহারা অবস্থা রৌদ্রের।ছেলেটার আবার এই এক জ্বালা! মেয়েটার কান্না দেখলে তার বুঝি নিজেকেই কেমন পাগল পাগল লাগে। এই যেমন এখন লাগছে…

রৌদ্র একের পর এক কথা বলে মেয়েটার কান্না থামাবার প্রয়াস চালাচ্ছে, অথচ অরিনটার কান্না বুঝি আজ আর থামবার নয়।একপর্যায়ে রৌদ্র অধৈর্য্য হলো।এমনিতেই মেয়েটার ফোলা ফোলা রক্তিম গালদুটোর ওপর বড্ড লোভ তার, তারওপর এখন কেমন টমেটোর মতো লাল টুকটুকে হয়ে গেছে পুরো মুখটা।
রৌদ্রের গলায় শুষ্কতা নেমে আসে মেয়েটার এই রূপ দেখে।সে ক্ষনে ক্ষনে শুষ্ক ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়।কিন্তু লাভের লাভ কিছু হলে তো! অরিনটার নাক টেনে কাঁদার শব্দে মাথা বুঝি হ্যাং হয়ে গেলো বেচারার।সে তৎক্ষনাৎ আলতো করে অরিনের হিজাবের ওপর দিয়ে চুলগুলো চেপে ধরে। মেয়েটার মুখটা নিজের একদম কাছে এনে হাস্কি স্বরে বলতে থাকে,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৩৮+৩৯

“ কান্না থামা বেইব! নাহলে আমি এখন কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো!”
অরিনের কান্নাগুলো বুঝি দৌড়ে পালালো কোথাও। তার চোখেমুখে এখন কেমন হতবাকতা লেপ্টে আছে। মেয়েটার ভেজা পল্লবিত আখিঁদ্বয় রৌদ্রের দিকেই তাক করা। তার তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠপুট বড্ড টানছে রৌদ্রকে। রৌদ্র খেই হারায় নিজের। অরিনের মুখটা নিজের ওষ্ঠপুটের কাছে এনে বলে ওঠে,
“ ড্যাম! ফা*ক অফ উইথ দেট ফা*কিং কন্ট্রোল! ”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৪১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here