সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৭
Jannatul Firdaus Mithila
“অনিক!!”
বাবার এহেন বজ্রকন্ঠে খানিকটা কেঁপে ওঠে বেচারা অনিক।ছেলেটা গালের এককোণে খাবার নিয়ে আহাম্মকের মতো বসে আছে।হতবিহ্বলতায় খাবারটা যেন চিবুতেও ভুলে গেছে বেচারা।হুট করে তার রোদ ভাই যে তার ওপর দিয়ে এমন একটা ঝড় পাঠাবে তা হয়তো ঘুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি সে। অনিক গালের কোণে ঠেসে রাখা খাবারটা পানি দিয়ে গিলে নিলো।এ মুহুর্তে বেচারার যা অবস্থা, তাতে ধীরেসুস্থে খাবার গিলবার প্রশ্নই ওঠে না! অনিক খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলানোর প্রয়াস চালায়। এরইমধ্যে সাব্বির সাহেব আরেকদফা গর্জন তুলে বলেন,
“ এই ছেলে এই…নিজেকে কি মনে করো তুমি হ্যা? কতবড় সাহস তোমার… আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছো অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করলে না!”
এহেন কথায় রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায়।অরিনকে নিজের সঙ্গে আগের ন্যায় দাঁড় করিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,
“ বুঝলাম না! তুমি একচুয়েলি এতো রিয়েক্ট করছো কি নিয়ে?তোমাকে বিয়ের ব্যাপারটা জানানো হয়নি এজন্য? না-কি আমাকেই মেয়ের জামাই হিসেবে পছন্দ হয়নি তোমার? কোনটা?”
অগত্যা এমন কথায় খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেন সাব্বির সাহেব। মানুষটা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে আমতা আমতা করতে লাগলেন। হয়তো কথা গুছিয়ে উঠতে পারছেননা তিনি। অনিক এবার বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ সরি আব্বু! এতবড় একটা বিষয় তোমাকে জানাইনি এটা নিশ্চয়ই আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো তো,তোমাকে কিংবা বাড়ির অন্য কাওকে এ বিষয়ে জানালে তোমরা কি ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখতে? অথবা হতে দিতে এই বিয়েটা? তাছাড়া ঐসময় আমার বনুর ভালোর জন্য যেটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়েছে, আমি সেটাই করেছি! এ নিয়ে যদি আমায় শাস্তি দিতে চাও তাহলে ফাইন…দাও।কিন্তু তবুও আমি বলবো — এই কাজটা করে আমি মোটেও দুঃখীত নই।”
ছেলের এমন সোজাসাপটা কথার পিঠে বলার মতো আর কোনো শক্ত বাক্য খুঁজে পেলেন না সাব্বির সাহেব। তিনি গম্ভীর মুখে ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। এদিকে, কেয়া বেগম রাগে-অপমানে ফুঁসছেন রীতিমতো। তার সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় এই প্রথম এতোটা অপমানিত হলেন তিনি।তাও আবার সে-ই ছেলের দ্বারা অপমানিত হলেন যাকে কি-না তিনি এতোগুলো বছর নিজের ছেলের মতো দেখে এসেছেন। কেয়া বেগম একবার অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকালেন জুবাইদা বেগমের দিকে।জুবাইদা বেগম খানিকটা ভড়কে গেলেন এহেন দৃষ্টি দেখে।মানুষটা তো নিজেও হতবাক হয়ে গিয়েছেন ছেলের ওমন কথাবার্তা শুনে।তিনি হয়তো স্বপ্নেও আন্দাজ করতে পারেননি ব্যাপারটা! কেয়া বেগম রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। জুবাইদা বেগমের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে যেইই না কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রৌদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“ চোখ নিচে নামাও মামনী! আমার মায়ের দিকে এভাবে তাকানোর অধিকার কারোর নেই!”
এমন কথায় কেয়া বেগম যেন ফুঁসে ওঠলো আরেকটু। তিনি এবার গজগজ করতে করতে বলে ওঠেন,
“ ছিহঃ ছিহঃ রোদ! তোর কাছ থেকে অন্তত এসব আশা করিনি আমি।শেষপর্যন্ত তুই কি-না নিজের হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করলি?”
এরুপ কথায় মুহুর্তেই রৌদ্রের মুখের আদলে পরিবর্তন ঘটলো। ছেলেটার দৃঢ় চোয়ালখানা ফুটে ওঠলো শক্ত হয়ে। সে আগুন চোখে তাকায় কেয়া বেগমের দিকে।কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,
“ আমি হাঁটুর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করি,না-কি মাথার বয়সী… তাতে আপনার কি? যেখানে আমার বউজানকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না,সেখানে আপনার এতো ইচিং হচ্ছে কেনো? আপনি জাস্ট নিজের মেয়ের কথা ভাবুন।আমার বউজানকে নিয়ে ভাবার জন্য আমি রোদ এখনো বেঁচে আছি!”
কেয়া বেগম থামলেন না।রাগে বুঝি জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন মানুষটা।হামিদ সাহেব স্ত্রীর মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে তৎক্ষনাৎ বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।মেয়ের হাত ধরে তাকেও নিজের সঙ্গে দাঁড় করালেন। অতঃপর সকলের উদ্দেশ্যে মাথানিচু করে বলতে লাগলেন,
“ ক্ষমা করবেন! আসলে… আমরা জানতাম না এতোকিছু….জানলে অবশ্যই এমন উদ্ভট আচরণ করতাম না।এজন্য আমরা সত্যি দুঃখীত!”
লোকটার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই সাব্বির সাহেব দ্রুত উঠে এলেন তার কাছে। হামিদ সাহেবের কাঁধে হাত রেখে অপরাধী সুরে বললেন,
“ নাহ ভাই!দোষটা শুধু আপনাদের না,আমাদেরও! আসলে দেখলেন-ই তো, আমরা নিজেরাও জানতাম না ওরা বিয়ে করে নিয়েছে।জানলে হয়তো…. ”
বাকিটা আর বলা হলো না সাব্বির সাহেবের।এর আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে হামিদ সাহেব বলতে লাগলেন,
“ সমস্যা নাই ভাই।আমি বুঝেছি!”
সাব্বির সাহেব জোরপূর্বক হাসি টানলেন ঠোঁটের কোণে। অতঃপর আড়চোখে শক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে।অনিক সে-ই দৃষ্টি দেখেও ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে বসে রইলো নিজ আসনে।বাব্বাহ! ছেলেটার বুঝি আজ সাহস বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। ওদিকে, এতক্ষণ যাবত নিরব দর্শকের ভুমিকায় ছিলেন তায়েফ সাহেব এবং তাশরিক সাহেব। কিয়তক্ষন বাদে তায়েফ সাহেব হালকা হেসে ওঠে এলেন রৌদ্রের কাছে।ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে হালকা বাহবা দেওয়ার সুরে বললেন,
“ এই নাহলে বাপের ব্যাটা! সাব্বাশ!”
এটুকু বলেই তিনি রাফিয়া বেগমের দিকে দৃষ্টি তাক করলেন। অতপর ভাবির কাছে বায়না করে বলতে লাগলেন,
“ বউমনি! আজকে তোমার হাতের স্পেশাল মিষ্টিটা একটু বানিও তো! এতোবড় একটা সুখবর, সেকি আর মিষ্টিমুখ ছাড়া জমে বলো? আমি নাহয় ফেরার পথে আরও কিছু মিষ্টি নিয়ে আসবো।”
বলেই তায়েফ সাহেব তৎক্ষনাৎ প্রস্থান ঘটালেন ডাইনিং থেকে।অন্যদিকে,দেবরের এমন কথায় রাফিয়া বেগম কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া ছাড়া গম্ভীর মুখে বসে রইলেন।
তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনো পাশাপাশি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রৌদ্র আর অরিনের ওপর নিবদ্ধ। কিছুক্ষণ পর তাশরিক সাহেব জোরালো কদমে এগিয়ে আসেন রৌদ্রের কাছে। এসেই কেমন অভিমান ভরা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ একটু জানালে কি এমন হতো রে বাপ?এটলিস্ট তোর বিয়ের মিষ্টিটা তো খেতে পারতাম?ধূর!ধূর! কিচ্ছু হলো না!”
মানুষটার এমন কথা বলার ভঙ্গিতে না চাইতেও মুচকি হাসলো রৌদ্র। ছেলেটা খানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“ কে বললো হলো না? তুমি কতগুলো মিষ্টি খাবে শুধু একবার বলো! দরকার হয় পুরো মিষ্টির দোকানটাই এনে দিবো তোমায়!”
তাশরিক সাহেব গালভরে হাসলেন এবার। তিনি রৌদ্রের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“ সুখে থাক ব্যাটা!তোর সকল মনের ইচ্ছেগুলো পূরণ হোক!”
রৌদ্র হাসলো একটুখানি।তাশরিক সাহেব চলে গেলেন সেখান থেকে। সাব্বির সাহেবও আর দাঁড়িয়ে না থেকে পা বাড়ালেন চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মানুষটা গম্ভীর হয়ে কোমরের পিঠে হাতে হাত রেখে যে-ই না একপা বাড়িয়েছে ওমনি তার পাদু’টো থমকে যায় কেয়া বেগমের কর্কশ কথায়!
“ বাড়ির ভেতর এমন ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে রাখলে আরও কতকিছু হবে!এখন তো শুধু শুনলাম লুকিয়ে বিয়ে করেছে, না জানি লুকিয়ে লুকিয়ে আরও কতকি….”
বাকিটা আর শেষ করতে পারলেন না কেয়া বেগম। তার আগেই তার দিকে রণমূর্তি রূপ ধারণ করে এগিয়ে আসে রৌদ্র।মানুষটার মুখের সামনে আঙুল উঁচিয়ে হিংস্র কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ খবরদার! আমার বউকে নিয়ে আরেকটা বাজে কথা ঐ জিহ্বায় আনলে,খোদার কসম — আমি ঐ জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলবো। আমি ভুলে যাবো আপনার মতো থার্ড ক্লাস মাইন্ডের মানুষ আমার পরিচিত।”
অগত্যা এমন কথায় থমকে গেলো সকলে।কেয়া বেগম রৌদ্রের এমন হিংস্র গর্জনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। শিশিরটা ভয়ে কুঁকড়ে গেলো বাবার সঙ্গে। এমনিতেই ঐদিন রৌদ্রের হাতের মা’র খেয়ে কয়েকদিন দেদারসে অসুস্থতায় ভুগেছে মেয়েটা।তারপর থেকেই রৌদ্রের এহেন শক্ত বাক্য শুনলেই বুক কাপেঁ তার!এদিকে,রাফিয়া বেগমসহ বাকিরাও উঠে পড়লেন বসা ছেড়ে। জুবাইদা বেগম একরাশ ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে নিজের ভাবির দিকে।এমন একটা বাজে কথা কিভাবে বললেন তিনি? এখন তো তাকে নিজের আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে জুবাইদা বেগমেরই লজ্জায় মাথাকাটা যাচ্ছে!রাফিয়া বেগম শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।শত হলেও,তিনি তো মা! নিজের সন্তানের ব্যাপারে এরূপ বাজে কথা কি আর সহজে সহ্য হয়?
অন্যদিকে, সাব্বির সাহেব কেয়া বেগমের প্রথম কথায় যতটাই না রেগে গিয়েছিলেন, পরক্ষণেই ঠিক ততটাই শান্ত হলেন রৌদ্রের ওমন কথা শুনে। মানুষটা মনে মনে ভিষণ গর্ববোধ করলেন রৌদ্রকে নিয়ে। কিছুক্ষণ বাদেই হামিদ সাহেব তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন স্ত্রীর কাছে।স্ত্রীকে নিজের আড়ালে দাড়ঁ করিয়ে তিনি বলতে লাগলেন,
“ এভাবে বলতে হয়না রোদ! শত হলেও তিনি তোমার মামণি!”
রৌদ্র এবার শ্লেষাত্মক হাসলো।হাত বাড়িয়ে নিজের ঘাড়ে ম্যাসাজ করতে করতে বললো,
“ আমার বউকে বাজে কথা বলা মানুষের সঙ্গে এরচেয়ে সুন্দর বিহেভ করা আমার দ্বারা সম্ভব না মামা! আপনি দয়া করে উনাকে বোঝান।আজকে একবার বলেছে, কিন্তু দ্বিতীয়বার যেন এই কথা স্বপ্নেও না ভাবে।কেননা আমি রৌদ্র এতোটাও ভদ্র ছেলে নই — যে কি-না নিজের বউজানের অপমান সহ্য করে কাপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে।”
হামিদ সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রৌদ্রের দিকে। যদিও এমুহূর্তে রৌদ্র একেবারেই সঠিক, তবুও তিনি নিজের বউয়ের পক্ষেই রইলেন। তিনি গম্ভীর মুখে নিজের স্ত্রীর হাত ধরে ডাইনিং থেকে সরে গেলেন আলগোছে। অতঃপর স্ত্রীকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসেই বললেন,
“ রেডি হও! চলে যাবো আমরা।”
রৌদ্র নিজের মুখভঙ্গি যথেষ্ট শক্ত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তার একহাত এখনো অরিনের কোমর চেপে তাকে আগলে রেখেছে।কিয়তক্ষন বাদেই, ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে আসে হামিদ সাহেবের দৃঢ় কন্ঠ!
“ শিশির! তারাতাড়ি এসো।আমরা রওনা হবো।”
বাবার কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই শিশির ধীর পায়ে ডাইনিং থেকে বের হবার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। যেতে যেতেই সে শক্ত চোখে তাকায় অরিনের দিকে।অরিন শিশিরের ওমন দৃষ্টি দেখে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নেয় রৌদ্রের সঙ্গে। রৌদ্র খেয়াল করলো বিষয়টা।পরক্ষণেই সে শিশিরের উদ্দেশ্যে শক্ত গলায় বলতে থাকে,
“ এই.. তুই চোখ নিচে নামা!আমি জানি, আমার বউজান ভিষণ সুন্দর কিন্তু তাই বলে তুই ওকে এভাবে চোখ দিয়েই গিলে খাবি না-কি? তোর মতো মানুষ, আমার বউজানের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে ওর গায়ে নজর লাগবে।সো কিপ ইউর আইস ডাউন! আদারওয়াইজ, বিশ্বাস কর — তোর ঐ চোখদুটো আমি এক্ষুণি উঠিয়ে ফেলবো।”
এমন কথায় রৌদ্রের দিকে ছলছল চোখে তাকায় শিশির। মেয়েটা হয়তো কিছু বলতে চাইলো,কিন্তু পারলোনা কেন যেন! হয়তো গলা ধরে এসেছে তার।শিশিরের ছলছল চোখজোড়ায় স্পষ্ট হারানোর শোক। যেই হারানো জিনিসটা তার কভু ছিলোই না!সে-তো এতদিন এক মরিচিকার পেছনে ছুটছে মাত্র। তার মস্তিষ্ক তাকে ক্ষনে ক্ষনে সর্তক করলেও, তার অবচেতন মনটা যেন তা মানতে নারাজ ছিলো।বারেবারেই সে ভেবেছিলাে — এবার হয়তো রোদ তার ভালোবাসাটা একটু হলেও বুঝবে। কিন্তু তা কি আর হলো? রৌদ্র যে সে-ই শুরু থেকেই তার বউজানের মায়ায় নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে। যেই মায়ার অদৃশ্য বাঁধন থেকে আমরন বেরোবে না ছেলেটা!
শিশিরের চোখফেঁটে অশ্রু ঝড়ছে।মেয়েটা ড্রয়িংএ আসতেই খানিকটা হেলেদুলে পড়তে নিলে, হামিদ সাহেব এসে তৎক্ষনাৎ মেয়েকে নিজের সঙ্গে আগলে নেন।মেয়েটাকে নিজের বাহুডোরে শক্ত করে চেপে ধরে এগিয়ে যান বাইরের দিকে। এমুহূর্তে হামিদ সাহেবের বুকটা বুঝি চিৎকার দিয়ে কাঁদছে মেয়ের জন্য। হতেই পারে তার মেয়ে ইতোমধ্যেই রৌদ্রের জন্য নাছোড়বান্দা আচরণ করেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু একটা বিষয় তো তিনি কখনোই অবহেলা করতে পারেন না।সেটা হলো রৌদ্রের প্রতি তার মেয়ের তীব্র ভালোবাসা। যেটা কি-না আজকে থেকে নয়,সে-ই ছোট বেলা থেকে।বাবা হিসেবে কি করে নিজের এই কষ্টটাকে লাঘব করবেন তিনি?
হামিদ সাহেব মেয়েকে ধীরেসুস্থে গাড়িতে বসালেন। মেয়ের একপাশে বসলেন কেয়া বেগম অন্যপাশে হামিদ সাহেব। অতঃপর গাড়ি চলতে শুরু করলো।গাড়িটা কিছুটা পথ পেরুতেই হঠাৎ করেই চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে শিশির।হামিদ সাহেব মোটেও চমকালেন না।তিনি আলগোছে মেয়েকে নিজের বুকে চেপে ধরলেন।অতঃপর মেয়ের প্রতিটি চিৎকারে নিঃশব্দে চোখের অশ্রু ফেলতে লাগলেন। অন্যদিকে কেয়া বেগম একেবারেই নিশ্চুপ! মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছেন না কেন যেন।তার চোখদুটো গাড়ির জানালার কাচঁ গলিয়ে বাইরের দিকে নিবদ্ধ। আশ্চর্য! মানুষটা নির্বিকার ভাবে বসে থাকলেও তার চোখ বেয়ে কেন যেন টুপ টুপ করে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা! হয়তো মেয়ের এহেন করুণ অবস্থায় নিজেকে সর্বাত্মক শক্ত রাখার প্রয়াস চালাচ্ছেন তিনি।কিন্তু বেইমান চোখদুটো সে কথা মানলে তো! তারা কেমন নিজ উদ্যোগে গড়িয়ে পড়ছে আপনমনে।
শিশির বুক ফাটিয়ে কাঁদছে। ভাব এমন — মেয়েটা বুঝি শেষবারের মতো রৌদ্রকে মনে করে নিজের অব্যক্ত অনুরাগ গুলো বের করছে আপন ধারায়। এই পৃথিবীতে একতরফা ভালোবাসা যে একটা অভিশাপ, এই ছোট্ট কথাটা কেনো বুঝলোনা মেয়েটা? কেনো যেচে পড়ে এতোবড় অভিশাপে নিজেকে লেপ্টে নিলো সযত্নে? রৌদ্র তো কোনোদিনও তার ছিলো না,তবুও কেনো পরের জিনিসের প্রতি এতোটা লোভ জন্মালো তার? কেনো নিজেকে এভাবে আত্মসম্মানহীন বানিয়ে ফেললো মেয়েটা?
সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমেছে! এহসান বাড়ির তিনভাই প্রায় আধঘন্টা আগে এসে পৌঁছেছে হাসপাতালে। এসেছে পর থেকেই কবির সাহেবের কেবিনে (সাধারণ)বসে চারজনের সেকি আড্ডা! বহুদিন পর বড়ভাইকে এরম সুস্থ পেলো কি-না! তাই বুঝি বাকিদের অবস্থা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। সাব্বির সাহেব তো মাঝেমধ্যেই কথা বলার ফাঁকে চুপচাপ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন বড়ভাইয়ের মুখের দিকে। এ-কদিনের পরিপূর্ণ যত্নে কবির সাহেবের মুখটা কেমন জৌলুশ ফিরে পেয়েছে যেন।এইতো এখন বাড়িতে নিয়ে গেলে বোধহয় ষোলকলা পূর্ণ হবে! কবির সাহেব ধীর কন্ঠে কথা বলছেন ভাইদের সঙ্গে। এখন অবশ্য টুকটাক ভালোই কথাবার্তা বলতে পারেন তিনি। তাছাড়া মানুষটা যা শক্ত প্রকৃতির! তিনি সুস্থ নাহলে কে হবে শুনি?
কবির সাহেবদের কথার মাঝপথেই রৌদ্র এসে হাজির হলো কেবিনে।তার সঙ্গে এসেছে আরও দুজন নার্স। রৌদ্র ইশারায় নার্সদের কি যেন একটা করতে বললো,ওমনি নার্স দু’জন হালকা মাথা নাড়িয়ে কাজে লেগে পড়লো।একজন গিয়ে কবির সাহেবের প্রেসার,হার্টবিট, জ্বর ইত্যাদি চেক করতে লাগলো।অন্যজন রোগীর কাটা জায়গার ড্রেসিং পরিদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।নার্সটি কবির সাহেবের বুকের কাছের ড্রেসিংটা আলতো হাতে খুলে নিলো।পরক্ষণেই রৌদ্র এগিয়ে এসে চেক করলো — বুকের কাছের সেলাইয়ের জায়গাটা ফোলা কিংবা ইনফেকশন হয়েছে কি-না। রৌদ্র সর্তক চোখে একবার পরোখ করে দেখলো পুরো ক্ষতস্থানটা। নাহ…আলহামদুলিল্লাহ তেমন কোনো সমস্যা নেই। তাই রৌদ্র নার্সকে গম্ভীর মুখে বললো,
“ নতুন করে ড্রেসিং করে দিন।”
নার্সও বাধ্যদের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে কাজে লেগে পড়লো।অতঃপর ধীরেসুস্থে কবির সাহেবের ক্ষতস্থানে নতুন করে ড্রেসিং করে দিতে লাগলো।রৌদ্র এবার বাবার রিপোর্টটা চেক করতে শুরু করে। সেথায় স্পষ্ট গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে তারই দেওয়া ঔষধের নাম,ডায়েট চার্ট এমনকি ফলোআপের তারিখ! রৌদ্র রিপোর্টটায় চোখ বুলানো শেষে, বাবার দিকে তাকায় সরু চোখে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“ তোমার কোথাও কষ্ট হচ্ছে?”
কবির সাহেব ডানে-বামে মাথা নাড়ালেন।রৌদ্র ফের জিজ্ঞেস করে,
“ কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে?”
কবির সাহেব এবারেও মাথা নাড়িয়ে না বললেন।রৌদ্র থামলো এবার। বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো আলগোছে। অতঃপর ক্ষুদ্র এক নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
“ দ্যান, ইউ আর অল সেট টু গো হোম নাউ!”
সদ্য গোসল সেরে একটা ঘিয়ে রঙের মোটা পাড়ের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন জুবাইদা বেগম। স্বামীর পছন্দসই খাবার-দাবার রেঁধে মাত্রই ফ্রী হলেন তিনি।এবার শুধু রোদের বাবার আসার পালা। জুবাইদা বেগম তোয়ালে হাতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসলেন। মাথার ভেজা চুলগুলো আলতো করে তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবতে লাগলেন স্বামীর কথা।সে-ই কবে থেকে মানুষটাকে দুচোখ ভরে দেখতে পারেননি তিনি!
স্বামীর কথা ভাবতে ভাবতেই চোখদুটোতে অশ্রু এসে ভীর জমালো তার।জুবাইদা বেগম ভেজা চোখে হাসলেন একটুখানি। অতঃপর গায়ের শাড়িটাকে আরেকটু টেনেটুনে ছুট লাগালেন ঘরের বাইরে। এদিকে, রাফিয়া বেগম মনমরা হয়ে কাজ করছেন। কি নিয়ে মানুষটার মনে এতো দুঃখ, তা যেন বোঝা বড় দায়! জুবাইদা বেগম রান্নাঘরে এসে খানিকটা উঁকি দিলেন। দেখতে পেলেন — তার প্রানপ্রিয় বান্ধবী কেমন মনমরা হয়ে কাজ করছেন! তিনি হালকা হেসে রাফিয়া বেগমের পেছনে এসে দাঁড়ালেন।অতঃপর আলতো করে মানুষটার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে ওঠেন রাফিয়া বেগম! রাফিয়া বেগম তৎক্ষনাৎ হকচকিয়ে পেছনে তাকালেন।অতঃপর চোখের সামনে জুবাইদা বেগমকে দেখতে পেয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“ তুই!”
জুবাইদা বেগম হাসলেন একটুখানি। দু’হাত দিয়ে রাফিয়া বেগমকে পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে, তার কাঁধে মুখ রাখলেন। বললেন,
“ কি নিয়ে এতো মন খারাপ তোর?”
“ কই না তো!”
“ তাহলে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
রাফিয়া বেগম এবার খানিকটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। তা দেখে জুবাইদা বেগম খানিকটা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে বসেন,
“ আচ্ছা…আমায় বেয়াইন হিসেবে পেয়ে কি খুশি হোস নি তুই?”
এহেন কথায় তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে দাঁড়ালেন রাফিয়া বেগম। জুবাইদা বেগমকে শুধরে দিয়ে খানিকটা জোর গলায় বললেন,
“ ধূর! কি বলছিস এসব? এই আমায় চিনলি তুই?”
জুবাইদা বেগম আগের ন্যায় মুখভঙ্গি রেখে বলতে লাগলেন,
“ তাহলে মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেনো?”
রাফিয়া বেগম আর লুকিয়ে রাখতে পারলেননা কিছু। তিনি এবার উদাস মনে বলতে লাগলেন,
“ এমনিতেই বাড়িতে কতশত ঝামেলা যাচ্ছে, তারওপর আজকের ঘটনা। ভাবতে পারছিস জবা? একবার যদি ভাইজানের কানে কথাটা যেতে পারে তাহলে ঠিক কি কি হতে পারে?”
এরূপ কথায় জুবাইদা বেগমও খানিক চিন্তায় পড়লেন। ঠিকই তো!কথাগুলো যদি সত্যিই তার স্বামীর কানে যায় তাহলে আবারও না যেন কোন প্রলয় ঘটে!
জুবাইদা বেগম একটু পরপর এসে সদর দরজার সামনে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছেন।মনটা তার বড্ড উসখুস করছে।কখন যে মানুষটা এসে পৌছঁবে কে জানে! এ নিয়ে সাতবার এসে উঁকি দিয়ে গেলেন তিনি। জুবাইদা বেগম অপেক্ষা করতে করতে এবার বিরক্ত হলেন বুঝি।তিনি বিরক্ত মুখে গিয়ে বসলেন ড্রয়িং রুমের সোফায়। অতঃপর বসে বসে গুনতে লাগলেন অপেক্ষার প্রহর।
প্রায় মিনিট দশেক পর বাড়ির সামনে এসে হর্ণ বাজলো গাড়ির। জুবাইদা বেগম তৎক্ষনাৎ বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।দ্রুত কদমে এগিয়ে গেলেন দরজার সামনে।অধির আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন গাড়িটার দিকে।কিয়তক্ষন বাদেই কালো চকচকে গাড়িটা থেকে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে আসেন সাব্বির সাহেব। তারপর তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন বড় ভাইয়ের দিকে। কবির সাহেব আলতো হেসে শক্ত করে চেপে ধরলেন ভাইয়ের হাত।অতঃপর ভাইয়ের হাতে ভর দিয়েই বেরিয়ে এলেন তিনি।কবির সাহেব গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলেন নিজের বাড়িটার দিকে।পরক্ষণেই মানুষটার কি হলো কে জানে! তার চোখদুটো কেমন ছলছল হয়ে এলো আপনা-আপনি। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন — এ বাড়িতে আবারও বোধহয় ফিরে আসা হবে না তার!
কবির সাহেবকে ধরে ধরে নিয়ে আসা হলো বাড়ির ভেতরে। জুবাইদা বেগম এতক্ষণ সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন কেমন ছুটে পালালেন সেখান থেকে। হয়তো স্বামীর চোখে চোখ রাখার ভয়ে চলে গিয়েছেন তিনি।কবির সাহেব একে একে সকলের সঙ্গে কথা বললেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর সাব্বির সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,
“ ভাইজান, এখন রুমে গিয়ে কিছুটা রেস্ট নাও।”
কবির সাহেব মাথা দোলালেন। তারপর সাব্বির সাহেবের হাত ধরে চলে গেলেন নিজের রুমের দিকে।
কবির সাহেব ঘরে ঢুকলেন। নিঃশব্দে হেঁটে আসতে লাগলেন বিছানার কাছে।কিছুটা এগোতেই অসাবধানতা বশত খানিকটা হোচট খেতেই, জুবাইদা বেগম ছুটে এসে স্বামীকে আগলে নিলেন নিজের সঙ্গে। কবির সাহেব থমকালেন। দৃষ্টি উঠিয়ে চাইলেন স্ত্রীর মুখপানে। দেখলেন, — জুবাইদা বেগমের সিক্ত আখিঁদ্বয় কেমন নিচু করে রাখা।হয়তো চোখে চোখ মেলাতে বেজায় কষ্ট হচ্ছে মানুষটার। জুবাইদা বেগম ধীরে ধীরে স্বামীকে বিছানায় বসালেন। অতঃপর টেবিল থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে, সেটা এগিয়ে দিলেন স্বামীর দিকে। কবির সাহেব আলগোছে মুচকি হাসলেন।ইচ্ছে করে স্ত্রীর হাতটায় স্পর্শ করে পানির গ্লাসটা নিয়ে নিলেন। তারপর ঢকঢক করে পুরোটা পানি শেষ করে ফেললেন তিনি।জুবাইদা বেগম স্বামীর হাত থেকে খালি গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে রাখলেন। তারপর করার মতো কিছু না পেয়ে চলে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। ঠিক তখনি পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরে কবির সাহেব। জুবাইদা বেগম থমকালেন। পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস পেলেন না তিনি।কবির সাহেব হয়তো বুঝে গেলেন প্রিয়তমার মনের অবস্থা! তিনি বসে থেকেই ধীমী স্বরে বললেন,
“ কথা বলবে না? এখনো রেগে আছো আমার ওপর?”
ব্যস! এটুকু কথাই যেন যথেষ্ট ছিলো জুবাইদা বেগমকে ভেতর থেকে নিংড়ে দেওয়ার জন্য। মানুষটা তৎক্ষনাৎ পেছনে ফিরে স্বামীর পায়ের কাছে বসে পড়লেন। অতঃপর কবির সাহেবের হাঁটুর ওপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন তিনি।কবির সাহেব আলতো হাসলেন। স্ত্রীর মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,
“ কাঁদছো কেনো জবা? আমিতো ফিরে এসেছি!আল্লাহ হয়তো এখনো হায়াত রেখেছেন!তাছাড়া তোমার ছেলে কি আর ওতো সহজে যেতে দিচ্ছে আমায়?”
জুবাইদা বেগম থামলেন না।তিনি এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন।কিয়তক্ষন বাদে কবির সাহেব ফের বললেন,
“ খারাপ লাগছে জবা!থামবে না?”
অগত্যা এমন কথায় কান্নাগুলো কোনমতে গিলে নিলেন জুবাইদা বেগম। তিনি অশ্রুসিক্ত লোচনে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ আমায় ক্ষমা করেছো তুমি? আমার ভুলগুলো ভুলে গিয়েছো তো?আমায়…”
বাকিটা বলার আগেই কবির সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজ থেকে বলতে লাগলেন,
“ পুরনো কথা মনে করে কি লাভ জবা? ভুলে যাও সবটা!”
বিকেল সাড়ে পাঁচটা!
কবির সাহেব বাগানে এসেছেন খানিকটা হাটাহাটি করতে। যেহেতু ডাক্তারের শক্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তিনি যেন সিঁড়ি না চড়েন।তাই তিনি বাগানেই টুকটাক হাঁটাহাঁটি করছেন।এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হয় অরিন।মেয়েটা নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো কবির সাহেবের পেছনে।কবির সাহেব সামনের দিকে তাকিয়ে কোমরের পেছনে দু’হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন।হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি। অরিনখানিকক্ষণ দোনোমোনো করতে করতে অবশেষে ধীর সুরে ডাকলো,
“ বড় আব্বু!”
কবির সাহেব ঘাড় বাকিয়ে পেছনে ফিরলেন।অরিনকে দেখে গম্ভীর মুখে হাসলেন একটুখানি। অতঃপর নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন,
“ এতক্ষণে দেখতে এলে আমায়? বড় আব্বুর ওপর কি খুব রেগে আছো মামনী?”
অরিন ভেজা চোখে ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। খানিক হেসে বলে ওঠে,
“ কেমন আছো তুমি? শরীরটা আগের চাইতে ভালো লাগছে তো?”
কবির সাহেব একদৃষ্টিতে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটখাটো পুতুলের মতো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।মনে মনে খানিকটা আশ্চর্যও হলেন বটে,কেননা কয়েকদিন আগেও মেয়েটার চেহারা জুড়ে ছিলো সেকি সৌন্দর্য, মায়া এবং হাসি হাসি ভাব! অথচ আজ কেনো মেয়েটার মুখের কোথাও সে-ই জৌলুশের দেখা মিলছে না? চোখের নিচে জমেছে দুঃখের ছাপ! ভাব এমন — বেশ কয়েকদিন বুঝি ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না তার! মুখটাও কেমন মলিন দেখাচ্ছে! বেশ কিছুক্ষণ হয়ে যাবার পরও বড় আব্বুকে নিজের দিকে ওভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরিন ফের বললো,
“ বড় আব্বু? কি হলো?”
কবির সাহেব তৎক্ষনাৎ সম্বিত ফিরে পেলেন যেন।তিনি অরিনের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, অন্যদিকে ফেললেন। অতঃপর খানিকটা দূরে দাড়িয়ে অরিনকে ইশারায় নিজের সঙ্গে হাঁটতে বললেন। অরিনও আর কিছু না ভেবে বড় আব্বুর সঙ্গে হাঁটা ধরে। হাঁটার একপর্যায়ে কবির সাহেব বলে ওঠেন,
“ কথাটা বুঝি এখনো কাওকে বলোনি?”
থমকায় অরিন। হাঁটা থামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লো মেয়েটা।কবির সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। অরিন খানিকক্ষণ সময় নিয়ে মাথা নিচু করে বলে ওঠে,
“ নাহ! বলিনি কাওকে! তুমি চিন্তা করো না বড় আব্বু! আমি কোনোদিনও বলবো না কাওকে।”
দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরও ১৫ টি দিন।এ ক’দিনে এহসান বাড়ির পরিবেশ হয়ে উঠেছে আবারও আগের মতো। রোজকার নিয়ম অনুযায়ী সকলে ছুটে গিয়েছেন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। শুধুমাত্র কবির সাহেব বাদে।মানুষটা এখন বেশ সুস্থ হলেও কর্মক্ষেত্রে যাবার মতো শিথিল অবস্থায় নেই।
সকাল সকাল রান্নার তোড়জোড় চলছে বেশ জোরালোভাবে।এইতো গতকাল বিকেলের দিকেই রৌদ্র এসে হুট করেই বললো — রুহি আর মেহরিন ফুপ্পি বাড়িতে আসবে।রৌদ্রই না-কি নিজ উদ্যোগে তাদের দাওয়াত করে এসেছে। কেনো এমন হুটহাট তলব,তা অবশ্য কারোরই জানা নেই। জুবাইদা বেগম ছেলের ওমন কথা শুনে গতকাল থেকেই বেশ চিন্তিত। না জানি ছেলেটা তার কি-না কি পরিকল্পনা কষছে মনে মনে!
এ ক’টাদিনে রৌদ্র কেমন যেন অনাকাঙ্খিতভাবেই বেশ পরিবর্তন হয়েছে! এই যেমন কারো সাথে খুব বেশি কথা বলে না, সবসময় গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে চলাফেরা করছে।সারাদিন পারেনা কাজের মধ্যে ঢুকে পড়তে! কাজ না থাকলে জোর করে হলেও কাজ করবে! তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার যেটা সবাইকে বেশ অবাক করেছে, সেটা হলো রৌদ্রের অরিনকে একেবারেই ইগনোর করার ব্যাপারটা! সকলের একটাই ভাবনা — যেই ছেলে কয়েকদিন আগেও বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে মেয়েটার জন্য কতশত পাগলামি করলো,সে-ই ছেলেই কি-না আজ ক’দিন যাবত মেয়েটাকে এতোটা উপেক্ষা করছে? অরিন যেখানে থাকে সেখানে পা অবধি ফেলছে না রৌদ্র। প্রতিদিন কায়দা করে সকাল সকাল মেয়েটার ঘুমে থাকা অবস্থাতেই হসপিটাল চলে যায় আবার রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন আসে!জুবাইদা বেগম অবশ্য এ নিয়ে ছেলের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু ছেলেটা প্রতিত্তোরে বরাবরই বলে এসেছে — তার না-কি কাজে ব্যস্ততা চলছে!
এটা কি আদৌও সত্যি কথা ছিলো না-কি একপ্রকার অজুহাত তা নিয়ে বেশ শঙ্কায় আছেন জুবাইদা বেগম। তবুও তিনি পারছেননা ছেলেকে কিছু বলতে।ছেলেটা ইদানীং কেন যেন একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। তা-ই তিনিও আর কিছু বলেন না!
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সকলে মিলে আড্ডা দিচ্ছে।যদিও এটা আড্ডা নয়,একপ্রকার যৌথ সম্মেলন বলা চলে।রৌদ্র কিছুক্ষণ আগেই কল করে জানায় — সকলে যেন একসঙ্গে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত থাকে।সকলে বলতে সকলেই! কেও যেন বাদ না থাকে।অগত্যা এমন কথায় সকলেই একযোগে এসে বসেছে ড্রয়িং রুমে।
রেহান উদাস মনে দাঁড়িয়ে আছে ড্রয়িং রুমের এককোণে।ছেলেটার চোখেমুখে স্পষ্ট বিষাদের ছাপ! কিন্তু তা কেনো, সেটা জানা নেই কারো! প্রায় মিনিট দশেক পর রৌদ্র এসে উপস্থিত হয় ড্রয়িং রুমে।তৎক্ষনাৎ সকলের উৎসুক দৃষ্টি এসে পড়লো রৌদ্রের ওপর। রৌদ্র ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ালো ড্রয়িং এর মাঝখানে। ছেলেটার চোখেমুখের অবস্থা যাচ্ছেতাই! সেথায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে একরাশ ক্লান্তি! রেহান একবার ছলছল চোখে তাকায় রৌদ্রের দিকে। পরক্ষণেই কি মনে করে ছেলেটা তৎক্ষনাৎ ড্রয়িং রুম থেকে চলে গেলো সিঁড়ি বেয়ে।এদিকে তার এমন ছুটে যাওয়া দেখে খানিকটা অবাক হলো সকলে।রুহিতো বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তৎক্ষনাৎ। সে রেহানের পিছু যেতে কদম বাড়াতেই রৌদ্র তাকে আঁটকায়। রুহি থেমে গেলো। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো ভাইয়ের দিকে। রৌদ্র এবার মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,
“ কথাটা শুনে যা!”
রুহি তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়িয়ে বলে,
“ হ্যা বলো!”
রৌদ্র একবার উপস্থিত সকলের মুখের ওপর চোখ বুলায়।অতঃপর এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করে বলে ওঠে,
“ আমি চলে যাচ্ছি! আবারও আগের জায়গায়…আগামীকাল আমার ফ্লাইট!”
এহেন কথায় বুঝি মুহুর্তেই বাজ পড়লো সকলের মাথায়। সকলেই বুঝি একপ্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন এমন বাক্যে।কিছুক্ষণ পর জুবাইদা বেগম কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠেন,
“ ক’দিনের জন্য যাবি বাবা?”
রৌদ্র মায়ের দিকে তাকায়। লাল হয়ে আসা চোখদুটো নিয়ে মাথা নাড়ায় খানিকটা। মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বলে,
“ আর ফিরবো না আম্মু! তোমাদের প্রয়োজন পড়লে ডেকো…অবশ্যই আসবো।কিন্তু এসে আবারও ফিরে যাবো!”
জুবাইদা বেগম থমকালেন। হতবাক মানুষটার চোখ বেয়ে কখন যে আপনা-আপনি অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে সেদিকে খেয়াল নেই তার!মানুষটার শরীরে হঠাৎই কেন যেন কম্পন বয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা বদনটা অবহেলায় হেলে পড়লো পেছনের দিকে। ভাগ্যিস পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাব্বির সাহেব! তিনি হুট করেই আগলে নিলেন জুবাইদা বেগমকে।জুবাইদা বেগম কাঁপা কাঁপা চোখদুটো তুলে ছেলের দিকে চাইলেন। আশ্চর্য! গলা থেকে শব্দ বেরুচ্ছে না কেনো তার? কতো কিছুই তো বলতে চাচ্ছেন তিনি! অথচ গলাটা থেকে কেন শব্দ বেরুচ্ছে এটাই বোধগম্য হচ্ছে না তার!
এদিকে বাড়ির বাকি সদস্যরাও একইভাবে থমকে দাড়িয়ে আছেন। অরিন খানিকটা দূরে দাড়িয়ে অনিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে। আজ কতগুলো দিন পর মানুষটাকে এভাবে চোখের সামনে দাঁড়ানো দেখতে পারছে সে! আগে নাহয় চোখের তেষ্টাটা মেটাক সে,তারপর নাহয় বাকিটা শুনবে!
অন্যদিকে কবির সাহেব এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ছেলের দিকে। এবার তিনি মুখ খুললেন। বললেন,
“ ভেবেচিন্তে বলছো সবটা?”
রৌদ্র বাবার দিকে না তাকিয়েই স্মিত হাসলো।মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বললো,
“ এতোদিন ধরে তো ভেবেই এসেছি!”
কবির সাহেব আর কিছু বললেন না। বসে রইলেন গম্ভীর মুখে।এদিকে বাড়ির সকলেই হতভম্ব! তাশরিক সাহেব কিছু বলতে যাবে তার আগেই রৌদ্র তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“ দয়া করে আর কিছু বলো না চাচ্চু! হয়তো শুনতে পারবো না সবটা!আমার কেন যেন দমবন্ধ লাগছে এখন!”
অগত্যা এমন কথায় চুপ করে গেলেন তাশরিক সাহেব। মানুষটা তৎক্ষনাৎ ছলছল চোখজোড়া নিয়ে চলে গেলেন ড্রয়িং থেকে।এদিকে রৌদ্র আর কিছু বলতে পারলোনা। সে কেমন মাথানিচু করে দৃষ্টি লুকিয়ে চলে যেতে লাগলো তবে তক্ষুনি কি যেন একটা মনে করে আবারও পেছনে ফিরে তাকালো ।ঘরভর্তি মানুষের সামনে বাবার উদ্দেশ্যে গলা উঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“ তোমার আর সানশাইনের মাঝে যেকোনো একজনকে চুজ করার প্রশ্ন উঠলে আমি নিসন্দেহে নিজেকে ব্যর্থ মনে করবো আব্বু! এতবড় সাহস আমার আগেও ছিলো না এখনো নেই!অতঃপর তোমরা ভালো থাকো।”
কবির সাহেব ছেলের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। হয়তো নিজের সিক্ত চোখদুটো লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় তৎপর হয়েছেন তিনি।রৌদ্র একবার অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা অরিনের পানে চাইলো।তারপর ধীর পায়ে খানিকটা এগিয়ে আসলো মেয়েটার দিকে। অরিনের নিচু করে রাখা মুখটার পানে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ তুই আমার সানশাইন! শুধুই আমার!তোর অস্তিত্বে সারাজীবন মিশে থাকবো আমি। তোর ঐ ছোট্ট মগজে ঢুকিয়ে রাখ মেয়ে — তুই এই ইফতেখার এহসান রৌদ্রের ছিলি,আছিস এবং সারাজীবন থাকবি! আমি যদি সারাজীবন তোকে দূর থেকে ভালোবাসতে পারি তাহলে তুইও পারবি!”
এই বলে রৌদ্র হাসলো ঠোঁট পিষে। তারপর কদম বাড়ালো সিঁড়ির দিকে।খানিক থমকে পেছনে না ফিরেই ফের বললো,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৬
“ আমি চলে যাচ্ছি, তার মানে এই নয় আমার সানশাইনকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে পারবে! উঁহু… এমন ভুলে মোটেও বাস করোনা।আমি যদি সারাজীবন একা থাকি তাহলে ও নিজেও একা থাকবে।আমি যদি সারাজীবন ওর অনুপস্থিতির দহনে পুড়ি তাহলে ও নিজেও পুড়বে।তবুও যদি আমার কথার বিন্দুমাত্র হেরফের করে ওকে আমার কাছ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টাও করো,তাহলে শুনে রাখো — আমার সানশাইনের গায়ে যেদিন আমি বাদে অন্যকারো নামের লাল শাড়ি উঠবে, সেদিনি কিন্তু আমার গায়ে কাফনের কাপড় উঠবে! এবং আমি এটা কথা দিচ্ছি!”