সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে গল্পের লিংক || জাওয়াদ জামী

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১
জাওয়াদ জামী

” শোন কুহু, শেষবারের মত বলছি, কান খুলে শুনে রাখ। তুই আমার বাবার বাড়ির আত্নীয়দের সামনে যাবিনা। এমনকি নিহানের বিয়ের কোন অনুষ্ঠানেই যেন তোদেরকে না দেখি। আমি চাইনা তোরা ভাইবোনেরা আমার আনন্দ মাটি করে দিস। তোরা তোদের বাড়িতেই থাকবি। তোদের ছায়াও যেন আমার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে না পরে। ”
বড়মার কড়া কথা শুনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে কুহু। বড়মা ওদেরকে বারণ করার পর থেকেই ওরা এ বাড়ির ছায়াও মাড়ায়নি। কিন্তু আজ বড় চাচা ডাকায় ও এই বাড়িতে এসেছে। তা-ও রুম অব্দি যেতেই পারেনি। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলো রাখি আক্তারের।

” আমি তোমাদের বাড়িতে আসতে চাইনি, বড়মা। বড় চাচা ডাকল তাই এসেছি। চাচা কি বলে সেটা শুনেই চলে যাব। ” মিনমিন করে বলল কুহু।
” তোর বড় চাচার খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তাই তোকে ডেকেছে। তার ঘাড়ে যদি কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতাম, তবে সে তোকে ডাকতনা খোশগল্প করার জন্য। আমার বাপের বাড়ির লোকজন এসে তার ছেলের বিয়ের সব কাজ করে দিচ্ছে, আর সে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব কাজ তার দ্বারাই সম্ভব। যা এবার নিজের বাড়িতে যা। আমার মাথা খাওয়ার জন্য তোর চাচা আছে, তোকে আর নতুনভাবে আমদানি হতে হবেনা। ”
” যাচ্ছি, বড়মা। ” চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। কান্না জড়ানো গলায় কোনমতে কথাটুকু বলে বড় চাচার বাড়ি ত্যাগ করল কুহু।
কুহুকে যেতে দেখে মুখ বাঁকালো রাখি আক্তার। তার জীবনের এই আনন্দঘন মুহূর্তে কুহুর পরিবারের কেউ উপস্থিত থাকুক সেটা সে চায়না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আম্মু, কুহুর গলা শুনলাম মনে হয়? কোথায় ও? ”
নিহানের গলা পেয়ে চমকে পেছনে তাকাল রাখি আক্তার। নিহান কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা সে বুঝতেই পারেনি। ছেলের এমন অযাচিত আগ্রহে সে বিরক্ত হল।
” কে এসেছে, কে আসেনি সেটা তোর না জানলেও চলবে, নিহান। আজ বাদে কাল তোর বিয়ে তুই সেদিকে মনযোগ দে। পৃথুর সাথে বেশি বেশি কথা বল। ওর মনে জায়গা করে নে। সেটাই তোর একমাত্র কাজ। ভালো কথা আজ তোর মেজো মামা, ছোট মামা আসবে পরিবার নিয়ে। তাদের সামনে অযথাই জ্ঞান ঝাড়তে যাবিনা। আমার মুখে মুখে তর্ক করবিনা। যা বলব বাধ্য ছেলের মত মেনে চলবি। ”

” আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি বিয়েটা আমি নিজের ইচ্ছেয় করছিনা। শুধুমাত্র তোমার কথা রাখতে গিয়ে আমাকে বলির পাঁঠা হতে হচ্ছে। তাই তুমি চাইলেও আমি পৃথুর সাথে কথা বলতে পারবনা। আমি তোমার বাধ্য ছেলে বলেই নিজের সুখের কথা চিন্তা না করে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত হয়ে আছি। এরপরও তুমি আমাকে বাধ্য ছেলে হতে বলছ! তোমার আর কোন কোন আশা পূরণ করতে পারলে, আমি বাধ্য ছেলে উপাধি পাব, সেটা একবার বলবে, আম্মু? ” দ্বিগুণ তেজে উত্তর দিল নিহান।

” কি হচ্ছে এখানে? ভাইয়া, তোমার মেজাজ মহাশয় হাই মনে হচ্ছে? কাহিনী কি? বিয়ের পাত্রের চেহারা থাকবে যুবতী নারীর মত টগবগে। কিন্তু না, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে নয়মাস অন্তঃস্বত্তা থাকার পর পাঁচঘন্টা ধরে লেবার পেইনের ধকল সহ্য করে ডেলিভারি হওয়া লিকলিকে নারী। যার মুখে শুধুই ব্যথা-বেদনার ছাপ। ” আনান গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে।
” আনান, কি হচ্ছে এসব? সবসময় তোকে ইয়ার্কি করতেই হবে? তোকে বারবার মনে করিয়ে দেই, নিহান তোর বড় ভাই, তবুও ভুলে যাস কেন? নাকি ইচ্ছে করেই ভুলে যাস? নিহানের সাথে মজা করার ছুঁতো খুঁজিস? এরকম বাজে ইয়ার্কি আর কখনোই করবিনা, বুঝেছিস? আমি মরছি কাজের ঠ্যালায়, আর এই বেয়াদব ছেলে বস্তাপঁচা ইয়ার্কি নিয়ে মেতে আছে। ফুলপুর থেকে সাহায্য করার জন্য লোকজন না আসলে আমি পাগল হয়ে যেতাম। ” রাখি আক্তার ধমক দিল আনানকে। আনানের কথাবার্তা শুনে সে রেগে গেছে।

” ফুলপুর থেকে কাজের লোক এসেছে জন্যই তোমার চাপার জোর দেখার সুযোগ হচ্ছে, মাননীয়া আম্মু। তোমার ভাই চারজন লোক পাঠিয়েছে বলে তুমি খুশিতে গদগদ হয়ে একে তাকে দু কথা শুনিয়ে দিচ্ছ, এটাই বা কম কি? তুমি সেই আনন্দেই থাক। আমাকে ভাইয়ার সাথে মজা করতে বাঁধা দিওনা। দুইদিন পর ভাইয়া আমার আরেক রমনীর জামাই হয়ে যাবে। দ্বায়িত্ব পালন করতে করতে কুঁজো হয়ে যাবে। কারও সাথে দুদণ্ড কথা বলার সুযোগও পাবেনা। আগামী দুইদিন মুক্ত জীবনের স্বাদ গ্রহন করতে দাও ভাইয়াকে। যে জিনিস ধরে বেঁধে ভাইয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছ, সেই জিনিসের ভার সহ্য করতে করতেই ভাইয়ার এক জীবন কেটে যাবে। ” আনান ওর মাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে কথাগুলো বলল৷

” আনান? তুই গেলি এখান থেকে, বেয়াদব ছেলে? আমার পছন্দের ওপর আঙ্গুল তুলছিস তুই? বাপের মতই ত্যাড়া হয়েছিস। আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছে বাপ-ছেলে মিলে। তোর বাপের সংসারে এসে শান্তি পাইনি। ভেবেছিলাম ছেলেরা অন্তত আমার দুঃখ বুঝবে। কিন্তু না, এইটা বাপেরও এককাঠি ওপরে চলে গেছে। আমার কষ্ট দেখলে এর আনন্দ হয়, হাসি পায়! বেইমান ছেলে জন্ম দিয়েছি। ” রাখি আক্তার রাগে তেড়ে গেল আনানের দিকে৷
” সংসারে শান্তি না পেয়েই তোমার যে অফুরন্ত ক্ষমতা , শান্তি পেলে না তুমি কি করতে! বেচারা আমার আব্বু শুধু হুকুম পালন করতে করতে তার সারাজীবন কাটল। আবার আমাকে দেখ, তোমার আদরের ছেলে হতে চেয়েও পারলামনা। যে বিয়ে করতে চায়না, তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছ। কিন্তু আমি বিয়ের জন্য দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সেটা তোমার চোখেই পরেনা। কত স্বপ্ন ছিল, তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে, আনান, তোর জন্য একটা রাজকন্যার মত মেয়ে পছন্দ করেছি। তুই রাজি থাকলেই বিয়েটা হয়ে যাবে। আমার বউমা এসে বাড়িময় প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াবে। একবছর পরই বাড়িটা ছানাপোনায় ভরে যাবে। কিন্তু তুমি আমার স্বপ্ন অংকুরেই বিনাশ করে দিয়ে বড় ছেলের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছ। আমার সাথে প্রতিবেশির ছেলেদের মত আচরণ করছ। এসব কি মানা যায়? ” আলাভোলা চেহারা করে বলল আনান৷ যেন রাখি আক্তারের রাগ ওর চোখেই পরেনি।

” নিহান, এই ছেলে কি বলছে এসব! লজ্জাশরমের বালাই নেই দেখছি এর! এই তোর বয়স কত? সবেমাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিস। এখন তোর পড়াশোনা করার বয়স। আর এই বয়সে তুই বিয়ের স্বপ্ন দেখিস? আসুক তোর বাপ। তোর বিয়ে করার স্বপ্ন আমি বের করছি। বাপের আস্কারা পেয়ে মাথায় উঠে নাচতে চাইছে। ” রাখি আক্তার এদিকওদিক তাকিয়ে লাঠি খুঁজছে। এই মুহূর্তে তার হাতে লাঠি থাকলে আনানকে দু ঘা লাগিয়ে দিত৷
” আম্মু, আমি শুধু বিয়ের স্বপ্নই দেখিনা, সাথে কয়েক হালি বাচ্চার স্বপ্নও দেখি। স্বপ্নগুলো বুকের মাঝে লালন করেই আমি বেঁচে আছি। স্বপ্নের বউ-বাচ্চারাই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। ” আনান বুঝতে পারছে ওর মা রেগে গেছে। তাই সে নিহানের পেছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল।

” আনান, থামবি প্লিজ? আম্মু, তুমি ভেতরে যাও। তুমি বোঝনা আনান তোমাকে রাগাতেই এসব বলে? তুমিও শুধু শুধু ছোট মানুষের মত রাগ কর। আনান, তুই গিয়ে সাকিবকে ডেকে নিয়ে আয়। ” নিহান মা-ছেলের খুনসুটির মধ্যে হস্তক্ষেপ করল।
নিহানের কথামত আনান সাকিবকে ডাকতে গেল। রাখি আক্তারও চলে গেল। বারান্দায় শুধু দাঁড়িয়ে রইল নিহান। ওর চেহারা দেখেই যে কেউ বলে দেবে, ছেলেটা ভালো নেই।

এলোমেলো পা ফেলে বাড়িতে ঢুকল কুহু। সদর দরজা বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আজকের বড়মা আর আগের বড়মার ভেতর আকাশপাতাল তফাৎ। আগে ওরা গ্রামে আসলে বড়মা ওদেরকে নিজের বাড়িতে রাখত। কত আদরযত্ন করত। কিন্তু বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকেই বড়মা পাল্টে গেছে। ওদের তিন ভাইবোনকে দু চোখে দেখতে পারেনা। কুহুরা নিজেদের বাড়িতেই থাকে। বড় চাচার বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি নেই। এমনকি নিহান ভাইয়ার বিয়েতেও ওদেরকে দাওয়াত করেনি।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কুহু। কারো ফোঁপানোর শব্দে চমকে উঠল। ওর সামনের রুম থেকে শব্দটা আসছে। কুহু সাবধানে উঁকি দিল রুমের ভেতর৷ দৃষ্টিকে কাঁদতে দেখে চমকে উঠল। হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকল।

” দৃষ্টি, কাঁদছিস কেন তুই? কি হয়েছে আমাকে বল? ”
হঠাৎই রুমে কুহুকে ঢুকতে দেখে ভয় পায় দৃষ্টি। হাতে থাকা চিরকুটটা লুকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কুহুর কাছে ধরা পরে গেল।
” ক…কিছু হয়নি, আপু। ”
” কিছু না হলে কাঁদছিস কেন? কি লুকাচ্ছিলি তুই? আমাকে দেখা। ”
দৃষ্টির হাত থেকে চিরকুটটা কেড়ে নিয়ে পড়তে শুরু করল কুহু। দৃষ্টি মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চিরকুটটা পড়ার পর দৃষ্টির দিকে চমকে তাকায় কুহু।
” দৃষ্টি! তুই! ছিহ্। বড়মা জানলে আমাদের কি হবে একবারও ভেবে দেখেছিস? অবিবেচক মেয়ে। যারা আমাদের দুঃসময়ে আমাদের মাথার ওপর ছায়া দিয়েছে, তাদের সম্মানেই হাত বাড়িয়েছিস তুই? একটুও লজ্জা লাগেনি তোর?

” আমি কিছু করিনি, আপু। নিহান ভাইয়াই তো আমাকে চিরকুটগুলো দিত। আমি তাকে নিষেধ করেছি, কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। আমি মানছি চিরকুটগুলো পড়তে পড়তে একসময় নিহান ভাইয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, সে কথা ভাইয়াকে আমি জানাইনি। আর কখনো জানাবোওনা। ” কাঁদতে কাঁদতে বলল দৃষ্টি।
” আজকের পর থেকে আর কখনোই বড় চাচার বাড়িতে যাবিনা। নিহান ভাইয়ার সাথে কথা বলবিনা। মনে রাখিস, বাবা-মার মৃত্যুর পর আমরা আগের সেই অবস্থানে নেই। বড়মার কাছে প্রিয়পাত্রী হতে গেলে আমাদের বাড়ি-গাড়ি থাকতে হবে। যেগুলো এখন আমাদের নেই। আগে যখন আমাদের ঢাকায় বাড়ি ছিল, গাড়ি ছিল তখন আমরা বড়মার আদরের ছিলাম। এখন আমরা নিঃস্ব। তাই আমাদের জন্য বড়মার ভালোবাসাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। তুই যতই নিহান ভাইয়ার প্রতি দুর্বল হোস না কেন, তাতে বড়মার কিছুই যাবে আসবেনা। তার পায়ে মাথা কুটে মরলেও তার মন গলবেনা। তাই মন থেকে সবকিছু মুছে ফেল। জেনে রাখ, প্রত্যাখ্যানের অপমানের চাইতে, বুঝেশুনে কষ্ট পাওয়া হাজার গুনে ভালো। বোঝাতে পেরেছি? ” দৃষ্টির মাথায় মমতায় হাত বুলিয়ে বলল কুহু।

” বুঝেছি, আপু। তোমার প্রতিটা কথাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করব আমি। কখনোই বড় চাচার বাড়িতে যাবোনা। নিহান ভাইয়ার সাথে কথা বলবনা। ” চোখ মুছে বলল দৃষ্টি।
কুহু দৃষ্টিকে বুকে জড়িয়ে নিল। দৃষ্টি চুপটি করে বোনের আদর নিচ্ছে।
” শিহাব কোথায় গেছে বলতো? দৃষ্টি, এক কাজ করলে কেমন হয়? আমরা মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি? অনেকদিন মামাকে দেখিনা। মামিও যেতে বলছে। ”

” খুব ভালো হয়, আপু। চল আমরা কালকেই মামার বাড়িতে যাই। ”
” তবে গোছগাছ শুরু করে দে৷ তোর তো আবার প্রতিবারই ভুল হয়। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় রেখে অপ্রয়োজনীয়গুলো নিয়ে যাস। ”
” এবার আর কোন ভুল হবেনা। ”
” গুড গার্ল। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২