সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২
জাওয়াদ জামী
” আপু, আমরা মামার বাড়িতে যেতে বড় চাচা রাগ করবেননা? বড় চাচা কখনোই চাইবেননা আমরা নিহান ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান রেখেই মামার কাছে যাই। ” শিহাব মামার বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে কুহুকে জিজ্ঞেস করল।
শিহাবের কথায় কুহু মলিন হাসল। ও ভালো করেই জানে, ওরা চলে গেলে বড় চাচা ভিষণ কষ্ট পাবেন। কিন্তু কুহু নিরুপায়। যেতে ওকে হবেই।
” আমরা বড় চাচাকে না জানিয়েই যাব। ভাইয়ার বিয়ের কয়েকদিন পর বাড়িতে আসব। তখনও যদি চাচা রাগ করে থাকে, তবে তার কাছে ক্ষমা চাইব। আর আমার বিশ্বাস চাচা আমাদের ওপর রাগ করে থাকতেই পারবেননা। ”
ছোট্ট শিহাব বোনের কথায় মাথা নাড়ালো।
” বড় মামী, তুমি সত্যিই এসেছ! আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছ। একটা চিমটি কাটতো, শিওর হয়ে নেই তুমি সত্যিই এসেছ কিনা। ” আফরোজা নাজনীনকে দেখে অবাক হয়ে যায় আনান। ও নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিল আফরোজা নাজনীনের দিকে।
আনানের কথায় হাসলেন আফরোজা নাজনীন। তিনি সত্যি সত্যিই চিমটি কাটলেন আনানের হাতে।
” এবার বিশ্বাস হলো আমি সত্যিই এসেছি কিনা? আমি শুধু একা আসিনি তোর মামা আর তার মেয়েকে নিয়েই এসেছি। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” জানো তো আম্মু যখন বলল তোমরা আসবেনা, তখন খুবই খারাপ লেগেছিল? বারবার মনে হচ্ছিল তুমি ছাড়া বিয়ের আয়োজন পানসে লাগবে। ”
” পাগল ছেলে। তুই কেমন আছিস বল? পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? একবারও আমার কাছে গেলিনা যে? ”
” এসব কথা ছাড়তো। আগে বল তোমার ন্যাকুবতী কন্যা কোথায়? ওর সাথে দেখা করে এসে তোমার সব প্রশ্নের জবাব দেব। ”
” সিক্তা তোর বাবার সাথে কথা বলছে। কিন্তু খবরদার, ওর সামনে আবার আবোলতাবোল কথা বলতে যাসনা। ও এখন আর আগের সেই সিক্তা নেই। আগে তুই ওকে রাগালে মন করে বসে থাকত। এখন কিন্তু সেটা মোটেও করবেনা। ”
” কি করবে তোমার মেয়ে? আগের সেই বিড়াল কি এখন বাঘিনীতে পরিনত হয়েছে? আগে যে আঁচড় দিত এখন কি সে কামড়ে দেয়? ”
” ফাজিল ছেলে, এসব কথা ওর সামনে মুখেও আনবিনা কেমন? ”
” তোমার প্রস্তাব এখনো সংসদে পাস হয়নি৷ কেবল সেটা সংসদে উত্থাপিত হয়েছে মাত্র। বিষয়টা বিবেচনাধীন রয়েছে। ”
আনানের কথা শুনে হাসলেন আফরোজা নাজনীন।
” কি রে ন্যাকুবতী, তোর নাকি প্রমোশন হয়েছে? বিড়াল থেকে বাঘিনীতে রুপান্তরিত হয়েছিস নাকি? দেখি তোর দাঁত আর হাত-পায়ের আঙ্গুলগুলো। ”
সিক্তা আনানের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল। ও ফুপার সাথে বসে সুখ-দুঃখের আলাপ করছিল, কিন্তু এই অসভ্য ছেলে এসে তাতে বাঁধ সাধল। সিক্তা ভেবে পায়না আনান কেন ওর পেছনে আঠার মত লেগে থাকে। সামনে ফুপা বসে আছে, তাই সিক্তা চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল। যদিও ওর ভেতরটা রাগে ফেটে যাচ্ছে।
” আমার দাঁত আর নখ দেখে তোমার কাজ নেই। তুমি নিজের চরকায় তেল মালিশ কর। এতে তোমারই উপকার হবে। ” দাঁতে দাঁত পিষে বলল সিক্তা। সেই সাথে একটু হাসারও চেষ্টা করল।
” ওমা আমাদের ন্যাকুবতী দেখছি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে! তুই কত বড় হয়ে গেছিস রে, সিক্ত। আগের সেই হাফপ্যান্ট পরা সিক্ত আর নেই তুই। তুই যেন কোন ক্লাসে পড়িস? ” কৃত্রিম আফসোস নিয়ে বলল আনান।
” বড় হবনা তো কি, সারাজীবন ছোটই থাকব! আমি এবার ভার্সিটিতে এ্যাডমিশন দেব। আজাইরা প্যাচাল বাদ দিয়ে যাও এখান থেকে। আমাকে ফুপার সাথে কথা বলতে দাও। ”
” ও হ্যাঁ, মনে পরেছে। তুই আর আমাদের কোকিলা একসাথে পড়িস। লেখাপড়ায় কোকিলা তোর থেকে কয়েকধাপ এগিয়ে। আমাদের কোকিলা তোর মত ফাঁকিবাজ নয়। ঠিক বলেছিনা, আব্বু? ” শেষের প্রশ্নটা আনান ওর বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
” আনান, তুমি সিক্তা মাকে বিরক্ত করছ কেন? কতদিন পর মেয়েটার সাথে তোমার দেখা হল। তুমি ওকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস না করে উল্টো ওকে খোঁচাচ্ছ? এই শিক্ষা তোমাকে আমরা দিয়েছি? ” নিয়াজ মাহমুদ ছেলেকে ভৎসনা করে বললেন।
ফুপার কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে আনানের দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাংচায় সিক্তা। চোপসানো মুখে আনান সিক্তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
” রাখি, পিয়াসের ছেলেমেয়েরা কোথায়? শুনেছিলাম ওরা এখন গ্রামেই থাকে। আসার পর থেকে ওদেরকে দেখলামনাতো? ” আফরোজা নাজনীন তার ননদকে জিজ্ঞেস করলেন। তারা ভাবী-ননদ মিলে বারান্দায় বসে চা পান করছেন।
” আছে বাড়িতেই। ওদের কি আর এই বাড়িতে আসার সময় আছে। বাপ-মা মরেছে, সেই সাথে ছেলেমেয়েরাও স্বাধীন হয়েছে। ইচ্ছে হলে এই বাড়িতে আসে, ইচ্ছে না হলে আসেনা। মনমর্জি মত চলাফেরা করে তিন ভাইবোন। আমি যে ওদের বড়মা সেটা ওরা মনেই করেনা। ” বিরক্ত হয়ে জবাব দিল রাখি আক্তার।
” কি বল তুমি! কায়েসের ছেলেমেয়েরা এতটাই বিগড়ে গেছে? অথচ কায়েস, আইরিন দু’জনেই বলতে গেলে আদর্শ মানুষ ছিল। আচ্ছা, ওদের সংসার চলে কিভাবে? কায়েস, আইরিনের চিকিৎসা করতে গিয়ে নাকি বাড়ি,গাড়ি, সম্পত্তি সবই বিক্রি করতে হয়েছে? ছেলেমেয়েগুলো চলছে কিভাবে? ”
আফরোজা নাজনীনের একের পর এক প্রশ্নে বিরক্ত হল রাখি আক্তার। সে ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ করছেনা। মুখে হাসি ঠিকই ধরে রেখেছে।
” কিভাবে আর চলবে? আমরাই দেই সবকিছু। ওদের কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে সবকিছুই নিহানের বাবা দেয়। তা-ও ওদের হয়না। কায়েসের বড় মেয়ে কুহু টিউশনি করে কয়েকটা। টিউশনির টাকা ছাড়া নাকি ওদের শখ-আহ্লাদ পূরণ হয়না। ”
রাখি আক্তারের কথা শুনে তার দিকে তাকালেন আফরোজা নাজনীন। দূরদর্শী আফরোজা নাজনীন রাখি আক্তারের চেহারায় কায়েসের ছেলেমেয়ের জন্য কোন সহানুভূতি দেখতে পেলেননা। তবে তিনি রাখি আক্তারকে কিছুই বুঝতে দিলেননা।
” আমি এসেছি একঘন্টার বেশি হলো। কিন্তু নিহানকে কোথাও দেখলামনা যে? কোথায় গেছে ছেলেটা? বিয়ে বাড়িতে এসে যদি পাত্রকেই না দেখতে পাই, তবে কেমন লাগে বল? ”
” কোথায় আর যাবে? হয়তো বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। অনেকদিন পর গ্রামে এসেছে। গ্রামে আসলে ওদের দুই ভাইকে খুঁজে পাওয়া যায়না। ”
” রাখি, এক কাজ কর, রাতে কি রান্না হবে তার লিষ্ট কর। তোমার বাকি তিন ভাই-ভাবী ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে পরল বলে। ওরা এসেই খেতে চাইবে। আমি একটু হেঁটে আসছি। এসেই রান্না শুরু করব। ”
” তুমি রাঁধতে যাবে কেন, ভাবী! কাজের মেয়ে আছে। সে-ই রান্না করবে। ”
” জানোনা তোমার ভাইয়েরা এবং ভাতিজা-ভাতিজীরা কাজের লোকের রান্না খায়না? শেষে দেখা যাবে, কাজের মেয়ের হাতের রান্না ওরা খেলোইনা। তাই তুমি না চাইলেও আমাকেই রান্না করতে হবে। আর যাইহোক সবাইকে না খাইয়ে রাখতে পারবনা আমি। ” আফরোজা নাজনীন রাখি আক্তারের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
উঠানের একপাশে পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া আর লাউয়ের মাচা। মাচায় লাউ আর মিষ্টি কুমড়া ঝুলছে। মাচার একপাশে কয়েকটা বেগুন আর ঢেঁড়স গাছ । কুহু একমনে লাউশাক তুলছে। বাড়ির খোলা সদর দরজার সামনে যে একজন দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে নজর নেই কুহুর। কয়েকটা লাউশাক তুলে, পুঁইশাকের ডগা কাটতে শুরু করল।
আফরোজা নাজনীন মুগ্ধ হয়ে দেখছেন শ্যামলাবরন মেয়েটিকে। চোখ ধাঁধানো রূপের মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। তিনি ভাবতেই পারেননি শ্যামলা চেহারার কোন মেয়ের এমন চোখ ধাঁধানো রূপ থাকতে পারে। তার মেঘবরণ কেশরাশি খোলা পিঠে উদ্দাম নৃত্য করছে। কোমড় ছাড়িয়ে নেমে এসে হাঁটু ছুঁইছুঁই করছে।
” তুমি কুহু? আনানের কোকিলা? ”
হঠাৎই অচেনা কারো গলা শুনে চমকায় কুহু। দরজায় দাঁড়ানো মধ্যবয়সী নারীকে দেখে আপনাআপনিই ভ্রু কুঁচকে আসল। কুহুর মনে হল, ইনাকে চেনে। কিন্তু কিভাবে চেনে সেটা মনে করতে পারছেনা।
” আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেনা যে? নাকি অচেনা কারও সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করোনা? ” কুহুকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবারও জিজ্ঞেস করলেন আফরোজা নাজনীন।
” জ্বি, আমিই কুহু। আনান ভাইয়া আমাকে কোকিলা বলে খেপায়। ” এক পা দু পা করে কুহু এগিয়ে গেল আফরোজা নাজনীনের দিকে। রিনরিনে গলায় জবাব দিল৷
” আমি আনানের বড় মামী। ”
” বড় মামী! অনেকদিন আগে আপনাকে দেখেছিলাম। তখন বোধহয় ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি। তাইতো আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। ভেতরে আসুন, মামী। ”
কুহুর গলার স্বর আচ্ছন্ন করে ফেলল আফরোজা নাজনীনকে। ধীর অথচ স্পষ্ট গলায় কথা বলছে মেয়েটা। তিনি সব সময় চেয়েছেন তার মেয়েরা এভাবে কথা বলুক। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। তাহমিদের ভাষ্যমতে তার তিন মেয়ে একেকটা লাউড স্পিকার।
” তোমার নাম কি, বাবা? ” শিহাবকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আফরোজা নাজনীন। কুহু তাকে রুমে এনে বসিয়েছে।
” শারিয়ার শিহাব। ” শিহাব একটু লজ্জা পাচ্ছে।
” কোন ক্লাসে পড় তুমি? ”
” ক্লাস ফোরে। ”
” কুহু মা, তুমি কিসে পড়ছ? আর দৃষ্টি তুমি? ”
” আমি এবার ভার্সিটিতে এডমিশন দেব। আর দৃষ্টি এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ”
” তুমি আর সিক্তা একই সাথে পড়? সিক্তা আমার ছোট মেয়ে। আমার সাথে এখানে এসেছে। তোমার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেব, কেমন? ”
” আচ্ছা, মামী। আপনি একটু বসুন আমি চা করে আনছি ”
” কিচ্ছু করতে হবেনা তোমাকে। তোমাদের সাথে গল্প করতেই ভালো লাগছে আমার। আমরা এসেছি দুপুরের দিকে, কিন্তু তোমাদের তিন ভাইবোনকে ঐ বাড়িতে দেখলামনা যে? আবার কুহু তুমি শাক তুলছ রান্নার জন্য। তোমাদের তো রাখির বাড়িতেই থাকার কথা। ”
” বড়মা আমাদের ঐ বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছে, মামী। ” কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটল শিহাব।
দৃষ্টি কুহুর দিকে অসহায় চোখে তাকাল।
” শিহাব সত্যি বলেছে, কুহু? রাখি তোমাদের দাওয়াত দেয়নি? ”
” দিয়েছে, মামী। শিহাব ছোট মানুষ, কিছু না বুঝেই কথাটা বলেছে। আপনি বড়মাকে কিছু বলবেননা। বড় শুনলে কষ্ট পাবে। ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১
কুহুর কথা শুনে হাসলেন আফরোজা নাজনীন। তিনি যা বোঝার বুঝে গেছেন। তার সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে বুদ্ধিমতী বলেই ধরে নিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, যেকোন পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম এই মেয়েটি।