সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৬

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৬
জাওয়াদ জামী

” এত নড়ছিস কেন? একটু শান্ত হয়ে থাকা যায়না? ” ধমক দিল নিহান।
নিহানের ধমক খেয়ে দৃষ্টি একটুও ভয় পেলোনা বরং খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
” সুড়সুড়ি লাগলে কি করব! ছেড়ে দাও, তাহলে আর নড়াচড়া করবনা। ”
” জড়িয়ে ধরে রাখলেই কি সুড়সুড়ি লাগে! আমি তোকে শুধু জড়িয়ে ধরে রেখেছি, আর কিছুই করিনি। ”
” আমি তার কি জানি! সুড়সুড়ি লেগেছে তাই তোমাকে বললাম। ”
” নড়াচড়া না করে চুপচাপ ঘুমা। আর আমাকেও ঘুমাতে দে। ” এবার নিহান জোড়ে ধমক দিয়ে, দৃষ্টিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
দৃষ্টি নড়াচড়া করার চেষ্টা করেও সুবিধা করে উঠতে পারলনা। বাধ্য হয়ে নিহানের বুকে মুখ গুঁজে রইল।

” তুমি পারবে , এই বিশ্বাস আমার আগে থেকেই ছিল। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিনই মনে হয়েছিল তুমি মেধাবী আর পরিশ্রমী। বাবা-মার মুখ তুমি উজ্জ্বল করেছ, সোনা। তারা দুনিয়ায় নেই তো কি হয়েছে, তাদের দোয়া তোমার সাথে আছে। তুমি আরও বড় হও, আরও অনেক দূর এগিয়ে যাও। ” কুহুর কপালে চুমু দিয়ে বললেন দিদুন।
রাশেদীন বাড়ির প্রত্যেকেই ভিষণ খুশি। তারা সকলেই কুহুকে ঘিরে বসে আছেন।
” কুহু মা, বিশ্বাস কর সিক্তা বুয়েটে চান্স পায়নি এতে আমার কোন আফসোস নেই। তুই সুযোগ পেয়েছিস এতে আমি ভিষণ খুশি। ” আবেগে আফরোজা নাজনীনের গলা রুদ্ধ হয়ে আসছে।
” আম্মু ভুল বলেনি, কুহু। আমি চান্স পাইনি তো কি হয়েছে, তুই চান্স পেয়েছিস তাতেই আমি খুশি। খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। ” সিক্তা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” তা তো নাচবিই। পড়া চোরের একটা লেবেল থাকে। তুই কোন লেবেলের মধ্যেই পরিসনা। তুই একজন লেবেলহীন অকর্মার ঢেঁকি। শুধু খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কোন কাজই পারিসনা। নিজেকে কিভাবে জাহির করতে হয়, সেটা তোকে দেখেই শিখলাম। ” আনান হাই তুলে বলল।
” ওরে আমার লেবেল ওয়ালা ভদ্রলোক রে! ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে, ভদ্রলোকের সারা শরীরে লেবেলে সাঁটা। দেখি কিসের লেবেল? এই সোহা, নিপুন, শায়ক, সন্ধি, শিহাব এদিকে আয়। এই সো কল্ড ভদ্রলোকের শরীর থেকে কাপড়চোপড় খুলে দেখতো কতগুলো লেবেল সাঁটা আছে। ” সিক্তা ওর চাচাতো ভাইবোনদের ডাক দিল। সিক্তার ডাক শুনে ওর চাচাতো ভাইবোনরা দৌড়ে এসে আনানকে জেঁকে ধরল।

” এই সর। সবগুলো একেকটা কুবুদ্ধির লিডার। তোরা অন্তত এই অর্কমার ঢেঁকির সাথে মিশলে সবাই একেকটা অকর্মার ঢেঁকিই হবি। কোকিলাকে দেখে কিছু শিখ। এই পড়া চুন্নির কথায় নাচিসনা। শেষে দেখবি, শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে হাঁড়ি ঠেলতে হবে। যা ভাগ সবাই। এই অকর্মা তোদেরকে নিজের দলে টানতে গিয়ে তোদেরকেও অকর্মা বানিয়ে ছাড়বে। ” আনান তেড়ে গেল মামাতো ভাইবোনদের দিকে।
” আনাইন্নার বাচ্চা, তুই আমাকে অকর্মা বললি কেন? ঢাবিতে পড়েই কি নিজেকে আইনস্টাইন মনে করিস? তুই….
” সিক্ত, একটু থাম। সব সময় এভাবে আনানের পেছনে লেগে থাকিস কেন বলতো? নিজে তো ওকে পঁচিয়ে মজা নিস, এখন আবার তোর ব্যাটেলিয়নকে ওর পেছনে লাগিয়েছিস! এটা কিন্তু অন্যায়। বেচারা একা একা তোদের সকলের চাপ কিভাবে সহ্য করবে? শোন, কারো পেছনে লাগার আগে ভাবনাচিন্তা করতে হয়। ” সিক্তাকে থামিয়ে দিয়ে কথাগুলো বলল তাহমিদ।

” ভাইয়া, তুমি আমাকে বকা দিচ্ছ! তা-ও আবার এই বিটকেলের পক্ষ নিয়ে! এটা আমি তোমার কাছ থেকে আশা করিনি। ” মুখ গোমড়া করে বলল সিক্তা।
রুমের প্রতিটি সদস্য কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে সিক্তা, আনান, তাহমিদের দিকে। একটা সহজ বিষয়কে কিভাবে টেনে লম্বা করতে হয়, সেটা তারা এই তিনজনকে না দেখলে জানতে পারতনা। নাজমা আক্তার এদের নাম দিয়েছেন টম এ্যান্ড জেরী গ্যাং।
” রাগ করলি, বুঁচি? আমি কিন্তু মোটেও আনানের পক্ষ নেইনি। আমি শুধু তোকে বোঝাতে চেয়েছি, এই তাল পাতার সেপাই একসাথে সবার পঁচানি নিতে পারবেনা। আচ্ছা যা, আজকে তোদের ট্রিট দেব। বিকেলে তোদের সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাব। যা খুশি অর্ডার দিবি। বিল আমার। ”
” সত্যিইইইইইই! ” সমস্বরে চিৎকার দিয়ে বলল সিক্তা ও গ্যাং।
মাথা নেড়ে সায় জানাল তাহমিদ।

” ভাইয়া, কুহু যাবে আমাদের সাথে? ” সিক্তা জিজ্ঞেস করল।
” আমি বলেছি, তোদের সবাইকে নিয়ে যাব। সবার মধ্যে কিন্তু সে-ও পরে। আনান, তুইও কিন্তু যাবি আমাদের সাথে। তবে যাওয়ার আগে ওয়ালেট ভর্তি করে নিস। ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বাহিরে বেরোনো কিন্তু কম ঝক্কির নয়। ”
” আমিও কিন্তু তোমার ছোট ভাই। তাই বড় ভাই থাকতে আমার ওয়ালেট ভর্তি করার কোন মানেই নেই। ঠিক বলেছি তো, নানু? ”
” শুধু ঠিক নয়, একেবারে খাঁটি কথা বলেছ। তুমি যেমন তাহমিদ দাদু ভাইয়ের ছোট, তেমনি কুহু, সোহা, নিপুন, শায়ক, সন্ধি তোমার ছোট। এরাও কিন্তু তোমার কাছ থেকে ট্রিট আশা করে। “দিদুন হাসিমুখে বললেন।
” বুঝলামনা তুমি কার পক্ষে কথা বললে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি ছাড়া দুনিয়ার তাবৎ মানুষই আমার বিপক্ষে। তাই বুঝতে পারিনা, কোন কথা আমার পক্ষে, আর কোন কথা আমার বিপক্ষে। ” মুখ গোমড়া করে বলল আনান।
আনানের কথায় হেসে উঠলেন আফরোজা নাজনীন। আনানের পক্ষ নিয়ে বললেন,
” সবাই তোর বিপক্ষে গেলেও আমি আর কুহু মা তোর পক্ষেই থাকব, আনান। নীরবতার মাঝেও কুহু কিন্তু তোর পক্ষই নেয়। সেটা তুই না বুঝলেও আমি কিন্তু ঠিকই বুঝি। এই তোরা সবাই রেডি হয়ে নে। কুহু মা, তুই ও যা রেডি হ। ”

” আমার না গেলে হয়না, মামী? ”
” এ কি কথা বললি তুই, কোকিলা? তোকে রেখে আমরা বাহিরে যাব! তোকে রেখে! বুয়েটিয়ান হতে না হতেই তোর এই পরিবর্তন! এটা মানতে পারবনা কিছুতেই। ” আনান কৃত্রিম আফসোস নিয়ে বলল।
” কেন যাবেনা, কুহু সোনা? যেতে তোমাকে হবেই। ঢাকায় আসার পর তুমি কোথাও যাওনি। সারাক্ষণ বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থেকেছ। এবার সময় এসেছে একটু রিল্যাক্স করার। ” দিদুনের আদুরে ধমকে মৃদু হাসল কুহু।

” সিক্ত, ঐ ভদ্র মহিলাকে এই গাড়িতে বসতে বল। আর তুই তোর ব্যাটেলিয়নের দুইজনকে সামলা। শিহাব, তুই কি আমার সাথে থাকবি নাকি ওদের সাথে? আনান ,সন্ধি, নিপুন, তোরা আমার সাথে আয়। ”
” আমাকে তোমার গাড়িতে যেতেই হবে? ” আনান মুখ বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
” সারাটা পথ দুই ঝগড়ুটে মিলে ঝগড়া করতে করতে ড্রাইভার চাচার কানের পোকা খেয়ে ফেলার ধান্ধায় আছিস? এটি হচ্ছেনা। তুই আমার সাথে আসবি। সোহা, শায়ক তোরা ঐ গাড়িতে ওঠ। শিহাব, তুই কি আমার সাথে যাবি? ”
আনান মুখ গোমড়া করে সিক্তার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিল। শিহাব কিছু না বলে তাহমিদের গাড়িতে গিয়ে উঠল। ও তাহমিদের ভক্ত। তাই সব সময় তাহমিদের আশেপাশেই থাকে।
আনানের মুখ ভ্যাঙ্গানো দেখে সিক্তাও ওকে পাল্টা ভেংচি কাটল।
কুহু পরেছে বিপদে। ওকে তাহমিদের সাথে যেতে হবে! ওর ইচ্ছে ছিল সিক্তার সাথে যাবে৷

” কোকিলা ঐ গাড়িতে যাক, ভাই? এখানে ও স্বচ্ছন্দ নাও হতে পারে। ”
” ঐ গাড়িতে নিপুনের ফ্রেন্ডের বড়ভাই থাকবে। রাস্তা থেকে ওদের তুলে নেব। তোর কোকিলা কি অচেনা ছেলেদের সাথে এক গাড়িতে বসতে পারবে? বসতে পারলে ঐ গাড়িতেই যাক। ”
” নিপুনের ফ্রেন্ডের বড়ভাই! গাড়িতে তার কি কাজ? ”
” সে আমাদের সাথে রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত যাবে। আমাদের সাথে এক কাপ কফি খেয়ে নিজের কাজে যাবে। ”
” কোকিলা, তোর তো আমাদের সাথে যেতে সমস্যা নেই? ”
সবটা শুনে কুহু আর আপত্তি করলনা।
ফ্রন্ট প্যাসেঞ্জার সিটে ড্রাইভারের পাশে বসল আনান। নিপুন, শিহাব বসল মিড সিটে। পেছনের সিটে ডান জানালার পাশে গিয়ে বসল সন্ধি।
” কুহুপু, তুমি আমার পাশে বস। তুমি মাঝখানে বস আর ভাইয়া বাম জানালার পাশে বসুক। তোমার সমস্যা আছে, ভাইয়া ” জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল সন্ধি।
” কোন সমস্যা নেই আমার৷ গাড়িতে ওঠ। ”
এবারেও কুহু কিছুই বললনা। তাহমিদের কথা মেনে নিয়ে গাড়িতে উঠল।

পুরোটা রাস্তা জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকল কুহু। সন্ধির দিকে চেপে বসে থাকল।
” সন্ধি, তোর কুহুপুকে বল এদিকে এগিয়ে আসতে। সে তোর দিকে আরেকটু সরে বসলে এবার তুই নির্ঘাত গাড়ি ভেঙে বাহিরে পরে যাবি। তাকে বল, আমার শরীর বিছুটি পাতায় তৈরী নয়। তার শরীর চুলকাবেনা। ”
তাহমিদের খোঁচা মারা কথায় কুহু লজ্জা পেল। ওর মনে হল, এই লোকটা ইচ্ছে করেই ওকে খোঁচা মারল।
” তোমার শরীর বিছুটি পাতায় তৈরী না হলে কি হবে, তোমার জন্মের পর মুখে নিশ্চয়ই বিছুটি পাতার রস দিয়েছিল। সেজন্য তোমার মুখ দিয়ে মিষ্টি কথার বদলে ঝাল ঝাল কথা বের হয়। তোমার কথার ঝালে অলরেডি আমার কলিজা পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। এখন দেখছি তুমি কোকিলার পেছনে লেগেছ। কোকিলা এবার শেষ। ” সামনে থেকে জোরেসোরে বলল আনান।

” আচ্ছা আনান ভাইয়া, তুমি কুহুপুকে কোকিলা ডাকো কেন? ” নিপুন আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
” আপু যে কালো, তাই আনান ভাইয়া আপুকে কোকিলা ডাকে। কোকিল থেকে কোকিলা। কোকিলও কালো, আবার আপুও কালো। তাই আপুর নাম কোকিলা। এটা বড়মা বলে। ” হুট করেই বলে ফেলল শিহাব।
শিহাবের কথা শুনে তাহমিদ চোয়াল শক্ত করে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ও রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আনান লজ্জায় মুখ নিচু করল। ও জানতো ওর আম্মু কুহুর সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্যই করে। এদিকে কুহু ভাবলেশহীন মুখে সন্ধির পাশের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল। ও কালো এই কথাটা ও ভালো করেই জানে। অনেকের বিদ্রুপও শুনেছে। তাই আজকাল কারো বিদ্রুপ গায়ে লাগেনা।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৫

” ওর কথা কানে নিসনা, নিপুন। শিহাব আস্ত একটা ভাদাইম্মা। ও আসল ঘটনাই জানেনা। আমার দাদা ভাই কুহুকে কোকিল পাখি নামে ডাকতেন। আর আমি দাদুর দেয়া নামের সাথে মিলিয়ে ডাকতে গিয়ে কোকিল না ডেকে কোকিলা ডাকি। তাইনা রে, কোকিলা? ”
কুহু মাথা নাড়ল।
” নাও। ” তাহমিদ পকেট থেকে চকলেট বের করে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিল।
কুহু ইতস্তত করেও হাত বাড়িয়ে চকলেটটা নিল। এরপর তাহমিদ একে একে সকলকে চকলেট দিল।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৭