সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২০
জাওয়াদ জামী
” কুহু মা, কেমন আছিস তুই? দৃষ্টি, তুইও এসেছিস? কেমন আছিস মা, তুই? ”
বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে সরাসরি বাড়ির ভেতর ঢুকলেন কুহুর একমাত্র ফুপু রেহানা আক্তার। উঠানের কোনে লাগানো গাছ থেকে করলা তুলছিল কুহু। দৃষ্টি বারান্দায় বসে আচার খাচ্ছে। ফুপুকে দেখে দৌড়ে তার দিকে গেল দৃষ্টি। কুহুও হেসে এগিয়ে গেল ফুপুর দিকে।
” ফুপু, তুমি সত্যিই এসেছ! আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা। একটা চিমটি কাটতো দেখি। ” দৃষ্টি ওর বাম হাত বাড়িয়ে দিল ফুপুর দিকে।
দৃষ্টির কথায় হেসেই খুন রেহানা আক্তার। তিনি চিমটির বদলে দৃষ্টির কপালে চুমু দিলেন। একহাতে কুহুকে অপরহাতে দৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরলেন।
” আমার আব্বা কোথায়? তাকে দেখছিনা যে? ”
” তোমার আব্বা বেড়াতে গেছে। সন্ধ্যার আগে তাকে বাড়িতে পাবেনা। ভেতরে চল, ফুপু। ” কুহু হাসিমুখে জবাব দিল।
” হ্যাঁ রে দৃষ্টি, শ্বশুর বাড়িতে থাকতে কেমন লাগছে? তোর শ্বাশুড়ি মানুষ হিসেবে কেমন? তোকে আদর করে তো? তার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কেমন? ” রেহানা আক্তার ভেতরে যেতে যেতে প্রশ্ন করলেন দৃষ্টিকে।
” ওটা তো শ্বশুর বাড়ি নয়, যেন পাগলা গারদ। আর আমার শ্বাউড়ি ঠাকরুন সেই পাগলা গারদের একমাত্র রুগী। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সাপেনেউলের ন্যায়। তার আদরের ঠ্যালায় কিছুদিনের মধ্যে আমিও ঐ পাগলা গারদের দ্বিতীয় রুগী হব। এবার বোঝ ঐ বাড়িতে থাকতে আমার কেমন লাগে? ” কুহুর চোখ রাঙানি স্বত্বেও দৃষ্টি কথাগুলো বলল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” ওর কথা কানে নিওনা, ফুপু। ও নিজেই যে ঝগড়ুটে সেটা একবারও কিন্তু স্বীকার করবেনা। আবার অন্যজনের দোষ ঠিকই খুঁজে বের করবে৷ ”
” দৃষ্টি একটুও ভুল বলেনি, কুহু মা। তবে আমার চিন্তা দুই ঝগড়ুটে একই ছাদের নিচে থাকছে, ওদের ঝগড়ার শব্দে ছাদটা না কবে ধ্বসে পরে। ”
” ফুপু, অপমান করলে! আমি ঝগড়ুটে! আমার মত ভদ্র, শান্ত মেয়ে তুমি আশেপাশের চার গ্রামে একটাও খুঁজে পাবেনা। ”
” থাক নিজের পক্ষে আর সাফাই গাইতে হবেনা। তুই কেমন ভদ্র, শান্ত সেটা আমরা জানি। আমার তো মনে হচ্ছে, তুই ইতোমধ্যেই বড়মার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিস। তুই যে চুপ থাকার বান্দা নয় সেটা আমরা ভালো করেই জানি। ”
রুমে এসে রেহানা আক্তার ব্যাগের ভেতর থেকে এটা-সেটা বের করতে শুরু করলেন। সেই সাথে তিনি কুহুর কথাগুলোও মন দিয়ে শুনছেন।
” তুই কি মনে করিস, আমার ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করতে গেলে দৃষ্টিকে বোবা হয়ে থাকলে চলবে? দৃষ্টি যতই বোবা হয়ে থাকবে, ঐ মহিলা ততই ওকে দুই পায়ে মাটিতে মাড়াবে। দৃষ্টি তোর থেকে বেশি জানে কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে চলতে হয়। তুই তো শুধু সবার কথা চুপচাপ শুনবি আর ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাবি। এখনকার জামানায় তুই অচল। যতই মার হজম করবি, মানুষ তোকে ততই মারবে। নীরবে মার হজম করছিস দেখে কেউ তোর প্রতি একটুও দয়্ দেখাবেনা। বরং তোকে নীরব থাকতে দেখে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে তোকে মারবে। কিন্তু যেই প্রতিবাদ করবি, দেখবি সবাই ভয়ে দূরে সরে গেছে। ”
” বাদ দাও তো ফুপু , এসব কথা। আমি এভাবেই ঠিক আছি। কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবোনা। তাই ঝগড়াঝাটি হওয়ার চান্স নেই। ”
” তোর নীতিতে চলতে গেলে দুনিয়ায় ভালো মানুষ থাকবেনা। এগুলো নে। মিষ্টি, ফল ফ্রিজে রাখ। আর পিঠাগুলো একটা বড় পাত্রে ছড়িয়ে রাখ। সকালে বানিয়েছি। সারা রাস্তা চিন্তা করেছি নষ্ট হয়ে গেল নাকি। ”
” এতকিছু কেন এনেছ, ফুপু? কে খাবে এসব? ”
” তুমি না খাও আমি খাব। তাই খাবারগুলো দেখে চমকানোর দরকার নেই। তুমি মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওনা ভালো করেই জানে ফুপু। তাই এগুলো আমার শিহাবের জন্য এনেছে। তোমার জন্য কি এনেছে সেটা খুঁজে বের কর। ” দৃষ্টি কুহুর হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ফ্রিজে রাখল। তবে তার আগে একটা মিষ্টি মুখে পুরল, আরেকটা হাতে রাখল।
” তোর জন্যও এনেছি, কুহু মা। তোর জন্য ডিমের পিঠা আর ঝাল চিতই, রুই মাছের কালিয়া, কাতলা মাছ ভুনা, পাবদা মাছের ঝোল, গরুর মাংস এনেছি। এসব কিন্তু দৃষ্টিকে দিবিনা। দৃষ্টি আবার এসব খায়না। ”
” কে বলেছে খাইনা! খুব খাই। আর তাছাড়া এতগুলো পিঠা কি আপু একা খেতে পারবে। আমাকে দিয়েই খাবে। তাইনা, আপু। ”
দৃষ্টির কথায় কুহু শুধু হাসল। ওরা দু বোন মিলে খাবারগুলো তুলে রাখল।
” ফুপু , ফুপাকেও সঙ্গে আনতে পারতে। অনেকদিন ধরে ফুপাকে দেখিনা। আচ্ছা, রোহান ভাইয়া দেশে আসবে কবে? ”
” তোর ফুপা আগেরমত হাঁটতে পারেনা। এতদূর পথ আসতে পারবেনা সে। অনেকদিন এদিকে আসেনি। আসতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষমেষ সাহসে কুলায়নি। রোহান আর ছয় মাস পর আসবে। ”
” ভাইয়ার বিয়ে দেবে তো এবার? গতবার বলেছিল, পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করবেনা। এবার বোধহয় পড়াশোনা শেষ করেই আসবে দেশে? এবার যেন বাহানা দিতে না পারে সেটা দেখো। অনেকদিন কারো বিয়েতে হৈ-হুল্লোড় করা হয়না। ”
” কেন রে দৃষ্টি, দুইমাস আগেই না তোর বিয়ে হলো! নিজের বিয়ের মত মজা, হৈ-হুল্লোড় আর কোন বিয়েতে হয় নাকি? ঠিক বলেছি না, কুহু মা? ”
” একদম সঠিক বলেছ , ফুপু। ”
” সঠিক না ছাই। আগের রাত পর্যন্ত চাচাতো ভাইয়ের হলুদে আনন্দ করলাম, সকালে ঘুম থেকে উঠতেই শুনতে পেলাম, আরেকজনের জামাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে। এমন টাস্কি খেয়ে রইলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত যে কবুল বলেছি কিনা সেটাও মনে করতে পারিনা। আবার বৌভাতে যে কব্জি ডুবিয়ে খাব তারও উপায় ছিলনা। রিনা খানের মত জল্লাদ শ্বাশুড়ির ভয়ে দুই লোকমা বিরিয়ানি খেয়েই উঠে গেছিলাম। অথচ বিরিয়ানি আমার ফেভারিট খাবার। এর থেকে বড় কষ্ট দুনিয়ায় আর হয়না বুঝলে? ”
” জানো ফুপু, দৃষ্টিপু সারাদিন আফসোস করে বিয়েতে বিরিয়ানি খেতে পারেনি জন্য। মাঝেমধ্যেই কপাল চাপড়ায় আর বলে, আমার শ্বাশুড়ি যদি দজ্জাল না হত তবে আমি পেট পুরে বিরিয়ানি খেতাম। আমার মনে হয়, দৃষ্টিপু আজীবন নিজের বিয়েতে বিরিয়ানি খেতে না পারার আফসোস করবে। ” শিহাব কথাটা বলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরল ফুপুর গায়ে।
রেহানা আক্তার শিহাবকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলেন। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালেন মৃত ভাইয়ের সন্তানদের দিকে। এদের দিকে তাকালে তার বুকটা ফেটে যায়।
” আচ্ছা ফুপু , রোহান ভাইয়ার জন্য কি পাত্রী দেখেছ? নাকি ভাইয়ার কোন পছন্দ আছে? ভাইয়া বলেছে কিছু? ” রেহানা আক্তার ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলেন দৃষ্টির প্রশ্ন শুনে।
” আমি সেকথা রোহানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু ও বলল, আমাদের পছন্দেই বিয়ে করবে। আর তাই আমিও মনে মনে একটা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি। অবশ্য ওকে এখনো কিছু জানাইনি। ও দেশে আসলেই বলব। আমার বিশ্বাস আমার ছেলে আমার কথার বাহিরে যাবেনা। ”
” রোহান ভাইয়াকে আমরা সব সময়ই মা ভক্ত ছেলে বলেই জানি। তাই তোমার পছন্দের মেয়েকে ভাইয়া বিনাবাক্যে বিয়ে করতে রাজি হবে। কিন্তু মেয়েটা কে, ফুপু? সে দেখতে কেমন? পড়াশোনা করে কোথায়? ভাইয়াকে কিন্তু যে সে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেয়া যাবেনা। ”
” মেয়েকে দেখলে যে কেউই পছন্দ করবে। আর সে দেশ সেরা ছাত্রী। তাই অপছন্দ হওয়ার কোন কারনই নেই। তবে পাত্রী কে সেটা রোহান আসলেই জানতে পারবি। ”
” ঠিক আছে। ভাইয়া আসার অপেক্ষায়ই দিন দিন গুনি। ”
কুহু এতক্ষণ নীরবে সবার কথা শুনছিল। তবে ওর মনে অন্য চিন্তা। ভাইভা, ভর্তি সবমিলিয়ে ঢাকা যাওয়া-আসায় অনেক খরচ হবে। ওর কাছে আপাতত খুব বেশি টাকা নেই। কিভাবে কি করবে সেই চিন্তায় মনটা অস্থির হয়ে আছে। আবার ভর্তি হলে নিজে কোথায় থাকবে, শিহাবকে কোথায় রাখবে সেই চিন্তাও পেয়ে বসেছে। সবমিলিয়ে কুহুর দিশাহারা অবস্থা।
” কুহু সোনা, কেমন আছো? দৃষ্টি মনি কেমন আছে? ”
দিদুনের গলা পেয়ে কুহুর মন ভালো হয়ে গেল।
” আমরা সবাই ভালো আছি, দিদুন। তোমরা কেমন আছো ? মামা-মামী পুচকুরা সবাই কেমন আছে? ”
” একজন ছাড়া সকলেই ভালো আছে। আর সেই একজন ভালো না থাকলে আমিও ভালো থাকতে পারিনা। ”
” বুঝি নাই, দিদুন। ”
” এখন অতশত বুঝে কাজ নেই। শোন, তোমার বিকাশে টাকা পাঠিয়েছি। তোমরা ঢাকা এসেছিলে কিন্তু আমি তোমাদের কিছুই দিতে পারিনি তখন। তাই আজকে হাতে টাকা আসতেই তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি ঐখান থেকেই পছন্দমত কিছু কিনে নিও। শিহাবকেও কিনে দিও। ”
” মামীরা সবাই আমাদের দু’জনের জন্যই কেনাকাটা করেছিল, দিদুন। সেগুলো সাথে করে নিয়েও এসেছি। তারপরও তুমি কেন টাকা পাঠিয়েছ ! আমার টাকা লাগবেনা, দিদুন। আমি তোমাকে টাকাগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”
” খবরদার, এমন কাজ করোনা। তোমার ওপর আমার দাবী আছে মনে করেই টাকাগুলো পাঠিয়েছি। আর সেই টাকা যদি ফেরত দাও, তবে আমি কষ্ট পাব। তুমি কি জেনেশুনে তোমার দিদুনকে কষ্ট দিতে চাইবে? ”
দিদুনের কথা শুনে কুহুর কথা বন্ধ হয়ে গেল। দিদুনের কথার পিঠে জবাব দেয়ার মত কথা ওর মুখে জোগালনা।
” চুপ করে গেলে কেন, কুহু সোনা? রাগ করলে আমার কথায়? ”
” রাগ করিনি, দিদুন। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, এখন আমার নতুন জামাকাপড় প্রয়োজন নেই। ”
” তাহলে টাকাগুলো কাছে রেখে দাও। যখন প্রয়োজন হবে তখন কিনে নিও। বুঝেছ আমার কথা? ”
” বুঝেছি। ”
” এবার তাহলে দৃষ্টিকে দাও। ওর সঙ্গে কথা বলি। ”
দিদুন দৃষ্টির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখলেন। এরপর তাকালেন সামনে বসা তাহমিদের দিকে৷
” তোমার কথামত কাজ করতে পেরেছি, দাদু ভাই? ”
” পারফেক্ট। কুহুর কথা শুনে প্রথমে তো আমি ভয়ই পেয়েছিলাম। কিন্তু শেষটায় তুমি সামলে নিয়েছ। ”
” তুমি আমাকে একটা কাজ দিয়েছ আর আমি সেটা করবনা, এটা হতেই পারেনা। আমার দাদু ভাই তার শখের নারীর জন্য টিউশনি করে টাকা গোছাচ্ছে এটা কি কম কথা! তাকে আমি সাপোর্ট দেবোনা এটা হতেই পারেনা। ”
” এজন্যই তোমাকে এত্ত ভালোবাসি, দিদুন। ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৯
কুহু ফোন হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। দিদুন ওর এ্যাকাউন্টে বিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। অথচ গতকাল পর্যন্ত ও টাকা কিভাবে জোগাড় করবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিল।